খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৭

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৭
আভা ইসলাম রাত্রি

আয়ুষ্মান বাড়ির পেছনের ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে বড় একটা হাওর আছে। হাওরে অনেক রকমের মাছ ধরে। সপ্তাহে একদিন আয়ুষ্মান বাড়ির পুরুষ মাছ ধরার আয়োজন করেন। আয়ুষ্মান পুরুষেরা যখন তোড়জোড় করে মাছ ধরার জন্যে ছিপ ফেলে, গ্রামবাসী অবাক চোখে চেয়ে দেখে। লুঙ্গি-গেঞ্জি পরিধান করা আয়ুষ্মান পুরুষদের দেখে তখন আভিজাত্যের কথা মনে হয় না! বরং গ্রামের অন্যান্য পুরুষদের ন্যায় সাধারণ পুরুষ মনে হয়।

আজকে শুক্রবার। জুম্মার নামাজ একসঙ্গে আদায় করে সবাই তৈরি হয়ে বেরিয়েছে মাছ ধরতে। দুপুরে তাদের ধরা মাছ নিয়েই রান্না করা হবে বাড়িতে। বাপ-চাচা-ভাতিজা মিলে মাছ ধরার হুলুস্থুল কান্ড। শেহজাদের বাবা নওশাদের ছেলের ছিপের দিকে নজর। হাওরের বড় মাছ যেন ছেলের ছিপে না ধরে সেজন্যে কি তোড়জোড়! সর্বপ্রথম মাছ উঠল সৌরভ আয়ুষ্মানের ছিপে, বড় কাতলা মাছ। সৌরভ বুক ফুলিয়ে তাকালেন ভাতিজার দিকে। বললেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘আমার মত একটা জেলে দেখাও দেখি এ গ্রামে? আমি সৌরভ আয়ুষ্মান মাছ ধরায় উস্তাদ!’
শেহজাদ ছিপ ফেলে স্বাভাবিক চোখে দেখল চাচাকে। হালকা আওয়াজে বলল,
‘চাচাজান, কাতলা মাছের মাথাটা তাহলে আপনার ভাগে পরল! জয় হোক!’
সৌরভ ভাতিজার কণ্ঠে নিজের সুনাম শুনে গলে গেলেন। লুঙ্গি তুলে ধুতির মত কোমরে গুঁজে নিয়ে হাক ছাড়লেন,
‘কে আছিস? মাছ নিয়ে যা বাড়িতে। আজ জমিয়ে কাতলা মাছের ঝোল খাব।’

সঙ্গেসঙ্গে এক ভৃত্য নত চেহারায় এগিয়ে এসে মাছ নিয়ে ছুটল বাড়ির দিকে। সৌরভ কিছুটা দূরে এসে পা ছড়িয়ে বসলেন। দেখতে লাগলেন বাকিদের মাছ ধরার সুন্দর দৃশ্য। নওশাদ ভাইয়ের বড় মাছ ধরা দেখে কিছুটা মনক্ষুন্ন হলেন। পরপরই নিজের পুরো দম লাগিয়ে ছিপ ফেলেন। আধা ঘন্টা চেষ্টার পর শেহজাদের ছিপ লক্ষণীয় ভাবে নড়ে উঠল। শেহজাদ বাবার দিকে একপল চেয়েই জোরে টান দিল ছিপ। ছিপে ছটফট করে উঠল অনেক বড় এক বোয়াল মাছ। সবার চোখ সে বোয়াল দেখে ছানাবড়া হয়ে গেল। শেহজাদ ছিপ থেকে বোয়াল নিজের হাতে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকাল চাচার দিকে। তার চোখ বলে দিচ্ছে তার জয়ের কথা। সৌরভ থতমত খেলেন। কেশে স্বাভাবিক স্বরে বললেন,

‘দেখতে হবে না ভাতিজা কার? সৌরভ আয়ুষ্মানের ভাতিজা তার মতই মাছ ধরায় উস্তাদ।’
শেহজাদ মাছ তুলে দিল আরেক ভৃত্যের কাছে। ইশারায় মাছ বাড়ি নিয়ে যাবার কথা বলে হাওরে হাত ধুয়ে চাচার পাশে এসে দাঁড়াল। ভ্রু নাচিয়ে হালকা আওয়াজে বলল,
‘উস্তাদের মাইর শেষ রাতে, চাচাজান।’

