প্রণয়ের বিরহ পর্ব ১৯

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ১৯
তাসনিয়া রহমান স্নিগ্ধা

ড. শাওনের কেবিনের সামনে বসে আছি গত দেড় ঘন্টা যাবত। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সাড়ে এগারোটা বাজছে।বিরস মুখে আবার অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন ডাক আসবে।পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে ক্ষিদেয়, সকালে পূর্বের উপর রাগ করে কিছু খাই নি। শাশুড়ি মা, দাদী অনেক জোরাজুরি করেছিলেন খাওয়ার জন্য কিন্তু খাওয়াতে পারেন নি কিছুই।কেয়া চলে গেছে কালকেই, বাড়িটা পুরো ফাকা নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে।

বাড়িতে মন টিকছিল না,তাই ভাবলাম হসপিটালে এসে তূর্য সম্পর্কে সব কিছু তদন্ত করা শুরু করি নিজেই। পূর্ব কে আমার পাশে পাবো না এটা আমার বুঝা হয়ে গেছে।বাসা থেকে যখন হসপিটালে আসছিলাম গাড়িতে করে তখন লুকিং গ্লাসে দেখেছিলাম পূর্ব তার গাড়িতে হেলান দিয়ে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছেন।আমলে নিলাম না উনাকে, উনার দিকে আর কোনো ধ্যান জ্ঞান দিতে চাই না।
‘আপনিই কি মিসেস পূর্ব চৌধুরী? আপনাকে শাওন স্যার ডেকে পাঠিয়েছেন।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। একটা অল্প বয়সী মেয়ে উজ্জ্বল নীল রঙা স্কার্ট সেট পরা।তার উপর সাদা এপ্রোন পড়েছে, দেখতে বেশ ভালোই লাগছে মেয়েটাকে। আমার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে হাতের ইশারায় ভিতরে যেতে বললো।প্রতিউত্তরে আমি মুচকি হাসি উপহার দিলাম মেয়েটাকে। এরপর উঠে কেবিনে ঢুকলাম। পুরো কেবিনে শুধু মাত্র ড. শাওন আর আমি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন মানুষের উপস্থিতি নেই।বেশ ভালো লাগলো পরিবেশ টা,ড. শাওন পেপার দেখছিলেন। আমাকে ভিতরে আসতে দেখে ইশারায় উনার সামনে চেয়ারে বসতে বললেন। আমি বসলাম চেয়ার টেনে।

‘ স্যার, আপনাকে ফোন করে বলেছিলাম কিছু বোধহয়!’ (আমি)
আমার কথা শুনে ড. পেপার রেখে ঠিক হয়ে বসলেন। নাকের ডগায় রাখা চশমাটা খুলে রুমাল দিয়ে মুছে আবার চোখে লাগালেন। টেবিলের উপর কলমটা হাতে নিয়ে ক্রমাগত ঘুরাতে লাগলেন, ঘুরাতে ঘুরাতেই বললেন,,

‘ মামণি, আমি যে এই অহেতুক কাজটি করছি এটার কারণ টা কি তুমি বুঝতে পারছ?'(ড. শাওন)
‘ না স্যার। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।আর স্যার আমি আপনাকে ফোনে তূর্য সম্পর্কে কিছু বলতে বলেছিলাম, আপনি ও বলেছিলেন আপনি আমাকে এমন কিছু তথ্য জানাতে চান যেটা কেউই জানে না।আর আমার বোন যে কারণে মারা গেছে সেই কারণটাও আপনি জানেন, আমাকে আপনি তাই বলেছিলেন কিন্তু।প্লিজ স্যার আমার সব কনফিউশন আপনি দূর করে দিন,প্লিজ!!'(অনুনয়ের সুরে বললাম আমি)

