প্রণয়ের বিরহ পর্ব ২৮

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ২৮
তাসনিয়া রহমান স্নিগ্ধা

‘ স্যার, একটা ভালো খবর আছে!’
পুলিশ অফিসার আয়মান শুভ্র বহু বছরের পুরোনো একটা ফাইল ঘাটছিলেন তখন জুনিয়র অফিসার এসে ফিসফিস করে কথাটা বলল। শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল জুনিয়রের দিকে। ওকে বহুবার বলা হয়েছে যখন শুভ্র কোন ফাইল ঘাটবে তখন যেন ওকে কোনোরকম বিরক্ত না করা হয় বিশেষ করে বিখ্যাত নারী পাচার চক্রের সদস্য আসিফের ফাইল ঘাঁটাঘাঁটি করার সময়।আর এ কি-না!

‘ আচ্ছা,জুয়েল তুমি কি কখনও শুধরাবে না?দেখছিলে তো আমি ফাইলটা দেখছি এখন এটা বলার কি দরকার ছিল তোমার, খবর ভালো সেটা পরেও বলতে পারতে তো।একেই আসিফ দেশে ফিরেছে দেখে টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে আমার,না জানি এখন আবার কি ঘটায় ?’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বেশ চিন্তিত গলায় বলল আয়মান শুভ্র।আসিফ তার পুলিশ জীবনের প্রথম কেইস ছিল আর এখনও তাই আছে। ওকে ধরার জন্য কত কিছু করেছে কিন্তু ফলাফল শূন্য।যেদিন এরেস্ট ওয়ারেন্ট পেল সেদিন শোনে আসিফ দেশ থেকে পালিয়ে গেছে।আর এতদিন পর আবার ফিরে এলো। এবার ওকে ধরতেই হবে, নাহলে পুলিশে চাকরি করাটা ব্যর্থ আয়মান শুভ্রর জন্য। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো শুভ্রর, ধরতে পারবে কি ওকে? জুনিয়র অফিসার জুয়েল স্যারের ধমক খেয়ে কিছুক্ষণের জন্য দমে গেলেও আবার স্বাভাবিক ভাবেই বললো,

‘ স্যার! খবরটা গুরুতর। আপনার আমার এমনকি পুরো দেশের মানুষের জন্য খুশির খবর বলতে গেলে। আপনি তো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পেয়ে যাবেন খবরটা শুনে!'(উল্লাসিত গলায় বলল জুয়েল)
‘ কি এমন খবর,বলো শুনি। না বলে তো আর ছাড়বে না আমাকে, তোমার যা স্বভাব।'(শুভ্র)
‘ স্যার ওই চক্রের সদস্যরা সবাই রোড এ’ক্সি’ডে’ন্ট এ মা’রা গেছে কিছুক্ষণ আগেই।'(জুয়েল)
‘ হোয়াট?’

প্রায় চিৎকার করে উঠল শুভ্র।কানে কিছু ভুল শুনলো নাকি,ওরা মা’রা গেছে মানে তা-ও আবার রোড এক্সি’ডে’ন্ট এ, ইটস্ আ জোকস্ শিওর!

‘ হ্যা স্যার আমি সত্যি বলছি। পূর্ব, তূর্য, আনোয়ার চৌধুরী, মহুয়া চৌধুরী, আফসানা চৌধুরী,ড. শাওন,আসিফ এরা সবাই আজ একসাথে সেলিব্রেট করতে ট্রেনে করে জাফলং যাওয়ার প্ল্যান করেছিল।প্ল্যান মোতাবেক স্টেশনে যাওয়ার পথে ট্রাকের সাথে ওদের গাড়ির এক্সি’ডে’ন্ট হয় আর তখনই! কিন্তু স্যার আশ্চর্যের ব্যাপার এটাই যে ওদের কারোর স্পট ডেথ হয়নি,সবাই হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার প্রায় ঘন্টাখানেক পর একসাথে মা’রা গেছে।ঢাকা মেডিকেল কলেজের হসপিটালের মর্গে ওদের ডেড বডি রাখা হয়েছে। আপনাকে এক্ষুনি যাওয়ার জন্য ডক্টর খবর পাঠিয়েছেন। আপনি আসুন আমি গাড়িতে যাচ্ছি।’

এটুকু বলেই জুয়েল বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। শুভ্র এখনও হা করে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে ঠিক যেখানে জুয়েল দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই ওর দৃষ্টি। কথাগুলো হজম করতে বেশ সময় লাগল শুভ্রর।ওরা নিজে থেকেই রাস্তা থেকে কিভাবে সরে গেল?আর পূর্বের গাড়ি করেছে ট্রাকের সঙ্গে এক্সি’ডে’ন্ট,ব্যাপারটা কেন জানি অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে শুভ্রর কাছে। আনমনে অফিস থেকে বের হতে যাবে তখন কল এলো ওর ফোনে। আননোন নাম্বার থেকে কল দেখে রিসিভ করে হ্যালো বললো। কিন্তু অপর পক্ষের কোনো জবাব নেই। কোন রেসপন্স নেই দেখেও কিছুক্ষণ হ্যালো হ্যালো করেই গেল। শেষমেষ বিরক্ত হয়ে কল কাটবে তখন একটা মেয়েলি কন্ঠ ভেসে এলো,,

