নীড়ের খোজে পর্ব ৯

নীড়ের খোজে পর্ব ৯
জান্নাতুল বিথী

শৈবাল আমাকে একটা কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে প্রয়োজনীয় সব কিছু কিনে দিয়ে সেই যে গেলো আজ এক মাস হতে চললো তার কোনো খোজ নেই।এর মাঝে আমাকে থ্রেট দিছিলো পাবলিক ভার্সিটি তে সান্স পেতে হবে।তাই সেভাবেই পড়া-লেখা শুরু করেছি।

এই বাড়িতে আমার প্রধান কাজ হলো তিন বেলা খাওয়া,কোচিংয়ে গিয়ে ক্লাস করা,নিয়মিত পড়া আর ঘুমানো!এছাড়া আম্মু,বড় মা কেউই আমাকে কোনো কাজ করতে দেয় না।বরং নিজে থেকে কাজ করতে গেলে দুই-তিনটা রা*ম ধ*মক দিয়ে বসিয়ে দেয় আমাকে।তাই কাজ করাও ব*ন্ধ করলাম।বর্তমানে আমি পড়তে বসে আছি।কিন্তু পড়া হচ্ছে না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শৈবাল আমার সাথে এখনো পর্যন্ত একবারও যোগাযোগ করেনি।অবশ্যই আমার কাছে তার নাম্বার আছে কিন্তু ফোন করতে ভ*য় লাগে।যদি সে ফোন রিসিভ করে ধ*মক দেয় তাহলে?বা জিজ্ঞেস করে কেনো ফোন করেছি তখন কি জবাব দিবো?সেই ভয়ে তাকে ফোন করা থেকেও বিরত আছি।এখন কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছি না।খুব বাজে ভাবে তাকে মিস করছি।তার অগোছালো চাল-চলন ভ্রু কুচকে কথা বলা সবাটাই খুব মিস করছি।

‘আপু চলো আমরা আইসক্রিম খাবো।’হিমেলের কথা শুনে আমি চমকে তার দিকে তাকাই।সে আমার সামনেই সাহেবী স্টাইলে দাড়িয়ে আছে।তার কথাটা বোধগম্য হতেই ভ্রু কুচকে আমি বললাম,
‘এই শীতে আইসক্রিম?’
‘হুমমম।জীবনে ইউনিক হতে শিখো আপু।ই-উ-নি-ক।’
শেষের কথাটা সে অনেকটা সুর টেনে বললো।

‘শীত কালে আইসক্রিম খেলেই কি মানুষ ইউনিক হয়ে যায়?আরোও কতো জন আছে তারাও তো শীত আর গরম কাল বুঝে না আইসক্রিম খাওয়ার সময়।’আমি বললাম।

‘তাহলে আমরা তাদের দলেই না হয় যোগ দিলাম।’কথাটা বলতে বলতে সে আমাকে চেয়ার থেকে টেনে নিয়ে বাইরে যেতে লাগলো।আমারই বা আর কি করার আছে।এই পাগলের পাগলামিতে সাই দেওয়া ছাড়া।তাই কিছু না বলে তার পায়ে পা মিলাতে ব্যাস্ত হয়ে যাই।নিচে নামতেই মুখোমুখি হই আম্মু,বড় মা আর ছোটমার।তারা বসে খোশ গল্পে মেতে উঠেছেন।আমাদের নিচে মানতে দেখে ছোটমা বললো,

‘কিছু লাগবে নাকি তোমাদের?’
‘না ছোট মা।আসলে আপুর একটা নো*ট লাগবে তো সেটাই নিতে যাচ্ছি আমরা।ইমা আপু এই তো বাহিরেই আছে।’

তার এতো গোছালো মিথ্যা দেখে আমি নিজেই ক*নফিউজড হয়ে যাই।আসলেই কি সে মিথ্যা বলছে নাকি সত্যি বলছে।ইমা আমার নতুন ফ্রেন্ড।আমরা একই কোচিংয়ে পড়ি।ইমা অনেক চুপচাপ স্বভাবের আর আমিও কারো সাথে কথা বলতাম না তাই সে আমার সাথে বন্ধুত্ব করেছিলো।

