খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২১

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২১
আভা ইসলাম রাত্রি

বদ্ধ ঘরের শান্ত পরিবেশ এক মুহূর্তেই কেমন তছনছ হল। শোনা গেল একের পর এক হুমকি–ধামকির কন্ঠ। শেহজাদের কন্ঠ তেমন শোনা যাচ্ছে না। মাঝেমাঝে তার শান্ত বুলি শুধু– ‘হ্যাঁ, হবে, হয়েছে’
তেমন শুনাচ্ছে। হঠাৎ বদ্ধ ঘরের দরজা শব্দ করে খোলা হল। রাগে গজগজ করতে করতে ভেতরে প্রবেশ করল অমল ঠাকুর এবং তার একমাত্র ছেলে সুহাস ঠাকুর। সুহাস ঘরে প্রবেশ করেই শেহজাদের কলার চেপে ধরে চেয়ার ছেড়ে উঠিয়ে নিল। শেহজাদ আচমকা এমন অভদ্র আচরণে খুব ক্ষিপ্ত হল। সে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাল সুহাস ঠাকুরের দিকে। সুহাস রাক্ষসের ন্যায় দাত খিঁচিয়ে বলল,

‘শা/লা, রাজাকারের অউলাদ। আমার বাপের রাজনীতিতে হাত বাড়ানোর সাহস কেমনে করস?’
শেহজাদ একবার তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাল অমল ঠাকুরের পানে। অমল ঠাকুরের ও চাওনি ভালো করে চেনা আছে। এখন যে এ বদ্ধ ঘরে কুরুক্ষেত্র ঘটে যাবে তার সন্দেহ নেই কোনো। শেহজাদের শান্ত অবয়ব কোনো এক সাংঘাতিক ঝড়েরই পূর্বাভাস। অমল ঠাকুর ছেলের কনের কাছে এসে বললেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘শোন, শান্ত ভাষায় কথা বলি। পরিস্থিতে গোলমেলে করার প্রয়োজন নেই।’
শেহজাদের দিকে তীক্ষ্ম চোখে চেয়ে সুহাস শেহজাদের কলার ছেড়ে দেয়। শেহজাদের বুকের উঠানামার গতি বেড়ে গেছে। চোখের কোণে রক্ত জমে গেছে কিছুটা। রাগে শরীরের কাপুনি দৃশ্যমান। শেহজাদ তবু কথা বলে না। চুপচাপ চেয়ারে বসে। কিছু একটা তার চালক মস্তিষ্ক করছেই নিশ্চয়ই। সুহাস শেহজাদের সামনের চেয়ারে পা উঠিয়ে বসে। এক হাতে টেবিলের উপর আঙ্গুল দিয়ে তবলা বাজাতে বাজাতে প্রশ্ন করে,

‘বল, কত টাকা দিলে নির্বাচন থেকে সরে যাবি? পাতি নেতার জাত, টাকা ছাড়া কিছু বোঝস?’
শেহজাদের চোখ সুহাসের পায়ের উপর থেকে সরে হাতে থামে। হাত থেকে সরে সরাসরি চোখে নিবদ্ধ হয়। শেহজাদ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে। চেয়ারের হাতলে এক হাত রেখে মিষ্টি স্বরে বলে,
‘এই পাতি নেতা তোমার কপালের ঘাম ঝড়িয়ে দিচ্ছে, তার মানে নিশ্চয়ই তার মধ্যে কিছু না কিছু বিশেষত্ব আছে, ঠাকুর মশাই।’

