যদি তুমি বলো পর্ব ৪

যদি তুমি বলো পর্ব ৪
আফনান লারা

তিথি হাতে এতটাই ব্যাথা পাচ্ছিল যার কারণে সে ইশানের থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নেয় তৎক্ষনাৎ।কিন্তু তার এই কাজে যেন ইশান একটা সুযোগ পেয়ে যায়।ওমনি সে গাড়ীটা স্টার্ট দিয়ে তিথির চোখের সামনে দিয়ে উধাও হয়ে গেলো।
তিথি হাত ঝাড়তে ঝাড়তে ইশানের চোখ দুটো কল্পনা করছে।ওর মাথার রক্তের কারণে চোখ দেখেও আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারেনি তিথি।তবে খারাপ লাগলো সে অনেক বেশি আঘাত দিয়ে ফেলেছে ভেবে।
তার এই হাতের ব্যাথার কাছে ঐ ছেলের মাথা ফাটা আরও অনেক বেশি!

তিথি ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিল,ওমনি তার হাতের ফোনটা বেজে ওঠে।বাবার নাম্বার থেকে কল।
তিথি শুরুতে ভয় পেয়ে যায়।সুরাইয়াদের গেইটের পাশে থাকা সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে ঢোক গিলে সে কলটা রিসিভ করে।
ওপাশ থেকে বাবা বলে উঠলেন,’তিথি মা!মাফ করে দিয়েছি।চলে আয়’
‘সত্যি বাবা?আবার জোর করবেনা তো?’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘জোর করতে যাবো কেন!তোর বোন তানিয়াকে রকিবের পরিবার পছন্দ করেছে,এখন তারা আমার ছোট মেয়েকেই বউ করে নিয়ে যাবে বলে সকলে সম্মতি দিয়ে রিং পরিয়ে চলে গেছে’
তিথি মাথায় হাত দিয়ে ফেললো এ কথা শুনে।রিদমের মুখ থেকে তানিয়ার কৃতকলাপ শুনে সে ভেবেছিল তানিয়া ঠাট্টা করছে।কিন্তু সে যে এরকম সত্যি সত্যি বিয়েটা পাকাপোক্ত করে নেবে তা তিথি কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি।
যাই হোক!এক দিক দিয়ে ভালই হলো।তিথিকে আপাতত কয়েক মাস কেউ জোরাজুরি করবেনা বিয়েতে।
এই খুশিতে তিথি এক ছুটে সুরাইয়ার বাসায় ঢুকে তার ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে ভাবে সে এখন গেলে এত বড় বাসার দরজা লক করবেটা কে!

পরে তার মনে পড়লো সুরাইয়া তিথিকে একটা এক্সট্রা চাবি দিয়ে গেছিলো,প্রয়োজনে বের হতে চাইলে যাতে বের হতে পারে।তাই সে ঐ চাবি দিয়ে বাসার দরজা লক করে বের হয়।কিন্তু এত রাতে রাস্তায় একটা রিকশাও তার চোখে পড়েনা।তিথি মনে মনে ভাবছিল ইশানের কথা,ওমনি তার সামনে এসে দাঁড়ায় ইশানের গাড়ী।তিথি ভয় পেয়ে যায় প্রথমে তারপর নিজেকে ঠিক করে সে গাড়ীর ভেতর তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে।গাড়ীতে এখন অন্য একটা লোক বসা।
লোকটা তিথির দিকে চেয়ে বললো উঠতে।তিথি তখন মানা করে দেয়।তখন সেই লোকটি বলে তাকে বলা হয়েছে তিথিকে তার বাসায় দিয়ে আসার জন্য।

কিন্তু তিথির ভয় হতে লাগলো তাই সে নাকচ করে দেয় আবারও।সে কিছুতেই যাবেনা।
তিথির এতবার করে মানা করে দেয়ায় গাড়ীটা চলে যায়।এর ঠিক পাঁচ মিনিট পর একটা সিএনজি আসে সেই রোড দিয়ে।তিথি খুশি হয়ে ঐ সিএনজিটাই ভাঁড়া করে।
কিন্তু সে জানেনা সিএনজিটা ইশানের পাঠানো।

সিএনজিতে করে তিথি তার বাসায় পৌঁছায় খুব দ্রুত।সেখানে এসে দেখে সকলের মুখে মুখে হাসি।এভাবে তাদের সম্মান বেঁচে যাবে তারা কেউই ভাবতেই পারেনি।পাত্রপক্ষ চলে গেছে একটু আগে।
তানিয়া নতুন বউয়ের মতন বসে বসে হাতের আংটিখানা দেখে চলেছে।তিথিকে কেউ পাত্তাই দিচ্ছেনা।তিথি মুখ বাঁকিয়ে তার রুমে যাওয়া ধরতেই দেখে রুমটা ভেতর থেকে বন্ধ।
দরজায় লেখা—–

