খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৫

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৫
আভা ইসলাম রাত্রি

শীতের পিঠার আমেজ প্রতাবপুর গ্রামের সর্বত্র ছড়িয়ে পরেছে। পিঠাপুলির বিশাল মেলার আয়োজন করা হয়েছে গ্রামের উত্তরে। মেলার মূল উদ্যোক্তা স্বয়ং আয়ুষ্মান পরিবার। এ মেলার আয়োজন প্রতি বছর ভীষন ঝাকঝমকপূর্ন ভাবে আয়োজিত হয়। এবারেও তার ব্যতিক্রম নয়। মেলা শুরুর আগে শেহজাদের ছোট্ট এক বক্তৃতা আছে। শেহজাদের সামনে বক্তৃতা লেখা কাগজ তুলে ধরে শেহজাদের সহকর্মচারী মুর্তজা আহমেদ। শেহজাদ বই পড়ার ফাঁকে কাগজের দিকে স্পষ্ট দৃষ্টিতে তাকাল। সহসা বই টেবিলে রেখে জিজ্ঞেস করল,

‘কিসের কাগজ?’
মুর্তজা উত্তর দিলেন, ‘মেলার বক্তৃতার, নেতাসাহেব।’
শেহজাদকে বিরক্ত হতে দেখা গেল। পুনরায় টেবিল থেকে বই হাতে নিতে নিতে বলল, ‘মুর্তজা, আমাকে কখনোই লেখা দেখে বক্তৃতা দিতে দেখেছ? আমি নিজের মত করে সবাইকে আকর্ষন করার ন্যায় বক্তৃতা দেওয়ার যোগ্যতা রাখি। কাগজ লাগবে না, সরিয়ে নাও।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মুর্তজা আলগোছে কাগজ সরিয়ে পকেটে রেখে দিল। শেহজাদ কাগজ দেখে বক্তৃতা দেয়না, সে মুর্তজা বেশ ভালো করে জানে। শেহজাদ পুরোপুরি নিজের মত করে ভাষন কিংবা বক্তৃতা দেয়। তার বক্তৃতার মধ্যে অযথা চাকচিক্য পছন্দ করে না সে। সত্য এবং ভীষন স্পষ্ট বক্তৃতা তার বৈশিষ্ট্যের অংশ। তবে আজকে তাকে বক্তৃতা লিখে দেবার কিছু কারণ আছে অবশ্য। নির্বাচন এগিয়ে আছে।

শেহজাদ বরাবরের মত এবারেও নির্বাচনে নামবে। গ্রামের মানুষ শেহজাদ বলতে উন্মাদ হলেও, শেহজাদের বাবা চান এবারের নির্বাচনে শেহজাদের নাম কামিয়ে কিছু অতিরিক্ত টাকা গ্রামবাসী থেকে হাতিয়ে নিতে। গ্রামবাসী যেরূপ শেহজাদ বলতে পাগল, তারা দু বাক্য খরচ না করে টাকা নিজ হতে শেহজাদের হাতে ধরিয়ে দিবে এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই কারো। শেহজাদ হয়ত কিছুই আন্দাজ করতে পেরেছে বাবার অসৎ উদ্দেশ্যে।

এজন্যেই সে এই বিষয় খোলাসা করতে চায় সরাসরি নওশাদের সঙ্গে কথা বলে। তবে আজ নয়! মেলা আজ! মেলার আয়োজনে বিন্দুমাত্র ত্রুটি রাখতে চায় না শেহজাদ। এ মেলা প্রতাবপুর গ্রামের বহু যুগের ঐতিহ্য! এ ঐতিহ্য রক্ষা করার শপথ নিয়েছে শেহজাদ।

শেহজাদকে রাজি করাতে না পেরে মুর্তজা বিষন্ন হল। শেহজাদের সহকর্মী হলেও, এককথায় সে নেতা বংশের গোলাম। শেহজাদ তাকে সর্বদা স্নেহ করলেও, নওশাদ সৌরভ তারা উভয়েই তার প্রতি কিছুটা রুক্ষ থাকেন সবসময়। এর পেছনে কারণ অবশ্য আছে! শেহজাদ নিজের মত করে চলতে পছন্দ করে। কারোর অসৎ উদ্দেশ্যে সম্পর্কে সবার আগে সে জানতে পারে। তার গোপন গোয়েন্দার দায়িত্ত্ব পালন করে মুর্তজা। মূলত এই কারণে নওশাদ এবং সৌরভ সবাই বিরক্ত এবং রাগান্বিত মুর্তজার প্রতি। তবে মুর্তজা এসব পরোয়া করে না। যতদিন শেহজাদ আয়ুষ্মানের ছায়া তার উপর আছে, ততদিন সে নিরাপদ।

