যদি তুমি বলো পর্ব ৬

যদি তুমি বলো পর্ব ৬
আফনান লারা

তানিয়া তার কলেজের দোলনায় বাঁদরের মতন ঝুলছিল।কলেজের পিওন আর একজন স্যার এসে ওকে থামানোর চেষ্টা করছেন তাও পারছেন না।সে ঝুলছেই তো ঝুলছেই।
এটা নতুন না।তানিয়া প্রায় সময় এমন করে।তার বাসায় দোলনা নেই,আনলেও একদিনের ভেতরে রিদম সেটাতে ঝুলে ঝুলে দড়ি ছিঁড়ে ফেলে।এদিকে তানিয়ার দোলনার প্রতি অনেক শখ।

তাই কলেজে এসে এই শখ মেটায়।স্যার ওকে বলতে বলতে বিরক্ত হয়ে চলে গেছেন।তিথি কলেজে এসে দেখে সব ছাত্রছাত্রী চলে গেছে।শুধু তানিয়া রয়ে গেছে।
তিথি এসে ওর দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে বললো,’তোর যে আর এক মাস পর বিয়ে সে নিয়ে কোনো চিন্তা নেই?’
এ কথা শুনে তানিয়ে ঝুলতে ঝুলতে পেছনে তাকায়।এরপর বলে,’কিসের টেনসন?আমি বিন্দাস’
‘নাম!’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তিথি জোর করে ধরে নামায় ওকে।এরপর ওকে নিয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে ফুটপাত দিয়ে চলতে চলতে বলে,’একটা কথা বলবি!রকিবকে তোর ভাল লেগেছে?’
‘খারাপ না।’
‘তোর তো বোকা ছেলে পছন্দ ছিলনা।তোর পছন্দ চালাক চতুর ছেলে।সবসময় বলতি বোকা টাইপের ছেলেরা মায়ের কথায় উঠে বসে, তুই নাকি কখনও বোকা ছেলে বিয়ে করবিনা।এটাও বলতি তোর জামাই হবে হ্যান্ডসাম।আর পেলি মেদ-ভূড়ি হওয়ালা একটা বয়স্ক লোক।আমার চাইতেও অনেক বড়।তোর থেকে তো আরও বেশি বড়।কি করে সংসার করবি?চাপে পড়ে হ্যাঁ বলার কি দরকার ছিল!’

‘আমি চাপে পড়ে করিনি।হ্যাঁ এটা ঠিক যে আমার অনেক চাহিদা ছিল,অনেক স্বপ্ন ছিল জীবনসঙ্গী নিয়ে।কিন্তু সেদিন রকিবের সাথে কথা বলে বুঝলাম সংসারে চেহারা কিংবা অতি চালাক হওয়া ম্যাটার করেনা।সংসার তার সাথেই করা যায় যার কাছে দিনশেষে মানসিক শান্তিটা মিলবে।আমি সেদিন বুঝেছি রকিব আমার জন্য একেবারে ঠিক।জানো টুকু! আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম,কখনও যদি আমার আর তার পার্সোনাল কিছু ঝামেলা ঘটে,সে কথাটা কার সাথে শেয়ার করবে,কিংবা কার কাছে পরামর্শ চাইবে, তখন সে বললো দোষটা আমার হলে সে নিজে নিজে ঠিক করবে আর দোষ তার হলে আমার কাছে এসে পরামর্শ চাইবে।এমন আরও অনেক প্রশ্ন আমি করেছি, শুধু জানতে চেয়েছিলাম সে আজীবন বোকাই থাকবে নাকি সংসার জীবনে এসে সে দায়িত্ব নেয়া শিখবে”

‘তা মানে তুই সিরিয়াস? ‘
‘ইয়েস!’
তিথি খুশি হয়ে তানিয়ার কপালে চুমু খায়।তার ছোট বোন অনেক বড় হয়ে গেছে।চলতে চলতে তারা ফুচকাওয়ালা মামাকে দেখে থেমে যায়।আজ অনেক টক দিয়ে ফুচকা খাবে দুজনে।খাবার সময় তানিয়া বলে ওঠে তিথি তো ওকে বিয়ে দিয়ে হালকা হবে,কিন্তু তিথির বিয়ের কি হবে?’
‘আর মনে করিয়ে দিস না।আদিল যে চিট করেছে,সেটা ভুলতে আমার অনেক দিন লাগবে’
‘আমি তোমায় শুরুতেই বলেছিলাম আদিল ভাইয়া সুবিধার না!’

