প্রণয়ের বিরহ শেষ পর্ব 

প্রণয়ের বিরহ শেষ পর্ব 
তাসনিয়া রহমান স্নিগ্ধা

সময় বহমান, নদীর স্রোতের মত সময় এগিয়ে চললো কিন্তু শুভ্রর কেসের সমাধান হলো না আর।এক সপ্তাহ পেরিয়েছে। আম্মা কথা বলতে পারেন না,গলায় নাকি আঘাত লেগেছে ড. ফয়সাল বললো।মাঝে মধ্যে হসপিটালে এসে দেখে যায় তাসনিয়া আর মিসেস তারা খানমের অবস্থা।আর অফিসে ফিরে গিয়ে হাহুতাশ করে নিজের মনে। শুক্রবার সকালে বেশ তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙল শুভ্রর। মেসেজের টোনে ঘুম ভেঙেছে। ঘুমঘুম চোখে ফোনটা হাতে নিয়ে মেসেজ অপেন করেই তড়াৎ করে উঠে বসল বেডে।বড় বড় অক্ষরে লেখা,,

‘ HEY AYMAN SHUVRO, YOUR TIME IS START NOW. YOU JUST WAIT AND WATCH WHAT CAN I DO? GOOD BYE, SEE YOU VERY EARLY..’
আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ টা দেখে ঘুম সব উবে গেল শুভ্রর।এক সপ্তাহ হুম”কি মেসেজ বন্ধ ছিল কিন্তু আজ আবার শুরু হয়েছে। তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিল শুভ্র। নিজের জন্য তার একটুও চিন্তা হচ্ছে না,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

চিন্তা হচ্ছে তাসনিয়া আর মিসেস তারা খানমের জন্য। ওদের সেইফ টি দিতে হবে আগে। একটা নাম্বারে ডায়াল করে হসপিটালে কড়া গার্ডের ব্যবস্থা করলো শুভ্র। এরপর নিজেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো হসপিটালের উদ্দেশ্যে!
ধীর গতিতে চলা ট্রাকের ছাদ থেকে লাফিয়ে নিচে নামলাম। আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম কেউ এদিকে খেয়াল করেছে কি-না? কিন্তু তেমন কিছু চোখে পড়ল না দেখে নিশ্চিন্ত হলাম।

ট্রাক চলে গেছে।ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গেছে রাস্তাটা আর সেখানেই আমি দাঁড়িয়ে।রাস্তার একপাশে একটা বসার জায়গা দেখে হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম।বড় একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।বেশ ভালো লাগছে এখন। এতদিন নাটক করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছি একেবারে। এখন নাটকের পালা শেষ , এবার শুধু মুখোশধারী মানুষের মুখোশ খুলে সব সত্যি সামনে আনার পালা। রাস্তার দিকে তাকিয়ে যারপরনাই বিরক্ত হতে হলো,যার জন্য এখানে এসেছি সে কোথায়? এখনও আসলো না কেন? এমন সময় পিছন থেকে কে যেন আমার কাঁধে হাত রাখল। চকিতে ফিরে দেখি কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটি দাঁড়িয়ে আছে। মুচকি হেসে বলল,,

‘ আমাদের কাজ শেষ। এবার যা হওয়ার তা নিজে থেকেই সব হতে থাকবে।’
‘ সবকিছু স্বীকার করবে তো?দেখ যদি স্বীকার না করে তাহলে আমার এতো পরিশ্রম এত কষ্ট সব জলে যাবে।’
‘ এমনভাবে ফাসিয়েছি ওকে যে স্বীকার না করে উপায় নেই।নিজেই সুর সুর করে থানায় গিয়ে সমস্ত অপরাধ স্বীকার করবে নাহলে যে ওর প্রাণ প্রিয় জিনিস টা আমি শেষ করে দিবো!’

বলে তাহমিমা পকেট থেকে ফোন বের করে একটা ভিডিও প্লে করে দেখাল। ভিডিওটি তে দেখাচ্ছে একটা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে চেয়ারে বসে আছে,আর তাকে খেলনা দেখিয়ে হাসাচ্ছে জুয়েল। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে।এই সাংঘাতিক কাজটা ও করেছে কিভাবে? আর ড. ফ্লোরার নাতনি ফিলিসা।ফিলিসা ওর মায়ের কাছে লন্ডনে ছিল তাহলে তাহমিমা কি করে?

