আড়ালে ভালোবাসি তোমায় শেষ পর্ব 

আড়ালে ভালোবাসি তোমায় শেষ পর্ব 
নুসাইবা জান্নাত আরহা

‘ পরপর দুটো গুলি করে আহনাফকে মেরে ফেলেন নাফিয়া রহমান। তবুও তার রাগ যেন এখনও উপচে পড়ছে। আহনাফকে মারতে পেরেও যেন ক্ষ্যান্ত হননি তিনি।
আহনাফের বাসায় তিনি আহনাফকে না জানিয়ে চলে এসেছিলেন আহনাফকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি এসে যে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে যাবেন ভাবতেও পারেননি তিনি।

তার একমাত্র কলিজার টুকরা মেয়েটাকে এই আহনাফ মেরে ফেলেছে। এটা শুনতেই যেন রাগ তার মাথায় চড়ে বসল। তার মানে এতোদিন সে দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছে। ভাবতেই ঘৃণায় গা ঘিনঘিন করছে তার।
পাশে পড়ে থাকা চকচকে ছুড়িটা নজরে পড়তেই তা হাতে তুলে নেন তিনি। এলোপাতাড়ি ভাবে ছুড়িটা দিয়ে আঘাত করতে লাগলেন তিনি আহনাফকে। বেশ কিছুটা সময় পর শান্ত হন তিনি। ফ্লোরে বসে রক্তাক্ত হাতটাকে সামনে নিয়ে অঝোরে কাদতে লাগলেন তিনি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এলোমেলো পায়ে কোনোমতে আহনাফের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। তার এখন সবকিছু ফাকা ফাকা লাগছে। মেয়েটাকে বড্ড মনে পড়ছে তার। সিদ্ধান্ত নিলেন তিনিও আর নিজের জীবন রাখবেন না।
তাইতো চলন্ত ট্রাকের সামনে ঝাপিয়ে পড়ে নিজের প্রাণটা দিয়েই দিলেন। রক্তের স্রোত বয়ে গেল পিচঢালা রাস্তায়। চোখ দুটো তার এখনও খোলা। গড়িয়ে পড়ল দুফোটা নোনা জল। ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে। ‘

মুখের উপর পুরো এক জগ পানি ঝপঝপ ঢেলে দেওয়ায় হকচকিয়ে উঠে বসলাম আমি। চোখ মুখ কোনোমতে মুছে সামনে তাকাতেই আমার একদম কাছাকাছি রাশফিনকে দেখে আতকে উঠলাম। চোখ মুখ অসম্ভব রকম লাল হয়ে আছে রাশফিনের। এই মুহুর্তে এই মানুষটাকে দেখে অসম্ভব রকম ভয় লাগছে আমার। পর মুহূর্তে কিছুক্ষণ আগের কথা মনে পড়তেই পরপর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিললাম। সেই সাথে অবাকও হলাম বেশ।

আমাকে উঠতে দেখেই শক্ত করে আমার দুই বাহু চেপে ধরে রাশফিন। দাতে দাত চেপে বলল
-‘ তোমার এতো বড় সাহস হয় কি করে, আমি বারন করা সত্ত্বেও তুমি বাইরে বের হও। কি বলেছিলাম মনে আছে? কোনো অঘটন ঘটলে তোমার কি হাল করব, বলেছিলাম?
আমি আতকে উঠলাম। সেই সাথে হাতে প্রচণ্ড ব্যাথায়ও করছে। অস্ফুট স্বরে বললাম

-‘ হ হাতটা ছ ছেড়ে দ দিন না? ব্যাথা লাগছে তো।
-‘ লাগুক ব্যাথা। ব্যাথায় দেওয়ার জন্যই ধরেছি হাতটা।
-‘ এ এমন ক কেন ক করছেন? আ আমি ক কি করেছি? লাগছে তো ছাড়ুন না?
আমার কথা শুনে যেন আরও জোরে চেপে ধরল আমার হাতটা রাশফিন। আমি ব্যাথায় কেদে উঠলাম। রাশফিনের আগের তুলনায় আরও জোরে ধমক দিয়ে আমার দুই বাহু ঝাকিয়ে বলল

