খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২০

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২০
আভা ইসলাম রাত্রি

ভোরের আলো ফুটলে আয়ুষ্মান বাড়িতে কিসের তোড়জোড় লাগে। বাড়ির মহিলারা পাকের ঘরে এটাসেটা রাঁধছেন। পুরুষরাও আজকে বড্ড ব্যস্ত। ইতি–অতি দৌঁড়ে সব তৈরি করে দিচ্ছেন। উঠোনে পৈতৃক গাড়িটিও সকাল থেকে অপেক্ষা করছে। শেহজাদ মর্তুজাকে শিখিয়ে দিচ্ছে আজকের ভাষণে কিভাবে লোকজনকে ঘণ্টা যাবৎ আটকে রাখা যায়।

অনেক সাধনার পর শেহজাদ আজকে জেলার নির্বাচনে যাচ্ছে। সামনের কদিন এ নির্বাচনেই সময় যাবে তার। আজকে প্রচারণার প্রথম দিন। শেহজাদ তাই আঁটসাঁট বেঁধেই লেগেছে প্রচারণার কাজে। শেহজাদ নির্বাচনের আগাগোড়া একবার মগজে তুলে নিচ্ছে। মর্তুজা পাশে থেকে ধরিয়ে দিচ্ছে কোনো ভুল-ত্রুটি! শেহজাদ বেরিয়ে যাবে আর কিছুক্ষণ পর। নওশাদ তখন শেহজাদের ঘরে এলেন। শেহজাদ নওশাদকে দেখে মতুর্জাকে ইশারা করে। মর্তুজা তাৎক্ষণিক মাথা নত করে নওশাদকে সালাম করে বেরিয়ে যায়। শেহজাদ বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘বসেন, আব্বাজান।’
নওশাদ বেতের সোফায় আরাম করে বসেন। শেহজাদের হাতে একটা রাজনীতির বই। নওশাদ সেটা দেখে পলক ফেলেন একবার। পরে বলেন,
‘নির্বাচনের প্রথম দিন আজ! কেমন প্রস্তুতি?’
শেহজাদ বই বন্ধ করে বিছানায় রাখে। চোখের চশমা খুলে উত্তর দেয়,
‘আল্লাহর রহমতে এখন অব্দি ভালো চলছে। জেলার মানুষের পেছনে মোটা অঙ্ক খরচ করা হয়েছে। অর্ধেক জনগন আমার পক্ষে।’

‘তাহলে তো রাস্তা পরিষ্কার।’
‘অর্ধেক এখনো বাকি, আব্বাজান। তাছাড়া অমল ঠাকুরের নিজের ছেলে নির্বাচনে নেমেছে। প্রতিপক্ষ শক্ত।’
‘নিজের ছেলে নেমেছে? ভাইপোর না নামার কথা ছিল?’
‘নামাতে চেয়েছিল। কিন্তু ভাইপোর পেছনের কাজ ভালো না। তাই জনগন ক্ষেপে আছে।’
‘তাহলে তো চিন্তার বিষয়। তুমি নিজে কিভাবে সামাল দিবে এসব ভেবেছ কিছু?’
শেহজাদ গোপনে ভাবে কতকিছু। রহস্যপূর্ন ঠেকে তার মুখের অবয়ব। শেহজাদ মুখে জানায়,
‘আমার রাজনীতি জনগণের জন্যে। তারা আমার সাথে থাকবে ইন শা আল্লাহ!’
‘তাহলে ভরসা আছে নিজের উপর?’

শেহজাদ হালকা আওয়াজে আত্মবিশ্বাস সহকারে জানায়,
‘নিজের উপর ভরসা না থাকলে রাজনীতিতে টিকে থাকা যায় না। আর রাজনীতি থেকে ছিটকে পরা শেহজাদ আয়ুষ্মানের কম্য নয়।’
নওশাদ হালকা হাসেন। সোফা ছেড়ে উঠে ছেলের কাঁধে হাত রেখে হালকা শব্দ করে চাপড়ে দেন। গর্ব নিয়ে বুক ফুলিয়ে বলেন,

‘আমার রাজা ছেলে, বিজয়ী হয়ে ফেরো। আল্লাহর সাহায্য এবং তোমার আব্বাজানের দোয়া আছে তোমার জন্যে।’
শেহজাদ কৃতজ্ঞতা বোধ নিয়ে তাকায় নওশাদের দিকে। নওশাদ চলে যান। শেহজাদ আবারও বই হাতে নেয়। ঠোঁটে কুটিল বাঁক। কি সাতপাঁচ চিন্তা করছে কেউ জানে না। এ পুরুষ সবার কাছেই বড্ড রহস্যময় ঠেকে। কখন কি ভাবে, কি করে সবার আন্দাজের বাহিরে। শেহজাদ সবার কাছে শুদ্ধ পুরুষ, পবিত্র পুরুষ। অথচ সে ভেতরে ভেতরে কেমন তাহা সবারই অজানা। কেহ জানে না শেহজাদ আয়ুষ্মানের মন পবিত্র হলেও তার মস্তিষ্ক কেমন? কেহ জানে না, কেহ না।