‘ তুই ওকে পেলি কোথায়?’
‘ জুয়েল কে পাঠিয়েছিলাম ওকে আনার জন্য।ফ্লোরা বুড়ি যখন রেগে হন্যে হয়ে বাংলাদেশে ফিরল তোকে আর শুভ্র স্যার কে শায়েস্তা করতে তখন আমি জুয়েল কে ওইদিক দিয়ে লন্ডনে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।সুযোগটা পুরো কাজে লাগিয়েছি!’
স্বস্তির হাসি হাসলাম দু’জনেই। অবশেষে এই পাপের নগরীর বিনাশ করা সম্ভব হয়েছে আমাদের পক্ষে।যেদিন জানতে পারলাম পূর্ব রা সবাই দোষী সেদিন মাথায় খু’ন চেপে বসেছিল।

ইচ্ছে করছিল সবগুলো কে নিজের হাতে শেষ করে দেই কিন্তু আমার আগেই ওদের উপর আরেকজন রাগ পুষে রেখেছিল,ওই ওদের হসপিটালে গিয়ে চুপিসারে বিষ দেয়। আমি ও গিয়েছিলাম ওদের সেই একই কাজ করতে কিন্তু আমি দেওয়ার আগেই ওরা মা’,রা যায়। কিন্তু তাৎক্ষণিক ভাবে আমার মনে হয়েছিল যে আমি ই বুঝি ওদের মে’রে’ছি তাই অস্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলাম।

হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার সময় পাশের বাসার ছেলেটা অন্য একটা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় আমাকে, ওখানেই প্রপার ট্রিটমেন্ট এর ব্যবস্থা করে আমাকে সুস্থ করে তোলে।তখন কথায় কথায় জানতে পারি ওই ছেলেটাই এসব করেছে । এরপর ছেলেটার কাছে সব জানতে পারি,কে এসবের পিছনে। সবকিছু জেনে পূর্বের জন্য খারাপ লেগেছিল খুব, হাজার হলেও স্বামী ছিল তো আমার।আর মহুয়া চৌধুরী, আফসানা চৌধুরী, আনোয়ার চৌধুরীর এই শাস্তি টা প্রাপ্য ছিল না।

ছেলেটা ও স্বীকার করেছিল যে ও পূর্ব আর তূর্য কে আলাদা করে চিনতে পারেনি তাই একসাথেই বিষ দেয়।যে এসবের মুলহোতা ওর চেলাদের তো শেষ করেছে এখন তাকে কিভাবে বাগে পাওয়া যায় সেটা নিয়ে বিস্তর পরামর্শ হলো আমাদের।প্ল্যান করলাম লম্বা।আর সেই প্ল্যান মোতাবেক সিটি হসপিটালে যেখানে ড. ফয়সাল চাকরি করে সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো আমাকে।এসব যে সত্য আর আমি সত্যিই অসুস্থ তা প্রমাণ করতে আয়মান শুভ্র কে মাঝখানে টানলো তাহমিমা।

বেচারা শুভ্র অনেক হেল্প করেছে আমাদের। দুর্ধর্ষ অফিসার,আর একটুর জন্য আমরাও ধরা পড়ে যেতাম ওর কাছে। আমাদের মোটিভ ছিল ফ্লোরা কে দেশে আনা,ও দেশে আসলে ওর সব চ্যালাদের খুঁজে বের করা সহজ হবে আমাদের কাছে আর এসব বংশ পরম্পরায় চলে আসা অন্যায় ও।

ড. ফ্লোরা!অন্যায় আর নারী নিয়ে ব্যবসামহলের এক আতঙ্কিত নাম। বিদেশে থেকে এসব অপকর্মকান্ড চালিয়ে যায়।দেশে কাজ করে তার সাঙ্গপাঙ্গরা। পূর্বের দাদা নিষিদ্ধ পল্লীর ব্যবসা শুরু করেছিল ঠিকই কিন্তু নারী পাচার চক্রের সাথে কোন যোগাযোগ ছিল না তার।বাবা মরে যাওয়ার পর আনোয়ার চৌধুরী নিষিদ্ধ পল্লীর দায়িত্ব নেন তখনও এসব ছিল না। সবকিছু শুরু হলো যখন দুই ভাই বিদেশে থেকে পড়াশোনা করে ফিরলো।

পড়াশোনা করতে গিয়ে কৌতুহল বশত ফ্লোরার লোকেদের সাথে মারাত্মক অপরাধ করেছিল পূর্ব আর তূর্য।ব্যাস শাস্তিস্বরূপ তাদের বাংলাদেশে এজেন্ট হিসেবে কাজ দেওয়া হয়। পূর্ব যেহেতু বাবার এই নিষিদ্ধ পল্লীর ব্যবসার কথা জানত তাই বিনা বাক্য ব্যয়ে রাজি হয় কাজ করতে।দেশে এসেও কাজ গোছাতে পারছিল না তখন ফ্লোরার আরেক এজেন্ট শাওন কবীর ওকে সাহায্য করে।

এতে ও যখন কাজ গুছিয়ে উঠতে পারছে না তখন বাধ্য হয়েই আসিফ কে পাঠায় দেশে। শুধু পূর্ব কে সব বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আসিফ যাওয়ার সময় কিছু ঘটনা ঘটিয়ে কেস খায়। পরে পুলিশের তাড়া খেয়ে লন্ডনে পালিয়ে যায় আবারই। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু মাথা বিগড়ে গেলো মহুয়া চৌধুরী আর শাওন কবীরের। মহুয়া চৌধুরী পাপের ভয়ে সবকিছু বাইরে বলতে চাইছিল আর শাওন কবীর তো সরাসরি অ্যাটাক করে বসে। তখন শুরু হয় দুজনের মধ্যে যুদ্ধ।