সুহাস কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে কপালে হাত রাখে। হাতের তালুতে লেগে আসে ঘামের ফোঁটা। সে সঙ্গেসঙ্গে তাকায় শেহজাদের দিকে। শেহজাদের ঠোঁটের কোণে বাঁক। বসে বসে সে তার সামনে ঘটা সার্কাস দেখছে যেমন। শেহজাদের এমন তীক্ষ্ম হাসি দেখে সুহাস মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। শেহজাদের দিকে চেয়ে তারপর ঝুঁকে আসে টেবিলের উপর। ফিসফিস করে দাঁত খিঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘ডিলে আয়। অযথা ঝামেলা করিস না। নাহলে এই ঠাকুর তোর উপর ভারি পরবে।’
শেহজাদ এবার কিছুটা নড়েচড়ে বসে। আরাম করে টেবিলের উপর ঝুঁকে এসে সুহাসের ন্যায় ফিসফিস করে বলে,
‘সওদা করতে আসিনি, রাজনীতি করতে এসেছি। রাজনীতিতে তুমি আমার প্রতিপক্ষ। প্রতিপক্ষের সাথে শেহজাদ আয়ুষ্মান সওদা করে না, বিরোধিতা করে।’

সুহাস কিছুক্ষণ ঠাই চেয়ে থাকে শেহজাদের আত্মবিশ্বাসী চোখের দিকে। চোখ যেন তার কত কথা বলে। সুহাসের মাথা জ্বলে উঠে যেন। দাত খিঁচিয়ে হেসে বলে,
‘তুই বৈধ উপায়ে এ রাজনীতিতে নামলে, তবে আমিও অবৈধ উপায়ে নেমেছি। ন্যায় এবং অন্যায়ের মধ্যে হামেশা ন্যায় জিতে গেলেও বাহবা পায় অন্যায়। তুই সবার কাছে নায়ক হলে আমিও হলাম খলনায়ক। জিততে না পারলেও, কেড়ে নিতে জানি। ধর একদিন, তোর পক্ষের মানুষদের আগুনে পুড়ে গেল, কেমন হবে? কিংবা যে বস্তিতে তুই রোজ টাকা পাঠাস, সেই বস্তির মানুষরা হুট করে বিষাক্ত পানি খেয়ে মরে গেল? কেমন হবে, আয়ুষ্মান মশাই?’

শেহজাদ আঁতকে উঠে চেয়ার ছেড়ে উঠে পরে। চিৎকার করে বলে,
‘এতটা খারাপ কি করে হবে তুমি? জনগণের জন্যে আজ তুমি এখানে, এই জায়গায় বসে নিজের বিলাসিতা জাহের করছ। জনগণের অবদান তুমি ভুলে যাবে?’
সুহাস দাঁড়িয়ে থাকা শেহজাদের ভয়ার্ত চোখের পানে তাকাল। আরামে আবারও চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বলল,
‘জনগন হল আমার হাতের পুতুল, ওদের কে গোনায় ধরে। এসব কুকুররা দিনরাত ভকলেও আমার বা/লটাও ছিঁড়তে পারবে না।’

শেহজাদ আতঙ্ক নিয়ে তাকায় সুহাসের দিকে। সুহাস হাসে শেহজাদের এমন আতঙ্কভরা চেহারা দেখে। পাশে বসে থাকা অমল ঠাকুরের কিছু যেন ঠিকঠাক লাগছে না। কোথাও একটা গোলমেলে তো নিশ্চয়ই আছে। শেহজাদকে তিনি চেনেন আজ প্রায় ছ বছর ধরে। ছোট থেকে শেহজাদকে তিনি দেখে আসছেন। তিনি জানেন, শেহজাদ তো ভয় পাবার মানুষ নয়, সে কেন এমন ভয়ার্ত চেহারা করে রেখেছে? তাছাড়া শেহজাদের কথার ধরন বদলে গেছে। এমন অদ্ভুত ভাবে সে কেন কথা বলছে? কিছুই ঠিকঠাক অমল ঠাকুরের মাথায় প্রবেশ করছে না। অমল ঠাকুর ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন। চোখের ইশারায় বললেন,

‘এত কথা বলে লাভ নেই। ভাষণের সময় হয়েছে। যেতে হবে।’
সুহাস শেহজাদের ভয়ার্ত চেহারার দিকে চেয়ে সামান্য হাসল। শেহজাদ আয়ুষ্মানকে সে ভরকে দিয়ে দারুন আনন্দিত। শুধুশুধু তার বাবা শেহজাদকে ভয় পান, গুরুত্ব দেন বেশি। এমন দু চার আনার নেতাকে কে গোনায় ধরে? চোখে সানগ্লাস পরে উঠে দাড়াল চেয়ার ছেড়ে। যেতে যেতে শেহজাদের দিকে দু কদম এগিয়ে এসে বলল,
‘তুই তো গেছিস রে, আয়ুষ্মান। একদম ঘ্যাচাং ঘ্যাঁচ!’

