প্রণয়ের বিরহ পর্ব ২৯

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ২৯
তাসনিয়া রহমান স্নিগ্ধা

সকাল সাতটা বাজে। তাহমিমা তাড়াতাড়ি করে ঘুম থেকে উঠেই অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিলো। অফিসিয়ালি সে এখন পুলিশ অফিসার আয়মান শুভ্রর এসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করছে। জুয়েল আর তাহমিমা দু’জনেই আয়মান শুভ্রর এসিস্ট্যান্ট এখন।কালো শার্ট আর কালো রংএর জিন্স প্যান্ট পড়েছে তাহমিমা।সাথে কোমরে কালো গান বেল্ট।আইডি কার্ড ঝুলছে বেল্টের এক কোণে। মাথার চুল গুলো ঝুটি করে বাধতে বাঁধতে রুম থেকে বের হচ্ছে তখনই বাধা পড়লো সামনে। মিসেস সাবিনা দরজার সামনে দুহাত মেলে দাঁড়িয়ে,,

‘ কি হলো টা কি মা? এভাবে কাকতাড়ুয়া সেজে দাঁড়িয়ে আছো কেন, ঘরে কি পাখির উপদ্রব হয়েছে আজকাল নাকি তোমার কাকতাড়ুয়া সাজার শখ জেগেছে?'(বিরক্ত হয়ে বলল তাহমিমা)
‘ তোর যেটা ইচ্ছা ভাব কিন্তু আজ আমি তোকে না খেয়ে যেতে দিবো না। চুপচাপ গিয়ে খাবার টেবিলে বস, আমি নিজে হাতে তোকে খাইয়ে দিবো এরপর অফিসে যাবি। বুঝতে পেরেছিস?'(মিসেস সাবিনা)

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ আদরের মা জননী আমার, আমি যদি এখন খেতে বসি তাহলে তোমার মেয়েকে সুস্থ করে বাড়িতে নিয়ে আসার সময় আরোও পিছিয়ে যাবে।যদি চাও তোমার মেয়ে তাসু আবার আগের মত স্বাভাবিক হয়ে যাক তাহলে আমাকে যেতে দাও।’
বলে পাশ কাটিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো তাহমিমা। বাড়ির সামনে অফিসের গাড়িটা নিয়ে অপেক্ষা করছে জুয়েল। গাড়িতে উঠে বসলো তাহমিমা। সাথে সাথে জুয়েল গাড়ি স্টার্ট দিলো। হালকা স্পিডে গাড়ি পুলিশ স্টেশনের দিকে এগিয়ে চললো।

‘ ডক্টর! আপনার কি মনে হয় উনি কি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবেন? দেখুন ডক্টর ইটস্ এমার্জেন্সি কেইস। উনার সুস্থতা আমাদের জন্য খুবই জরুরি, শুধু উনার বয়ানের উপরেই বিখ্যাত নারী পাচার চক্রের সদস্যদের ধরা ছোঁয়া নির্ভর করছে।’
ব্যস্ত কন্ঠে বলল আয়মান শুভ্র।এক বছর হয়ে গেল নারী পাচার চক্রের সদস্যদের মৃ’ত্যু’র কারণ রহস্য সব বাইরের আমজনতার কাছে চুকেবুকে গেছে।

কিন্তু পুলিশ অফিসার আয়মান শুভ্রর কাছে এই কেইস নিত্য নতুন রূপ দেখাচ্ছে, একেকবার একেক মোড় নিচ্ছে।ভোর চারটা থেকে হসপিটালে বসেছিল শুভ্র। তিনটার দিকে তাসনিয়ার চিকিৎসা করছেন যেই ডক্টর তিনি হঠাৎ করে কল করে শুভ্র কে হসপিটালে আসতে বলেছেন এমার্জেন্সি।তাসনিয়ার নাকি জ্ঞান ফিরছে! খবর পেয়ে এক মুহূর্তও নষ্ট না করে শুভ্র পাগলের মত হসপিটালে ছুটে এলো।

কারণ তাসনিয়ার উপর এই রহস্যময় কেইসের সবকিছু নির্ভর করছে। হসপিটালে এসে শোনে জ্ঞান ফিরার চান্স দেখেছিল একবার কিন্তু এখন আর নেই। তারপরও অপেক্ষা করতে লাগলো বেচারা শুভ্র। কিন্তু কোন খবর না পেয়ে বাধ্য হয়ে সকাল সাতটায় ডক্টরের কেবিনে গিয়ে উক্ত কথাগুলো বলে উঠলো শুভ্র। শুভ্রর কথায় ডক্টর ফয়সাল বেশ অবাক হলো,কেইস তো কবেই ক্লোজ হয়ে গেছে তাহলে আবার কি?