‘ ওয়েল। আমি তোমাকে সব কিছু বলবো কিন্তু তার আগে তুমি আমাকে কথা দাও আমার কথার মাঝখানে কোনো রিয়েক্ট করতে পারবে না বা কোনো প্রশ্ন ও না।আগে সবকিছু শুনবে এরপর আমাকে যা খুশি জিজ্ঞেস করবে, কথা বলবে।আর হ্যা,হাতে বেশ কিছুক্ষণ সময় আছে তো?'(ড. শাওন)
‘ হ্যা স্যার, আমি আপনার সব শর্ত মেনে নিচ্ছি। আমার হাতে বেশ সময় আছে আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আপনি বলুন স্যার! সমস্ত রহস্যের জট খুলে দিন এবার।'(আমি)

ড. শাওন ঠিক হয়ে চেয়ারে বসলেন।দেখে মনে হচ্ছে বিশেষ কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন মনে মনে। আমি ও নিজেকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করে নিলাম ভ’য়’ঙ্ক’র কিছু শোনার জন্য। বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারছি শাওন স্যার এখন যা বলবেন তা আমার জন্য খুব সুখকর হবে না মোটেই। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত যেন হয়ে না পড়ি সেজন্য মনকে প্রস্তুত করলাম তূর্য আর পূর্বের সম্পর্কে কিছু জানার জন্য। ওদের রহস্যময় অধ্যায়গুলো আজ আমাকে স্যারের কাছ থেকে জানতেই হবে।

‘ শোনো তাহলে। আজকে যেটা আমি তোমাকে বলতে চলেছি আমি জানি তুমি এসবের কিছুই জানো না, এমনকি আমি, তাহমিমা ছাড়া আর কেউ জানে না এই বিষয়ে।তাই ধৈর্য ধরে সবটা শুনবে। তূর্য আর পূর্ব! দুই বন্ধু এরা, তুমি এবং পূর্বের পরিবারের সবাই এটাই জানো এবং মানো শুধুমাত্র আনোয়ার চৌধুরী ছাড়া। সত্যি কথা তো এটাই যে পূর্ব আর তূর্য দুজন একই বাবার সন্তান।

তূর্যের যখন জন্ম হয় তখন ওর মা মা’রা যান, এতো ছোট একটা বাচ্চাকে মানুষ করা একজন ব্যবসায়ীর পক্ষে নিতান্তই কষ্টকর,তার চেয়েও বড় কথা তূর্যের মা’কে আনোয়ার চৌধুরী লুকিয়ে বিয়ে করেছিলেন।ঘরে বউ থাকা সত্ত্বেও উনার তূর্যের মায়ের সাথে প্রেম ছিল আর সেই সূত্রেই বিয়ে।যখন তূর্য কে দেখাশোনা করার কেউ রইল না তখন তিনি পূর্বের মা’য়ের কাছে তূর্য কে নিয়ে আসেন।

কিন্তু তূর্য যে উনার সন্তান এই পরিচয় পূর্বের মা’কে তিনি কখনোই দেননি, পূর্বের একটা খেলার সাথী দরকার তাই তিনি অনাথ আশ্রম থেকে একটা বাচ্চা নিয়ে এসেছেন এটাই বলেন আফসানা চৌধুরী কে।সেই থেকে তূর্য আর পূর্ব একসাথে বড় হতে থাকে। আমি ও জানতাম না এসব কিছুই। আমি চৌধুরী বাড়ির ফ্যামিলি ডক্টর হওয়ার সুবাদে প্রায়ই ওই বাসায় যেতাম।যখন তূর্যের বয়স পনেরো বছর তখন হুট করেই ওর ম্যালেরিয়া হয়।

তখন সবচেয়ে বেশি ওকে নিয়ে টেনশনে ছিলেন আনোয়ার চৌধুরী, একটা অনাথ বাচ্চার জন্য এতো উদ্বিগ্ন আমি কাউকে হতে দেখিনি তাই কিছু টা সন্দেহ হয়। এরপর জেরা করতেই সব বলেন আনোয়ার চৌধুরী। এদিকে আমাকে যখন সবকিছু বলছিলেন আনোয়ার চৌধুরী তখন আড়ালে দাঁড়িয়ে তূর্য আর পূর্ব দু’জনেই সব শুনে নেয়।বহু কষ্টে ওদের দুজনকে সামলানো যায়।

