প্রণয়ের বিরহ পর্ব ১৮

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ১৮
তাসনিয়া রহমান স্নিগ্ধা

রাত আটটা বাজছে। পূর্ব আমাকে ধরে ধরে রুমে নিয়ে এসেছেন, হুটহাট তূর্য কে নিয়ে চিন্তা করার ফলে মাথাটা ধরেছে খুব তাই ঠিকভাবে হাঁটতে ও পারছিলাম না।টলে টলে পড়ে যাচ্ছিলাম, পূর্ব আমাকে রুমে নিয়ে এসে বেডে শুইয়ে দিলেন। রুমের দরজা টা লক করে দিয়ে পূর্ব কোট খুলছে আর আমি উনাকে নির্লজ্জের মত তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি।আজ আমাদের বিয়ের তিন মাস হতে চলল অথচ আমাদের সম্পর্কের এতটুকু ও উন্নতি হলো না।

আমি এই কয়দিনে পূর্বের মায়ায় খুব করে জড়িয়ে পড়েছি কিন্তু জানি না উনি আমাকে কি ভাবেন! উনার আচার আচরণ দেখে মনে হয় উনি ও আমাকে ভালোবাসেন কিন্তু আবার ভয় ও পাই।হতেও পারে উনি উনার দায়িত্ববোধ থেকে এসব করছেন; কিন্তু আজ এটার একটা হেরফের করে নেওয়া উচিত।হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপর থেকে মেডিসিনের প্যাকেট টা নিয়ে একটা মেডিসিন খেয়ে নিলাম।মাথা ধরা কমে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পূর্ব ফুল শার্ট খুলে একটা টি শার্ট পড়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসল বিজনেসের কাজ করতে। অনেক ডাউন হয়ে গেছে আমাদের বিজনেস টা, এটার জন্য পূর্ব সবসময় কেমন মনমরা হয়ে থাকে।ওর সবকিছু এই বিজনেস,আর এটাই এখন অর্ধেক হাতছাড়া হয়ে গেছে ওর থেকে।এক ঘন্টা পর পূর্ব ল্যাপটপ ছেড়ে উঠে বেলকনিতে গিয়ে বসলো। আমি বেড থেকে উঠে পড়লাম, মাথা ধরা অনেকটাই কমে গেছে এতক্ষণে।ড্রেসিন টেবিলের সামনে কতগুলো টাটকা গোলাপ ফুল রাখা, সকালে বাগান থেকে তুলে এনেছিলাম কি মনে করেই। সেগুলো দিয়ে বেড টা সাজিয়ে ফেললাম সুন্দর করে। পুরো বেডে গোলাপের পাপড়ি মেলে সাজিয়ে মাঝখানে হার্ট শেইপ করে রাখলাম।

এরপর আলমারি খুলে একটা লাল টুকটুকে সিল্কের শাড়ি বের করে পড়ে নিলাম চটপট।কুচি করে শাড়ি পড়েছি।হাত দুটো লাল রঙা কাঁচের চুড়ি দিয়ে ভরিয়ে ফেললাম, ঠোঁটে হালকা একটু লাল লিপস্টিক আর কপালে একটা কালো রঙের টিপ দিলাম।ব্যস আমার সাজ শেষ। এবার ড্রেসিন টেবিলের আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। মায়ের মতো চেহারা পেয়েছি আমি,লাল রঙের সাজে আমাকে আমার চোখে বেশ লাগছে। আয়নার দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। আমার এই সাজের হেতু আছে অনেক। পূর্বের ভালোবাসা সত্যি ই কি আমার জন্য, এটা আমার জানা দরকার আজই।

যদি পূর্ব আমাকে সত্যিই ভালোবেসে থাকে তাহলে উনি উনার আর তূর্যের কি রহস্য আছে সবকিছু ক্লিয়ার করে দিবেন আমার কাছে নিজেই। আমি জিজ্ঞেস করলে উনি বলতে বাধ্য থাকবেন নিজের প্রিয়তমার কাছে।আর আমি ও তামুর এক্সি’ডে’ন্ট এর রহস্য নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে পূর্ব কে আমার পাশে পাবো, আমার তামুর এক্সি’ডে’ন্ট এর পিছনে তূর্যের কোন হাত আছে কি-না সেসব জানতে হলে আমার পাশে পূর্ব কে প্রয়োজন।