অবশ্য আয়মান শুভ্র সম্পূর্ণ অন্য কাহিনী জানে এসব নিয়ে।ফ্লোরা হাতের ইশারায় সবকিছু নাচায়, এদেরও নাচিয়েছে।যেই ছেলেটা আমাদের সাহায্য করেছে সে ফ্লোরার প্রতি রাগ পুষে রেখেছিল চার বছর ধরে।ও একটা মেয়েকে খুব ভালো বাসত কিন্তু তার উপর নজর পরে আসিফের।

পাগলা কুকুরের মত ছিঁড়ে খেয়েছিল ওর ভালোবাসা কে আর এতে কেউ কিচ্ছু করতে পারে নি।ফ্লোরার সাম্রাজ্যে ওর আইন চলে তাই কারোর কিছু বলার সাহস নেই।বুকে তুষের আগুন ধরিয়ে দেশে ফিরে ছেলেটা। তখন থেকেই ওর লক্ষ্য ফ্লোরাকে তার সবকিছু সহ নির্মূল করা।আর আজ ও আমরা সবাই সফল।আর কোনো মেয়ের কপাল পুড়বে না নিষিদ্ধ পল্লী বা বিদেশে পাচার হয়ে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে থানার দিকে পা বাড়ালাম। আমার মা, জন্মদাত্রী মা সেখানে আমার অপেক্ষা করছে।

এর পরের ঘটনা অতি সংক্ষিপ্ত। নিজের নাতনি কে বাঁচানোর জন্য শেষ পর্যন্ত থানায় গিয়ে শুভ্রর কাছে জবানবন্দি দেয় ড. ফ্লোরা। শুভ্র সব শুনে হতবাক হয়ে গিয়েছিল কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে ফ্লোরা কে এরেস্ট করে।আর ওর থেকে ওর সব সাঙ্গপাঙ্গদের নাম ঠিকানা জেনে নিয়ে ওদের ও এরেস্ট করে।আদালতের আইন অনুসারে এত বড় বড় অন্যায়ের জন্য মৃ’ত্যু’দ’ন্ড দেওয়া হয় ফ্লোরা ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের। সবকিছু ঠিক হয়ে যাওয়ার পর তাহমিমার সাথে দেখা করেছিল শুভ্র। একদিন সন্ধ্যায় রমনা পার্কে ডাকল তাহমিমা কে।

‘ ডেকেছেন কেন স্যার?’
‘ আমায় বিয়ে করবে? হসপিটালে প্রতিনিয়ত বিয়ে নিয়ে এত কথা বলেছি যে এখন একটা বিয়ে না করলেই নয়।আর তোমার মত সাহসী ও ডিটেকটিভ মেয়েকে বউ হিসেবে পেতে আমার কোন আপত্তি নেই। তোমার আমাকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে আপত্তি আছে?’

তাহমিমা কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়ল। লজ্জায় নুইয়ে পড়েছে বেচারি।এই কাজ চলাকালীন সময়েই শুভ্রর প্রেমে পড়েছিল তাহমিমা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাসনিয়া কে সব জানিয়েছে, তাসনিয়া ও খুশি হয়েছিল এটা শুনে। শুধু অপেক্ষা ছিল শুভ্রর পজিটিভ রেসপন্স এর, সেটাও পূর্ন হলো। পশ্চিম দিগন্তে তখন সূর্য হেলে পড়েছে, সূর্যাস্তের কি সুন্দর দৃশ্য।ডুবে যাওয়া আলোয় এক লজ্জায় রাঙা হয়ে যাওয়া মেয়ের মুখ দেখা যাচ্ছে!কি সুন্দর,কি সুন্দর সেই মুখখানি।

সমাপ্ত

আসসালামুয়ালাইকুম।আর কেউ কোনো অভিযোগ করতে পারবেন না কারণ সম্পূর্ণ রহস্য খোলাসা করে দিয়েছি। গল্পটা যতটা ভেবেছিলাম ততটা লিখতে পারিনি আমি সেজন্য দুঃখিত।তবে হ্যা গল্পের রহস্য খোলাসা করে দিয়েছি সেজন্য সমাপ্ত এটা।আর কোনো সিজন আসবে না। পুরোপুরি এই গল্পের সমাপ্তি।আর আপনাদের সমস্ত রাগ আজকে থেকে মুছে ফেলুন।এই অনিয়মিত লেখনিতে আর বিরক্ত হবেন না। আমি আপনাদের এই রাগ, অপেক্ষা বড্ড বেশি মিস করব। দোয়া করবেন আমার জন্য, আমি যেন আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি, আল্লাহ হাফেজ!

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ৩১