-‘ আজ তোমার সাথে কি হতে যাচ্ছিল কোনো খেয়াল আছে তোমার? তোমার লোকেশন ট্রাক করে সময় মতো আমি ওখানে না গেলে তোমার আর আজ বেচে ফিরে আসা হতো না। নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে আসতে হতো ঐ বা**টার্ডকে। বলি হতে ঐ আহনাফের হাতে। আর এসবই হয়েছে তোমার করা ভুলের জন্য। এ ভুলের মাশুলও দিতে হবে তোমাকে।
আমি এবার শব্দ করে কেদে উঠলাম। ইতোমধ্যে আমার দুহাত ব্যাথায় লাল বর্ণ ধারণ করেছে যেন। এটা দেখে রাশফিন দ্রুত ছেড়ে দেয় আমায়। অন্যদিকে ঘুরে শ্বাস টেনে টেনে নিজের রাগ কমানো চেষ্টা করছে।
কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বললাম

-‘ আ আমি কি জ জানতাম নাকি যে ওখানে আহনাফ আসবে। ও তো আর আমার ভার্সিটিতে পড়তো না। আমি কিভাবে বুঝবো?
-‘ তুমি কিছুই বুঝো না, ছোট বাচ্চা তো? তাই সব আমাকেই বুঝিয়ে দিতে হবে। আমি কতো বার করে বলেছিলাম খেয়াল আছে কোনো?
-‘ আপনি এমন করছেন কেন? সামান্য..

-‘ এটা সামান্য মনে হয় তোমার কাছে? তোমাকে কেন ঐভাবে স্পর্শ করতে গিয়েছিল ঐ আহনাফ। আমি মেরে ওর হাত ভেঙে গুড়ো গুড়ো করে দিয়েছি। ওর সাহস হয় কিভাবে আমার বউয়ের গায়ে হাত দেওয়ার। তুমি শুধুই আমার। তোমাকে স্পর্শ করার অধিকার শুধুমাত্র আমার। অন্য কারো নয়।
রাশফিনের কথা শুনে মৃদু হাসলাম। বড্ড হিংসুটে তো লোকটা। আমায় হাসতে দেখে কঠিন চোখে তাকায় রাশফিন। আমার হাসি যেন আপনা আপনিই হাওয়া হয়ে যায়।

এই মানুষটা আমায় এতো ভালোবাসে এটা ভাবতেই মনের মাঝে ভালো লাগা কাজ করে। খুশিতে ইচ্ছে করছে যেন গাল দুটো টেনে দেই।কিন্তু এতো বড় দুষ্সাহস নেই আমার।
রাশফিন গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল

-‘ এখানে এখনও বসে বসে কি এতো ভাবছো? আমার চোখের সামনে দিয়ে চলে যাও।
রাশফিনের কথা শুনে বাধ্য মেয়ের মতোই রুমে বাইরে পা রাখতে নিলে হ্যাচকা টান দিয়ে নিজের সাথে আমায় মিশিয়ে নিল রাশফিন। হঠাৎ এমন হওয়াতে আমি ভড়কে গেলাম। আমায় চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বাকা হাসল রাশফিন।

-‘ ভালো কথা তো শুনো না। যেই চলে যেতে বললাম অমনি এক কথায় চলে যেতে চাইছো? তুমি সবসময় আমার থেকে পালিয়ে বেরাও কেন?
-‘ আমায় যেতে বললেন তাই তো..
-‘ আমার পারমিশন ছাড়া এ ঘরের বাইরে এক পাও রাখবা না। বুঝচ্ছো?
-‘ আপনিই তো বললেন…
-‘ হুশ, চুপ একদম। কোনো কথা নয়। এখন তোমাকে শাস্তি দিব আমি।
-‘ ক কি শ শাস্তি?
রাশফিন দুষ্টু হেসে বলল

