খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৬

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৬
আভা ইসলাম রাত্রি

শেহজাদ আয়ুষ্মান মেলার দোরগোড়া দ্বারা প্রবেশ করলে, মেলা জুড়ে সাজ সাজ রব লাগল। মেলার মানুষ দৌঁড়ে এদিকেই আসছে। দোকানদাররা হাতজোর করে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে।
‘নেতাসাহেব আইসেন, সইরা দাঁড়াও রে লোকপাল! জায়গা দাও তারে। আহেন নেতাসাহেব। চেয়ারে বয়েন।’

শেহজাদের বড্ড চাহিদা গ্রামবাসীর নিকট। যা শেহজাদের চাচার চক্ষুশূল! তিনি কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকলেন শেহজাদের দিকে। মেলার দায়িত্বে থাকা প্রধান কর্মচারী খলিল মিয়া শেহজাদের পা ছুঁয়ে সালাম করল। শেহজাদ চোখের ইশারায় মুর্তজাকে মেয়ে-বউদের নিয়ে এক কোণে দাঁড়াতে বলল। মুর্তজা তাৎক্ষণিক আয়ুষ্মান নারীদের নিয়ে বরাদ্দ করা ছাওনির নিচে হয়ে দাড়াল। শেহজাদ খলিলকে জিজ্ঞেস করল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘মেলার কাজ ঠিকঠাক চলছে?’
খলিল সামনের চোয়ালের ভাঙা দাঁত দেখিয়ে হেসে বলল,
‘আপনার কাইজ কখনো বেঠিক হইতে পারে, নেতাসাহেব? এক্কেরে জবরদস্ত আয়োজন হইসে। নিজেই দেইখ্যা নেন। আহেন, ঘুরে দেহেন মেলা।’

শেহজাদ তার বাবা-চাচাদের নিয়ে খলিলের সঙ্গে চলল। খলিল তাদের পিছু পিছু বাধ্যগত ভৃত্যের মত এগিয়ে আসছে। শেহজাদ মেলা দেখার একফাঁকে চিত্রাদের দিকে তাকাল। সবাই সকালে হালকা নাস্তা করে বেরিয়েছে। শেহজাদ খলিলকে ডাকে,

‘আমাদের বাড়ির নারীরা এসেছে। ওদের খাবারের ব্যবস্থা করে দাও।’
খলিল সঙ্গেসঙ্গে ছুটে গেল ছাওনির দিকে। সবাইকে বড় করে সালাম দিয়ে যথাসম্ভব নম্র গলায় বলল,
‘আম্মাজান, আপনাদের কুনো দরকার হইলে অধমরে স্মরণ কইরবেন। আমি আইয়া পরমু। আমি কিছু খাওন পাঠাইতাসি। কি খাইবেন আম্মাজান? পরথম আইলেন আপনাগো মেলায়। যা চাইবেন, তাই পাইবেন আইজ। কন কি খাইবেন?’
রেখা বেগম নিকাবের আড়ালে ভীষন আস্তে করে বললেন,

‘যে ধরনের পিঠা আছে, নিয়ে আসো।’
খলিল কান পেতে শোনার চেষ্টা করল রেখা বেগম কি বলেছেন। কিছুটা বুঝতে পেরেই সে আবার ছুটে গেল। রেখা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিজের দেবরের স্ত্রীকে বললেন,
‘মেলা ভালো লাগছে, শেফালী?’
শেফালী ফিসফিস করে বললেন,

‘ভীষন ভালো লাগছে আপা। কি দারুন আয়োজন। গ্রামের মেলা দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে আমার।’
রেখা আশ্বস্ত হলেন। বাড়ির প্রধান বউ হিসেবে সবার প্রতি তার কিছু দায়িত্ত্ব-কর্তব্য আছে। তিনি সেটাই পালন করছেন বটে। চিত্রা নিকাবের আড়ালে ফ্যালফ্যাল চোখে ঘুরেঘুরে দেখছে মেলার আয়োজন। না চাইতেও, মেলা থেকে বারবার চোখ চলে যাচ্ছে অদূরের শেহজাদ আয়ুষ্মানের পানে।