সৌরভ শেহজাদের চোখে নিজের পরাজয় দেখতে পারলেন স্পষ্ট। তিনি হালকা কেশে উঠে চলে গেলেন নওশাদের মাছ ধরা দেখতে। শেহজাদ ঠোঁট হালকা বাঁকিয়ে চেয়ে দেখল বাবার মাছ ধরার দৃশ্য।
নওশাদ অনেকক্ষণ হল, ভালো মাছ ধরতে পারছেন না। যা ছিপে লাগছে, সব চুনোপুঁটি। এসব মাছ বাড়ি নিলে ইজ্জত খোয়াতে হবে। তাই তিনি ধৈর্য্য নিয়ে অপেক্ষা করছেন বড় মাছ ছিপে তোলার। সৌরভ পাশে দাঁড়িয়ে তামাশা করছেন নওশাদকে নিয়ে। নওশাদ দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করে পূর্ন মনোযোগ দেবার চেষ্টা করছেন মাছ ধরায়। শেহজাদ তখন একপাশে এক ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধের কাদামাখা পা হাওরে ধুতে সাহায্য করছে।

‘মাছ লেগেছে রে, মাছ লেগেছে।’
শোরগোল লেগে গেল হাওরের চারপাশে। নওশাদ ছেলে-ভাইয়ের দিকে গর্ব নিয়ে চেয়ে দেখে ছিপ টান দিলেন। ছিপে উঠে এল ছোটখাটো এক বোয়াল। নওশাদকে হতাশ হতে দেখা গেল। সৌরভ যেন জয় ফিরে পেলেন আবার। ভাইয়ের কাঁধে হাত দিয়ে চাপর দিয়ে সুধালেন,
‘আসছে সপ্তাহ আবার হবে, ভাইজান। হতাশ হবেন না।’

মুখে এ কথা, অথচ অন্তরে জয়ের হাস। নওশাদ রাগে ছিপ থেকে মাছ টেনে ছুঁড়ে হাওরের পানিতে ফেলে দিলেন। শেহজাদ এগিয়ে আসল। বাবার পাশাপাশি দাড়িয়ে শান্ত আওয়াজে বলল,
‘আমার বোয়াল আপনি ধরেছেন। বাড়ির সবাই এটাই জানাবে। হতাশ হবেন না। আপনার হতাশা আমাকে পীড়া দেয়।’
নওশাদ ছেলের দিকে মমতা নিয়ে চাইলেন। হাওরের পানির দিকে ঘৃনাভরা দৃষ্টি ছেড়ে বললেন,
‘বেকার হাওর একটা। শুধু নামেই কটা মাছ, লোক বুঝে ধরা দেয়। তোমার মাছ তোমারই, ওটা আমার লাগবে না। আসছে সপ্তাহ আবার হবে।’

শেহজাদ বাবার কাঁধে হাত রেখে ভরসা দিল। আয়ুষ্মান পুরুষরা কাঁধে কাঁধ রেখে চললেন বাড়ির দিকে। আজ জমিয়ে মাছ খাওয়া হবে সবার। মাছের কথা শুনলে এ বাড়ির পুরুষদের চোখ ঝলমলিয়ে উঠে। যেন মাছ নয়, রত্ন পেয়েছেন।
দুপুরের খাবারের সময় বোয়াল মাছের মাথা শেহজাদ নওশাদের পাতে তুলে দিল। নওশাদ জোর করে সেটা আবার শেহজাদের পাতে দিলেন। বললেন,

‘গ্রামের মাথা তুমি। তাই মাছের মাথা তোমার খাওয়া প্রয়োজন।’
শেহজাদ শুনল না। বরং একপ্রকার জোড় করে মাছের মাথা নওশাদের পাতে তুলে দিয়ে বলল,
‘গ্রামের মাথা আমি, আমার মাথার ছায়া আপনি। আপনি ভালো থাকলে, আমি থাকি।’