-‘ দেওয়ার সময়ই দেখতে পাবে কি শাস্তি দেই আমি।
বলে আমার আরও কাছে চলে এলো রাশফিন। ততক্ষণে আমার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগে হঠাৎ রাশফিন এগিয়ে আসতে আসতে আমার ঠোট জোড়া নিজের দখলে নিয়ে নিল।
মিনিট পাচেক পর ছেড়ে দিল আমায়। আমি তখনও চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছি। জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছি। এটুকু সময়ের জন্য মনে হচ্ছি আমার শ্বাস আটকে গিয়েছিল। এখনও আমার হ্রদপিণ্ডে কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে এমন মনে হচ্ছে।

রাশফিন আমার আরও কাছে আসতে যাবে তখনই মামনির ডাক পড়ে। আমরা দুজনই হাপাচ্ছি এখনও। রাশফিন বলল
-‘ এখনের মতো বেচে গেলা, কিন্তু রাতে আমার কাছ থেকে কিভাবে ছাড়া পাও, সেটাও দেখবো আমি। আজকে কোনো বাহানায় কাজ হবে না। না আসতে চাইলে কোলে তুলে নিয়ে আসবো।
কথাটা বলেই হনহন করে চলে যায় রাশফিন। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি হতভম্বের ন্যায়।
রাতের খাবার শেষে করে, মামনির হাতে হাতে সব কাজ গুছিয়ে দিয়ে, আজকেও কালকের মতো মামনির রুমের দিকে পা বাড়ালাম। উদ্দেশ্য রাশফিন থেকে নিজেকে দূরে দূরে রাখা। এই মানুষটার কাছে গেলেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। তাই যেই ভাবে সেই কাজ।

যখনই মামনির রুমে গিয়ে দরজা আটকাতে যাব ওমনি আমায় হ্যাচকা টান দিয়ে একেবারে কোলে তুলে নেয় রাশফিন। আমি ওর এহেন কাণ্ডে হকচকিয়ে উঠি। এদিকে মামনি আমাদের কাণ্ডকারখানা দেখে হেসে ফেলেন।
আর এদিকে আমি লজ্জায় লাল, নীল, বেগুনি, কমলা, গোলাপি হয়ে যাচ্ছি। ইচ্ছে করছে মাটির অতল গভীরে চলে যাই।
রাশফিন কোনো কথা না বলে আমায় কোলে নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা দিয়ে দেয়।
এদিকে রাহেলা খাতুন মুচকি হাসেন। মনে মনে বলেন

-‘ যাক ছেলেটা তবে ওর বাবার মতো অমানুষ হয়নি। একদম বউ পাগল আমার ছেলেটা। এভাবেই সুখে থাকুক আমার ছেলে মেয়েটা।
খুশিতে ওনার চোখ দিয়ে অশ্রু গরিয়ে পড়ে। তিনি নিজেকে এখন গর্বিত মনে করছেন। সত্যিই তিনি কোনো ভুল করেননি, রাশফিনের সাথে অরনিশার বিয়েটা দিয়ে।

আমাকে বিছানায় বসিয়ে লাইট অফ করে দেয় রাশফিন। ধীরে ধীরে আমার কাছে এগিয়ে আসতে থাকে। আমার নিশ্বাস ঘন হয়ে আসতে থাকে। এখন শুধু দুটি মানুষের হ্রদস্পন্দন আর নিশ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
ভালোবাসাময় রাতটা উপভোগ করতে থাকে ওরা দুজনে। দুজনেই এখন ব্যস্ত ওদের ভালোবাসা বিনিময়ে।