আপনি ভু্ল জায়গায় এসেছেন।এই রুমটি এখন আর আপনার নেই।মনে আছে? আজ সকালে এগারোটা বারো মিনিটে সই করেছিলেন?দলিল দেখতে হলে ৫ চাপুন।দলিল দেখতে না হলে ৩ চাপুন। আর রুমে থাকতে হলে পা চাপুন’
তিথি দরজা ধাক্কিয়ে বললো,’এই রিদইম্মা!বাদাইম্মা!দরজা খোল!আমার ঘুম আসতেছে’
রিদম তখন বলে,’সরি!এখানে রিদম নামের কেউ থাকেনা ‘

তিথি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,’মহারাণী ভিক্টরিয়ার নাতিন !দরজা খুলেন প্লিজ!’
ওমনি রিদম এসে দরজা খুলে বলে,’দলিলে লেখা আছে তুমি যদি বাসায় আবার ফিরে আসো তবে আমার পা টিপে দিবা ডেইলি পনেরো মিনিট।আর আমাকে রুহ আফজা মিল্ক শেক বানিয়ে খাওয়াবা সপ্তাহে সাতদিন’
‘করবো রে ভাই।থাম! ‘

এটা বলে তিথি রুমে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়ে।শুতেই তার চোখে রাজ্যের ঘুম এসে যায়।
সকালে তিথির ঘুম ভাঙ্গে সুরাইয়ার কলে।তিথি ঘুম ঘুম চোখে কলটা রিসিভ করে কানে ধরতেই সুরাইয়া বললো আজ তাদের ইংরেজী ক্লাসে ম্যাম নাকি যারা অনুপস্থিত থাকবে তাদের সাময়িক পরীক্ষায় নাম্বার কমিয়ে দেবে।এটা শুনে তিথি লাফ দিয়ে উঠে বসে।তারপর ঘড়িতে দেখে আর আধ ঘন্টা আছে ম্যামের ক্লাস শুরু হবার বাকি।

তিথি জলদি উঠে ওয়াশরুমের দিকে ছোটে।দ্রুত ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে টেবিলের উপর থেকে ব্রেড আর কলা একটা নিয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সে বেরিয়ে যায়।যাবার সময় দেখা হয় বাবার সাথে।বাবা ওর একটু আগেই বেরিয়েছিলেন অফিসের জন্য।বাবা তিথিকে বললেন বাইকে উঠতে। তিনি ওকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দেবেন।
যাবার অনেকটা পথে বাবা চুপই ছিলেন।তিথি মনে করলো বাবা তার উপর রাগ করে আছেন।তাই কিছু সময় পর সে বললো,’আচ্ছা বাবা তুমি কি আমার উপর রেগে আছো?’

‘নাহ রে মা’
‘সরি বাবা’
‘ইটস ওকে।তুই তো জানিসই আমি তোকে সব স্বাধীনতা দিয়ে বড় করেছি।তাও কাল ভয় পেয়ে গেছিলাম।রকিবের পরিবারের সামনে কি করে মুখ দেখাবো সেইসব ভাবতে গিয়ে।কিন্তু আমার তানিয়া মা আমার মান রাখলো।এখন তোকে একটা কাজ দেবো।তানিয়া আসলে আমাদের সম্মান বাঁচাতে রকিবকে বিয়ে করতে চায় নাকি নিজের মতেই চায় সেটা তোকে জানতে হবে।জানিস তো,তানিয়া একটু অন্যরকম,ছোট কাল থেকেই। ওর মন বুঝতে আমার বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়।তাও বুঝিনা তার মনের ভেতর কি আছে।তুই মা আমার এই কাজটা করে দিবি?’

‘দেবো।করে দিলে,কি দিবে বলো?’
‘তোর পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে দিবো তোকে’
‘পছন্দ নেই বাবা’
তিথির মলীন মাখা সুরের কথাটি শুনে বাবা বললেন,’কেউ কষ্ট দিয়েছে মা?তবে একটা কথা শুনবি?কেউ যখন কারোর হৃদয় ভাঙ্গে,ঠিক তখনই অন্য একটা জায়গায় অন্য একটা মানুষের হৃদয় তৈরি হয় এই ভাঙ্গা হৃদয়টাকে জোড়া লাগাবার জন্য।তোর জন্য ও তাই আছে।ভাবিস না’

তিথি খুশি হলো বাবার কথা শুনে।খুশি মনে সে তার ডিপার্টমেন্টে আসা ধরতেই দেখে ম্যাম আসছে এদিকেই। এটা দেখে তিথি খুব দ্রুত ঢুকতে যায় ক্লাসে, ওমনি তার সাথে ধাক্কা লাগে একটা ছেলের।
ধাক্কা খেয়ে তিথি তার কালকে রাতের হাতের চোটে ব্যাথা পায়।তারপর বিরক্ত হয়ে বলে,’দেখে হাঁটতে পারো না!’
এটা বলে সে তাকিয়েই ছিল।কিন্তু যে ছেলেটা তাকে ধাক্কা দিয়েছে সে ওর দিকে আর তাকায়নি।সোজা গিয়ে একটা সিটে বসে পড়ে।তিথি হাত ঘঁষতে ঘষতে এসে সুরাইয়ার পাশে বসে আবারও তাকায় ছেলেটার দিকে।ছেলেটির মুখে মাস্ক ছিল।তখন তিথির মনে পড়ে সাবিনা ম্যাম মাস্ক নিয়ে অনেক কথা শোনান।এটা মনে পড়ায় সে ব্যাগ হাতায় কিন্তু কোনো মাস্ক পায়না,তার স্পষ্ট মনে আছে সে তার ব্যাগে মাস্ক সবসময় রাখে।