সবাই কি সম্মানই না করে তাকে! কি মার্জিত কথাবার্তা, হাঁটাচলায় আভিজাত্য, গর্বে বুক সবসময় ফুলে থাকে, শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি পরিধান করা তাকে দেখলে সর্বপ্রথম পবিত্রতার কথা মাথায় আসে। এমন একটা মানুষকে গ্রামবাসী মাথায় তুলে রাখে সবসময়। চিত্রা দু চোখে সিসা ঢেলে চেয়ে আছে শেহজাদের দিকে। শেহজাদ মেলা দেখার একফাঁকে এদিকেই তাকাল। সঙ্গেসঙ্গে চোখে চোখ মিলে গেল। চিত্রা আঁতকে উঠে চোখ সরিয়ে নিল। শেহজাদের ভ্রু কুঁচকে গেল। পুনরায় মাথা ঝাড়া দিয়ে মেলার কাজে লেগে গেল।

হরেক রকমের পিঠা কলা পাতায় সাজিয়ে রাখা। পক্কন পিঠা, পাটিসাপটা, কুশলি পিঠা, ভাপা পিঠা, ভাত পিঠা, কাটা পিঠা, নকশি পিঠা, পুলি পিঠা, দুধ পিঠা, লাউ পায়েস, ছিট পিঠা, লবঙ্গ পিঠা, গোকুল পিঠা এমন আরও অনেক ধরনের পিঠার মিশ্র গন্ধে পেটের ক্ষুধা আপনা-আপনি বেড়ে যাচ্ছে যেমন। তাদের সামনে বিছানার চাদর দিয়ে পর্দা টাঙানো হল। সবাই নিকাব খুলে পিঠা খেতে বসলো।

চিত্রা সর্বপ্রথম ভাঁপা পিঠা হাতে তুলল। পিঠায় কামড় দিলে মনে হয় যেন অমৃত খাচ্ছে। চিত্রা শুনেছে, এ মেলা এ গ্রামের ঐতিহ্য। দূর দূরান্ত থেকে পিঠার মেলা দেখতে মানুষ এ গ্রামে আসে। বিরাট আয়োজনে গ্রামের মানুষের ভালো টাকা আয় হয় এ মেলা থেকে। চিত্রা শুনেছে, যে মানুষ একবার প্রতাবপুর গ্রামের পিঠা খেয়েছে, সে যেন নিজের দু যুগ হায়াৎ বাড়িয়েছে। অমৃত হার মানে এমন পিঠার স্বাদে। ঠিকই শুনেছে চিত্রা। সবাই দিনদুনিয়া ভুলে পিঠা খাওয়ায় মগ্ন হয়ে যাচ্ছে।

মেলার উপভোগ করার একফাঁকে, চিত্রা শুনে মাইকে শেহজাদের গাম্ভীর্যপূর্ন কণ্ঠের আভাস। তীব্র-নির্ভীক কণ্ঠে শেহজাদ ভাষণ দিচ্ছে। সামনের নির্বাচন নিয়ে শেহজাদ নিজের পরিকল্পনা জানায়। গ্রামবাসীকে নিজের পাশে চায়। শেহজাদ যখন ভাষণ শেষ করল, পুরো মেলা জুড়ে তখন একটাই নামের শোরগোল হতে থাকল,

‘শেহজাদ আয়ুষ্মানকে নেতাপদে দেখতে চাই, আমাদের নেতা শেহজাদ আয়ুষ্মান, আমাদের নেতা শেহজাদ আয়ুষ্মান, জয় হোক শেহজাদ আয়ুষ্মানের।’
শেহজাদের দশ মিনিটের ভাষণ পুরো মেলার পরিবেশ পরিবর্তন করে দিয়েছে। মেলার আনাচে কানাচে এখন শুধু শেহজাদ আয়ুষ্মানের গুণের কলরব। শেহজাদ নেমে এলো স্টেজ থেকে। খলিলকে ডেকে বলল,
‘আম্মাদের বাড়ি দিয়ে আসো এবার। আমরা আরো কিছুক্ষণ থাকব এখানে।’

খলিল আবারও ছুটে গেল ছাওনির দিকে। পর্দার ওপাশ থেকে নম্র গলায় ডাকল,
‘আম্মাজান, নেতাসাহেব আপনাগো বাড়ি দিয়ে আসতে কইসেন।’
রেখা নিকাব টানলেন মুখের উপর। রেখার দেখাদেখি বাকিরাও মুখের নিকাব টানল। রেখা উঠে দাঁড়ালেন। খলিল পাঁচটা ছাতা তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিল। ছাতা দিয়ে মাথা ঢেকে পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন আয়ুষ্মান নারী পরিবার।

সারা বিকেল মেলার কাজ পরিচালনা করে রাতের দিকে বাড়ি ফিরেছে শেহজাদ। রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে চিত্রা পাকের ঘর গুছিয়ে সবে তাদের ঘরে এসেছে। শেহজাদ মুঠোফোনে ভিডিও কলে কথা বলছে কারো সঙ্গে। শেহজাদের মুখের অভিব্যক্তি অত্যন্ত বিরক্ত। তাকে বলতে শোনা গেল,
‘তুমি আজও মদ খেয়েছ, মেহজাদ?’