‘ বিরক্ত হয়ে গেলেন নাকি আয়মান শুভ্র? নাকি পথের কাঁটা সরে যাওয়ায় আনন্দে আত্মহারা হয়ে আছেন?যদি আপনার কাজ দ্বিতীয়টি হয় তাহলে একটা চাঞ্চল্যকর তথ্য দেই আপনাকে, আপনার আনন্দ নয় বরং দুঃখের দিন শুরু হলো আজ থেকে। পথের কাঁটা আপনার সরে যায় নি আমার গেছে। আপনার কাঁটা তো কেবল জন্ম নিলো মিস্টার আয়মান শুভ্র!’

সাথে সাথে কল কেটে গেল। শুভ্র চিন্তিত হয়ে আবার সাথে সাথেই কল ব্যাক করলো কিন্তু নাম্বার বন্ধ দেখালো।তার মানে এটাই মেয়েটা শুধু ওকে কল করার জন্য সিম কার্ড ইউজ করেছে। এখন কাজ শেষ তাই সিম খুলে ফেলেছে ফোন থেকে।ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল শুভ্র।না শুধু আজকের ফোনকলের জন্য ও চিন্তিত হয়নি,যেদিন থেকে পুলিশ ফোর্স এ জয়েন করেছে আর আসিফের কেইস হাতে নিয়েছে সেদিন থেকেই ওর দুঃখের দিন শুরু হয়েছে।

একের পর এক হুমকি দিয়েছে কোন আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ করে আর আজ তো ডিরেক্ট কল। শুভ্র ভাবতে লাগলো এই চক্রের মূলহোতা আসলে কে? পূর্ব কে সহকারী ধরে আসিফ ছিল সবকিছুর মূলে, এতদিন তো এটাই ধারণা ছিল। কিন্তু আজকের এই কিছুক্ষণ আগের ফোনকল ধারণা টা বদলে দিয়েছে। অসহ্য লাগছে সবকিছু! ধুপধাপ পা ফেলে গাড়িতে এসে উঠে বসলো। জুয়েল পিছনে তাকিয়ে শুভ্র স্যার কে দেখে গাড়ি স্টার্ট দিলো। তীব্র গতিতে গাড়ি ছুটে চললো ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিকে…………

রুম অন্ধকার করে বসে আছি। ভয়ে কেঁপে উঠছি বারবার, মনে জানান দিচ্ছে আমি আর বাঁচতে পারবো না বুঝি। কিছুক্ষণ আগেই আমার হাত দিয়ে একি হয়ে গেল?এই আমি এতো বড় একটা কিছু করবো কখনো ভাবিনি,এসব কি হয়ে গেল আমার সাথে?

রুমের দরজায় সেই কখন থেকে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে তাহমিমা আর মা।, বুঝতে পারছি ওদের খুব চিন্তা হচ্ছে আমাকে নিয়ে কিন্তু আমার কিছু করার নেই।কিছুক্ষণ আগেই আমার সাথে তাহমিমা বাসায় ফিরেছে,যদিও আমি সবকিছু জানি না ওর।তবে ও আমাকে সময় করে সব বলবে বলেছিল ফোন করে। মা’কে কিভাবে এতো বড় একটা শক সামলাতে সাহায্য করেছে ও আমি জানি না আর জানতেও চাইনা। আমি জানতে চাই আমার আসন্ন পরিণতি সম্পর্কে।কি হবে এখন আমার? নিশ্চয়ই এতগুলো মানুষকে খু*ন করার অপরাধে ফাঁসি হয়ে যাবে আমার!মা! কথাটা মনে হতেই দুহাতে মাথা চেপে ধরে মা বলে চিৎকার করে উঠলাম।

‘ আন্টি কি হয়েছে আপনাদের বাসায়, এতো জোরে চিৎকার করলো কে?’
তাসনিয়ার চিৎকারে পাশের বাসার একটা ছেলে দৌড়ে ওদের বাসায় এলো। তাহমিমা আর মিসেস সাবিনা তখনও দরজা ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে, ভিতর থেকে আর কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে মিসেস সাবিনা মেঝেতে বসে কেঁদে উঠলেন। তখনই পাশের বাসার ছেলেটা এলো। তাহমিমা বেশ বিরক্ত হয়ে তাকালো ছেলেটার দিকে, একেতো আপু দরজা খুলছে না ,না জানি ভিতরে আপুর সাথে কি হয়েছে ওভাবে চিৎকার করে উঠল কেন আপু?তার উপর এই উটকো ঝামেলা এসে কি হয়েছে জানতে চাইছে!

