আড়ালে ভালোবাসি তোমায় সারপ্রাইজ পর্ব 

আড়ালে ভালোবাসি তোমায় সারপ্রাইজ পর্ব 
নুসাইবা জান্নাত আরহা

হলুদ রঙের শাড়ি পরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে এক পলক দেখে নিলাম। শাড়ির আচলটা ঠিক করে যখনই রুম থেকে বের হতে যাব তখনই ধাক্কা লাগে কারো সাথে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আলতো করে দুহাত দিয়ে মুখে হলুদ মাখিয়ে দেয়। সামনে তাকাতেই দেখলাম রাশফিন দাঁড়িয়ে, মুখে তার লেগে আছে মুচকি হাসি। পড়নে তার হলুদ পাঞ্জাবি, উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ে বেশ মানিয়েছে পাঞ্জাবিটাতে।

আমায় এমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে হালকা কেশে ওঠে রাশফিন। দুষ্ট হেসে বলে উঠল
-‘ এভাবে তাকিয়ে থেকে না, জান। তুমি কি জানো, তোমার এই দৃষ্টি প্রতিবার ঘায়েল করে আমায়। আমি যে তোমার ঐ মায়াবী চোখের গভীরতায় হারিয়ে ফেলি নিজেকে। ইচ্ছে করে বারবার হারিয়ে যাই তোমার মাঝে।
রাশফিনের এমন কথা শুনে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলি আমি। রাশফিন মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-‘ ওরে, আমার লজ্জাবতী লতা রে।
বলে আরেকটু হলুদ মাখিয়ে দিল আমায়। আমায় ছেড়ে বিছানায় আরাম করে বসে আমাকেও টেনে পাশে বসিয়ে বলল
-‘ প্রথমে আমিই হলুদ মাখালাম তোমায়। কেমন লাগল?
-‘ একদমই বাজে।

-‘ এটা কি বললে তুমি? আমাদের বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু ঘরোয়াভাবে হয়েছিল। কোনো অনুষ্ঠান হয়নি। নিজের বিয়েতে যদি একটু মজাই করতে না পারি তাহলে কি ভালো লাগে? আম্মুকে বারবার না বললে তো উনাদের কারো কোনো মাথাব্যাথ্যাই ছিল না যে আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান করা বাদ পড়েছে। সেটা বাকি এখনো।
-‘ সবই ঠিক আছে কিন্তু এটা কি করলেন? সবাই হলুদ মাখানোর আগে আপনি কেন হলুদ মাখালেন? এখন সবাই কি ভাববে বলুন তো?

-‘ বাহ্ রে, আমার বউকে আমি হলুদ মাখাবো না তো কে মাখাবে? সবাই দেখলে কি হবে? তোমার বর মানে আমি হলুদ মাখিয়েছি, কোনো পরপুরুষ তো আর হলুদ দেয়নি।
আমি কোনো কথা না বলে,গালে হাত দিয়ে হা করে তাকিয়ে রইলাম রাশফিনের দিকে। মুখের সামনের তুড়ি বাজিয়ে বলল
-‘ হা করে তাকিয়ে থাকতে হবেনা ম্যাডাম একেবারে বাসর রাতেই যত ইচ্ছা দেখেন আমায়।
বিরক্ত হয়ে আমি উঠে চলে যেতে নিলেই হাত ধরে ফেলল রাশফিন। অসহায় মুখ করে বলল

-‘ তোমার হাতের মেহেদিটা দেখি তো বউ। শত চেষ্টা করেও তোমার মেহেন্দি অনুষ্ঠানে আসতে পারলাম না আমি। কাজিনরা ধরে রেখেছিল আমায়। তিনটা দিন দেখতে পারিনি তোমায়, কত কষ্ট হয়েছে আমার, জানো? আজকে সবার চোখ ফাকি দিয়ে এসে পড়ছি আমি। এই সুযোগ কি কেউ হাত ছাড়া করে, বউ?
রাশফিনের এমন ভাবভঙ্গি দেখে হাসি পেল আমার। হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে রাশফিনের দিকে কিছুটা ঝুকে আমার গালে মাখানো হলুদটা মাখিয়ে দিলাম রাশফিনের গালে।

-‘ আমরা কিচ্ছু দেখিনি। এই চল সবাই। ওদেরকে ওদের মতো থাকতে দে।
দরজার কাছ থেকে এমন কণ্ঠস্বর কর্ণকুহুরে পৌছানো মাত্রই আমি বিদ্যুৎ গতিতে সরে এলাম রাশফিনের কাছ থেকে।
আমাদের দুজনের এমন অবস্থা দেখে আমাদের সব কাজিনরা উচ্চস্বরে হেসে দিল। আমার কাজিন রিমা হাসতে হাসতে বলে উঠল