‘আ-মি খাই-নি, ভাইয়া। জা-স্ট একটুখানি রেড ও-য়াইন।’
‘ওটা মদ না?’
‘অ্যা-লকোহল সা-মান্য তো।’
‘অ্যালকোহল খাওয়া হারাম, মেহজাদ। কবে বুঝবে তুমি সেটা?’.

‘গা-ন শোনাও কিন্তু হা-রাম, ভা-ইয়া। তু-মি কিন্তু বাউল গান শুনো।’
‘হারাম কোনো দ্রব্য দ্বারা শরীরের যে অঙ্গ পুষ্টি নেবে, সেই অঙ্গ বেহেশতে যাবে না, মেহজাদ। হারাম শোনা আর খাওয়া দুটোর মধ্যে কিছুটা হলেও পার্থক্য আছে। তাছাড়া আমি গান শোনা এখন অনেকে কমিয়ে দিয়েছি। তোমারও উচিৎ মদ খাওয়া নিয়ন্ত্রণে আনা।’

‘কন্ট্রোলে আ-নছি তো ভাইয়া। কিন্তু বন্ধু-রা ফো-র্স করলে আর মানা করতে পারি না।’
‘কেমন অসভ্য বন্ধুদের সঙ্গে মিশো তুমি? মদ খাওয়ার জন্যে জোড় করা বন্ধুরা ভালো হয়না কখনো। তুমি ওদের সঙ্গে আর মিশবে না।’
‘তা-হলে কাদের সঙ্গে মিশব, ভাইয়া? মে-য়েমানুষের সঙ্গে?’

শোনা গেল এক সুন্দর হাসির শব্দ। শেহজাদকে আরো বেশি বিরক্ত হতে দেখা গেল। সে পারে না ফোনটা আঁছাড় মারতে। অথচ সে সেটা করে না। চিত্রা এসব শুনে শুনে কৌতুহলবশত শেহজাদের পাশে এসে বসে। শেহজাদ চিত্রাকে দেখে মেহজাদকে বলে,

‘তোমার ভাবি পাশে, কথা বলবে?’
চিত্রাকে এ কথা শুনে অপ্রস্তুত হতে দেখা গেল। সংকোচের কারণে দু কদম পিছিয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে শেহজাদের দিকে তাকাল।
মেহজাদ কথা বলার মধ্যেই ঘুমে হেলে পরছে যেমন। সে বিছানায় আলগোছে মাথা রাখল। দু চোখ বুঁজে ঘুমঘুম গলায় বলল,

‘দে-শে আসলে সা-রপ্রাইজ দেব ভা-বিকে। বাট নাও, আই হ্যা-ভ টু স্লিপ। গু-ড বাই, ভা-ইয়া।’
ফোন কেটে দিল শেহজাদ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ও বিপথে চলেই গেছে, আমি চেয়েও আটকাতে পারিনি তাকে। কেন বিদেশ পাঠানোতে রাজি হলাম আমি। আমার একবার ভাবা উচিৎ ছিল সেসময়।’

চিত্রা শেহজাদের চিন্তার কারণ বুঝতে পারল। পাশ থেকে নিভু নিভু স্বরে বলল,
‘চিন্তা করিয়েন না। সব ঠিক হইয়ে যাবে।’
শেহজাদ কপালে হাত ঠেসে রাখল। কপাল দু আঙুলের ডগা দিয়ে মালিশ করে হালকা আওয়াজে উত্তর দিল,

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৫

‘ঠিক হবার অনেক অপেক্ষা করেছি। আর নয়। ওকে এই মাসেই দেশে ফিরিয়ে আনব আমি। আমি দেখছি সপ্তাহের মধ্যে কোনো প্লেনের টিকেট পাওয়া যায় কি না।’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৭