প্রণয়ের বিরহ পর্ব ৩১

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ৩১
তাসনিয়া রহমান স্নিগ্ধা

নিষিদ্ধ পল্লীতে ঢুকার সময় শুভ্রর গাড়ির পাশ দিয়ে সাই করে একটা গাড়ি বেরিয়ে গেল কিন্তু ওটা খেয়াল করলো না শুভ্র।ব্যস্ত হাতে গাড়ি ড্রাইভ করে নিষিদ্ধ পল্লীর মেইন পয়েন্ট যেই বাড়ি সেখানে এসে গাড়ি দাড় করিয়ে নেমেই বাড়ির ভিতরে দৌড়ে গেল। ভিতরে তখন সবকিছু চুপচাপ শান্ত, কেমন একটা গুমোট আবহাওয়া চারদিক। কোন বেশ্যালয় এরকম ঝিম ধরে থাকে এটা শুভ্রর জানা ছিল না তাই ব্যস্ত পায়ে সামনের একটা দরজায় উঁকি দিল।ঘরটা আম্মার।

ঘরে উঁকি দিতেই সারা শরীর কেঁপে উঠলো শুভ্রর,কি বিভৎস দৃশ্য! মেঝেতে দীপ্তি পড়ে আছে। চোখের পাতা খোলা,গ্যাজলা বেরিয়ে এসেছে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে। ছটফটানির চিহ্ন স্পষ্ট। হঠাৎ চাপা গোঙানির শব্দ পেয়ে একটু চমকে উঠলো আরেক দফায়। শব্দ অনুসরণ করে এগিয়ে যেতেই দেখলো আলমারির আড়ালে আম্মা পড়ে আছেন,রক্তের বন্যা বইছে তার শরীর থেকে।খুব সম্ভবত ছু*রি মা*রা হয়েছে তাকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দ্রুত পকেট থেকে ফোন বের করে হসপিটাল এ কল করে অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বললো। মিনিট বিশেক পরেই পো পো শব্দ তুলে অ্যাম্বুলেন্স ঢুকলো নিষিদ্ধ পল্লীতে।দীপ্তির ডেড বডি আর আম্মাকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স বেরিয়ে গেল। শুভ্র সাথে আসা নার্স কে বারবার বলে দিল আম্মাকে যেকোনো মূল্যে সুস্থ চাই।সে একটু পরেই হসপিটালে যাবে।নার্স মাথা দুলিয়ে সায় দিয়ে ওদের নিয়ে বেরিয়ে গেল।অ্যাম্বুলেন্স বেরিয়ে যাওয়ার পর শুভ্র এদিকে মনোযোগ দিলো ভালো করে।

এতকিছু ঘটে গেছে আর একটা মানুষ ও নেই আশপাশে।কেউ বেরিয়ে এলো না দেখে বেশ অবাক হলো সে। সবগুলো ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও কাউকে না পেয়ে ক্ষীণ সন্দেহ হলো মেসেজের মালিকের উপর।সে আবার এই মেয়েগুলো কে তুলে নিয়ে যায় নি তো?আর ধরা পড়ার ভয়ে আম্মা আর দীপ্তিকে শেষ করে দিয়ে গেছে। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি ও বের হলো কোনদিক দিয়ে, শুভ্র তো এই পথেই এসেছে।

‘অফফ শিট! আমি যখন আসি তখনই তো একটা বড় গাড়ি বেরিয়ে গেছে পাশ কাটিয়ে।ওই গাড়িতেই মেয়েগুলো কে নিয়ে যায়নি তো আবার?কি ভুল করে বসলাম আমি?’