কথা বলতে বলতে তিথি ফুচকার বিল নিয়ে মামাকে দিতেই উনি বললেন লাগবেনা।তখন তিথি বলে কেন লাগবেনা।সেইসময় মামা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন দূরে একটা ছেলে চলে যাচ্ছে,বিলটা সে দিয়েছে।ছেলেটা হঠাৎ করে এসে ওদের বিলটা দিয়ে চলে গেলো মাত্র।যাবার সময় ইশারা করে গেছে।তিথি আর তানিয়া কথা বলায় এতটাই ব্যস্ত ছিল যে তারা খেয়ালই করে নাই।

তিথি তো ছাড়ার মেয়ে না।সে হাতের ব্যাগ তানিয়ার হাতে ধরিয়ে, দিলো এক ছুট।ছেলেটা পকেটে হাত দিয়ে হাঁটছিল।তিথি ছুটতে ছুটতে ওর অনেকটা কাছে এসে গেছিলো কিন্তু তার আগেই ছেলেটা গাড়ীতে উঠে যায়।গ্লাস কালো রঙের ছিল বলে গাড়ীর ভেতরে তিথি কিছুই দেখেনা।সে বাহিরে থেকে চিল্লাচিল্লি করে কিন্তু গাড়ীর ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেয়নি।গাড়ীটা ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।
তিথির কাল রাতের কথা মনে পড়ায় সে গাড়ীর নাম্বার চেক করে দেখে এটা অন্য একটা গাড়ী।তবে মনে হয় মানুষ একটাই।

তিথি এবার রাগ করে নিচু হয়ে মাটি থেকে কিছু একটা নিয়ে গাড়ীর ভেতর মারবে বলে ঠিক করে কিন্তু মনে হয় গাড়ীর ভেতরের মানুষটা তার এই স্বভাবের সাথে পরিচিত।সে গাড়ীটা দ্রুত চালিয়ে চলে যায় ওখান থেকে।
তিথি রাগে চেঁচামেচি করতেছিলো একা একা,তখন তানিয়া ওর পাশে এসে বলে,’তোমার কোনো সিক্রেট লাভার আসলো নাকি টুকু?’

এ কথা শুনে তিথির হাত থেকে কঙ্করটা পড়ে যায়।নামটা শুনে মূহুর্তেই তার সারা শরীর কেঁপে ওঠে।তার চোখের সামনে কতগুলো স্মৃতি ভেসে ওঠে আচমকা।
তানিয়া তখন মুখটা মলীন করে বলে,’সরি টুকু। আমার আসলে হঠাৎ মনে আসলো,তাই বলে দিছি।আমি কিন্তু ভুলিনি,তুমি কি ভুলেছো?’
তিথি কিছু বলেনা।রিকশা একটা দাঁড় করিয়ে উঠে পড়ে চুপচাপ।

গাড়ীতে ইশান ছিল এবং তার বড় বোন তামিয়া ছিল।
(তামিয়া নামটা আমার একজন ভক্তের অনুরোধে দেয়া।)
তামিয়া ইশানকে বলে’একবার শাস্তি দিস,দাঁত কেলিয়ে হাসিস।আবার ওকে কেয়ার ও করিস।ঠিক কি চাইছিস?এইসব না করে বড় কোনো শাস্তি দে!যেন জন্মের শিক্ষা পেয়ে যায়।
তিথি কি করেছে তোর সাথে সেটা কি ভুলে গেছোস?তোর উচিত কেয়ার না করে বরাবরের মতন শাস্তি দেয়া।’
ইশান দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে গাড়ী চালাতে থাকে।
তারপর কি মনে করে গাড়ী থামিয়ে আদিলকে কল দিয়ে তার কাজটা বুঝিয়ে দেয় তাকে।

বাসায় আসার পর থেকে তিথির মন ভাল না।কোনো একটা কারণে সে ভার হয়ে বসে আছে।বেশ কিছু সময় পর তার ফোনে একটা কল আসে। অপরিচিত নাম্বার থেকে।
তিথি শুয়ে থেকেই ফোন নিয়ে কানে ধরে।
‘তিথি!’