রাশফিনের কাধে মাথা রেখে ছাদের বসে আছি। আকাশে মস্ত বড়ো থালার মতো চাদ উঠেছে আজ। রাতের আকাশের অসংখ্য তারারা মিটমিট করে জ্বলছে। বারবার মিষ্টি বাতাস এসে আমার চুলগুলো উড়িয়ে দিচ্ছে। রাশফিন আমার চুলে মুখ গুজে তার ঘ্রাণ নিচ্ছে।
পাশে থাকা গোলাপ গাছটা থেকে একটা সুন্দর গোলাপ ছিড়ে আমার কানে গুজে দিল। এক নজর তাকিয়ে রাশফিন বলে উঠল

-‘ মাশাল্লাহ বউ তোমায় অনেক সুন্দর লাগে। বারবার তোমার মাঝে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে আমার।
লজ্জায় আমার মাথা নুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ আগের কথা মনে পড়তেই আরও বেশি লজ্জা এসে ঘিরে ধরল আমায়।
আমার অবস্থা বুঝতে পেরে মুচকি হেসে আমার কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে রাশফিন বলে উঠল

-‘ মনের সুপ্ত কোণে এতোদিন ধরে জমিয়ে রেখেছিলাম ভালোবাসা শুধুমাত্র তোমার জন্য। ভেবেছিলাম তোমায় হয়তো কখনো বলা হবেনা, ভালোবাসি তোমায়। আমার ভালোবাসা হয়তো আড়ালেই রয়ে যাবে। তবে না, আমি আজ আমার ভালোবাসা প্রকাশ করতে পেরেছি। উপহার দিতে পেরেছি ভালোবাসাময় রাত। বড্ড ভালোবাসি তোমায় প্রিয়তমা। কথা দাও আমায় ছেড়ে কখনো কোথায় যাবেনা। আমি যখন ডিপ্রেশনের অতল তলায় চলে গিয়েছিলাম তখন তখন স্পর্শে আমি আবার নতুন করে সব ফিরে পেলাম। সত্যিই ভালোবাসি, অনেক ভালোবাসি।

রাশফিনের কথা শুনে আমি ওকে জড়িয়ে ধরি। আলতো হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চুলে বিলি কেটে দিতে থাকে রাশফিন। আমি ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললাম
-‘ আমিও আপনাকে বড্ড বেশি ভালোবাসি মিস্টার রাশফিন চৌধুরী।

আড়ালে ভালোবাসি তোমায় পর্ব ১৬

রাশফিন বিজয়ের হাসি হাসল। অামার মুখ থেকে এই প্রথম ভালোবাসি শব্দটা শুনে আনন্দে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আমায় রাশফিন। আমিও শক্ত করে জড়িয়ে ধরি রাশফিনকে। বড্ড ভলোবাসি এই মানুষটাকে। আমার আড়ালে থাকা ভালোবাসাটা প্রকাশ করতে পেরেছি আজ। আজ থেকে আর বলতে হবেনা #আড়ালে_ভালোবাসি_তোমায়, মনের সুপ্ত অনুভূতিটা যে আজ প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছি আমরা। আমার স্মৃতির পাতায় আজীবন গেথে থাকবে আমাদের ভালোবাসাময় রাত্রির কথা।

সমাপ্ত 

অবশেষে এই গল্পটা শেষ করে দিলাম। চেয়েছিলাম আরও দু এক পর্ব লিখব। তবে এতো লিখতে মন চাইনি। হঠাৎ করে যে গল্পটা শেষ হয়ে যাবে আমিও বুঝতে পারিনি। সবাই দোয়া করবেন আমার জন্য। লেখিকাকে আবার ভুলে যেয়েন না যেন। হয়তো আবারও নতুন কোনো গল্প নিয়ে হাজির হবো। সেই পর্যন্ত সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ। আসসালামু আলাইকুম। আর হ্যাঁ সবাইকে অগ্রিম ঈদ মোবারক। 💝

আড়ালে ভালোবাসি তোমায় সারপ্রাইজ পর্ব 

1 COMMENT

Comments are closed.