প্রণয়ের বিরহ পর্ব ৩০

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ৩০
তাসনিয়া রহমান স্নিগ্ধা

কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে শুভ্র ফুল স্পীডে গাড়ি ড্রাইভ করতে শুরু করলো।গাড়ি এগিয়ে চলেছে নিষিদ্ধ পল্লীর দিকে। এইমাত্র যেই মেসেজ টা এসেছে সেটা দেখে পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছে শুভ্রর।এই মেয়েটা চাইছে কি সেটাই শুভ্র বুঝতে পারে না। মনে পড়ে গেল তার পাঁচ বছর আগের কথা।যেদিন ও চাকরিতে জয়েন করে আর নারী পাচার সম্পর্কিত কেইস টা হাতে পায়। সেদিন বিকাল চারটায় ওর ফোনে একটা মেসেজ আসে।

সেখানে লেখা ছিল শুভ্র যেন এই কেইস টার দায়িত্ব না নেয়, ওদের মত যেন ওদেরকে চলতে দেয় নাহলে আগের অফিসারদের মত ওকে ও অকালে প্রাণ হারাতে হবে। কিন্তু শুভ্র সেটা না শুনে কেইস টা সম্পর্কে আরো বেশি উৎসাহী হলো। বিভিন্ন তদন্ত চালাতে চালাতে যখনই মেইন পয়েন্টে এলো তখনই আসিফ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। ফলস্বরূপ কেইস ইজ ক্লোসড্।কেইস ক্লোজ হলেও তার কাছে হুমকি বার্তা আসা থেমে থাকেনি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রতিনিয়ত নতুন নতুন হুমকি আসত,আসিফ দেশে ফিরলেও যেন শুভ্র এতে নাক না গলায় তা লেখা থাকতো। কিন্তু শুভ্র সেটা শুনলে তো!ও তদন্ত চালিয়ে গেল। তদন্ত করার সময় অনেক কালো সত্যি ওর সামনে চলে আসে। দেশের বাইরে নারী পাচার চক্রের সদস্যদের সাথে যার যোগাযোগ তাকে খুঁজে পেয়ে শুভ্র যতটা খুশি হয়েছিল কিন্তু ততটা অবাক ও হয়েছিল। দেশের নামকরা কোম্পানির মালিক আনোয়ার চৌধুরী আর তার মা মহুয়া চৌধুরী এইসব কিছুর মূলে।সবার প্রথমে ছিল আনোয়ার চৌধুরীর বাবা, বুড়ো ম’রে যাওয়ার পর ছেলে তার দায়িত্ব নিল।

তাই বলে আনোয়ার চৌধুরীর ছেলে গুলো ভালো থাকবে কেন,বিদেশ থেকে উচ্চতর পড়াশোনা শেষ করে শেষমেষ এই ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত হলো আনোয়ার চৌধুরীর দুই ছেলে। কিন্তু এরা রাতের আঁধারে নিজেদের কাজকর্ম চালিয়ে যেত তাই বাইরের লোকের কাছে পূর্ব আর তূর্য ধোঁয়া তুলসী পাতা। শুভ্র ও এগুলো জানতে পারতো না যদি না তাহমিমা তাকে সাহায্য না করতো।

ড.শাওন কবীর আর তাহমিমা দু’জনেই এইসব পাপ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কপাল গুনে পূর্ব ঘটনাক্রমে সবকিছু জানতে পারে আর প্রাণে মে’রে দেওয়ার হুমকি দিয়ে ড. শাওন কে নিজের দলে টেনে নেয়। তাহমিমা কে তখনও পর্যন্ত সবাই মৃ’ত হিসেবে জানতো তাই ওকে নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় নি।এটাই এতদিন শুভ্র জানতো। কিন্তু ভিতরের খবর ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। নারী পাচার চক্রের সাথে আনোয়ার চৌধুরী আর মহুয়া চৌধুরী ছাড়া আরও একজন যুক্ত ছিলেন আর সেটা হচ্ছে ড. শাওন কবীর।