আদিলের গলার স্বর শুনে তিথি উঠে বসে সঙ্গে সঙ্গে।কলটা কাটতে যাবে তখনই আদিল বলে ওঠে,’কল কাটবানা প্লিজ।তিথি আমি জানি তোমার সাথে আমি খুব খারাপ করেছি।আমায় একটা সুযোগ দেবে নিজেকে শুধরানোর?প্লিস তিথি’
‘সুযোগ তোমায় আমি বহুবার দিয়েছি।আর দিবোনা।এরপর আর আমায় কোনোদিন ফোন দিবেনা তুমি’
‘তিথি একবার শোনো আমার কথা।আমি চাই তোমার সাথে দেখা করে বিষয়টা মিটিয়ে নিতে।প্লিজ একবার দেখা করবে?আমি কথা দিচ্ছি,আমার সব শুনে যদি তোমার কাছে মনে হয় আমি ক্ষমার অযোগ্য,তখন তুমি চলে যেও।আমি আর কখনও তোমায় কল করবোনা’

যতই হোক,এতগুলো বছরের প্রেম।তিথি তো ভালবেসেছিল।তাই আদিলের কথায় সে রাজি হয়।তবে খুশি হয়ে না।আদিল জোর করছে বলেই কাল দেখা করবে বলে ঠিক করে সে।

রকিব তানিয়াকে বিকেলে একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করতে বলে।এদিকে তানিয়া একা যেতে একটু লজ্জা পাচ্ছিল,বন্ধুবান্ধবের সাথে শত রেস্টুরেন্ট ঘোরা হলেও,একা একটা ছেলের সাথে ঘোরা অন্য বিষয়।
তাই সে তিথিকে নেবে বলে ঠিক করে।
দুই বোন তৈরি হয়ে বেরিয়েও যায়।কিন্তু যাবার পথে মা ওকে থামিয়ে বললেন তিথি যেন রকিবের সামনে না যায়।
কেন বললেন তা তিথি বুঝতে পারলো,কিন্ত তানিয়া বুঝলোনা।সে এর ব্যাখা জানতে চাইছে।তিথি তখন কথা ঘুরিয়ে ওকে নিয়ে চলে আসে ওখান থেকে।

রিকশায় করে দুজনে সেই রেস্টুরেন্টে চলে আসে।তিথি এমন একটা কেবিনে বসে যেখান থেকে তানিয়া,রকিবকে দেখা গেলেও ওরা ওকে দেখতে পাবেনা।
তিথি বসে বসে বোর হচ্ছিল বলে সে একটা নুডুলস অর্ডার করে।
সে কাঁচামরিচ একদমই খেতে পারেনা।খেলেই তার দম বন্ধ হয়ে যায়।এরকম অবস্থা থাকে প্রায় এক দু ঘন্টা ধরে।
এ কথা তিথির কাছের মানুষ ছাড়া আর কেউ জানেনা।
অল্প সময়ের মধ্যে তিথিকে তার অর্ডার করা নুডুলসটা দিয়ে দেয়া হলো।সে নুডুলস পেয়ে মহা খুশি।খুঁজে দেখলো কোথাও কাঁচা মরিচ আছে কিনা।

