অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৩৩

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৩৩
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা হলো সাতদিন পর। সাথে আরো টুকটাক আলাপচারিতা চললো। সবাই দুপুরের খাবার এখানেই খাবেন। মামি আয়োজন করলেন। ইরাকে ইশারায় তরীকে ডেকে দিতে বললেন।
ইরা ইশারা পেয়ে উঠে গেল। সিঁড়ি ঘরে পা রেখে এগিয়ে গেল ধীরে ধীরে।

প্রকৃতি থেকে এখনো শীতের রেশ কাটেনি। দখিনা হাওয়ায় শরীর কাটা দিয়ে উঠলো তরীর। মাথানিচু করে নিলো মেয়েটা। হুট করেই ভীষণ লজ্জা লাগলো তার। মাহমুদের সাথে সহজ হয়ে যাওয়া সম্পর্কে আবারো লজ্জারা বেড়াজাল টানলো। অস্থিরতায় বারবার চোখের পলক ঝাপটালো। মাহমুদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরোখ করলো তাকে। নিঃশব্দে ঠোঁটের কোন প্রসারিত হলো। আবারো আদুরে সরে ডাকলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“তরী!”
তরী কথা খুঁজে পেলো না। অস্বস্তি নিয়ে বলল,
-“আমাদের নিচে যাওয়া উচিত।”
পা ঘুরিয়ে হাঁটতে গিয়েই হাতের কব্জিতে টা*ন পড়লো। মাহমুদ আলতো হেসে বলল,
-“পালাচ্ছো কেন, তরী? আর তো মাত্র কিছুদিন। তারপর কী করবে?”
তরীর মৃদু লজ্জা ভুরভুর করে কঠিন লজ্জায় পরিণত হলো। নিজেকে আড়াল করার প্রচেষ্টায় নামতে কার্পণ্য করলোনা। কঠিন ধমক দিতে গিয়েও নরম হয়ে এলো স্বর। বলল,

-“হাত ছাড়ুন। আশেপাশে অনেকেরই বাসা আছে। লোকে দেখলে কীবলবে?”
মাহমুদ কথা বাড়ালোনা। তরীর কথা অনুযায়ী আস্তে করে ছেড়ে দিল হাত। কপালের একপেশে তিলটা ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
-“এটা মাঝখানে হলো না কেন?”
তরী ফ্যালফ্যাল করে তাকালো। এই পর্যন্ত মাহমুদ কতবার যে তার তিলটা ছুঁয়ে দিয়ে একই কথা বলেছে, তা গুণে শেষ করতে পারবে না সে। এটা কি তার হাতে নাকি? সবইতো উপরওয়ালার সৃষ্টি। তরীর চোখেমুখে আষাঢ় নামলো। তার এই একটা জিনিস বুঝি মাহমুদের খুব অপছন্দ!

তরীর দৃষ্টি দেখে মাহমুদ আবারও হেসে ফেললো। এবার অল্পস্বল্প শব্দ হলো। তরীকে রাগিয়ে দিতে তার ভালোই লাগে। সে অরুর মতো ফটাফট উত্তর দেয় না, কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মাহমুদ বারবার কথার ছলে তিলটা ছুঁয়ে দেখে। অথচ তরীর কাছে প্রকাশ করেনা। সে এতে ভালোলাগা খুঁজে পায়।
হুট করেই ছাদে ইরার আগমন। নিচে নামার জন্য তাড়া দিলো দুজনকে। তরী আর দেরি করলোনা। ত্রস্ত পায়ে নেমে পড়লো। মাহমুদ ধীরেসুস্থে সিঁড়ি ধরে পা ফেলছে। ইরা পেছন থেকে বলল,
-“নতুন করে প্রেমে পড়লে নাকি আজ আবার?”

মাহমুদ হাসলো। বলল,
-“এ আর নতুন কী? আমি তো রোজই তার প্রেমে পড়ি। ভালোবাসা আছে বলেই পৃথিবীতে প্রেম বেঁচে আছে। যদি ভালোবাসার অস্তিত্ব না থাকতো, তবে এই প্রেম, সংসার কিছুই বোধহয় স্থায়ী হতো না!”
ইরা মলিন হেসে বলল,
-“সত্যিই বলেছো। ভালোবাসা আছে বলেই এখনো আমি তোমাদের পরিবারে, তোমার ভাইয়ের জীবনে আছি। নয়তো সেই কবেই আমার ঠাঁই হতো বাবার বাড়িতে।”

মাহমুদ পা জোড়া আরো ধীর করলো। একটু থেমে পেছনে ইরার মুখোমুখি তাকালো। নরম স্বরে বলল,
-“নিজেকে শক্ত করো ভাবি। আল্লাহ একদিন ঠিকই মুখ ফিরিয়ে তাকাবেন।”
ইরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রায় আট বছর হতে চললো বিয়ের। অথচ এখনো সন্তানের মুখ দেখেনি। মাঝেমাঝে নিজের ভাগ্যকে দো*ষা*রো*প করে। আবার ভাবে, ভাগ্য যদি খা*রা*প*ই হতো, তবে সে নিসন্তান হয়ে এই বাড়িতে টিকতে পারতো না।

