যদি তুমি বলো পর্ব ৫

যদি তুমি বলো পর্ব ৫
আফনান লারা

সাবিনা ম্যামের ক্লাস শেষ হয়ে যাবার পর ছিল মিজান স্যারের ক্লাস।সম্ভবত স্যার আজ আসবেননা।পঁয়তাল্লিশ মিনিটের এই ক্লাসটি তাই অনেক বেশি বোরিং হয়ে গেছে।তিথি সুরাইয়াকে বললো তারা ক্যানটিন থেকে ঘুরে আসবে।কিন্তু তিথিদের ভার্সিটির নিয়ম হলো ক্লাস টাইমে কেউ ক্যানটিন কিংবা ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরি করতে পারবেনা।
এখন যেহেতু স্যারের ক্লাস নেই,তারা যেতেই পারে।এই ভেবে ওরা দুজন বেরিয়ে গেলো।

ইশান মুচকি হেসে পকেট থেকে ফোন বের করে ডিপার্টমেন্টের অফিস সহকারী কামালকে কল দেয়। কল দিয়ে খবরটা সে সাবিনা ম্যামের কাছে জানাতে বলে,নিজের পরিচয়টা দেয়না আর।
ঠিক তাই হলো।কামাল সোজা গিয়ে সাবিনা ম্যামকে বলে এসেছে ক্লাসের কিছু স্টুডেন্ট ক্লাস টাইমে বাহিরে আড্ডা দিতে গেছে।ম্যাম তো রেগে আগুন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ম্যাম সোজা ক্লাসে ছিলেন এরপর জানতে চাইলেন ক্লাসে কারা উপস্থিত নেই।
একজনে জানিয়ে দিলো ওটা তিথি আর সুরাইয়া।
ম্যাম নাম শুনে যাবার সময় বলে গেলেন ওরা আসলে যেন ডিপার্টমেন্টের অফিসে যেতে বলে।
তিথি আর সুরাইয়া ক্যানটিনে বসে চাউমিন খেয়ে খুশি মনে ক্লাসে আসতেই জানতে পারে ম্যাম ওদের ডেকেছে।
তিথি কিছু বুঝতে না পারলেও সুরাইয়া আন্দাজ করে নেয় তারা যে ক্লাসে ছিল না তাই হয়ত ম্যাম শাস্তি দেবে বলে ডেকেছিল।সে ভয়ে চুপসে যায়,এদিকে তিথি বলে এ কারণে না।ক্লাসে তো স্যার আসেনি তবে বের হলে কি সমস্যা!
সে বেশ সাহস নিয়ে ডিপার্টমেন্টোর অফিস রুমে আসে।

ম্যাম তখন একটা ছেলেকে ঝাড়ি দিচ্ছিল।ওদেরকে দেখে ছেলেটাকে বিদায় করেন তিনি এরপর তিথির দিকে তাকিয়ে বললেন,’তোমরা কি ভার্সিটির রুলস গুলা সব ভুলে গেছো?’
ওমনি সুরাইয়া কানে ধরে বললো,’ম্যাম সরি,আর এমন হবেনা’
‘ভুল করে সরি বলে কোনো লাভ নেই আমার কাছে।আজ যে এসাইনমেন্ট আমি দিয়েছি সেটা ডাবল লিখে আনবে,ফটোকপি দিতে পারবেনা।যাও এখন’
তিথি মন খারাপ করে ক্লাস থেকে বের হতেই দেখে ইশান নামের ছেলেটা অন্যদিকে মুখ করে হাঁটা ধরেছে।এতক্ষণ সে এখানেই ছিল।

তিথি সুরাইয়াকে ক্লাসে যেতে বলে সে ইশানের পিছু পিছু এসে দ্রুত হেঁটে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়।
ইশান ভাবেনি তিথি হঠাৎ সামনে চলে আসবে।সে মাথা নিচু করে রাখে।তিথি হাত ভাঁজ করে বলে,’তোমার বাসা কোথায়?’
‘গুলশান’
‘গুলশান?এতদূর থেকে আসো?’
‘হ্যাঁ’
‘কিসে করে আসো?’
‘কা…. নাহহহ,বাসে করে আসি’

‘বাসে আসতে তো পাঁচ ঘন্টা লেগে যাবার কথা।তুমি রওনা হও কখন?আচ্ছা তোমার কপালে কি হয়েছে দেখি’
ইশান হাত দিয়ে কপাল ঢাকতে ঢাকতে বলে,’জন্মদাগ’
‘জন্মদাগ?দেখে তো নতুন দাগ মনে হলো।কিভাবে ফাটলো?’
‘ফাটেনি।এটা জন্মদাগ’
‘বয়স কত তোমার?ফেইল করেছো কলেজে?তোমাকে কেমন বড় বড় লাগে’
‘২৩বছর’

‘আমার তো মনে হয় সাতাশ বছর।মাস্ক খুলো তো!তোমাকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে’
ওমনি ইশান ওখান থেকে চলে যায়,আর একটা কথাও না বলেই।তিথির সন্দেহ আরও গাঢ় হয় তখন।ছেলেটাকে এত চেনা চেনা লাগছে কেন!