আর পূর্ব আমার জন্য শুভ না অশুভ সেটা আজ উনার ভালোবাসার পরীক্ষা দিয়েই প্রমাণ হয়ে যাবে।বেডের মাঝখানে সুন্দর করে বসে রইলাম পূর্বের জন্য। লম্বা একটা ঘোমটা টেনে নিয়ে পূর্ব আসার অপেক্ষা করতে লাগলাম।কি আশ্চর্য আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা মূহূর্ত আসতে চলেছে আমার জীবনে অথচ আমার এটার জন্য কোনো রকম লজ্জা বা উৎকণ্ঠা কাজ করছে না। শুধু মন এটাই অপেক্ষা করছে পূর্ব কে যাচাই এর!!!

প্রায় বিশ মিনিট পর পূর্ব হাই তুলতে তুলতে রুমের ভিতর এলো।এসেই খানিকটা চমকে উঠলো রুমের এই বাহারি অবস্থা দেখে।ধাক্কা টা সামলিয়ে নিয়ে আমার পাশে এসে বসলেন উনি। কিছুক্ষণ নিরবতা চললো, আমার ভয় করছে এবার। হাজার হলেও মেয়ে তো আমি, এতক্ষণ লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে উনাকে যাচাই করতে নেমেছিলাম, কিন্তু এখন আর লজ্জা দমন করতে পারছি না। লজ্জায় নুয়ে রইলাম আর উনি চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। পাতলা আঁচল হওয়ার কারণে বাইরে থেকে স্পষ্ট আমার মুখখানি দেখা যাচ্ছে, উনি এদিকে ই তাকিয়ে।

‘ সারাদিন বাইরে ঘুরা ঘুরি করে অনেক ধকল গেছে তোমার উপর দিয়ে।আজ এসবের কি দরকার ছিল বলো?’
ঘোমটা টা খুলে দিয়ে বললেন পূর্ব। অপ্রস্তুত হয়ে পরলাম আমি,কি বলবো বুঝতে পারছি না। দাঁত দিয়ে নখ কাটতে লাগলাম, উনি আমার উত্তরের আশায় আমার দিকে তাকিয়ে আছেন এখনও। কিছুক্ষণ পর মনটা হঠাৎ করেই খুব খারাপ হয়ে গেল, আমি এতো সুন্দর করে সাজলাম উনার জন্য আর উনি এমন করছেন আমার সাথে? কান্না পাচ্ছে খুব।

মুখে কিছু বললাম না,কোল বালিশ টা মাঝখানে রেখে বালিশ নিয়ে শুয়ে পড়লাম।যা বুঝার বুঝে গেছি আমি, আর কোনো কিছুই দরকার নেই উনার থেকে পাওয়ার। কিছুক্ষণ পর পূর্ব ও শুয়ে পড়লেন, মেইন লাইট অফ করে ড্রিম লাইট অন করে দিলেন। একবার আমার দিকে পাশ ফিরে শুয়ে বললেন,

‘ আমাকে ভুল বুঝিও না। তোমার সুস্থতা, তোমার ভালো থাকা আমার কাছে সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।যেদিন আমি তোমাকে চাইবো সেদিন সাড়া দিও শুধু,এতেই আমি খুশি হবো। কান্না বন্ধ করে ঘুমাও এখন।'(পূর্ব)
আমি চুপ করে শুনে গেলাম শুধু,টু শব্দটি পর্যন্ত করলাম না। চোখ দিয়ে শ্রাবণের ধারা বয়ে চলেছে থামানোর কোন চেষ্টাই করলাম না। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম,,,,,,,,,,