তিনি পেশায় একজন ডাক্তার তার উপর পুলিশের লোক তাই কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পায় নি উনার এই গোপন কথাটা।ড. শাওনের বাড়ি তল্লাশি করে বিভিন্ন কিছু জানতে পারে যেগুলো এতদিন অজানা ছিল।তাহমিমার বয়ান আর বিভিন্ন প্রমাণ সাপেক্ষে শুভ্র সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আনোয়ার চৌধুরী, মহুয়া চৌধুরী, পূর্ব, তূর্য আর শাওন কবীর এরা সবাই একজোট হয়ে কাজ করতো। লোকচক্ষুর সামনে নিজেকে ভালো রাখতে তাহমিমা কে সাহায্য করে ড. শাওন আর তাহমিমার কাছে ও পূর্বের স্ত্রী তাসনিয়ার কাছে পূর্ব আর তূর্য কে খারাপ প্রমাণ করে। তাহমিমা ও ওর কথায় ভুল বুঝে ওর হাতের পুতুলের মত কাজ করে এতদিন।

কিন্তু বেশিদিন টিকে নি ড.শাওনের এই চাল। পূর্ব সবকিছু টের পায় আর অমানুষিক নির্যাতন করে ওর উপর। তাহমিমা কোনোরকমে পালিয়ে বেঁচেছে। তাসনিয়া ও বাঁচত না যদি পূর্ব ওকে নিষিদ্ধ পল্লীতে রেখে না আসতো। পূর্ব মানুষটা খারাপ হলেও মন প্রাণ দিয়ে তাসনিয়া কে ভালোবাসত।সে জানে ওরা যার জন্য কাজ করছে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেই ওদের সবাইকে কোনো না কোনো ভাবে মে’রে ফেলবে।যতই পালিয়ে যাক তার বাঁচার কোন উপায় থাকবে না।

কিন্তু ওদের মাঝখানে পড়ে তাসনিয়া কে যেন কোনোরকম কষ্ট পেতে না হয় তাই নিষিদ্ধ পল্লীতে রেখে আসে নিরাপদ জায়গায়।আর সব মেয়েদের জন্য ওটা যম খানা হলেও তাসনিয়ার জন্য সেটা শতভাগ নিরাপদ জায়গা ছিল। পূর্ব জানে তাসনিয়া নিজেকে নিয়ে কতটা সতর্ক, ওর গায়ে কেউ ছুঁতে আসলে ওকে তাসনিয়া শেষ করে দিবে এটা পূর্ব শতভাগ নিশ্চিত।আর একবার কাউকে প্রাণে মে’রে দিলে ও খুব সহজেই সাহস পাবে।

পূর্ব অন্যায় করেছে সাথে তার পরিবার ও।ওরা তো ওরা যার এজেন্ট তার হাতেই শাস্তি পাবে কিন্তু যে ওদের দিয়ে এই কাজগুলো করাচ্ছে তার ও তো শাস্তি প্রাপ্য।আর তাকে যেন নিজের হাতে শাস্তি দেয় তাসনিয়া সেজন্য ওকে তৈরি করতে নিষিদ্ধ পল্লীতে রেখে আসে। কিন্তু তাসনিয়া ভুল বুঝে ওকে।সে একজন কে খু’ন করে পালিয়ে যায় ঠিকই কিন্তু____ ।

যেদিন পূর্বদের গাড়ি এক্সি’ডে’ন্ট হয় আর ওদের সবাইকে হসপিটালে এডমিট করে সেদিন নাকি তাসনিয়া ও হসপিটালে এসেছিল কোন ডাক্তারের কাছে।এই জায়গাটাতেই খটকা লাগে শুভ্রর। একটা সুস্থ স্বাভাবিক মেয়ে যে কি-না দুই মাসে একবার ও হসপিটালে আসেনি সে হঠাৎ করেই সেদিনই সেই মুহূর্তে হসপিটালে কেন ছিল?

আবার সেদিন বিকেলেই ব্রেইন ফিভার প্লাস ব্রেইনের ইন্টার্নাল ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়ে কমায় চলে গেল। অপারেশন করানো হয়েছে একবছর হয়ে গেছে এখনও পর্যন্ত সুস্থ হয়ে উঠলো না। সেজন্যই শুভ্র সবকিছু ছেড়েছুড়ে পড়ে আছে তাসনিয়ার সুস্থতা নিয়ে।ও সুস্থ হলেই এই রহস্যের জট খুলবে। এই সবই ভাবছে আর ড্রাইভ করছে এমন সময় কল এলো শুভ্রর ফোনে। রিসিভ করে হ্যালো বললো,,

‘ হ্যালো!’
‘ হ্যা স্যার আমি তাহমিমা বলছি।আ স্যার আপনি কি বাইরে কোথাও বেরিয়েছেন? কতক্ষণ হয়ে গেল অফিসে এসেছি কিন্তু আপনার কোন পাত্তাই পাচ্ছি না।’
‘ হ্যা, আমার অফিসে আসতে একটু দেরি হবে। তুমি আর জুয়েল ও দিকটা সামলে নিও আর হ্যা, হসপিটালে আমি খবর নিয়েছি তোমার আর আসার দরকার নেই।’
‘ ওকে, ওকে স্যার।সি ইউ!’

