প্রিয়োসিনী পর্ব ২৯

প্রিয়োসিনী পর্ব ২৯
নীরা আক্তার

-এই নওরিন স্যারটা জোশ না একে বারে…সেই
নওরিন পূর্ণার মুখ চেপে ধরে,
-টিচারকে নিয়ে কেউ এইসব বলে?বেদ্দপ মহিলা
পূর্ণা মুখের উপর থেকে নওরিনের হাত সরিয়ে দেয়,
-সুন্দরকে সুন্দর বলতে হয়….দেখনা কি হ্যান্ডসাম।স্যার নতুন এসেছেন।ইংরেজি পড়াবেন।তুই তো ঠিক করে দেখলিই না।
নওরিন ভ্রু কুচকে তাকায়, মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠে

-আমি দেখি নাই!আমি যা দেখছি তুই তা ধারণা ও করতে পারবি না।
পূর্ণা কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইসরাক ধমক দেয়,
-দাঁড়াও!দুইজনই দাঁড়াও
নওরিন মাথা নিচু করে শুনেও না শোনার ভান করে বসে আছে,
-নওরিন আমি তোমাকেই বলছি।একেই তো লেইট করে আসছো তার উপর ক্লাসে মনোযোগ নাই।এক্সামে তো বড় বড় জিরো পাবা।ক্লাসে মনোযোগ দাও
ইসরাকের ধমকে নওরিন রাগী চোখে তাকায়,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

– আমি কিন্তু বের হয়ে যাবো
ইসরাক দমে যায়
-না থাক আর কথা বলিও না। মনোযোগ দাও ক্লাসে।
নওরিন বাঁকা হাসি দেয়,
পাশ থেকে পূর্ণা আর টিয়া নওরিনের দিকে তাকিয়ে আছে।
-স্যার তোর নাম জানলো কেমনে?
নওরিন বাঁকা হাসি দেয়,
-বলবো না
-বলিস না আমরা স্যারকেই জিগাই।কি বলিস

টিয়া স্যার বলে চিৎকার করতে গেলেই নওরিন আবারও তাদের মুখ চেপে ধরে।
দুইজনই হেসে উঠে।নওরিন খেয়াল করে ইসরাক তার দিকে তাকিয়ে আছে।বোধহয় আবার বকা দিবে।নওরিন অসহায় দৃষ্টিতে ইসরাকের দিকে তাকায়।
ইসরাক কিছু না বলেই পূর্বের মতো পড়াতে শুরু করে।এখন
নওরিনকে বকতে মান চাইছে না!!
ক্লাস শেষ করে ইসরাক বের হয়ে যায়।নওরিনও ক্লাস থেকে বার হয়।কিছু দূর যেতেই ইসরাককে পেছন থেকে ডেকে উঠে,
ইসরাক পেছন ফিরে তাকায়,নওরিন হাঁপাচ্ছ

-কি হলো কিছু বলবে?
-আপনি এখানে কি করেন?
-তোমাকে পাহারা দিতে এসেছি
-পাগল নাকি?
-পড়াইতে আসছি দেখো না!
-কেন?আপনার বড়লোকদের কলেজে কি আপনাকে রাখবে না?বার করে দিছে
-রাখবে না কেন?
-তাহলে এখানে কি?
-আমি এখানে গেস্ট টিচার।প্রিন্সিপাল স্যারের রিকুয়েষ্টে এসেছি।কিছু দিনের জন্য
-ওহ্

-হুম্ম।ক্লাসে যাও পড়াশোনাটা সবার আগে
ইসরাক কথাটা বলেই হাটা দেয়,
-শুনুন।শরীরটা কি খুব খারাপ?ভালো আছেন আপনি?মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে।
-একটু খারাপ।আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।পরীক্ষা নিয়ে ভাবো।
-ধূর…..এই শরীর খারাপ নিয়ে দুই জায়গায় পড়াতে পারবেন?কষ্ট হবে না?
-এর চেয়ে বেশি কষ্ট হয়, যখন ভাবি আমার বউ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
নওরিন মুখ বাঁকায়…