শেহজাদ এক্ষুনি বেরুবে। রেখা ভোরে উঠে চুলোয় পায়েস বসিয়েছেন। শেহজাদ বেরুবে শুনে গরম গরম পায়েস বাটিতে নিয়ে চিত্রার হাতে ধরিয়ে দিলেন। গম্ভীর স্বরে আদেশ করেন,
‘বড় খোকার কাছে নিয়ে যাও।’
চিত্রা মাথা নাড়ায়। সেদিকেই যাবে বলে পা বাড়ায়। তবে আটকান রেখা।
‘থামো মেয়ে।’
চিত্রা তাৎক্ষনিক থেমে যায়। বাটি হাতে পেছনে ফিরে।

‘জ্বি, আম্মাজান।’
‘স্বামীর কাছে যেতে হলে সুন্দর শাড়ি, সুন্দর চেহারা নিয়ে যেতে হয়। এমন ঘামে ভিজে মুখে কালো মুখ আরো কালো লাগছে। যাও, মুখ ধুয়ে তারপর যাও। গায়ে আতর মেখে যাবে।’
চিত্রার মুখখানা অপমানে শুকনো হয়ে এলো। মুখের অবয়ব বদলে গেল। চোরা চোখে রেখার দিকে চেয়ে মিনমিন করে বলল,

‘জ্বি, যাচ্ছি আম্মাজান।’
রেখা প্রসন্ন হন। চিত্রাকে যত খুঁচিয়ে কথা বলেন না কেন চিত্রা কখনো মুখ ফুটে অভিযোগ জানায় না। কিংবা মুখ কালো করে কথায় কথায় তর্ক করে না কখনো। রেখা চিত্রার এমন সু-আচরণে বড্ড খুশি বলা চলে। চিত্রার সামনে কুকথা বলে তার মন দুঃখী করলেও, অন্য কারো সামনে তিনি চিত্রার সুনাম করতে বেশি পছন্দ করেন এখন। নিজের বাড়ির বউদের দুর্নাম মানুষের কাছে কি বলে–কয়ে বেড়ানোর জিনিস? চিত্রা চলে যেতেই রেখা বাড়ির কাজের মহিলাদের উদ্দেশ্যে গর্ব করে বললেন,

‘দেখেছিস কত বাধ্যগত বউ আমার। একটা কথা বললে মাটিতে চোখ রেখে শুনে। তর্ক করতে দেখেছিস কোনোদিন? বাড়ির বউদের এমন হওয়া উচিত। পটরপটর কথা বলা বউরা বাড়ির জন্যে বিষ। নীরব বউরা আল্লাহর দেওয়া রহমত বাড়ির জন্যে।’
কাজের মহিলারা মাথা নত করে সশব্দে একযোগে রেখার কথা সম্মতি জানায়। গর্বে এবং ভালো লাগায় রেখার মন ঝলমলিয়ে উঠে। এমন একটা বউই তিনি তার রাজা ছেলের জন্যে চেয়েছেন। আল্লাহর কি রহমত, না চাইতেও এমন একটা সোনার মত বউ আল্লাহ তাদেরকে মিলিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া, আলহামদুলিল্লাহ!

চিত্রা শেহজাদের ঘরে পায়েস নিয়ে প্রবেশ করে। শেহজাদ তখন সবে পাঞ্জাবি পরেছে। এখন নির্বাচনের কাগজগুলো ফাইলে রাখছে একটা একটা করে। চিত্রা এগিয়ে যায়। শেহজাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে পায়েস এগিয়ে দেয়,
‘পায়েস, আম্মাজান পাঠিয়েছেন।’
চিত্রার মধুর কন্ঠ শেহজাদের ক্লান্তিকে নিমিষেই নির্মূল করে দেয়। শেহজাদ ফাইল তৈরি করে একপাশে রেখে ঘুরে দাঁড়ায়। হাত বাড়ায়,

‘দাও।’
শেহজাদের হাতে পায়েস দেয় চিত্রা। শেহজাদ বসে বিছানায়। পায়েস খেতে খেতে হঠাৎ আদেশ করে,
‘এদিকে এসো।’
চিত্রা কথা বাড়ায় না। চুপচাপ এগিয়ে যায় দু কদম। শেহজাদ চামচ দিয়ে এক চামচ পায়েস চিত্রার মুখের দিকে এগিয়ে দেয়। শেহজাদ নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে দেখে চিত্রা এবারেও লজ্জা পায়। হা করে খাবে তার আগেই গম্ভীর স্বরে শেহজাদ আদেশ করে,
‘সকল খাবার বসে খেতে হয়। এটা সুন্নত।’