ভালোই জমে উঠেছে আমাদের দুজনের ভাব।হঠাৎ করে কেউ দেখলে বলবেই না যে আমরা নতুন বান্ধুবি।যাইহোক কোনো মতে হিমেল মিথ্যাটা বলে আমাকে টেনে নিয়ে চলে আসে।তারপর শুরু হয় তার সারাদিনে যতো কিছু করেছে তার হিসেব।আমি আর হিমেল গল্প করতে করতে অনেক দূরে চলে আসার পর সে বললো,

‘আপু তুমি এখানে দাড়াও আমি আইসক্রিম নিয়ে আসছি।’
‘আচ্ছা,তাড়াতাড়ি আসিও।’
সে মাথা দুলিয়ে চলে যায়।হঠাৎ আমার হাতে থাকা মুঠোফোন টা কেঁপে উঠতেই আমি চমকে যাই।স্কিনে তাকিয়ে দেখি ‘Ima’ নামটা জ্বলজ্বল করছে।আমি কোনো কিছু না ভেবেই ফোন রিসিভ করে কানে নিয়ে বলি,
‘এতক্ষনে তোর আমার কথা মনে পড়লো।সারাদিনে একটা কলও করিসনি।আর আজ কোচিংয়ে আসিসনি কেনো?’

‘স্যরিরে আসলে বড় ভাইয়া খুব অসুস্থ ছিলো তাই আসতে পারিনি।’
‘তো সেটা বুঝি আমাকে জানানো যায়না?কি হয়েছে তোর ভাইয়ের?’
‘গত রাত থেকে প্রচুর জ্ব*র।আর সারাদিন অনেক ব্যাস্ত ছিলাম তাই তোকে জানাতে পারিনি।তারপর বল তোর জামাইয়ের কি খবর?’
‘খবর আর কি বলবো………

ইমার সাথে কথা বলতে বলতে খেই হারিয়ে ফেলেছি আমি।কখন যে ফুটফাট ছেড়ে রাস্তায় নেমে পড়েছি তা খেয়ালই করিনি।হঠাৎ কোনো কিছুর ধা*ক্কায় আমি ছিটকে রাস্তার মাঝখানে গিয়ে পড়ি আর আমার পায়ের উপর দিয়ে রিকসার চাকা উঠে যায়।যেটার ধাক্কা খেয়েছি সেটা হলো একটা সিএনজি।ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতভম্ব হয়ে যাই।অতঃপর পায়ের উপর দিয়ে চাকা যে*তেই অনেক জোরে চিৎকার করে উঠি।

এক মিনিটের মাঝেই আমার চারদিকে ভী*ড় জমে যায়।আমি আসেপাশে অ*সহায়ের মতো তাকাচ্ছি একটা চেনা মুখ দেখার আশায়।কিন্তু এখানকার কাউকেই আমি চিনতে পারছিনা।চারদিক থেকে এক এক জনের এক এক কথা ভেসে আসছে।আমি চোখ ব*ন্ধ করে পায়ে হাত দিয়ে বসে আছি।চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।হঠাৎ ভীড় ঠেলে হিমেল ভেতরে এসে আমাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে গাল ধরে জিজ্ঞেস করে,

‘আপু,এ্যাই তুহাপু।তুহাপু তুমি ঠিক আছো?কোথায় ব্যাথা পেয়েছো তুমি দেখি।বলোনা আপু কোথায় ব্যাথা পেয়েছো।খুব বেশি জোরে লেগেছে তোমার?চিন্তা করেনা আপু আমি এখনি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি এখান থেকে।মামা প্লিজ একটু হেল্প করুন না আপুকে তুলতে।’

হিমেলের ব্যাকুল স্বর শুনে আমি তার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসি।চৌদ্দ বছরের ছেলেটা মনে হচ্ছে হঠাৎ করে কতো বড় হয়ে গেলো।তার কথা শুনে পাশ থেকে একজন এগিয়ে এসে বললো,
‘বাপজান চলেন আমার রিসকা দিয়া আপনেগোরে একখান কিলিনিকে পোচাইয়া দিয়া আসি।’

বলতে বলতে লোকটা আর হিমেল আমাকে তুলে দাড় করায়।আমি কোনো মতে হিমেলের গায়ে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছি।হিমেল অনেক যত্ন করে আমাকে রিকসায় বসিয়ে আমার মাথাটা তার কাধে রেখে,পকেট থেকে রুমাল বের করে আস্তে আস্তে রক্ত পরিষ্কার করে দেওয়ার চেষ্টা করে।