-শুধু আমি বলে এখনো পার্মানেন্টভাবে যাই নি।অন্যকেউ হলে আপনার সংসারের মুখে লাত্থি দিয়া কবেই চলে যেতো।
-কি বললা
-না না কিছু না
নওরিন ক্লাসে ফিরে যায়। ইসরাক প্রিন্সিপালের রুমে যায়।প্রিন্সিপাল ভদ্রলোক ইসরাকের বাবার বন্ধু।তার রিকুয়েষ্টেই ইসরাকের এই কলেজে আসা।তবে তার চেয়ে বড় ফ্যাক্ট হলো নওরিন।
সারাদিন চোখের সামনে থাকবে।আজকাল নওরিনকে চোখের আড়াল করতে মন চায় না।
কষ্ট হয়।ভীষণ কষ্ট হয়।

আজকে সকাল থেকেই আমানের মনটা ভীষণ রকম ভার হয়ে আছে।সোফায় শুয়ে শুয়ে হরর মুভি দেখছে ইশা।আর আমান বিছানায় উবু হয়ে শুয়ে আছে।আজকাল আমান ঘর থেকে বার হওয়ায় বন্ধ করে দিয়েছে।সারাদিন বন্ধ ঘরে শুয়ে বসে থাকাই তার কাজ
ইশা ভ্রু কুচকে তাকায়,

-তোমার শরীর খারাপ আমান ভাই?
-হু
-কেন?
-মায়ের কথা মনে পড়ছে।
ইশা ক্যালেন্ডারের দিকে খেয়াল করে।আজকে তো মেজো চাচার আর মেজো চাচীর মৃত্যু বার্ষিকী।
ইশারও একটু মন খারাপ হয়ে যায়।
-মন খারাপ করোনা।ওনারা যেখানেই আছেন ভালো আছেন।দোয়া করো
-হুম্ম।মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে।ইস্ কতোদিন মাকে দেখি না।

-মন খারাপ করো না চোখ বন্ধ করো…মনে মনে মায়ের মুখটা কল্পনা করো।দেখবে ভালো লাগবে
-জানিস ইশা শেষবার মাকে যখন দেখেছিলাম মাকে খুব বিদ্ধস্ত দেখাচ্ছিলো।বোধহয় বাবার সাথে ঝগড়া হয়েছিলো।
ইশা ভ্রু কুচকে তাকায় আমানের দিক,
-তুমি তো অনেক ছোট ছিলে।তোমার এতো কিছু মনে আছে নাকি?
-খুব আছে,মা সেদিন শেষ বারের মতো আমার কপাঁলে চুমু খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাবার পেছনে ছুটে গিয়েছিলো।আর ফিরেনি।সেদিনের মায়ের মুখটা আমি কখনো ভুলবো না।মাঝে মাঝে স্বপ্নেও দেখি

-কি হয়েছিলো সেদিন?মনে আছে কিছু?
-জানি না…
কথাটা বলেই আমান বালিশে মুখ গুজে আবার উপর হয়ে শুয়ে পড়ে।
-আমান ভাই
-(…)
-শুনো না
-হুম্ম
-আম্মার কাছে জানতে চেয়েছিলে?
-না তো
-তুমি না হয় ছোট ছিলে আম্মা তো ছিলো না।আম্মার হয় তো মনে আছে।
আমান লাফিয়ে উঠে,

-ঠিকিই তো।
আমান বিছানা থেকে উঠে বড় বড় ধাপ ফেলে জিনাত সিকদারের ঘরের দিকে যায়।
জিনাত সিকদার বিছানায় বসে পান সাজাচ্ছিলেন পাশে শিউলি পারভিন বসা।
আমান ঘরে আসে,
-বড় আম্মু
আমান কথাটা বলেই শিউলি পারভিনের দিকে তাকায়,