‘ স্যার কেইস তো ক্লোজ হয়ে গেছে না? আপনি তো তাসনিয়া ম্যামের রিলেটিভস তাই ওকে সুস্থ করে তুলতে চাইছেন বলেছিলেন। তাহলে এখন এসব কি বলছেন আবার?’
ড. ফয়সালের প্রশ্নে বোধোদয় হলো শুভ্রর।মুখ ফসকে কি বলতে কি বলে ফেলেছে? এখন সামাল দেওয়া দায়। কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থেকে ভেবে নিল কি বলবে। এমনিতেই যা চালাক এই ডক্টর, ঠিক কথার মারপ্যাঁচে সবকিছু পেট থেকে বের করে আনবে।

‘ আসলে অতিরিক্ত চিন্তায় কি বলছি কি করছি আমি নিজেই বুঝতে পারছি না। আমার মনে হয় আমার নার্ভ উত্তেজিত হয়ে গেছে তাই অতীত নিয়ে ভুলভাল ব’ক’ছি।বলছি যে তাসনিয়ার সুস্থতা আমার জন্য খুব বেশি জরুরি। আমার মা চায় তার বোনের মেয়েকে আমি বিয়ে করি। আমার মায়ের পছন্দ ই,,,,,'(আয়মান শুভ্র)
‘ থাক,রক্ষে করুন আমাকে। আপনার এই মায়ের আর আপনার চাওয়ার গল্প শুনতে শুনতে গত এক বছরে আমার কান ঝালাপালা হয়ে গেছে মশাই। আল্লাহ করে মিস তাসনিয়া তাড়াতাড়ি কমা থেকে বেরিয়ে আসুন আর তাকে নিয়ে আপনি এখান থেকে বিদায় হলেই বাঁচি আমি।’

শুভ্র কে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ঝাঁঝ গলায় বলল ড. ফয়সাল। শুভ্র আঁশটে মুখ করে অন্য দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে উঠলো।ড. ফয়সাল শুভ্রর সামনে হাত জোর করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন তাই শুভ্রর হাসি দেখতে পেলেন না। ভিতরের কথা গোপন রাখতে বেশ লম্বা একটা মিথ্যা গল্প বানিয়েছে শুভ্র আর সেই গল্প নিয়ম করে রোজ একবার ড. ফয়সাল কে শোনায়।

প্রথম যেদিন তাসনিয়া কে তাহমিমা হসপিটালে ভর্তি করায় তখন শুভ্র পূর্বদের ডেড বডি দেখার জন্য হসপিটালে এসেছিল। তাসনিয়ার অস্বাভাবিক অবস্থা দেখে হসপিটাল কতৃপক্ষ ভর্তি নিতে চাইছিল না তখন শুভ্র ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করে। তাহমিমা আর মিসেস সাবিনা কে কোনোরকমে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে ড. ফয়সালের কাছে গিয়ে ইমোশনাল একটা নাটক করে যেন তাসনিয়া কে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলে।

এর পিছনে একটা কারণ ও আছে, তাসনিয়া পূর্বের স্ত্রী তাই ওর মৃ*ত্যুর আসল কারণ সম্পর্কে কিছু না কিছু তাসনিয়া জানবে আর তাই এই নাটক।ইনিয়ে বিনিয়ে বিশাল বড় একটা কাহিনী বলে ডক্টরের কাছে।ব্যস ডক্টর গলে গিয়ে পেশেন্টের আসল পরিচয় গোপন রেখে চিকিৎসা করতে রাজি হয়ে গেলেন।

আর এরপর থেকে যতবারই ড. ফয়সাল তাসনিয়ার বিষয়ে বা অন্য কোনো বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেছেন শুভ্র কে তখনই শুভ্র সেই কাহিনী শুনিয়েছে। এমনকি না জিজ্ঞেস করলেও দিনে একবার ফয়সালের কানের কাছে এই কাহিনী তুলবেই সে। কাহিনী শুনতে শুনতে ফয়সালের নিজেরই এই কাহিনী হুবহু মুখস্থ হয়ে গেছে। কপাল করে তার ভাগ্যেই জোটে এসব পাগল পেশেন্ট আর পাগল পুলিশ অফিসার!

