প্রণয়ের বিরহ পর্ব ১৭

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ১৭
তাসনিয়া রহমান স্নিগ্ধা

‘ভাবী আমার চশমাটা কোথায়? তাড়াতাড়ি এনে দাও, আমার তাহমিমা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর আমি ওকে ঝাপসা দেখছি কেন, তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো চশমাটা!’

এক দমে কথাগুলো বলে থামলো তূর্য। সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে এই কয়দিনে, পূর্বের বিজনেসের অর্ধেক মালিকানা সিয়ার নামে করে নিয়ে চাচা চাচী বিদেশে চলে গেছে। বিজনেস ডাউন হয়ে গেল আর আমাদের উপর এতো বড় একটা মানসিক চাপ।ব্যথাতুর নয়নে তূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলাম,ও পাগলের মত চারপাশ হাতড়ে বেড়াচ্ছে চশমার জন্য। পূর্ব বাইরে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গিয়েছিলেন,ফিরে এসে বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ স্নিগ্ধ, ওকে ওর মতো করে থাকতে দিতে বললেন ডাক্তার।চলো আমরা বাইরে যাই।'(পূর্ব)
মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম। পূর্ব আমার হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে এলেন, আমরা বের হওয়ার পর ডাক্তার আর একটা নার্স ঢুকলো কেবিনে ওকে শান্ত করার জন্য। পূর্ব গাড়ি ড্রাইভ করছেন আর আমি তার পাশের সিটে চুপচাপ বসে আছি।দুই মাস আগের কথা স্মৃতিতে ফিরে এলো আবার,,,,

সেদিন পূর্ব আমাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে দেখে আমার মনটা দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল।তামু ওর জন্মদিনে এমন একটা ঘটনার সম্মুখীন হতে পারে এটা আমি কখনও কল্পনায় ও আনিনি। খুব কান্না করছিলাম হসপিটালে গিয়ে,প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর ডাক্তার আই সি ইউ থেকে বেরিয়ে আসে আর আমার তামু কে ডে’ড ঘোষণা করে।পুরো পৃথিবী টা অন্ধকার হয়ে এসেছিল আমার কাছে, মনে হচ্ছিল বারবার এসব কিছুই স্বপ্ন।

কোন কিছুই হয়নি, ঘুম ভাঙলেই দেখবো তামু আমাকে আপু আপু বলে ডাকছে আর আমাকে জ্বালাতন করছে। কিন্তু ওসব কিছুই হলো না,ডাক্তার তামুর বডি টা শেষ বারের মত দেখতে বলে, এরপর নাকি পোস্টমর্টেম এর জন্য পাঠানো হবে।আই সি ইউ এর ভিতর যেতে পা যেন চলছিল না আমার, পূর্ব আমাকে শক্ত করে ধরে ভিতরে নিয়ে গেলেন। ভিতরে ঢুকে ই পড়ে যেতে নিলাম, পূর্ব সাথে সাথেই আমাকে ধরলেন, উনার গায়ে হেলান দিয়ে সামনের দিকে তাকালাম অশ্রুসিক্ত নয়নে।

আমার তামু টা চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে, শুভ্র সাদা বেডে নীল পোশাকে ওকে কত সুন্দর লাগছে। কপালে, মাথায় পুরো শরীরের এখানে ওখানে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে ওর, মুখটা বুঝা যাচ্ছে না স্পষ্ট। পূর্বের বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি।তামু কে ছাড়া কিভাবে থাকবো আমি? আমি ওর বোন, আমার কথা নাহয় বাদ দিলাম কিন্তু এই ছেলেটা?যে ওর পাশের কেবিনে অজ্ঞান হয়ে শুয়ে আছে ওর কি হবে?

ও তো ওর সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিল,কত সুন্দর একটা ভবিষ্যত অপেক্ষা করছিল ওদের জন্য কিন্তু এই এক্সি’ডে’ন্ট!!! এটা ওদের জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিল,তূর্যের কাছ থেকে আমার তামু কে কেড়ে নিল এই এক্সি’ডে’ন্ট।তামু!বলেই চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি আমি,যখন জ্ঞান ফিরে তখন নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করি। পাশে পূর্ব আমার হাত ধরে বসেছিল,ওর চোখ মুখ লাল দেখে আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে এর মধ্যেই অনেক কিছু ঘটে গেছে। পূর্ব কে জিজ্ঞেস করলাম,

‘ আমার তামু কোথায়?’
পূর্ব কিছু না বলে শুধু ইশারায় ক্যালেন্ডারের দিকে দেখিয়ে দিল আমাকে। ওদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম আমি জ্ঞান হারানো অবস্থায় দুইদিন ছিলাম। আমার জ্ঞান ফিরে আসতে দেখে মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল, তাহমিমা কে ডাকছে আর কাঁদছে ।কি বলে শান্তনা দেবো মা’কে? হাজার হলেও তিনি তো আমার মা হন যদিও রক্তের সম্পর্ক নেই। উনার মেয়ে, আমার বোন আমাদের ছেড়ে চলে গেছে যে, আমি ও কেঁদে উঠলাম মা’কে ধরে। কিছুক্ষণ পর খেয়াল হলো তূর্যের কথা। তূর্য কোথায় আর ও কি ঠিক আছে?