সুহাস হাত দিয়ে গলা কাটা ইশারা করল। শেহজাদের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি এসে মুহূর্তেই তা সরে যায়। সুহাস শীষ বাজাতে বাজাতে চলে গেল ঘর ছেড়ে। সুহাস বেরিয়ে যেতেই ধীরে ধীরে শেহজাদের মুখের রং বদলে গেল। সে চেয়ারে ধপ করে বসে। কিছুক্ষণ মাথা তুলে সিলিংয়ের দিকে চেয়ে হুট করে মুচকি হেসে উঠে। অতিষ্ট ভঙ্গিতে হেসে হেসে মুখের আদল বদলে ফেলে। পাশে থাকা মর্তুজা কিছুক্ষণ থম করে শেহজাদের দিকে চেয়ে পরপরই নিজেও শব্দ করে হেসে উঠে। দুজন মিলে এতটা হাসছে যে তাদের দেখে বোঝার উপায় নেই একটু পরে তারা কি পরিকল্পনা সাজাচ্ছে, কি ছক কষছে। অথচ একজনের জীবনের সমস্ত রং ফিকে করে দেওয়ার দুর্দান্ত দাবার গুটি ইতিমধ্যে চালা হয়ে গেছে।

ভাষণের সময় হয়ে এসেছে। সুহাস গর্ব নিয়ে বুক ফুলিয়ে ভাষণ দিচ্ছে। জনগন উচ্ছসিত, ময়দান জুড়ে সাজ সাজ রব। জনগণের ভালোবাসা উপচে পরছে তাদের কন্ঠ থেকে। সুহাস আড়চোখে অমল ঠাকুরের দিকে চেয়ে বিজয়ীর হাসি হাসল। নির্বাচনের রাস্তা একটু একটু করে পরিষ্কার হচ্ছে। আগামীকাল নির্বাচন! আজকেই শেষ ভাষণ, শেষ প্রচার। আজকেই জনগণকে দারুন ভাবে আকর্ষণ করে নিজের পক্ষে টেনে নিচ্ছে। একপর্যায়ে সুহাসের সহকর্মী লালু প্রজেক্টর চালু করে। উদ্দেশ্য জনগণের ভিড় এবং সুহাস ঠাকুরের ভাষণ দেবার দৃশ্য প্রদর্শন করা। সুহাস মৃদু হেসে সাদা পর্দার দিকে তাকায়। প্রজেক্টর চালু করার পর পর্দায় বড় করে লেখা উঠে,

‘জনদরদী নেতা, জাতির ভাই সুহাস ঠাকুর এবং তার প্রিয় দেশের মানুষ!’
শোনা যায় ভিড়ের মধ্যে শোরগোলের আওয়াজ। সবাই একযোগে সম্মতি দেয় সুহাস ঠাকুরের জয়গানের। জনগণের নিজের পক্ষে শোরগোল দেখে সুহাসের ঠোঁট থেকে হাসি সরছে না। সুহাস বারবার নিজের মনের চোখে শেহজাদের হার দেখতে পারছে। বুকের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে।