দুহাতে মাথা চেপে ধরে তাড়াতাড়ি বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলো শুভ্র।কোনো না কোনো প্রমাণ রেখে যাওয়া উচিত তার, একেবারে নির্ভুল কাজ এত কম সময়ের মধ্যে করা সম্ভব নয়।কারণ মেসেজ এ বলেছিল ‘ পাখি শিকারের জন্য তিন ঘন্টার মধ্যে নিষিদ্ধ পল্লীতে আসছে শিকারী ‘।আর এখন হয়েছে দুই ঘণ্টা। আশপাশে ভালো করে তাকিয়ে ও কিচ্ছু টি খুঁজে পেল না শুভ্র। মানতে বাধ্য এই মেয়েটা খুব ধুরন্ধর। প্রচুর চালাক আর ক্রিমিনাল মাইন্ডের মেয়ে এটা, কোনোরকম প্রমাণ রাখেনি বাড়িতে বা বাইরে। একরকম হতাশ হয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে পুলিশ স্টেশনের দিকে ছুটতে থাকে।

ড. ফয়সালের কেবিনে মাথা নিচু করে বসে আছে তাহমিমা। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে কেবিনে ঢুকলো শুভ্র। পুলিশ স্টেশনে পৌঁছে জুয়েলের কাছে শোনে তাসনিয়ার জ্ঞান ফিরেছে আর তাহমিমা ওকে দেখতে এসেছে হসপিটালে।ব্যস সবকিছু ফেলে দৌড়ে এলো হসপিটালে।আই সি ইউ তে ঢুকতে যাবে তাড়াতাড়ি করে তখন আই সি ইউ এর বাইরে মিসেস সাবিনা কে কাঁদতে দেখে থমকে গেল।নিছক কৌতুহল বশত জিজ্ঞেস করতেই মিসেস সাবিনা বললো তাসনিয়া নাকি কাউকে চিনতে পারছে না। এমনকি তাকেও না।তাই শুভ্র আর সেখানে না ঢুকে ড. ফয়সালের কেবিনে এলো। তাহমিমা কে মাত্র কিছু বলতে যাবে এমন সময় শুভ্র কে দেখে থেমে গেল। ওকে ও সামনের একটা চেয়ারে বসতে বললো। শুভ্র একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে তাতে বসে পড়লো, এতো এতো চাপ আর শরীর নিতে পারছে না। দুহাতে মাথা চেপে ধরে ড. ফয়সালের দিকে তাকিয়ে রইল উৎসুক দৃষ্টিতে।

‘ দেখুন আপনাদের হয়তো বা মানতে কষ্ট হবে কিন্তু আমি আমার চেষ্টায় অপারগ এবার।মিস তাসনিয়ার ব্রেইন সেলস অতিরিক্ত প্রেশার নিয়ে ফেলেছিল। ফলস্বরূপ তার মেমোরি সেলস থেকে বেশ কিছু পুরোনো স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে। একেবারে হারিয়ে যায় নি সেটা।মনে পড়তেও পারে আবার নাও পড়তে পারে।সে কাউকে চিনতে পারছে না এমনটা কিন্তু নয়,সে জানে এই মানুষটি তার পরিচিত কিন্তু কিভাবে পরিচয় সেটা মনে করতে পারছে না।এটা মস্তিষ্কের একটা দীর্ঘ মেয়াদি রোগ।ব্রেইন ফিভার প্লাস ব্রেইনের ইন্টার্নাল ইনজুরিতে অপারেশন করানোর জন্য এটা বেশ ভালো ভাবেই জেকে বসেছে ওর ব্রেইনে। এখন সুস্থ হবে কিনা সেটা আমি বলতে পারছি না। হতে পারে হুট করে এখনই ওর ব্রেইন সেলস ঠিক হয়ে গেছে আবার এটাও হতে পারে আর কখনোই ঠিক হলো না।এটা আপনাদের মেনে নিতে হবে!’

এক দমে কথাগুলো বলে থামলো ড. ফয়সাল। দুজনের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো ওর কথা ওরা বিশ্বাস করেছে কিনা। তাহমিমা এতক্ষণ চুপ করে ছিল কিন্তু ফয়সালের কথা শুনে কাঁদতে শুরু করলো। শুভ্র ওকে শান্তনা দিতে গিয়েও পারল না।সে নিজেও বিপর্যস্ত এই খবরে। তাসনিয়ার সবকিছু খেয়াল হারিয়ে গেলে এই রহস্যের কুল কিনারা পাবে কি করে? সেদিন ও কেন হসপিটালে এসেছিল তখন আর কিইবা এইসবের সাথে তার যোগ সূত্র তা জানা সম্ভব নয় তাসনিয়া কে ছাড়া। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে ধীর পায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো বাইরে। এখন আম্মা কেমন আছে সেটা জানা দরকার…………