তিথি যখন এসব ভাবছিল তখন সেই ছেলেটা তার হাতে থাকা তিথির নীল রঙের মাস্কটা জানালা দিয়ে ফেলে দেয়।
তিথি তার মাস্ক ব্যাগের বাহিরে পিন দিয়ে আটকে রাখে।ছেলেটা তখন ধাক্কা দেয়ার সময় মাস্কটা নিয়ে নিছিলো।
সাবিনা ম্যাম ক্লাসে ঢুকে পুরো ক্লাসরুমে চোখ বুলিয়ে দেখলেন তিথি বাদে সবাই মাস্ক পরে এসেছে।
তখন ম্যাম ওকে দাঁড়াতে বললেন।

‘কি ব্যাপার তিথি?মাস্ক পরোনি কেন?’
‘ম্যাম মাস্ক আনতে ভুলে গেছি।আমার ব্যাগেই ছিল!কিন্তু এখন পাচ্ছিনা’
‘পুরোনো বাহানা।যাই হোক ক্লাস থেকে বের হও।বাহিরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরো ক্লাস এটেন্ড করবে’
তিথি মাথা নিচু করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকলো।
ম্যাম বই বের করে পড়ানোতে মন দিয়েছেন।সেই ছেলেটা এক দৃষ্টিতে তিথির দিকে তাকিয়ে ছিল।তার চোখে তিথির এই হাল দেখে আনন্দ ফুটছিল। সে এতটাই খুশি হচ্ছিল যে তার জোরে জোরে হাসতে মন চাইলো কিন্তু সে হাসবেনা!কাউকে বুঝতে দেয়া যাবেনা সে ইচ্ছে করে তিথিকে বকা খাইয়েছে ম্যামকে দিয়ে।

তিথি গাল ফুলিয়ে রেখে ম্যামের দিকে তাকিয়ে আছে।এভাবে আর কত তাকানো যায় বলে সে ক্লাসের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল আজ কারা কারা এসেছে।সবাইকে চিনলেও একটা ছেলেকে সে চিনতে পারলোনা।সেই মাস্ক পরা ছেলেটা।তখনই ম্যাম এটেন্ডেন্স ডাকলেন সে ছেলেটার।নাম ইশান আরাফাত।ম্যাম এটাও বললেন ইশান নতুন স্টুডেন্ট।
তিথি চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে ছিল।ছেলেটা তখন ওকে ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছে এটা সে বেশ বুঝতে পেরেছিল।

ম্যামের ক্লাস শেষ হবার পর তিথি এসে সুরাইয়ার পাশে বসে।তখন সুরাইয়া তার কালকে রাতের লং ড্রাইভ নিয়ে কথা বলা শুরু করে।তিথির মন সেদিকে নয় বরং ইশানের উপর ছিল।কিন্তু ইশান এমন ভাবে তার পাশের ছেলেটার সাথে কথা বলছে যেন সে জানেই না তিথি তার দিকো তাকিয়ে আছে কিন্তু সে বেশ জানে তিথি ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।জেনেশুনেও না জানার ভান করে সে পাশের ছেলেটির সাথে তার কলেজ লাইফ নিয়ে কথা বলছে।

ছেলেটির নাম রাজু।রাজু ইশানের কাছে জানতে চায় সে কোন কলেজে পড়েছে।ইশান যখন কলেজের নাম বলে তখন ছেলেটি আশ্চর্য হয়ে যায়।এত বড় কলেজ থেকে পড়ে এসে ইশান কিনা এই ভার্সিটিতে ভর্তি হলো, তখন রাজু জানতে চাইলো সে কি চান্স পায়নি ভাল ভার্সিটিতে।
ইশান মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললো,’নাহ পাইনি।আমি দূর্বল ছাত্র’
‘দূর্বল ছাত্র হলে এতো বড় কলেজে পড়লে কিভাবে?’

যদি তুমি বলো পর্ব ৩

‘তখন মেধাবী ছিলাম।এখন দূর্বল হয়ে গেছি। অনেক দূর্বল!’
এটা বলে ইশান পেছনে ফিরে তিথির দিকে তাকায়।তিথি সেইসময় সুরাইয়ার ফোনে ওর ছবি দেখছিল।

যদি তুমি বলো পর্ব ৫