লালু এবার ক্যামেরা চালু করে। কিন্তু হঠাৎ করে পর্দায় কাঙ্ক্ষিত দৃশ্য না ফুটে ফুটে অন্য এক কালো দৃশ্য। সমস্ত ময়দার নিস্তব্ধ হয়ে যায়। সুহাসের কপাল বেয়ে ঘাম ছুটে যায়। সে মাইক থেকে সরে গিয়ে একপাশে ঢকঢক করে কয়েক ঢোক পানি গিলে। পর্দায় দেখাচ্ছে শেহজাদের সঙ্গে সুহাসের সকালের কথোপকথন। জনগণকে কুকুর বলা, আগুনে পু/ড়িয়ে মা/রার হু/মকিসহ সকল কু-কথা ফাঁস হয় একের পর এক। ময়দান জুড়ে কানাঘুষা শুরু হয়। জনগন ক্ষিপ্ত চোখে সুহাসকে দেখে। সুহাস দৌঁড়ে মাইকের কাছে আসে। ভাঙ্গা গলায় বলতে চায়,

‘এস-ব বি-রোধী দলের ষ-ড়যন্ত্র। এসব ভিডিও মিথ্যা, কু প্রচারনা। আপনারা––এসবে বিশ্বাস করবেন না। এসব —-‘
জন সমুদ্র থেকে আওয়াজ আসে,
‘এই জনগণ মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের উপরেও ভারি পরছে। তুই কোনখান থেকে আসছিস রে পাগল? আমরা তোর কি বা/ল ছাড়া দেখবি এখন।’

সুহাস কথা শেষ করতে পারে না। ময়দান থেকে জুতো ছুঁড়ে ফেলা হয় সুহাসের মুখে। মাইক ভেঙে যায়। জনগন গালাগালি করতে করতে পুলিশ ঠেলে স্টেজে উঠে সুহাসকে ঘিরে ধরে। অমল ঠাকুর চেয়েও আটকাতে পারেন নি এসব। সবাই অমল ঠাকুরের গায়ের পাঞ্জাবি ছিঁড়ে ফেলে। সুহাসকে গণ ধোলাই দিয়ে জুতোর মালা পরিয়ে দেওয়া হয়। জনগণের এসব মারপিঠের বদৌলতে আপাতত সুহাস মূর্ছা যাবার পথে।

জনগন সুহাসকে মনের তৃপ্তি মিটিয়ে মারধর করে স্টেজ থেকে নেমে আসে। স্টেজে এককোণে রক্তাক্ত অবস্থায় পরে আছে সুহাস। চোখ বুঁজে আসছে ব্যথায়। সুহাস কিছুটা কষ্ট করে চোখ খোলার চেষ্টা করে উপরে তাকায়। হঠাৎ চোখ যায় একটা পুরোনো পাঁচ তলা মেরামত চালু রাখা বিল্ডিংয়ের ছাদে।

শেহজাদ দাড়িয়ে আছে। ভ্রু কুঁচকে, ঠোঁটে মৃদু হাসি, বুকের মধ্যে আড়াআড়ি হাত ভাঁজ করা, তাচ্ছিল্য ভরা হেসে যেন সুহাসকে ব্যঙ্গ করছে সে। সুহাস দাত খিঁচিয়ে তাকায়। এসব অপমান, ভিডিও, জনগণকে উস্কে দেওয়া এসব যে স্বয়ং শেহজাদের কাজ বুঝতে অসুবিধা হয় না সুহাসের। সুহাস নিজের ক্লান্তি ভাব ভুলে যায় নিমিষেই। রাগে-দুঃখে-অপমানে শেহজাদের উদ্দেশ্যে থুতু ছুঁড়ে দেয়। অথচ আফসোস, নিজের ছুঁড়ে দেওয়া থুতু নিজের গায়ের উপরে লেপ্টে পরে সুহাসের। শেহজাদের ঠোঁটের হাসি চওড়া হয়। সুহাস অবশেষে অত্যধিক ব্যাথা এবং অপমানে জ্ঞান হারায়।

চিত্রা সকালে নিজের বাপের বাড়ি এসেছে। আসার সময় চিত্রার বাবার জন্যে হরেক রকমের ফল কিনে দিয়েছে নওশাদ আয়ুষ্মান।
চিত্রাকে বাজারে যাবার সময় নওশাদ সজীব মজুমদারের বাড়ি রেখে যায়। ড্রাইভার ফলের পলিথিন ও মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে চিত্রাকে ঘর অব্দি এগিয়ে দেয়। চিত্রা ঘরে প্রবেশ করে নিকাব খুলে আশেপাশে দেখে।
‘বুবু, তুই? কহন আইলি?’