‘শেহজাদ? মেলায় যাচ্ছ কখন?’
নওশাদ পাঞ্জাবি গায়ে পরিধান করতে করতে বসার ঘরে প্রবেশ করলেন। শেহজাদ চোখের ইশারায় মুর্তজাকে এ ঘর ছেড়ে চলে যেতে বলল। মুর্তজা নত হয়ে নওশাদকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। শেহজাদ বই রাখল টেবিলে। নওশাদের দিকে চেয়ে বলল,

‘এখন যাব। আপনি কি মুর্তজাকে দিয়ে কিছু পাঠিয়েছিলেন আমার কাছে?’
নওশাদ ভ্রু কুঁচকে তাকালেন ছেলের দিকে। পরপরই উত্তর দিলেন,
‘তুমি বোধহয় কাগজটা হাতে নাওনি। এ আর নতুন কি? যাজ্ঞে! দেরি হচ্ছে। উঠতে হবে আমাদের। গাড়ি উঠোনে দাঁড়ানো। তৈরি হয়ে বের হও। আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি।’

শেহজাদ গা ঝাঁকালো। হাতের আঙ্গুল সব একে একে ফুটিয়ে নিল আরেকবারের মত। নওশাদ ছেলের এই কাজে প্রচন্ড বিরক্ত হলেন। ছেলের সব অভ্যাস ভালো হলেও, এমন আঙ্গুল ফুটানোর অভ্যাস নওশাদ পছন্দ করেন না। ছোটবেলায় ছেলের আঙ্গুলে লোহা গরম করে মেরেছেন। অথচ ছেলে এক ফোঁটা কাঁদে নি, বরং পরদিন থেকে যেন এই অভ্যাস আরো প্রবল আকার ধারণ করেছে। নওশাদ এড়িয়ে গেলেন আবারও। হেঁটে বেরিয়ে গেলেন উঠোনের দিকে।

শেহজাদ নিজের ঘরে এসে দেখে চিত্রা বসে আছে বিছানায়। হাতে বই। চিত্রা পড়ার চেষ্টা করছে সে বই। কিছুসময় বানান করে পড়ছে, কিছুসময় সহজে বানান ছাড়াই পড়ছে। শেহজাদ গম্ভীর দৃষ্টিতে তা দেখে আলমারির দিকে এগুল। আলমারি থেকে পাঞ্জাবি বের করতে যাবে, পেছন থেকে চিত্রা ডাক দিল,

‘কোথাও যাবেন?’
শেহজাদ আলমারি থেকে সাদা রঙের পাঞ্জাবি এবং সাদা পায়জামা বের করে বিছানায় রাখল। উত্তর দিল একফাঁকে,
‘মেলায়।’
চিত্রাকে আগ্রহী দেখা গেল। সে বই রেখে বিছানা থেকে নেমে শেহজাদের পিছু পিছু দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করল,
‘কিসের মেলা?’
‘পিঠাপুলির।’

শেহজাদ পাঞ্জাবি পরে নিয়েছে ততক্ষণে। চিত্রা কিছু একটা বলবে। অথচ সংকোচের কারণে বলতে পারছে না, শুধু উশখুশ করছে। শেহজাদ হয়ত সেটা বুঝতে পারল। সে গায়ে আতর মেখে বলল,
‘এ বাড়ির মেয়ে-বউরা মেলায় যায় না।’

চিত্রা বিষ্ময় নিয়ে তাকাল শেহজাদের দিকে। মানুষটা বুকের কথা মুখে আনার আগে কিভাবে বুঝে ফেলে? শেহজাদের বিচক্ষণতা দেখে চিত্রা যারপরনাই বিস্মিত হল। অতঃপর নিজের বিষ্ময় কাটিয়ে বলল,
‘যদি বোরকা পইরে যাই? সারা গা ঢাইকা। তাও নেওয়া বারণ?’

শেহজাদ আকষ্মিক পেছনে ফেরে তাকাল। শেহজাদের ভ্রু কুঁচকানো। দু চোখ যেন বেরিয়ে আসবে কোটর ছেড়ে। চিত্রা শেহজাদের এমন চাওনি দেখে ভয়ে দু কদম পিছিয়ে গেল। কম্পিত কণ্ঠে কষ্ট করে উচ্চারণ করল,
‘আ-মি আর কো;থাও যা-মু না। ব-লমু না কা-উরে নিয়ে যা-ওয়ার লা-ইগা। আমাকে মা-ফ কইরে দিন।’
শেহজাদের কুঁচকানো ভ্রু সোজা হল। সে স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘অযথা ভয় পাচ্ছ কেন? তোমাকে কেউ কিছু বলেছে এখানে?’