‘ আসলে ডক্টর আমার মা তো বয়স্ক হয়ে গেছে,,,,,,,’
‘ গেট আউট ফ্রম মাই কেবিন।’
প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বললেন ড. ফয়সাল। কাচুমাচু হয়ে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল শুভ্র। পুরো কথাটা শেষ ও করতে দিল না।রোজ এই এক ঘটনা ঘটে তার সাথে। তাসনিয়া কে নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেছে মানেই সেই মায়ের কাহিনী শুরু আর ডক্টর রেগে গিয়ে কেবিন থেকে বের করে দেন।

‘ আমি আপনার এই উত্তেজিত নার্ভ ঠান্ডা করার ওষুধ লিখে দিচ্ছি সেগুলো খাবেন আর দিনরাত ঘুমাবেন। তাহলে একটু হলেও আপনি এই কাহিনী ভুলে যেতে পারবেন। এখন বিদেয় হন আমার কেবিন থেকে,মিস তাসনিয়ার জ্ঞান ফিরলে আমি নিজেই তাকে নিয়ে আপনার বাসায় রেখে আসবো কিন্তু আপনি আর হসপিটালে আসবেন না।আর হ্যা,দয়া করে আপনার বাসায় গেলে সবার সামনে অন্তত এই মায়ের ইচ্ছা আর আপনার চাওয়ার কাহিনী বলতে শুরু করবেন না। এবার আসুন আপনি!’

বেশ কাটকাট কথাগুলো বললেন ড. ফয়সাল। শুভ্র একটা হাসি দিয়ে সম্মতি দিল এরপর শান্তভাবে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো। ফয়সাল একটা জোরে নিঃশ্বাস ফেলে হাত পা ছড়িয়ে চেয়ারে বসে পড়ল।সে ভেবে পায়না এমন পাগল ধরনের লোককে কে পুলিশ অফিসার বানিয়েছে।রোজ এক কাহিনী তা-ও সবসময়,ধ্যাৎ!

কেবিনের বাইরে বেরিয়ে এসে শুভ্র কিছুক্ষণ আশপাশে তাকিয়ে সবকিছু ঠিক আছে কিনা দেখে নিল।তার দুজন স্পাই ছদ্মবেশে পাহারা দেয় তাসনিয়া কে।আই সি ইউ তে কে কে যাচ্ছে কখন যাচ্ছে কি নিয়ে যাচ্ছে প্রতিমুহূর্তে তার আপডেট জানায় ওকে কিন্তু কেউ কিচ্ছু টি টের পায় না। দুজনেই ইশারায় বললো সবকিছু ঠিক আছে। শুভ্র আশ্বস্ত হয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এলো বাইরে।

নিজের কাজকর্মের জন্য লজ্জিত হয় বারবার, একজন পুলিশ অফিসার হয়ে কিছুটা পাগলামি করে তা-ও আবার ডক্টরের সাথে কিন্তু কোন উপায় নেই তার কাছে। ভিতরের কোন খবর লিক হতে দেওয়া যাবে না।সে জানে এই ডক্টরের তাসনিয়াকে নিয়ে খুব বেশি কৌতুহল জমেছে ,সে অনেক কিছুই জানতে চায় তার সম্পর্কে। কেননা দীর্ঘ এক বছর ধরে কাউকে পরিচয় লুকিয়ে চিকিৎসা করানোটা স্বাভাবিক বিষয় নয়।

কিন্তু শুভ্র নিরুপায়,এই ডক্টরকে কিছু বললেও ও কাউকে বলবে না সে জানে কিন্তু তারপরও আলগা নিরাপত্তার জন্য এই নাটক চালাতে হবে। আজকে একটুর জন্য ধরা পড়ে যাচ্ছিল কিন্তু কাহিনী টা বাঁচিয়ে দিল তাকে। আনমনে হেসে উঠলো শুভ্র!জব্বর একটা ঘটনাই বটে, কিন্তু ডক্টর এতদিন ধরে এই কাহিনী সহ্য করেছেন এটাই ঘাট।বশ ধৈর্য আছে বলতে হবে,বলে শুভ্র গাড়ি স্টার্ট দিলো।

ধীরে ধীরে ড্রাইভ করছে শুভ্র।হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো আটটার কাঁটা ছুঁইছুঁই করছে ঘড়ি। তখনই টুং টুং শব্দ করে ফোনের মেসেজ টোন বেজে উঠলো। গাড়িটা রাস্তার একপাশে থামিয়ে দিয়ে ফোন হাতে নিয়ে মেসেজটা অপেন করলো শুভ্র। বিস্ফোরিত চোখে কিছুক্ষণ ফোন স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল শুভ্র। মনে মনে বারবার বললো,,
‘এসব মিথ্যে। আমি যা দেখেছি সব মিথ্যে, কিচ্ছু সত্যি না।এই মেসেজ মিথ্যে,এটা আমার কল্পনা!’

প্রণয়ের বিরহ  পর্ব ২৮

(ইদানিং খুব ব্যস্ত তারপরও গল্পটা লিখে ফেললাম। বিশেষ করে তাদের জন্য যারা আমার বার্থডেতে ট্রিট চাইছিলেন।নেন আপনাদের ১৬ ই জানুয়ারির ট্রিট দিয়ে দিলাম 😐)

প্রণয়ের বিরহ  পর্ব ৩০