চিত্রাকে আচমকা পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে সুহাসিনী। চিত্রা প্রথমে কিছুটা ভয় পেয়ে যায়, পরপরই নিজের বোনের স্পর্শ দ্রুত চিনে ফেলে। চিত্রা মৃদু হেসে সুহাসিনী কপালে চুমু খায়। জিজ্ঞেস করে,
‘ভালো আছিস?’
সুহাসিনী চোখ বড়বড় করে তাকায়। চিত্রাকে আপদমস্তক দেখে ভারি অবাক কণ্ঠে বলে,
‘বুবু, কি তরতর করে শহরে ভাষায় তুই কথা কইছিস। কেমনে শিখলি? নেতাসাহেব শিখাইসেন?’
চিত্রা হালকা হেসে মাথা নাড়ল,

‘হ্যাঁ, ও বাড়িতে থাকতে হলে নাকি শহরের ভাষায় কথা বলতে হবে। তাই তিনি শিখিয়েছেন। ভালো পারছি না?’
সুহাসিনী আঙ্গুল দিয়ে চিত্রার কপালে টোকা দিয়ে বলল,
‘এক্কেরে জবরদস্ত কথা কইছিস। আমারেও শিখাবি?’
‘শেখাব। আব্বা কোথায়?’

‘বাজারে গেছেন। এক্ষুনি আইবেন। তুই বয়, আমি শরবত বানাই আনি।’
চিত্রা মেঝেতে রাখা তিনটা ফলের পলিথিন, দুটো মিষ্টির প্যাকেট দেখিয়ে বলল,
‘এসব পাকের ঘরে নিয়ে যা। আব্বা এলে দেখাবি।’

সুহাসিনী মেঝেতে তাকায়। এত রকমের ফল দেখে তার চোখ চড়কগাছ। সুহাসিনী খুশিমনে সকল পলিথিন ও প্যাকেট দুহাতে নিয়ে পাকের ঘরে চলে যায়। চিত্রা এবার বুক ভরে শ্বাস নেয়। কতদিন পর বোনকে দেখল। এবার আব্বাকে বুকটা জুড়িয়ে যাবে। চিত্রা ঘরে গিয়ে বোরকা খুলে দড়িতে ঝুলিয়ে রাখে। মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে পাকের ঘরে যায়। সুহাসিনী লেবু চিপে শরবত বানাচ্ছে। চিত্রা সুহাসিনীর পাশে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করে,

‘সারাদিন কি করিস এখন? আমি নেই, কার সঙ্গে ঝগড়া লাগিস এখন?’
সুহাসিনী শরবতের গ্লাস চিত্রার হাতে ধরায়। তারপর দু তিনটে ফল নিয়ে বটি দিয়ে কাটায় মন দিয়ে বলে,
‘বালা লাগে না রে। সারাদিন একা একা থাকি, রান্ধি, আব্বারে খাওয়াই, ঘর গুছাই, মেলা কাম করতে হয় সারাদিন। সময়ই পাইনা এহন, জানিস।’

চিত্রা শরবতের গ্লাস টেবিলে রাখে। তারপর হেসে বলে,
‘বিয়ে করে নে, জামাই দেখি তোর জন্যে।’
সুহাসিনী মুখ লুকিয়ে হেসে বলে,
‘ধুর, বিয়ের কথা কইও না তো। আমার লজ্জা করে।’

সুহাসিনীর কথার ধাঁচে চিত্রা শব্দ করে হেসে উঠে। সুহাসিনী তাকায় চিত্রার দিকে। বুবকে হাসতে দেখে তার চোখটা জুড়িয়ে যায়। বুকটা জ্বলে উঠে পরম আনন্দে। সুহাসিনী আপনমনে বিড়বিড় করে বলে,
‘তুই হাস বুবু, হাসতে থাক সারাদিন। তোর হাসি এই জগতের সবচেয়ে সুন্দর হাসি।’
চিত্রা নিজের ঘরে আসে। সুহাসিনীও এসে বসে চিত্রার পাশে। চিত্রার ব্যাগে হঠাৎ কিসের আওয়াজ হয়। সুহাসিনী আওয়াজ শুনে চেঁচিয়ে উঠে,