এরপর বেশ কয়েক বছর সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই চলছিল কিন্তু তাতে বাধ সাধে যখন পূর্ব আর তূর্য বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষ ফিরে।দুজনেই ভ’য়া’ন’ক রকমের হি’ং’স্র হয়ে দেশে ফিরে। নারীর নেশায় পেয়ে বসে দুজনকেই। আমি কি বলতে চাইছি সেটা তুমি খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছো তাসনিয়া! একের পর এক অন্যায় করে যায় ওরা,যারাই এই দুই ভাইয়ের রাস্তায় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের কে শেষ করে দিয়েছে তখনই। কাউকে প্রাণে মে’রে ফেলেছে কাউকে প্রতিবন্ধী করে দিয়েছে।

এইসব দেখেও না দেখার ভান করে থাকেন আনোয়ার চৌধুরী। তিনি চাইলেও কিছু করতে পারেন না কারণ তূর্য তাকে হুমকি দেয় যে যদি ও কিছু করার চেষ্টা করে তাহলে ওর সমস্ত কালো সত্যি সামনে চলে আসবে। আনোয়ার চৌধুরী নিজের সম্মানের ভয়ে দুই ছেলের অন্যায় কে প্রশ্রয় দিলেও আমি এসব সহ্য করতে পারছিলাম না। কোনোভাবে এই দুজনকে থামাতে চাইছিলাম আমি। ওদের যেই বিজনেস টা আছে সেটা আসলে বর্তমানে নারী বিজনেস বলা চলে।

বাইরে থেকে এটা একটা আর সব কোম্পানির মতোই কিন্তু এটাতে যারা কাজ করতে যায় তাদের কি সর্বনাশ হয় সেটা তারা খুব ভালো করেই জানে। আমার নিয়মিত রোগী তোমার বোন তাহমিমা।সে ডিফেন্সের সিক্রেট এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে এটা বোধহয় তুমি জানো না, ইভেন আমি ছাড়া আর কেউই জানে না এই ব্যাপারে।তার সাথে আমি প্লান করি তূর্য আর পূর্বের রাজ শেষ করার।প্লান মাফিক তূর্যের সাথে রিলেশন এ যায় তাহমিমা আর সেখান থেকে বিয়ের সম্পর্কে গড়ায়।

তূর্য কে তাহমিমা হ্যান্ডেল করে নিল কিন্তু পূর্ব কে হ্যান্ডেল করা বেশ কঠিন কাজ তাই তোমার অজান্তেই তোমাকে আমাদের প্লানের অংশীদার করা হয়। পূর্বের সাথে তোমার বিয়েটা, সেটা সম্পূর্ণ আমার তাহমিমার প্লান অনুযায়ী হয়েছিল। সবকিছু আমাদের মত অনুসারে চলছিল কিন্তু মাঝখানে ফাইরুজ এসে সব ঘেটে দেয়।ও আমাদের আর তূর্যের ব্যাপারে সবকিছু জেনে যায়, এরপর পূর্ব কে আমাদের সম্পর্কে সবকিছুই বলে দেয়।

পূর্ব তো এসব শুনে সাথে সাথেই তোমাকে মে’রে ফেলতে চেয়েছিল কিন্তু ফাইরুজ ওর গোপন সত্য কথা নিয়ে ওকেই ব্লাকমেইল করতে শুরু করে। বারবার পূর্ব কে চাপ দেয় যেন পূর্ব তোমাকে ছেড়ে ফাইরুজ কে বিয়ে করে,আর পূর্বের বিজনেসের অর্ধেক প্রফিট ওকে দেয়। পূর্ব এতে রাজি হয়নি,পথের কাঁটা তূর্য সরিয়ে দেয় রোড এ’ক্সি’ডে’ন্টে এর মাধ্যমে।ফাইরুজ আর তার বাবার সেদিন বাড়ি ফেরার পথে রোড এ’ক্সি’ডে’ন্টে স্পট ডে’থ হয় । একটা পথের কাঁটা সরে গেলেও থেকে যাই আমরা তিন জন।