বেডে চুপচাপ বসে আছি। একটু আগেই একটা মেয়ে জোর করে খাইয়ে দিল।মাথাটা ঝিমঝিম করছে খুব। ঘন্টা খানেক আগে যখন চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলাম তখন শুনেছি কানের কাছে একটা ছেলের গলা ফিসফিস করে বলছে,
‘ স্নিগ্ধা,চোখ খুলে দেখো আমি তোমার কাছে ফিরে এসেছি?’

প্রায় সাথে সাথেই চোখ খুলে দেখি কেউ নেই।ভুত প্রেত ভেবে জোরে চিৎকার করে উঠেছিলাম।সেই চিৎকারে কয়েকটা নার্স এসে হাজির,আর তখন থেকে বসেই আছি। বারবার মনে হচ্ছে শুয়ে চোখ বন্ধ করলেই সেই গলা টা আবার চলে আসবে। কেন জানি খুব চেনা চেনা লাগছিল গলাটা, মনে হচ্ছে যেন অনেক দিনের পরিচিত কিন্তু আমার আশপাশের তো কেউ এরকম গলায় কথা বলেনা। এমন সময় একটা নার্স এল ওষুধ নিয়ে। মাথা নাড়িয়ে না করতেই ডক্টর এসে ইশারায় খেয়ে নিতে বললো।বাধ্য মেয়ের মত ওষুধ খেয়ে আবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখতে লাগলাম কেউ আছে কিনা। আমাকে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে ডক্টর নার্স সবাই চলে গেছে।আই সি ইউ পুরো ফাকা এখন।দরজা টাও বন্ধ। কেমন ভয় ভয় লাগছে,সাদা চাদর টা টেনে নিয়ে বেডের সাথে সিটিয়ে রইলাম।ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, মনে হয় ঘুমের ওষুধ দিয়েছে আবার। কিন্তু চোখ বন্ধ করা চলবে না,যদি আবার কেউ কানের কাছে এসে চোখ খুলতে বলে?

সকাল সাতটা বাজেনি এখনও। ফুরফুরে মেজাজে শুভ্র হসপিটালের বাইরে পায়চারি করছে। এসেছিল আম্মার কন্ডিশন জানতে।এসে শোনে তিনি এখন সুস্থ আছেন কিছুটা, একটু ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে চলে এসেছে। এখন ওসব বিষয়ে কথা বলা টা ভুল হতো। শুভ্র একমনে ভাবছে তাসনিয়ার কথা।কবে ও আগের মত সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে উঠবে কে জানে,ও সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তো ওদের খু’ন কে করেছে তা জানা যাবে না।

যদিও সবাই জানে পূর্বদের স্পট ডে’থ হয়েছে কিন্তু আদতে তা না। হসপিটালে নিয়ে আসার পর কেউ ওদের বিষ দিয়েছিল আর তারই প্রতিক্রিয়ায় ওদের প্রাণ গেছে। একবার মনে হয় তাসনিয়াই ওদের বিষ দিয়েছে আরেকবার মনে হয় না, একটা মেয়ে কখনোও তার স্বামীকে নিজের হাতে শেষ করতে পারে না।সে স্বামী যতই নিকৃষ্ট মানুষ হোক না কেন,কেউ চায় না নিজের গায়ে বিধবার ট্যাগ দিতে।আর সেই মেয়েটি কে,যে ওকে আড়াল থেকে সমানে হুমকি দিয়ে চলেছে আর এইসমস্ত কলকাঠি নাড়ছে।এসব তো তাসনিয়ার স্মৃতি ফিরলেই জানা যাবে। ততদিনে আবার খুব দেরি না হয়ে যায়?

প্রণয়ের বিরহ  পর্ব ৩০

আমি আমার দ্বারা যতটা সম্ভব রহস্য খোলাসা করার চেষ্টা করছি।আর হ্যা আজ থেকে রোজ গল্প দিবো ইনশাআল্লাহ!

প্রণয়ের বিরহ শেষ পর্ব