কিন্তু কোথাও সে পায়নি কোনো মরিচ।নুডুলস সমাান্য সবুজ রঙের কেন সেটা ও জানতে চাইলো ওয়েটারের কাছে।
তখন ওয়েটার বলে এটা ফুড কালার।
তিথি আর সাত পাঁচ না ভেবে প্রথবারেই বড় এক চামচ নুডুলস মুখে দিয়ে চিবিয়ে গিলেও ফেলেছে।
গিলে ফেলার পরই তার মনে হলো ওটা ফুড কালার ছিল না,এরা নুডুলসে কাঁচামরিচ বেটে দিয়েছে।তিথি মাথায় হাত দিয়ে পানির জন্য হাঁপাতে লাগলো।টেবিলে একটু পানিও নেই।তার বুক জ্বলছে আগুনের মতন।মুখের চেয়েও বুক জ্বলাটা তার কাছে বেশি কষ্টের মনে হয়।

তার মাথা ঘুরছে।দম পুরো বন্ধ হয়ে আছে।
সে রেগে চেঁচামেচি করতে করতে বলে,’নুডুলসে কেউ কাঁচামরিচ বাটা দেয়!কেস করবো আমি!ভোক্তা অধিকারের কেস!’
তখন ওয়েটার দুজন এসে বলে এটা ফুড কালার।তিথি তাও চিৎকার করতে থাকে।এরপর ওয়েটার দুজন ওকে দেখিয়ে নুডুলস কয়েক চামচ খেয়েও দেখায়।তিথির নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছেনা।
এরা এত ঝাল কি করে খাচ্ছে!তাহলে সে খেতে পারেনাই কেন!
মরিচ আর ফুড কালারের আকাশ পাতাল তফাৎ!

তিথির মরে যাওয়ার মতন অবস্থা হয়ে গেছে।
ওয়েটার দুজন মুচকি হেসে চলে গেলো ওখান থেকে।তিথি যে এত পানি পানি করছে তাও কেউ তাকে পানি এগিয়ে দিলোনা।
শেষে আর সইতে না পেরে তিথি কান্না করতে থাকে।কারণ তার পেট জ্বলছিল।
চেঁচামেচির আওয়াজ তানিয়ার কানে পৌঁছায়।সে রকিবকে রেখে ছুটে এসে দেখে তিথির হাল বেহালৃ
সে দ্রুত পানি এনে ওকে খাইয়ে দেয়,তাও তিথির অবস্থার কোনো উন্নতি হয়না।এই সময়ের মাঝে ওয়েটারটা সেইই নুডুলসের বাটি গায়েব করে ফেলেছে।

তানিয়া ভয় পেয়ে গেলো,সে কি করবে না করবে।সে আরও পানি আনতে ছুটলো অন্যদিকে।তখন সেখানে তিথির সামনে এসে দাঁড়ায় ইশান।মুখে আগের মতন মাস্ক লাগানো।
এই সব কিছু ইশানেরই করা।
তিথি ইশানকে খেয়াল করেনি।সে ঝালে মাথা ঠোকড়াচ্ছে টেবিলে।
ইশান কাছে এসে তিথির মুখ টিপে ধরে।তিথি চোখ বন্ধ করে পানি পানি করছিল।

ইশান ওমনি তিথির মুখ খুলে ওর মুখের ভেতর আঙুল দিতেই তিথি ঐ জায়গাতেই বমি করে দেয় সবার সামনে।
বমির পরেই তার যত হাঁপানি সব আস্তে আস্তে থামে।পেটে যে জ্বালা করছিল সেটাও বন্ধ হয়ে যায়।
তিথি টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে ইশানের দিকে তাকায়।ইশান এক বোতল পানি ওর সামনে রাখে এরপর ওখান থেকে চলে যায়।
তিথি কিছুই বলেনা।শুধু তাকিয়ে থাকে।সেই অজ্ঞাত ছেলেটা আর ইশানের মাঝে কি কোনো যোগসূত্র আছে!

যদি তুমি বলো পর্ব ৫

হাঁটা চলা,ভঙ্গিমা সব এক রকম মনে হয় তাদের দুজনের।
ইশাম যাবার সময় ওয়েটারের হাতে টাকা দিয়ে চলে যায়।কাজটা সে করিয়েছিল।তিথিকে কাতরাতে দেখতো তার আনন্দ লাগে!ভীষণ আনন্দ।

যদি তুমি বলো পর্ব ৭