নওশাদ ছেলের দিকে অপলক চেয়ে থাকলেন। অতঃপর হালকা হেসে মাছের মাথা যতটা পারেন, দু টুকরো করলেন। অর্ধেক ছেলের পাতে, বাকি অর্ধেক নিজের পাতে নিলেন। সৌরভ তা দেখে নিজে থেমে থাকতে পারলেন না আর। নিজের মাছের মাথা হাত দিয়ে ভেঙে যতটা সম্ভব তিন টুকরা করলেন। শেহজাদ, নওশাদের পাতে এক টুকরো করে দিয়ে নিজে আরেক টুকরো দিয়ে খেতে থাকলেন। পাশ থেকে চিত্রা সবার এত ভালো বন্ধন চোখ জুড়িয়ে দেখল। চোখে জল জমল তার। ওমন ভালো পরিবার সে কখনো দেখেনি। চিত্রা মাছের ঝোল তুলে দিল সবার পাতে। সেদিন সবাই নিজেদের হাতে ধরা মাছ কব্জি ডুবিয়ে খেলেন।

দুপুরে ভাতঘুম দিচ্ছিলেন সবাই। চিত্রা গোছল করে বেরিয়েছে সবে। শেহজাদ তখন ঘরের লাগোয়া লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ছে। ভীষন মনোযোগ তার সেখানে। চিত্রা চুলে গামছা পেঁচিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সেদিকে, পাছে যেন শব্দে শেহজাদের মনোযোগ বিঘ্ন না হয়। চিত্রা শেহজাদের পেছনে এসে দাঁড়াল। উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল সে কি বই পড়ছে! বানান করল চিত্রা,

‘জি ও এন ই-গান. ডাব্লিউ আই টি এইচ-উইথ…’
‘গান উইথ দ্যা ওয়াইন্ড! ‘
শেহজাদের আকষ্মিক কণ্ঠ শুনে ভয়ে বুকে হাত দিয়ে দু কদম পিছিয়ে গেল চিত্রা। বুকে থুথু ছুঁড়ে ঢোক গিলে তাকাল শেহজাদের দিকে। শেহজাদ বই পড়তে পড়তে বলল,
‘অষ্টম শ্রেণী অব্দি পড়ে, ভালো করে ইংলিশ পড়তে পারছ না, বানান করা লাগছে, দুঃখজনক।’
চিত্রা লজ্জা পেল। ধীর পায়ে শেহজাদের পাশের চেয়ার টেনে বসল। বইয়ের দিকে একনজরে চেয়ে থেকে উত্তর দিল,
‘বালা ছাত্রী ছিলাম না, তাই।’

‘কেন ছিলে না? এত ছোট বয়সে পড়াশোনা ছাড়া কি কাজ ছিল তোমার?’
শেহজাদ বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে প্রশ্ন করল। চিত্রা নম্র কণ্ঠে জবাব দেয়,
‘মা মরা ঘরে মাইয়াদের অনেক কাজ থাহে। পড়াশোনা করলে ঘর চইলব ক্যামনে?’
শেহজাদ আবারও চিত্রার অশুদ্ধ ভাষা শুনে বিরক্ত হয়। বই বন্ধ করে চিত্রার মুখোমুখি তাকায়। ভেজা চুলে শ্যামবর্ণের কন্যাকে দেখতে অপ্সরী লাগছে। শেহজাদের চোখের মণি কেমন নড়ে উঠে। সঙ্গেসঙ্গে চোখ সরিয়ে নেয় সে। স্বাভাবিক কণ্ঠে উচ্চারণ করে,

‘চইলবে বলবে না, চলবে বলবে।’
শেহজাদের কথা শুনে চিত্রা যারপরনাই আশাহত হয়। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে, ‘আবারও শিখাইতেসেন? কই যামু আমি।’
তারপর জোড় কণ্ঠে বলে, ‘চলবে।’
শেহজাদ বলে,
‘মাইয়া না, মেয়ে।’
‘মেয়ে।’
‘ক্যামনে না, কিভাবে!’
‘ক্যা–কিভাবে।’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৬

শেহজাদ আরো কটা কথা বলবে, কিন্তু থেমে যায় সে শোরগোলের আওয়াজে। কোথা থেকে চিৎকার কণ্ঠে ভেসে আসছে,
‘বড়সাবরে সাপে কাটছে রে, জলদি সাপুড়ে ডাইকা আনো রে সবে, খালাম্মা, ভাবি, ভাইজান জলদি আন আফনারা।’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৮