চিত্রা অপ্রস্তুত হয়ে পরে। শেহজাদ জীবনের প্রতিটা কদমে ধর্ম খুব মেনে চলে। চিত্রার নিজের কাছেও আজকাল এসব অভ্যেস হয়ে গেছে। কিন্তু মাঝেমাঝে ভুলে যায় চিত্রা। চিত্রা দাঁত দিয়ে ঠোঁট জিহ্বা কামড়ে বলে,
‘ভুলে গেছি, দুঃখিত।’
চিত্রা শেহজাদের থেকে কিছুটা দূরে বিছানায় বসে। শেহজাদ তীক্ষ্ম চোখ চিত্রার বসা দেখে। তারপর নিজেই এগিয়ে এসে চিত্রার সঙ্গে ছুঁইছুঁই করে বসে। পায়েস চিত্রার মুখে তুলে দিতে দিতে বলে,
‘স্বামীর সঙ্গে দূরত্ব বজায় —–‘

চিত্রা জানে এর পরের কথা কি হবে? শেহজাদ বাকি কথা সম্পূর্ন করতে পারে না। চিত্রা সঙ্গেসঙ্গে উঁচু হয়ে শেহজাদের মুখ চেপে ধরে। চোখ খিঁচে আওড়ায়,
‘আমাকে মাফ করুন, আর হবে না।’
শেহজাদ শুনে। চিত্রা সরে আবার। শেহজাদের সঙ্গে এবার চিত্রা ছুঁইছুঁই হয়ে বসে। শেহজাদের গায়ের মিষ্টি গন্ধ চিত্রার নাকে লাগছে। এতেই কেমন মোহিত হয়ে যাচ্ছে চিত্রা। একটা পর্যায়ে চিত্রা সকল লাজ–লজ্জা জলাঞ্জলি দিয়ে শেহজাদের কাঁধে মাথা রেখে তার বাহু জড়িয়ে ধরে। শেহজাদের ঠোঁটে বাঁক দেখা যায়। সঙ্গেসঙ্গে সেটা সরেও যায় আবার। শেহজাদ বলে,

‘আজ এত কাছে?’
চিত্রা কথা বলে নিজের মত,
‘আসার সময় শহর থেকে আমার জন্যে আতর আনবেন?’
‘কেমন আতর?’
‘আপনি যা মাখেন, তাই।’
‘আমি পুরুষের আতর মাখি। তুমি পুরুষ আতর মাখবে?’

‘আমি আমার স্বামীর গায়ের গন্ধ শরীরে মাখতে চাই। যেন আপনি কখন কোথাও চলে গেলে আমার আপনার কথা মনে পরে কষ্ট না আসে। মনে হয়, আপনি আমার সঙ্গেই মিশে আছেন, আমার গায়ে আপনার গন্ধ আমাকে আপনার কথা ভুলতে দিবে না। আনবেন এমন আতর?’
শেহজাদের বুকের ভেতর অদ্ভুত এক প্রশান্তি বয়ে যায়। নারীর বুকভরা ভালোবাসা যে পুরুষ অর্জন করেছে, সে সত্যিকারের ভাগ্যবান পুরুষ। শেহজাদ হালকা স্বরে বলে,

‘শহর থেকে ফেরার পথে আনব আতর। আর কিছু?’
‘বলছি। আগে বলুন, আপনি ফিরবেন কবে?’
‘দুদিন পর।’
‘একটা আবদার করি?’
‘কি?’

‘আমি এ দুদিন বাপের বাড়ি থেকে আসি? আসার পর থেকে একবারও যাইনি। মন টানছে বাপের জন্যে।’
‘আম্মাজানকে জিজ্ঞেস করে যেও। আমি বলে যাব আম্মাজানকে।’
চিত্রার ঠোঁটে হাসি লেগে থাকে। এ মানুষটা এত আদুরে কেন? মাঝেমাঝে চিত্রার মন চায় এ মানুষের বুকের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে থাকতে।

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ১৯

বুকের খাঁচার মধ্যে চেনা পাখির ন্যায় ডানা ঝাপটাতে। তারপর হঠাৎ হঠাৎ বুক থেকে বের হয়ে মানুষটার সঙ্গে সমুদ্র সমান ভালোবাসা বিনিময় করতে। এ পুরুষ ধীরে ধীরে চিত্রার সর্বস্বের সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে। চিত্রা শ্বাস নিতে পারে না, শ্বাসের সঙ্গে এ পুরুষের জন্যে চিত্রার অফুরন্ত ভালোবাসা কথা বেরিয়ে আসে।

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২১