চিত্রা অস্বাভাবিকভাবে মাথা নাড়িয়ে মানা করল। পেছনে হাত বাড়িয়ে কাঠের পালঙ খামচে ধরল। কম্পিত কণ্ঠে উচ্চারণ করল, ‘আ-মি আফ-নার চো-খ দেইখে ভ-য় পাইছি।’
‘মানুষ দুটো জিনিস সবসময় ভয় পায়। আগুণ আর পানি। আমার চোখে আগুন রাখা নাকি পানি?’
ভয়ে চিত্রার বুকের উঠানামা বেড়ে গেছে। হাপরের মত শ্বাস নিচ্ছে সে। চিত্রা সরাসরি শেহজাদের চোখের দিকে তাকাল। কিছু একটা হয়ে গেল তার মধ্যে। সঙ্গেসঙ্গে চোখ সরিয়ে নিল সে। অন্যদিকে চেয়ে বলল,

‘আ-ফনার চোখ ভীষন অ-দ্ভুত। আমি আফনার চো-ক্ষের দিকে চাইয়া থাকতে পারি না। ভ-য়ে আমার ক-লিজা শু-কিয়ে যায়।’
শেহজাদ চিত্রার কথা শুনে হাফ ছাড়ল। বাড়তি কথা না বলে হেঁটে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। চিত্রাকে রেখে গেল আতঙ্কে। চিত্রা শেহজাদের এমন করে বেরিয়ে যাওয়া দেখে ভয়ে নেতিয়ে গেল। আঁচল মাথায় তুলে দৌঁড়ে গেল শেহজাদের পিছু পিছু। শেহজাদ তার মায়ের ঘরে গেছে। চিত্রা তা দেখে ভয়ে এবার শুধু অজ্ঞান হওয়া বাকি। শেহজাদ মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। চিত্রা ঘরের দরজার সামনে কান পেতে দাঁড়িয়ে আছে।

‘আম্মাজান?’
রেখা তখন নামাজ পরে সালাম ফিরিয়েছেন। শেহজাদের কথা শুনে তিনি জবাব দিলেন। শেহজাদ বলল,
‘মেলায় যাবার জন্যে তৈরি হোন। এ বাড়ির সবাই আজ একসঙ্গে মেলা উপভোগ করব।’
রেখা বিস্ময়ে কথা বলা ভুলে গেলেন যেন। হাতের রেখায় তাজবিহ পড়া আঙ্গুল থেমে গেল। ডাগর ডাগর চোখে ছেলের দিকে চেয়ে বললেন,

‘তুমি ঠিক আছো? এ বাড়ির মেয়েরা মেলায় যাবে? এ কখনও হতে দেখেছ তুমি? খামোকা অশান্তি করো না। মেলায় যাচ্ছ, যাও। আমরা যাচ্ছি না কেউই।’
শেহজাদ মায়ের পাশে হাঁটু গেরে বসল। মায়ের হাতদুখানা নিজের হাতে নিয়ে সহসা বলল,
‘আমার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিনে আপনি আমার সাথে থাকবেন না, আম্মাজান?’
রেখা ছেলের মুখের দিকে চেয়ে থাকলেন নির্নিমেষ। ছেলের মুখের দিকে স্নেহের কারণবশত মানা করার সাহস হল না তার। হেসে বললেন,

‘আমার ছেলে যা বলে তাই হবে। তুমি গাড়িতে বসো। আমরা আসছি।’
শেহজাদ মায়ের দিকে চেয়ে উঠে দাঁড়াল। মায়ের ঘর ছেড়ে যাবার আগে একবার পেছন ফিরে বলল,
‘সুভাষিণীকে তৈরি হতে বলে দিবেন। সবাই যাচ্ছে, ও না গেলে খারাপ দেখাবে।’
রেখা ছেলের সামান্য কথায় যতটা খুশি হয়েছেন, সুভা বউকে নেবার কথা বলায় তিনি ততটা মনে ধরলেন না কথাটা। তিনি হেসে বলেন,

‘ঠিক আছে। তুমি যাও, আমরা আসছি।’
শেহজাদ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। চিত্রা সঙ্গেসঙ্গে সরে গেল দরজা থেকে। তবে শেহজাদ যা দেখার দেখে নিয়েছে। শেহজাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে কপাল কুঁচকে এগিয়ে গেল দরজার পর্দার দিকে। চিত্রা লুকিয়ে আছে, থরথর করে কাঁপছে সে। শেহজাদ এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে চিত্রার আঁচল ছুঁয়ে দিল। চিত্রা ভয়ে মৃদু স্বরে আর্তনাদ করে উঠল। চমকে আড়চোখে তাকাল শেহজাদের দিকে। শেহজাদ চিত্রার আঁচল টেনে নিজের সামনে নিয়ে এল। আতঙ্কে চিত্রার মুখের রক্ত সাদা হয়ে গেছে। শেহজাদ আঁচল ছেড়ে দিল। গম্ভীর স্বরে বলল,

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৪

‘পরবর্তীতে আড়ি পেতে শুনতে যেন আর না দেখি। এটা বাজে অভ্যাস।’
শেহজাদ চলে গেল। রেখে গেল আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে থাকা চিত্রা সুভাষিণী মজুমদারকে।

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৬