-হ্যা বাবা কিছু বলবা?
আমান তখনো শিউলি পারভিনের দিকে তাকিয়ে আছে।
জিনাত সিকদার বুঝতে পারেন,সে হয়তো শিউলি পারভিনের জন্য অস্বস্তি বোধ করছে।
জিনাত সিকদার বোনকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
-তুই ঘরে যা…আমার লাগলে আমি ডেকে নেবো
শিউলি পারভিন সেখান থেকে বেরিয়ে যায়,
-বড় আম্মু আজকে মা আর বাবার মৃত্যু বার্ষিকী

-হ্যা বাবা মনে আছে আমার।ফজরের নামাজের পর তাদের জন্য দোয়া করেছি।তোমার বড় আব্বু বলছিলো এতিমখানায় খাবার দেবে।মিলাদও নাকি পড়াবে
আমান জিনাত সিকদারের কাছে গিয়ে বসে।কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে,
জিনাত সিকদার আমানের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
-মায়ের কথা মনে পড়ছে!
-কষ্ট পেয়োনা বাবা।

-সেদিন মা ওভাবে বেরিয়ে গিয়েছিলো কেনো?
জিনাত সিকদার একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়।কিছু একটা ভাবতে ভাবতে উওর দেয়,
-তোমার মা তোমার মতোই জিদ্দী ছিলো।কারো কথাই শুনতো না।যা মাথায় আসতো তাই করতো।রাগ সামলাতে পারতো না।আমি যদি সেদিন জানতাম তোমার মা এমন কিছু করে বসবে, আমি কখনো এমন কিছু হতে দিতাম না……
কথা বলতে বলতে তিনি আমানের মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। আমান তখন বড় মায়ের কোলে শোয়া।
আমান শোয়া থেকে উঠে বসে

-মা করেছে মানে?কি করেছে মা?
জিনাত সিকদারের মুখটা ফ্যাক্যাশে হয়ে যায়।মিনিটেই চুপসে যায়।
-কিছু না বাবা।তুমি ঘরে যাও।আমি খাবার পাঠাই।সকাল থেকে তো কিছুই খাও নি।তুমি খাও নি বলে ইশাও খায় নি।ওর তো ঔষধ খেতে হয়

-বলোন কেন, বড় আম্মু?কি হয়েছিলো সেদিন?
-সেদিন তোমার বাবা মায়ের মধ্যে ঝগড়া হয়েছিলো।সেটাই বলছিলাম আমি থাকলে আটকাইতাম তাই বললাম আর কি!
-কি নিয়ে?
-থাক না বাবা এতো দিন পুরানো ছাই চাপা আগুন কেন ঘাটছো?বাবা মায়ের ঐসব কথা শুনতে নেই।বাদ দাও। তুমি ঘরে যাও আমি খাবার নিয়ে আসছি তোমাকে আর ইশাকে নিজের হাতে খাইয়ে দেবো….

আমান ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।এখন মন মস্তিস্ক কোনোটাই কাজ করছে না।পরে সময় করে বড়আম্মুর কাছে জেনে নেবে।এখন থাক না।
আমান বেরিয়ে যেতেই,শিউলি পারভিন আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে,
-কি জানতে চায় পোলায়?
জিনাত সিকদার ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকায়,
-ইচ্ছে করছে তোকে বটিতে কেটে দুইভাগ করে ভাসায়া দেই।আব্বা আম্মা আমার হাত পা বেঁধে দিছে শিউলি।খোদারে ভয় পা।মাফ করবে না তোরে।
তিনি একটু থেমে আবারও বলে উঠেন,

-বাবা মায়ের পাপের ফল সন্তানরা পায় আমি পাপরে চেপে রেখে আরো বড় পাপ করছি।তার ফল আমার নাড়ি ছেঁড়া ধণরা ভোগ করছে।দূর হো চোখের সামনে থেকে!মুখ দেখতে চাই না তোর
শিউলি পারভিন মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ঘর থেকে বার হয়ে যায়…..।।
বোনের শত অপমান সহ্য করেও তিনি এখানে মাটি কামড়ে পরে আছেন।কোথাও যাওয়ার জায়গা বা মুখ কোনোটাই তার নেই।