আমরা বেঁচে থাকা মানেই ওদের কাজে বাধার সৃষ্টি হওয়া তাই পূর্ব আর তূর্য একটা আলাদা প্লান করে আমাদের শেষ করার জন্য। ভাগ্যক্রমে আমি ওদের প্লানের ব্যাপারে কোনোরকমে জেনে গিয়েছিলাম তাই ওদের সাথে টক্কর দিতে আমরা ও উল্টো একটা প্লান বানাই। ওদের প্লান ছিল তাহমিমা কে ওর জন্মদিনে র দিন এক্সি’ডে’ন্ট করে শেষ করবে, সেজন্য আমি তাহমিমা কে এক্সি’ডে’ন্ট এর জন্য পুরো প্রস্তুত করি।দিনে দিনে সময় ঘনিয়ে আসে। ওদের প্লান অনুযায়ী এক্সি’ডে’ন্ট হয় এবং তাহমিমা ও গুরুতর আহত হয়।

আহত অবস্থায় যেই ছেলে গুলো ওকে হসপিটালে এনেছিল ওগুলো পূর্বের ঠিক করা ছিল আর সেদিন হসপিটালে আমি ইচ্ছে করেই নাইট ডিউটি তে ছিলাম তাহমিমার জন্য।যখন ওকে হসপিটালে নিয়ে আসা হয় তখন কায়দা মাফিক বডি চেঞ্জ করি, একটা ডেড বডির সাথে ম্যাচ করে তাহমিমার বডি চেঞ্জ করি আমি।এতে আমার এসিস্ট্যান্ট আমাকে সাহায্য করেছিল।তাহমিমার মুখটা ততোটা ও বিকৃত হয়নি কারণ ওর মুখের উপর আমি হার্ড মাস্ক ব্যবহার করতে বলেছিলাম।

ওদের প্লান বানচাল করা হয় আমাদের প্লান দিয়ে কিন্তু এর কিচ্ছুটি টের পায় নি তূর্য ও পূর্ব। ওদের দ্বিতীয় প্লান অনুযায়ী তূর্য পাগলের অভিনয় করা শুরু করে।কারণ ও যদি পাগল হয়ে যায় তাহলে ওর ট্রিটমেন্ট এর জন্য হসপিটালের কতৃপক্ষ ওকে হসপিটালেই রাখবে আর সেইসাথে ও সুযোগ বুঝে আমাকে শেষ করে দিতে পারবে। এখন ওদের দ্বিতীয় প্লান অনুযায়ী সবকিছু ঠিকঠাক চলছে!

প্লাস ওদের তৃতীয় প্লান কি জানো?এন্টিসেপ্টিক এ বিষ মিশিয়ে তোমাকে শেষ করা আর সেটা করবে পূর্ব নিজে। আচ্ছা তোমার কোথাও কেটে যায় নি তো আবার? পূর্ব তোমাকে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিল কি এর মধ্যে কোনো দিন?কুইক বলো তাসনিয়া!যদি করে থাকে তাহলে তোমার হাতে খুব বেশি সময় থাকবে না। আমার ও করার কিছু থাকবে না কারণ ওরা যেটা মেশাবে তার প্রতিষেধক এই বাংলাদেশে নেই।বলো!!!!!’ (বেশ তাড়া দিলেন শাওন স্যার)

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ১৮

আমি কোন রেসপন্স করতে পারলাম না। চুপচাপ শান্ত চোখে শুধু স্যারের দিকে তাকিয়ে রইলাম, এরপরই হঠাৎ করেই চেয়ার থেকে মাটিতে ঢলে পড়লাম ____

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ২০+২১