সুরাইয়ার ডাকে তিথির মন ঘুরে যায়।সে চলে যায় ওর কাছে।এদিকে ইশান যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো।আরও সাবধানে থাকতে হবে।কিন্তু ম্যামের শাস্তিটা আরও কঠিন হলে ভাল লাগতো।এত সহজ শাস্তিতে তো মন ভরছেনা!
ভার্সিটি ছুটি হবার পর তিথি ভাবলো একবার তানিয়ার কলেজে গিয়ে ওকে সাথে নিয়ে বাসায় ফিরবে।তাই সে বাহিরে বেরিয়ে বাসের অপেক্ষা করছিল, ইশান সবেমাত্র তার গাড়ীতে উঠবে ওমনি তার আর তিথির চোখাচোখি হয়।তিথি আর একটুর জন্য ওকে ধরে ফেলতো কিন্তু তার আগেই ইশান তার গাড়ী থেকে দশ হাত সরে দাঁড়ায়।
তিথি গাড়ীটার দিকে তাকিয়ে অন্যদিকে ফিরে যায় আবার।এটা অন্য রঙের গাড়ী ছিল।কালকের গাড়ীটাতে তো তিথি ইট দিয়ে নাজেহাল করে রেখে দিয়েছে।

তিথি ওদিকে চোখ বুলাতে যেয়ে আবার ইশানকে দেখে ফেলে।তারপর একটু এগিয়ে বললো,’কি হলো বাসে উঠবে না?’
ইশান এ কথা শুনে ভয় পেয়ে যায়।সে ভাবে তিথি বুঝে গেলো নাকি সব!কিন্তু তখনই তিথি সামনের বাসটাতে ওঠার সময় বললো,’এটা মনে হয় গুলশানের একটু আগে যাবে,চলো’

এই বলে রীতিমত জোর করেই সে ইশানকে বাসে ওঠায়।ইশান ওর পাশে বসে পকেট হাতাচ্ছিল।তার কাছে কার্ড বাদে খুচরো পয়সা নেই।তিথির সাথে টেক্কা দেয়া যে কঠিন তা সে জানতো,কিন্তু এত কঠিন তা জানতোনা।ইশান বারবার এদিক সেদিক করছিল বলে তিথি জানতে চাইলো কোনো সমস্যা কিনা।তখন ইশান না বলে চুপ করে থাকে।একটু পরেই কন্ডাকটর আসলো ভাড়া নেয়ার জন্য।ইশান না পারছে কার্ডের কথা বলতে আর না পারছে তার কাছে টাকা না থাকার কথা বলতে।তিথি তার ভাড়া বের করে দিয়ে দিয়েছে,ইশান দিচ্ছেনা বলে সে কিছু বলতে যাবে ওকে ওমনি পিছনের সিট থেকে আদিল হাত বাড়িয়ে ইশানের ভাড়াটা দিয়ে দেয়।

ইশান পেছনে ফিরে আদিলকে দেখে মুচকি হাসে।আদিল যে এ বাসে উঠেছে তা ওরা কেউই জানতোনা।তিথি তো আদিলকে দেখে রেগে আগুন।সে ইশানের কাছে জানতে চাইলো ও আদিলকে চেনে কিনা।ইশান কিছু বলার আগেই আদিল বললো,’আমার ছোট ভাইয়ের ক্লাসমেট হয়”
‘তোমার ছোটভাই আমার থেকে এক বছরের ছোট।তার ক্লাসমেট এই বুইড়া বেটা?’
‘বুড়ো কোন বলছো!ইশান আমার চাইতেও ইয়াং”

‘আমি চোখ দেখেই বয়স বলে দিতে পারি।যাই হোক তোমার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।আগে যদি জানতাম তুমি এই ছেলের পরিচিত তবে এই ছেলেটার সাথে আমি কোনো কথা বলতাম না’
এট বলে তিথি বাস থামাতে বলে।কিন্তু বাস তখন এমন রোডে ছিল যে থামানোর প্রশ্নই আসেনা।
তিথি তাও দাপট দেখিয়ে চলন্ত বাস থেকে নামার চেষ্টা করে।ইশানকে হটিয়ে নিচে পা রাখতে যেতেই বাসের গতির সাথে না পেরে হোচট খায় সে।আদিল উঠে গেছিলো ওকে ধরার জন্য কিন্তু ইশানই বোধহয় তিথির জন্য যথেষ্ট।