তামুর চলে যাওয়ার শক টা ও সামলাতে পেরেছে তো, ওর ও তো এ’ক্সি’ডে’ন্ট হয়েছিল!ওর বিশেষ কোনো ক্ষতি হয়নি তো। তাড়াহুড়ো করে বেড থেকে নেমে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলাম তূর্য কে খুঁজতে। পূর্ব আমাকে আটকানোর আগেই তূর্য যেই কেবিনে ছিল সে কেবিনের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলাম। সাথে সাথেই পূর্ব এসে আমাকে ধরে বাইরে নিয়ে এলেন, ভিতরে কি ঘটছে সেটা আর দেখতে দিলেন না। জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘আস্তে আস্তে সব জানতে পারবে। আগে তুমি সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে আসো। শাশুড়ি মায়ের এক মেয়ে চলে গেল তাই বলে কি তুমি উনার সেই মেয়ের অভাব টা পূরণ করবে না?’

মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিলাম পূর্বের কথায়। আমার তামুর বডি আর দেখতে পাইনি আমি।এক সপ্তাহ পর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসার পর মেডিকেল কলেজের গোরস্থানে দাফন করা হয় ওকে, শেষবারের মতো ওকে দেখার সাহস হয়নি আমার।জানি আমি, আমার আদরের তামু কে আমি ওই কাঁটা ছেঁড়া অবস্থায় কিছুতেই সহ্য করতে পারবো না।যখন ওকে দাফন করা হয় পূর্ব জানাজায় অংশ গ্রহণ করেছিলেন, আমি কলেজের সামনে গাড়িতে বসে তামুর জন্য কাদছিলাম। খুব করে মনে পড়ছিল আমার ওর কথা, কেন চলে গেল ওভাবে? আমি তো ওকে জন্মদিনে একটা সুন্দর জীবন উপহার দিতে চেয়েছিলাম,তূর্যের সাথে ওর এংগেজমেন্ট হতো ওদিন কিন্তু এটা কি হয়ে গেল?

‘ স্নিগ্ধ!’
পূর্বের ডাকে হুঁশ ফিরল আমার।চোখ দিয়ে আপনা থেকেই শ্রাবণের ধারা বয়ে চলেছে খেয়ালই করিনি।চোখ মুছে নিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম উনার দিকে।
‘ কিছু খাবে তুমি?মলে যাচ্ছি, তুমি গাড়িতেই থাকো। তোমার জন্য কিছু আনতে হবে নাকি বলো?'(পূর্ব)

আমি না বললাম। পূর্ব আমার গালে একবার হাত রেখে গাড়ি থেকে নেমে দরজা লক করে দিয়ে চলে গেল। মেইন রোডের একপাশে ফুটপাতে গাড়ি দাঁড় করানো হয়েছে। আশপাশে কত গাড়ি চলছে শব্দ করে। আমি সেদিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম আচ্ছা সেদিন কি সত্যিই তামুর এক্সি’ডে’ন্ট হয়েছিল?তামু আমাকে ওই রাতে বট গাছের ওখানে ডেকেছিল এই চৌধুরী পরিবারের রহস্যময় কাহিনী বলতে। কিন্তু বলতে পারেনি।ওর সাথে দেখা করার সময় কেউ আমাদের দেখে নিয়েছিল আর তামু এমনিতেই অনেক ভয় পেয়ে ছিল তাই মুখ ফুটে কিছু বলেনি।

শুধু বলেছিল তূর্য আর পূর্ব এদের অনেক বড় রহস্য আছে যেটা আর কেউই জানে না।কি রহস্য ছিল সেটা আর তামু বলতে পারল না। সত্যিই আমার তামুর এক্সি’ডে’ন্ট হয়েছিল তো নাকি ওকে খু’ন করা হয়েছে? এই চৌধুরী পরিবারের রহস্যময় কাহিনী আড়াল করে রাখতে,যেন সেটা কেউ জানতে না পারে। আচ্ছা তামুই বা এসব কিছু জেনেছিল কি করে,ওকে কে বলেছিল? এসব ভাবতে ভাবতেই আরো একটা বিষয় খটকা লাগলো আমার। তূর্য কে নিয়ে খটকা টা লাগল।

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ১৬

এতদিন শোকে কাতর হয়ে ছিলাম তাই এসব চিন্তা ভাবনা মাথায় আসেনি কিন্তু এখন এটা মাথায় এলো হুট করেই।বাইক তো তূর্য চালাচ্ছিল আর তামু পিছনে বসেছিল আমার যতদূর মনে হচ্ছে তাহলে তূর্যের বেশি আঘাত না লেগে আমার তামুর এতো বাজে ভাবে আঘাত লাগল কেন? আরো একটা বিষয়, আঘাত তূর্যের হাতে আর বুকের এক সাইডে লেগেছে তাহলে ও এমন পাগলের মত বিহেভিয়ার কেন করছে?আজ যখন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম তখন প্রথমেই ডাক্তার আমাকে একা ডেকে নিয়ে বলেছিলেন তূর্য মেন্টালি পুরোপুরি সুস্থ আছেন। তাহলে এসব তূর্য!

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ১৮