বড়ো ভাইয়া গলা ঝেড়ে বললেন,
-“তরী আর মাহমুদের বিয়ের কথা তো হলো। এবার আমার আর অরুর বিয়ের কথাটাও বলুন।”
অরু দাঁত কিড়মিড় করে তাকিয়ে আছে। সবাই মুখ চেপে হাসছে। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো তিনিও হাসছেন। এবার অরুর সবচেয়ে বেশি রাগ হলো। অভিমানে বাবার কাছ থেকে সরে গেল। মাহমুদের বড়ো ভাইয়ার উদ্দেশ্য বললো,
-“নিজের চেহারা দেখেছেন? আমার মতো সুন্দরী মেয়ে তো জীবনে দেখেন নি, তাই লাফাচ্ছেন। আমি কোন বুড়োলোককে বিয়ে করবো না। আমার কি রূপ নেই না-কি?”
বড়ো ভাইয়া আরেকটু রাগিয়ে দিলেন অরুকে। বললেন,

-“কিন্তু আমার তো তোমাকেই পছন্দ হয়েছে। ইরাকে দেখেছো? কেমন বুড়ি হয়ে গিয়েছে। তাই তোমার মতো একটা সুন্দরী বাড়ি নিয়ে যাওয়া দরকার। বলো বিয়ে করবে না আমায়?”
রামি আতঙ্কিত স্বরে বলল,
-“এই কু*ট*নি বুড়িকে বাড়িতে নিলে সর্ব*নাশ হয়ে যাবে। সারাদিন সবার সাথে কোমর বেঁধে ঝগড়া করবে।”
রামিকে ধমক দিলো অরু,

-“তুমি চুপ থাকো। আমি কি তোমার সাথে কথা বলেছি? সব জায়গায় নাক গলিয়ে বসি থাকে।”
রামিও এবার ভাইয়ার দলে যোগ দিলো। বলল,
-“তোর মতো লঙ্কার জন্য আমার ভাইয়ের মতো বুড়োলোকই ঠিক আছে। ভাইয়া ওকে নিয়ে যেও। যেতে না চাইলে আমাকে বলো, বস্তা খুঁজে নিচ্ছি। হাত-পা বেঁধে বস্তা ভরে নিয়ে যাবো।”
অরুর চোখে পানি টলমল করছে। বাবা, আপু, মিঠু কেউই তার পক্ষে কথা বলছে না। সবাই চুপটি করে আছে। ক্রমশ নাকের পাটা ফুলিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো। কেঁদে ফেলে চিৎকার করে বলল,

-“তোমায় বস্তা ভরবো। আমাদের বাসা থেকে বের হও।”
তরী বোনকে কাঁদতে দেখে এগিয়ে গেল কোলে নিতে। অরু হাত পা ছড়ানো শুরু করলো। তরীকে ধমক দিয়ে বলল,
-“ধরবে না আমায়।”
বাবা এসে ধরতে গেলেন। অরু ফের সরে দাঁড়ালো। হুট করেই অভিমানী স্বরে বলল,
-“তুমিও আমায় ধরবে না। আমার আল্লাহ ছাড়া কেউ নেই।”

সবার কাছে অরুর কথাটি হাস্যকর লাগলেও তরীর বুকের ভেতর ছ্যাত করে উঠলো। মায়ের অনুপস্থিতিতে মেয়েটাকে সামলাতে বড্ড কষ্ট হয়েছে তার। সেই পুরোনো অরুকে ফিরে পেতে প্রচুর সময় লেগেছে। এখনো একা একা মন খা*রা*প করে বসে থাকে। মন খা*রা*পে*র কারণ জিজ্ঞেস করলে মায়ের নামে একগাদা অভিযোগ নিয়ে বসে। মা কেন তার কাছে আসে না?
তরীর ভাবনার মাঝেই ছোট্ট, অবুঝ অরু বলল,

-“আমি ম*রে গেলে আমাকে আমার মায়ের পাশে ক*ব*র দিয়ে দিও।”
চমকে উঠলেন তরীর বাবা। হাসিহাসি, আনন্দে পরিপূর্ণ ঘরে বিষাদ নামলো। বাবা আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে অরুকে কোলে তুলে নিলেন। সারা মুখে চুমু দিয়ে বললেন,
-“এমন কথা বলে না মা। তাহলে বাবা কী নিয়ে থাকবো?”
অরু বাবার কাঁধ জড়িয়ে হেঁচকি তুলে বলল,

-“তোমার ছেলেমেয়ে আছে না? তাদের নিয়ে থাকো। আমাকে মা বলতে হবে না।”
বাবা অনেক কষ্টে অরুর অভিমান কমাতে সক্ষম হলেন। আয়েশা সুলতানা আশার সময় বুঝ করেই এসেছেন। যদি সুখবর হয়, তবে তিনি আসার পথেই তরীকে রিং পরিয়ে আসবেন। ঠিক সেটাই করলেন। বাক্স খুলে তরীর হাতে রিং পরিয়ে দিলেন। বাবার হুট করেই তিয়াসের বাবামায়ের দেওয়া রিং এর কথা মনে পড়লো। তরীকে জিজ্ঞেস করলেন,
-“তোর চাচার দেওয়া রিংটা কোথায়?”
তরী মাথানিচু করে জবাব দিলো,