‘কিসের আওয়াজ রে? মোবাইল? বুবু, তোর কাছে মোবাইল আছে?’
‘হ্যাঁ, আসার সময় আব্বাজান দিয়েছেন। কোনো দরকার হলে কল দেওয়ার জন্যে।
চিত্রা কথা বলে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে। সুহাসিনী অবিশ্বাস্য চোখে চিত্রার হাতের ছোট বাটন ফোনের দিকে চেয়ে আছে। চিত্রা ফোনের নাম্বার দেখে। তারপর লজ্জিত কণ্ঠে সুহাসিনীকে বলে,
‘তোর দুলাভাই কল দিয়েছেন।’

সুহাসিনী শেহজাদের কথা শুনে উচ্ছসিত হয়ে উঠে। দ্রুত চিত্রার পাশে বসে বলে,
‘কলে ধর, কথা ক, আমি শুনি কি কন। কখনো নেতাসাহেবের কথা শুনি নাই আমি, শুধু লোকের মুখেই শুনি তার কথা।’
চিত্রা যেমন লজ্জায় নুইয়ে পরছে। গতকালের পর আজকে শেহজাদ কল করেছে একটু কথা বলবে দেখে। চিত্রার মনে খুশির ঢেউ খেলে যায়। চিত্রা কম্পিত হাতে কল ধরে রিসিভ করে।
চিত্রা হালকা আওয়াজে সালাম দেয়। শেহজাদ সালামের উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘পৌঁছেছ?’
‘হুঁ।’
‘কে নিয়ে গেছে?’
‘আব্বাজান বাজারে যাবার পথে দিয়ে গেছেন।’
‘যাবার পথে কিছু নিয়েছ তোমাদের বাড়ি?’
‘আব্বাজান ফল আর মিষ্টি কিনে দিয়েছেন।’
‘ভালো। এবার মন শান্ত হয়েছে তো?’
চিত্রা হালকা হেসে জবাব দেয়,
‘হ্যাঁ। আপনার নির্বাচনের কাজ কেমন যাচ্ছে?’
এখন অব্দি ভালো। আগামীকাল ভোট হবে। দোয়া করো।’

‘আপনার জন্যে আমার হাত সবসময় আল্লাহর কাছে তোলা থাকে। আল্লাহর কাছে আপনার ভালো চাইতে আমি কোনোদিন কার্পণ্য করিনা, নেতাশাহ!’
শেহজাদ কি হাসল সামান্য? চিত্রার বোধ হল, শেহজাদ হেসেছে, একটু হলেও হেসেছে। চিত্রার মন দুরুদুরু করছে। শেহজাদকে একটুখানি দেখার জন্যে তড়পাচ্ছে মনের ভেতর।
শেহজাদ কিছুক্ষণ নিরব থেকে তারপর বলে,

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২০

‘আমি ফিরব পরশু। ফেরার পথে নিয়ে যাব তোমাকে।’
‘আরো কটাদিন থাকি না? আজ এলাম মাত্র।’
শেহজাদের কথা শোনা যায় না কিছুক্ষণ। চিত্রা ভেবেই বসে শেহজাদ রাগ করেছে। তাই সে কিছু বলতে যাবে, তার পূর্বেই শেহজাদকে গম্ভীর কণ্ঠে, অথচ পরম অধিকারবোধ নিয়ে বলতে শুনে,
‘শেহজাদ আয়ুষ্মান নিজের অভ্যাস ছাড়ে না কখণো। তাহলে সে তোমাকে ছাড়ে কি করে? বাড়তি কথা নয়। তৈরি থেকো, ফেরার পথে নিয়ে আসব।’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২২