ঘুম ভাঙল সকাল আটটার দিকে, মুখের উপর পানির ছিটা পেয়ে চোখ খুলে তাকালাম। দেখি পূর্ব হাতে পানির মগ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। তাড়াতাড়ি করে উঠে বসলাম, শাড়িটা ঠিক করে নিতে বেড থেকে নেমে সুতির একটা শাড়ি নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে চলে এলাম। আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে আবার কান্না পেল, এতো সেজে কিছু হয়নি আমার। উনি আমাকে ভালোবাসেন না কখনই, আমার তামু আর বিশেষ করে তূর্য আর উনার রহস্য খুঁজে বের করতে উনি আমার পাশে থাকবেন না এটা আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে গেছি।

ভুল মানুষকে ভালোবাসলাম আমি,অ পাত্রে আমার ভালোবাসা পড়লো। নিজের উপর রাগ হলো খুব,সব চুড়ি টেনে খুলতে শুরু করলাম। কাঁচের চুড়ি, জোরে টেনে খুলতে ভেঙে হাত কেটে গেল অনেকটা। সেদিকে খেয়াল নেই আমার,সব চুড়ি খুলে শাড়িটা বদলে নিলাম।ফ্রেশ হয়ে নরমাল লুকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। পূর্ব মুখটা কালো করে অফিসের জন্য রেডি হচ্ছেন, তখন উনাকে ওভাবে ইগনোর করে চলে আসবো এটা হয়তো উনি ধারণা করেননি। শার্টের বাটন লাগাতে লাগাতে উনি আমার দিকে ঘুরে তাকালেন, আমি শাড়িটা আলমারিতে তুলতে উনার চোখে চোখ পড়লো। সাথে সাথে ই চোখ নামিয়ে নিলাম। রুম থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দরজার দিকে এগিয়ে যেতে উনি চট করে আমার হাত টেনে ধরলেন।

‘ পালিয়ে যাচ্ছ কোথায়? কালকের জন্য রেগে আছো আমার উপর তাই না?'(পূর্ব)
আমি হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই উনি,,
‘ ত তোমার হাতে রক্ত এলো কোথা থেকে স্নিগ্ধ?হাত কেটে ফেলেছো নাকি তুমি হ্যা?’

বলে তিনি নিজেই হাতটা পরখ করে দেখতে হাতের এক পাশে লম্বা কাঁটা দাগ দেখে উনার বুঝতে অসুবিধা হলো না কিভাবে কেটেছে এটি।চোখ কটমট করে আমার দিকে একবার তাকিয়ে হাত ধরে টেনে বেডে বসিয়ে দিলেন।এরপরই রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন কোথায় যেন, পাঁচ মিনিট পর হাতে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে রুমে এলেন।বক্স থেকে সেইফ টি তুলা,ব্যান্ডেজ বের করছেন দেখে আমি উঠে দাঁড়ালাম।

‘ যাচ্ছ কোথায়, চুপচাপ বসে থাকো।ততক্ষণ না ব্যান্ডেজ করা হচ্ছে তুমি এক পা ও নড়বে না।'(বেশ রাগী গলায় বললেন পূর্ব)
‘ আমাকে নিয়ে আপনার চিন্তা ভাবনা করার কোন দরকার নেই মি. আজমীর চৌধুরী পূর্ব! আমি আমার হাত ঠিকই ব্যান্ডেজ করে নিতে পারবো। আপনি আপনাকে নিয়ে ভাবুন, আমার উপর খবরদারি করতে আসবেন না আর প্লিজ।’

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ১৭

একরাশ অভিমানী গলায় কথাগুলো বলে প্রায় দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। উনার সামনে যদি আর এক সেকেন্ড ও থাকি তাহলে নিজের কান্না আটকাতে পারবো না, আমি দুর্বল যে উনার প্রতি। কিন্তু আমি চাইনা উনি আমার দুর্বলতা টের পেয়ে যান, উনি উনার মতো থাকুন আর আমি আমার মতো।যখন আমাকে উনি ভালোই বাসেন না তখন আমার এতো কেয়ারের দরকার নেই উনার!

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ১৯