-‘ দেখ, আমাদের দুলাভাই আমাদের আপিকে ছাড়া থাকতেই পারেনা। তিনদিন আপিকে ছাড়া থেকে বেচারা কেমন শুকিয়ে গেছে। তাইতো ছুটে চলে এসেছে আপিকে দেখার জন্য। বলি দুলাভাই আর মাত্র একদিন অপেক্ষা করা গেল না আপির জন্য? খুব তো বিয়ের সব অনুষ্ঠান করতে হবে বলে লাফিয়েছিলেন এখন কেমন লাগছে দুলাভাই?
রিমার কথা শুনে সবাই হাসল। পাশ থেকে টিয়া বলে উঠল

-‘ শুধু কি দেখতে এসেছে, দেখ হলুূদও মাখিয়েছে। আমরা না আসলে আরো কতো যে কি করে বসত?
আমি চোখ রাঙিয়ে তাকালাম সবার দিকে। রাশফিনের কাজিন মাহিন বলে উঠল
-‘ থাক থাক ভাবী, আর চোখ রাঙাতে হবেনা। আপনি চলুন। আর রাশফিন ভাই তুমি কিন্তু রুলস্ ব্রেক করেছ। এটা কিন্তু ঠিক না।

রাশফিন আড়চোখে সবার দিকে একবার তাকিয়ে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। এদিকে এখনো সবাই মুখ টিপে হাসছে। আর আমি লজ্জায় মরছি।
সবাই মিলে আমাকে হলুদ মাখিয়ে ভুত বানিয়ে ফেলেছে একেবারে। ইতোমধ্যে রাশফিনকেও হলুদ মাখানো হয়ে গেছে। সবাই কেমন যেন আড়চোখে দেখছে আমাদের। আর তাকাবেই তো রাশফিন যে কাণ্ডটাই না করল। সবার আগে হলুদ মাখিয়ে একেবারে লজ্জায় ফেল দিল আমায়।

দেখতে দেখতে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানটাও শেষ হয়ে গেল। বিয়ে বাড়ি, সবাই এদিক ওদিক যে যার মতো ছবি তুলতে আর খাওয়া দাওয়ায় ব্যস্ত। এই সুযোগে আমার গালে টুপ করে একটা চুমু খেয়ে নিল রাশফিন। আমাকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসল রাশফিন।
এখন আমার বিদায়ের পালা। মা বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করল। আমিও কেদেছি তবে এটা নতুন না, এর আগেও বিদায়ের সময় অনেক কেদেছিলাম।

গাড়িতে গিয়ে বসে পড়লাম, কিন্তু আমার আশেপাশে রাশফিনকে দেখতে পেলাম না কোথাও। পাশ থেকে টিয়া বলল
-‘ ভাবী, ভাইয়াকে খুজচ্ছো বুঝি? ভাইয়া তো অন্য গাড়িতে।
টিয়ার কথা শুনে বড্ড রাগ হলো রাশফিনের উপর। এ গাড়িতে বসলে তো আমার পাশে বসতে হতো। অন্য গাড়িতে গেলে তো মেয়েদের পাশে বসতে পারবে। রাগে ইচ্ছে করছে রাশফিনের চুল ছিড়ে ফেলতে।
আমার এই অবস্থা দেখে সবাই মিটিমিটি হাসছে। আমি তাকাতেই সবাই চুপসে গেল।

গোল্ডেন কালারে পাড়ের লাল টুকটুকে বেনারসি সাথে ভারী জুয়েলারি পরে মাথায় একহাত ঘোমটা টেনে সেই তখন থেকে অপেক্ষা করছি আমি। রাশফিনের আসার এখনও কোনো নাম নেই। অবশেষে বিরক্ত হয়ে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাড়ালাম।

এদিকে সব কাজিনরা আজকে এসে দাড়িয়ে আছে রাশফিনের রুমের সামনে। রাশফিন আসলেই টাকা চাইবে। রাশফিনকে আসতে দেখেই সবাই ঠিকঠাক হয়ে দাড়াল। পরপর কয়েকটা শুকনো ঢোকও গিললাম। এমনিও এই চারদিন যাবত সুযোগ পেয়ে অনেক জ্বালিয়েছে রাশফিনকে, এখন আবার চ*ড় মে*রে না বসে এই লোকটা।
রাশফিন ওদের সবাইকে দেখেই বুঝে ফেলল। একজন সাহস করে কিছু বলতে আসলেই রাশফিন এমনভাবে তাকাল,মুখ দিয়ে আর টু শব্দও বের হলো না, আস্তে করে যাওয়ার পথ করে দিল। রাশফিনও রুমে গিয়ে ঠাস করে দরজা দিয়ে দিল।