ইশান এক হাতেই তিথিকে ধরে ফেলেছে।তবে যেভাবে ধরেছে সেটা তিথির পছন্দই হয়নি।সে হাতটা সরিয়ে ইশানের দিকে আঙ্গুল দিয়ে বললো,’আর কোনোদিন টাচ করলে!!’
এরপর সে চলে যায়।আদিল এসে ইশানের পাশে বসে তখন ।
ইশান আদিলের ঘাড়ে হাত রেখে বলে,’তুমি টাচ করেছিলে কখনও?’
‘না স্যার’

‘অনেক ঝাঁঝালো হয়ে গেছে তিথি’
‘আগে কেমন ছিল স্যার?’
‘আগে নম্র ছিল,মুখ দিয়ে কথা বের হতোনা।আর এখন সে পুরোটাই বদলে গেছে। আগেকার তিথি আর এখনকার তিথির মাঝে আমি আকাশ পাতাল তফাৎ দেখি।তবে এই রুপটাই ভাল,গেমস খেলতে দারুণ লাগছে আমার’
‘কিন্তু স্যার বিপদ তো বাঁধিয়ে ফেললেন।মাথা কতটা ফেটে গেছে।বড় ম্যাডাম দেখলে কাঁদতে কাঁদতে বন্যা বানিয়ে দেবেন’
‘আর তাই কাল রাত থেকে আমি বাসায় ফিরিনি।হোটেলে ছিলাম।এখনও হোটেলেই যাবো।তোমায় আরেকটা কাজ দিবো।সেটা আগামীকাল করবে।আমি টেক্সট করে জানিয়ে দিবো।কাজটা সাবধানে করবে।’

‘ঠিক আছে স্যার’
কন্ডাকটর ওদের দুজনের কথা শুনলো।আর ভাবলো এতক্ষণ আদিল ইশানকে তুই তুকারি করে কথা বলছিল,কিন্তু তিথি চলে যাবার পর সে আবার স্যার ডাকছে।কাহিনী কি!!!

তিথি গাল ফুলিয়ে ফুটপাত দিয়ে হাঁটছে।যে আদিলকে দেখলে তার মনে ফুলের মেলা বসতো,আজ সেই আদিলকে দেখে তার গায়ে আগুন জ্বলছে।লাভা ভাসছে চারিদিকে!
কতটা ধোকাবাজ!! তাও একটুও অনুতপ্ত না সে!দিব্যি আরামসে অফিসে যাচ্ছে!
‘আমার দরকার ছিল ধরে বাসে সবার সামনে গনপিটুনি দেয়া।এরপর বাসে দেখলে একবার হলেও মাইর খাওয়াবো।আমাকে নিয়ে গোমস খেলার ফল ওকে ভুগতেই হবে!’

আদিল নেমে যাবার পর ইশান ও নামে বাস থেকে।হোটেলে যাবে নাকি বাসায় যাবে সেটা নিয়ে কনফিউশানে আছে।
কপালের দাগ ডাক্তারকে বলেও মেটানো গেলোনা।সার্জারি করা ছাড়া নাকি উপায় নাই।
সার্জারি করতে হলে আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে,ততদিন বাসায় না ফিরলে মা অন্য কিছু ভেবে আবারও দুঃচিন্তা করবে।
যাবো তো কোনদিকে যাবো!!

ইশান পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোন বের করে মুখ থেকে মাস্কটা সরিয়ে নেয়।দম বন্ধ হয়ে আসে এভাবে মাস্ক পরে থাকতে থাকতে।ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে চিন্তা করছিল কি করবে না করবে ওমনি তার সামনে এসে দাঁড়ায় মিয়াজুল করিম আঙ্কেল।
ওনাকে দেখে ইশান শুরুতে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো।তারপর কি আর করবে কথা না বললে আরও বিপদ হবে ভেবে সে সালাম দেয় ওনাকে।

‘ইশান!কত বড় সারপ্রাইজ! তুই কোথায় ছিলি এত বছর?’
‘এ্যাব্রোড’
‘বাহ!একেবারে সাহেব হয়ে ফিরেছিস!তোকে তো শুরুতে চিনতেই পারি !তিথি কোথায়?’
ইশান ঢোক গিলে এদিক ওদিক তাকায় তারপর বলে,’তিথি বাসায়।’

যদি তুমি বলো পর্ব ৪

‘বাচ্চা কয়টা এখন তোদের?তিথিও কি তোর সাথে বিদেশ ছিল?আমাকে তোর বাসায় নিবিনা?আমি তো এখানেই থাকি।একটু হাঁটতে বেরিয়েছি।চা খেতে মন চাইলো।আমার বউয়ের হাতের চা ভাল না বুঝলি!তিথির হাতের চা খাবো।চল!’

যদি তুমি বলো পর্ব ৬