‘ কেন ভাই? আমার বোন কখন থেকে দরজা বন্ধ করে বসে আছে খুলছেই না দরজা।পারলে দরজা খুলে দেন,কে চিৎকার করেছে তা জানতে হবে না ‘
‘ হ্যা!’

ছেলেটা ও এসে হাত লাগালো ওদের সাথে। তিনজনে মিলে অনেক ধাক্কাধাক্কির পর দরজার হুক ভাঙতে সক্ষম হলো।দরজা খুলে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকেই তাসনিয়া বলে একটা চিৎকার দিয়ে মিসেস সাবিনা জ্ঞান হারালেন।রুম পুরো অন্ধকার, দরজা দিয়ে যেই এক ফালি আলো আসছে সেই আলোয় তাহমিমা তার তাসু আপুর অবস্থা দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠল। মেঝেতে এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে তাসনিয়া, চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকমের বড় হয়ে অন্য দিকে করে তাকিয়ে আছে,মুখ থেকে গ্যাজলা বেরিয়ে এসেছে।সে এক বীভৎস দৃশ্য! ছেলেটা কালবিলম্ব না করে তাড়াতাড়ি অ্যাম্বুলেন্সের জন্য কল করলো হসপিটালে।

‘ আম্মা!’
ঘরে মুষড়ে পড়েছিলেন মিসেস তারা খানম। একটু আগেই পুরো পরিবারটির এক্সি’ডে’ন্ট এ মৃ”ত্যু”র খবর পেয়েছেন তিনি। হুট করে কোথা থেকে কি হয়ে গেল এসব? আনোয়ার চৌধুরী আর মহুয়া চৌধুরী তাদের পাপের শাস্তি পেয়েছেন এটার জন্য একটুও দুঃখ হচ্ছে না তার কিন্তু বাকিরা?আর পূর্ব ও তূর্য?

ওরা তো নিছক ছেলেমানুষ ছিল, নাহয় যৌবনের শুরুতে বাপের দাদার পাপের ভাগীদার হয়েছিল কিন্তু পরে তো সেটা থেকে সরে এসেছিল। তাদের কেন এই শাস্তি হলো?ওই দুই পাপীর মতো এতো নিষ্ঠুর একটা মৃ”ত্যু ওদের কেন হলো? আমার তাসুর এখন কি হবে?এসবই ভাবছিলেন আর কাঁদছিলেন মিসেস তারা খানম তখনই দিপ্তী এল। ওকে দেখে তাড়াতাড়ি নিজের চোখের পানি মুছে নিয়ে স্বাভাবিক হলেন।

‘ কি হয়েছে বল?’
‘ আম্মা! একটা মেয়ে আসছে। এখানে থাকতে চায়, আমাদের মতোই দেহ ব্যবসায়ী হতে চায় কিন্তু ওর একটা শর্ত আছে।'(দীপ্তি)

দীপ্তির কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন মিসেস তারা খানম যিনি সবার পরিচিত আম্মা। এখানে সবসময় শর্ত উনিই দেন, সবকিছু এমনকি এই পুরো নিষিদ্ধ পল্লী এলাকায় যতগুলো আবাস আছে সবগুলো চলে তার মতামতের ভিত্তিতে, তার হুকুমে। আর কোথাকার কোন মেয়ে এখানে থাকতে এসে শর্ত দিতে চায়?উঠে দাঁড়িয়ে বললেন – ‘ দেখি আমি, কোন মা* আমার এখানে এসে আমাকে শর্ত দেখায়?’

হনহন করে পা চালিয়ে বসার ঘরে এলেন।দীপ্তি ও লাফাতে লাফাতে আম্মার পিছুপিছু সেখানে এলো। নিষিদ্ধ পল্লীতে মেয়ে নেওয়ার আগে যখন অশ্লীল আর বাজে কথা বলে মেয়ে যাচাই করা হয় তখন সেই কথাগুলো শুনতে আর উত্তর গুলো ও শুনতে বেশ লাগে দীপ্তির।

প্রণয়ের বিরহ  পর্ব ২৭

সে অবাক হয়ে সেইসব অসহায় মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে যারা না পেরে এই নিষিদ্ধ পল্লীতে আসে টাকার জন্য।আর আম্মার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর মাথা নিচু করে দেয়। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা অন্য।সব মেয়েই এখানে এলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে আম্মার বসার জায়গার পাশে, কিন্তু এই মেয়েটা সোজা আম্মার বসার জায়গাতেই বসেছে। রাগে হন্নে হয়ে ধাড়ি মা* বলে এতো জোরে চিৎকার করে উঠলেন আম্মা যে দীপ্তি ভয়ে কানে আঙ্গুল দিলো!

প্রণয়ের বিরহ  পর্ব ২৯