-‘ এটা কি করলি তোরা? এভাবে কেন যেতে দিলি ভাইকে?
রাগ করে বলে উঠল রিমা। মাহিন নরম স্বরে বলল
-‘ এখন রাগ করে কি হবে বেয়াইন সাহেবা? তার থেকে আমরা বরং দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকি। দেখি কি করে ওরা?
মাহিনের কথায় সম্মতি জানায় সবাই। রিমা আড়চোখে মাহিনকে দেখে তা দেখে মাহিন মুচকি হাসে।
কাধে কারো শীতল স্পর্শে ঈষৎ কেপে উঠলাম আমি। আমার কাধে মুখ গুজে দাড়িয়ে রইল রাশফিন। আমি ঝাড়ি দিয়ে সরিয়ে দিলাম, অবাক হলো রাশফিন, পরক্ষণেই আন্দাজ করতে পারল বিষয়টা।

-‘ ও বউ রাগ করেছে কেন গো? বউ কথা কউ না?
-‘ কিসের জন্য কথা বলবো আমি আপনার সাথে? গাড়িতে আমার সাথে না বসে, খুব তো অন্য গাড়িতে মেয়েদের সাথে ফুর্তি করেছেন, এজন্যই তো এতো দেরি হয়েছে আসতে। আমি বুঝিনা কিছু, তাইনা?এখন যান না ওদের কাছেই যান।আমার এখানে কেন এসেছেন?
রাশফিন অসহায় কণ্ঠে বলল

-‘ অন্য গাড়িতে তো আমি ইচ্ছে করে উঠিনি, আমার কাজিনরাই জোড় করেছে, আজকে একদিনের জন্য আর সিনক্রিয়েট করিনি আমি। আর না ওখানে কোনো মেয়ে ছিল, আমরা ছেলেরাই ছিলাম। বিলিভ মি। আচ্ছা বউ, এখন থেকে তোমার পাশে আমি আঠার মতো চিপকে থাকবো। হ্যাপি?
আমি এবার শান্ত হলাম কিছুটা তবে পুরোপুরি না। আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই রাশফিন দরজা খুলল।
রাশফিনকে এই অসময়ে দরজা খুলতে দেখে সবাই ভড়কে গেল। এখনও সবাইকে এখানে দেখে রাশফিন ভ্রু কুচকে ফেলল।সেসবে পাত্তা না দিয়ে চেচিয়ে বলল

-‘ তোদের কারণে আমার বউ আমার উপর রেগে আছে। তোরা পাকনামি না করে আমায় অন্য গাড়িতে না উঠালে তো এমন হতো না। আর হ্যাঁ আমার মেয়ে কাজিনরা আমার থেকে দূরে দূরে থাকবি। একদম আমার ধারে কাছেও ঘেষবিনা। আমার বউ এসবে জেলাস ফিল করে বড্ড আর সেই রাগগুলা আমার উপ্রে ঝাড়ে।
পাশেই আমি দাড়ানো ছিলাম। সবার সামনে আমাকে একটানে কোলে তুলে নিয়ে ঠাস করে দরজা দিয়ে দিল রাশফিন।
এদিকে সবাই রাশফিনের এমন পাগলামি দেখে হাসতে হাসতে যে যার রুমে চলে গেল।
এদিকে অরনিশাকে বিছানায় বসিয়ে রাশফিন ধরা গলায় বলল

আজকের পর থেকে যদি আমার মতো একটা নিষ্পাপ মানুষকে বিনা কারণে কোনোকিছু না বুঝেই সন্দেহ করো তাহলে কানের নিচে মা*রব এক চ*ড়, তিনদিন ধরে শুধু মাথা ঘুরবে তোমার। নাও এখন কোনো কথা বলবেনা, তাড়াতাড়ি কাছে এসো তো আমার।তোমায় ছাড়া চারটাদিন থাকতে অনেক কষ্ট হয়েছে আমার।
অরনিশাকে আর কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জাগটে ধরল রাশফিন। অরনিশাও আলতো করে হাত রাখল রাশফিনের পিঠে।পরক্ষনেই অরনিশার মাঝে ডুব দিয়ে হারিয়ে গেল রাশফিন।

সমাপ্ত

আসসালামু আলাইকুম। সারপ্রাইজ পর্ব দিয়ে চমকে দিলাম সবাইকে। গল্পটায় অনেক রেসপন্স পেয়েছিলাম আর অনেকের রিকোয়েস্টে সারপ্রাইজ পর্ব দিলাম। কেমন হয়েছে জানাতে ভুলবেন না। আর হয়তো নতুন কোনো গল্পে এই জুটিকে আবারও নিয়ে হাজির হবো কোনো একসময় ইনশাল্লাহ। আমার জন্য দোয়া করবেন, ভালো থাকবেন সবাই।

আড়ালে ভালোবাসি তোমায় শেষ পর্ব 

1 COMMENT

Comments are closed.