-“আছে, খুলে রেখেছি।”
বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন,
-“আমি সন্ধ্যায় বের হওয়ার সময় দিয়ে দিস। ওদের রিং ফেরত দিয়ে দেবো।”
তরী মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো।
বাবার আর সন্ধ্যায় বের হওয়া হলোনা। শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ায় বিশ্রাম নিলেন। তাই রিং তরীর কাছেই রয়ে গেল।

আপনমনে গুণগুণ করতে করতে ইউনিফর্ম বের করলো মিঠু। কেমন দুর্গন্ধ ঠেকছে নাকে। তবে দুর্গন্ধের উৎস খুঁজে পেলোনা। শার্টের বোতাম খুলতে গিয়ে হাতে পিচ্ছিল কিছু লাগলো। মিঠু নাকমুখ কুঁচকে জিনিসটা পরোখ করে দেখতেই আন্দাজ করে ফেললো কফ আটকে আছে শার্টে। কাছে আনতেই নাকে ভুরভুর করে গন্ধ ঢুকে গেলো। দূরে শার্ট ছুঁড়ে ফেলে হাত ধোঁয়ার জন্য ওয়াশরুমে দৌঁড়ে গেল মিঠু।

ভেবে পেলো না তার ইউনিফর্মে এসব আসবে কোথা থেকে! অরু এমনটা কখনোই করবেনা। বরং সে মিঠুকে অপরিষ্কার বলে নাক কুঁচকায়। হিসেব মেলাতে গিয়ে রামির কথা মনে পড়লো। কোমরে লা*থি খেয়েও কেমন শান্ত ছিলো গতকাল। তার আর বুঝতে বাকি রইলোনা এসব কার কাজ। রান্নাঘর থেকে পলিথিন এনে শার্টটি ভরে স্কুল ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো। তরী ফ্রিজ পরিষ্কার করছে। মিঠুর মাথায় বুদ্ধি খেলে যেতেই সে ওয়াটার পটে ফ্রিজ ধোয়া পানি ভর্তি করে নিলো। অন্য একটা শার্ট পরে বেরিয়ে গেল স্কুলের উদ্দেশ্যে। পথেই রামির সাথে দেখা। সে ঠোঁট টিপে হেসে জিজ্ঞেস করলো,

-“ইউনিফর্মে কী হয়েছে? কাক এসে বসেছিল বুঝি?”
মিঠু খুব স্বাভাবিক স্বরে বলল,
-“বুঝতে পারছি না। শার্টে দেখি কফ, দুর্গন্ধ। তাই অন্যটা পরতে হলো।”
রামিও আর ঘাটালোনা। মিঠু তার ব্যাপারটা ধরতে পারেনি ভেবেই চুপ রইলো। বারবার হাসছে। রামির আবার যখন-তখন পানি পান করার অভ্যেস। মিঠুকে জিজ্ঞেস করলো,
-“তোর কাছে পানি আছে?”
মিঠু বলল,

-“যা এখান থেকে। তুই সব পানি শেষ করে দিস।”
-“আরে ভাই দে।” বলে রামি ওয়াটার পট কেড়ে নিলো। মুখ খুলতে খুলতে বলল,
-“পানি এতো ঠান্ডা কেন?”
অতঃপর এক কুলি মুখে নিয়েই আর গলাধঃকরণ করতে পারলোনা। নাকে কেমন কাঁচা মাছ, মাংসের গন্ধ লাগলো। মুখের পানি ফেলে দিলো সাথে সাথে। বলল,

-“পানি থেকে এমন মাছের গন্ধ আসছে কেন?”
মিঠু হো হো করে হেসে উঠলো। ব্যাগ থেকে পলিথিনে মোড়ানো শার্ট বের করে বলল,
-“আজকের দিনের ভেতর আমার শার্ট ভালো করে ধুয়ে দিবি। কী ভেবেছিস তুই, তমি কিছু বুঝিনা, না?”
রামি রেগে বলল,
-“আগে বল, এগুলো কিসের পানি?”
মিঠু দাঁত কেলিয়ে বলল,

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৩২

-“আপু ফ্রিজ পরিষ্কার করছিলো। সেখান থেকেই তোর জন্য নিয়ে এসেছি।”
-“তবে রে..।”
মিঠু আর দাঁড়ালোনা। ছুট লাগালো। পেছন পেছন রামি দাঁত কিড়মিড় করে দৌঁড়ে আসছে। আজ মিঠুকে ধরতে পারলে তার খবর টিভির হেডলাইনে দেখিয়ে ছাড়বে।

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৩৪

1 COMMENT

Comments are closed.