কল কেটে গেল। শুভ্র ফোন রেখে দিয়ে ড্রাইভে মনোযোগ দিলো। আর মাত্র দশ মিনিটের পথ নিষিদ্ধ পল্লী।মনে মনে বারবার চাইলো মেসেজের কথা যেন সত্যি না হয়। মিসেস তারা খানমের যদি কিছু হয় তাহলে তো!কি সমস্যা ওই মেয়েটির কে জানে?ও ওর লক্ষ্য পূরণের জন্য আর কাকে কাকে শেষ করবে। পূর্বরা নাহয় ওর বিপদের কারণ ছিল কিন্তু বেচারি মিসেস তারা খানম কি করেছে?

হঠাৎ বিদ্যুতের মতো বুদ্ধির উদয় হলো শুভ্রর মাথায়।ওই নিষিদ্ধ পল্লী থেকেই তো মেয়েদের বাইরে পাচার করা হয় তার মানে সবকিছুর মূলে এই নিষিদ্ধ পল্লী আর মিসেস তারা খানম ওরফে আম্মা। ওখানে গেলেই আর ভালোভাবে তদন্ত করলেই সব বেরিয়ে আসবে। অহেতুক এতদিন অকাজে সময় নষ্ট করলো শুভ্র এটা ভাবতেই নিজের উপর বেশ রাগ হলো।

বিকেলে মিসেস সাবিনা হসপিটালে এলেন পাগলের মত দৌড়াতে দৌড়াতে।বেশ কিছুক্ষণ আগেই খবর পেয়েছেন তাসনিয়ার জ্ঞান ফিরেছে।আই সি ইউ এর সামনে একটা নার্স গার্ড দিচ্ছে, মিসেস সাবিনা কে জিজ্ঞেস করলো সে পেশেন্ট এর কি হয়। মিসেস সাবিনা তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন ‘মা হই আমি তার!’নার্স ভিতরে ঢুকতে দিলো শুনে।

চারপাশে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি আমি। কোথায় আছি কি করছি বুঝতে বেশ সময় লেগেছে আমার।যখন চোখ খুললাম দেখি সবকিছু সাদা। কিছুক্ষণ পর সব আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসে চোখের সামনে। নিজেকে হসপিটালের সাদা রঙের বেডে আবিষ্কার করে বেশ চমকে উঠেছিলাম পরে পাশেই থাকা ডক্টর স্বাভাবিক করলো।

‘ মা আমার, তুই আবার আগের মত হয়ে গেছিস?’
বলেই একটা মহিলা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।ডক্টর একটু দূরে দাঁড়িয়ে রিপোর্ট চেক করছিলেন । নিজেকে কোনোরকমে ছাড়িয়ে নিয়ে খেয়াল করলাম মহিলাটাকে, পরক্ষণেই তিনি আবার আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন।চুপ করে থাকলাম আমি। সবকিছু কেমন ঝাপসা লাগছে নিজের কাছে।কে ইনি আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। মনে হচ্ছে তিনি আমার পরিচিত কিন্তু তারপরও যেন বহু অচেনা। ভোঁতা যন্ত্রণা শুরু হলো মাথায়। দুহাতে মাথা চেপে ধরে চিৎকার করে উঠলাম আমি,সহ্য করতে পারছি না আমি আর। কিছু মনে পড়ছে না কেন?

প্রণয়ের বিরহ  পর্ব ২৯

খুব তাড়াতাড়ি সমাপ্তির পথে এগিয়ে চলেছি!আর এরপর কোন সিজন আসবে না এটার।আর হ্যা রহস্য কিন্তু সব খুলতে শুরু করেছে তারপরও যদি বলেন বুঝতেছি না তাহলে আমার অনুরোধ রইল শেষ হলে পড়তে। তাহলে জট বোঝা সম্ভব হবে আপনাদের পক্ষে।

প্রণয়ের বিরহ  পর্ব ৩১