ক্লাস শেষে নওরিন মেইন গেটে নিবিড়ের জন্য অপেক্ষা করছে।বেশ কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকার পরও নিবিড়ের কোনো খোঁজ নাই…
নওরিন বেশ কয়েকবার কল করে নিবিড়কে,
নাহ কিছুতেই কল ধরছে না।
নওরিন বিরক্ত নিয়ে কল করতে থাকে তাকে।হটাৎ পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠে,
-রিনি
নওরিন পেছন ফিরে তাকায়।
সাগড় দাঁড়ানো।
নওরিন ভ্রু কুচকে তাকায় সাগরের দিকে

-তুমি?কবে ফিরলে,এখানে কেন?কি চাই
-আজকে সকালেই ফিরেছি।
-এখানে কি চাই তোমার?
-তোমাদের বাসাতেই উঠেছি নওরিন।নিবিড় ভাই ঐখানেই উঠতে বললো।আর….নিবিড় ভাই তিশা ভাবির ঐখানে আটকা পড়েছে তাই আমাকে বললো তোমায় নিয়ে যেতে।
নওরিন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে,

-ভাইয়া নিয়ে যেতে পারবে না বললেই হতো আমি একাই যেতাম আমার কি পা নেই!
– না মানে
-তুমি দূর হও আমার চোখের সামনে থেকে
নিওরিন কথা বলতে বলতে পিছুতে গিয়ে ইটের সাথে পা বিধে পড়ে যেতে নেয়।সাগর খপ করে নওরিনের হাতটা ধরে নেয়,
-পরে যাবে তো
-ছাড়ো বলছি
নওরিন হাত মোচড়ায়।সাগর নওরিনের হাত ছাড়ার আগেই স্নেহা কোথা থেকে উড়ে এসে সাগরের গালে সপাটে একটা চড় বসিয়ে দেয়।

অচমকায় চড় খেয়ে সাগড় সটাং হয়ে দাড়িয়ে যায়।চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ।
স্নেহা চড় দিয়ে দমে যায় না বরং রাতে ফোঁস ফোঁস করতে করতে,সাগরের কলার চেপে ধরে,
-অসভ্য বোখাটে ছেলে আমার ভাবিকে ভালোমানুষ পেয়ে উত্যক্ত করা।নরম মাটিতে খুব আচড়াতে মন চায় না।আজ তোকে যদি গণধোলাই না খাইয়েছি আমার নামও স্নেহা নয়।বাপ দাদার নাম একদিনে ভুলিয়ে দেবো
সাগর ভ্যাব্যাচ্যাক্যা খেয়ে তাকিয়ে আছে স্নেহার দিকে। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে উওর দেয়,
-অসভ্য,গুন্ডী মেয়ে কোথাকার।কলার ছাড়ুন বলছি।

ততোক্ষণে আসে পাশে লোক জড় হয়ে গিয়েছে।স্নেহার চেচাঁমেচিতে ইসরাকও সেখানে উপস্থিত হয়।
লোকজন সাগরকে পেটানোর জন্য তৈরী।
নওরিন পরিস্থিতি সামলাতে সাগরকে স্নেহার হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয়।
-ছেড়ে দাও স্নেহা ও আমার কাজিন
স্নেহা ভ্রু কুচকে তাকায়,
-কাজিন তো তোমার হাত ধরলো কেন?

প্রিয়োসিনী পর্ব ২৮

-তুমি কিছু ভুল বুঝছো।বাদ দাও পরে কথা হবে এখন বাড়ি যাও।
নওরিন সাগরকে সেখান থেকে টেনে নিয়ে যায়।প্রাণ বাঁচানো ফরজ কাজ।
-তারাতারি চলো নয়তো লোকজন তোমাকে মেরে ভর্তা বানায়ে দিবে।তারপর আচারের সাথে খাবে
-আমার কি দোষ।ঐ ডাকাত মেয়ে…,হাত ভেঙ্গে দেবো ওর আমি
সাগর নওরিনকে নিয়ে বাইকে করে সেখান থেকে চলে যায়।ইসরাক আর স্নেহা সেখানে দাড়িয়ে তাদের যাওয়া দেখতে থাকে…..

প্রিয়োসিনী পর্ব ৩০