খাটে হেলান দিয়ে শুয়ে আছি আমি!আমার চারপাশে সবাই দাড়িয়ে আছে!আম্মু বসে বসে চোখের পানি ফেলছে।বড় মা যত্ন সহকারে আমাকে খাওয়িয়ে দিচ্ছে।ছোট মা একটা বালিস নিয়ে আমার পায়ে নিচে দিয়ে পাশে বসেই ভালো করে হাত পা আবারো চেক করে অন্য কোথাও আঘাত লেগেছে কিনা।আর আমার সামনেই অন্যরা বিরস মুখে দাড়িয়ে আছে।

আমি বারবার করে তাদের বলছি আমি ঠিক আছি তারপরো সবার হা-হুতাশ লেগেই আছে।
‘নে ঔষধ টা ধর।এটা খেয়ে এখন ঘুমাবি।আর কোনো কথা শুনতে চাইছিনা আমি।’বড় মা বলল।
আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে ঔষধ টা খেয়ে শুয়ে পড়ি।এর মধ্য আম্মু জেদ করে বসে আছে সে আমার সাথেই ঘুমাবে!আম্মুর কথা শুনে আমিও আর আপত্তি করিনি।সবাই একে একে করে চলে যায়।আব্বু যাওয়ার আগে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে একটা চুমু একে দিয়ে বললো,

‘তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠো।মোটেও ভালো লাগেনা তোমাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখতে।’
তার এতো আবেগ ঘন কথা শুনে আমার চোখ আবারো টলমল করে উঠে।আমি ঠোট কামড়ে ধরে অন্য দিকে তাকিয়ে আছি।সে কথাটুকু বলেই প্রস্থান করে।

সকালের মিষ্টি রোদ চোখ মুখে আচড়ে পড়তেই আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।চোখ বন্ধ করেই আড় মোড়া ভাঙ্গড়ে গিয়ে পায়ে টান ‘আহ’ করে মুদৃ চিৎকার দিয়ে উঠি।
‘এ্যাই তুহা ঠিক আছো তুমি?পায়ে ব্যাথা লাগছে বেশি?দেখি কি হইছে বলোতো।’

চোখ খুলে কথার মালিকের দিকে তাকিয়ে আমি যেনো আকাশ থেকে পড়ি।আমার মুখের উপর ঝুকে আছে শৈবাল।তার এক হাত আমার গালে।সে বারবার আমাকে জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছে একই কথা।আর আমি হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছি।তাকে একদমই এখানে আশা করিনি।

হঠাৎ তাকে দেখে খুশিতে কেদে দেই আমি।কাল রাত থেকে মন কিছুটা ভার ছিলো আমার এ অবস্থাতেও তাকে পাশে না পেয়ে।কিন্তু এখন যখন ঘুম ভাঙ্গার পর তাকে দেখলাম তাকে আমার খুশির বাধ ভেঙ্গে যায়।আমাকে কাদতে দেখে সে আরো অস্থির হয়ে উঠে।খুব যত্ন সহকারে আমাকে উঠিয়ে খাটে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিয়ে বললো,

‘একটু কষ্ট করে বসো জান।আমি এক্ষুনি ডাক্তার কে ফোন করছি।খুব বেশি ব্যাথা লাগছে?’
তার প্রশ্নকে আমি কোনো রকমে অগ্রাহ্য করে উল্টো তাকে প্রশ্ন করি,
‘আপনি কখন আসছিলেন?’

আমার প্রশ্ন শুনে সে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বললো আমি আসছি।বলেই সে বেরিয়ে গেলো।সে বেরিয়ে যেতেই রুমে আম্মু আসে।তাকে দেখে আমার ঠোটের কোণে এক চিলতে হাসি জমে।কাল সারা রাত সে আমার পাশে ছিলো।সে নিশ্চয় জানে শৈবাল কখন এসেছিলো।যেই ভাবা সেই কাজ,আম্মু আমাকে কিছু বলার পুর্বেই আমি তাকে প্রশ্ন করলাম,

‘আম্মু উনি কখন এসেছিলো?’
‘কাল রাত্রে আসছে দেড়টার দিকে।মধ্য রাত থেকে তোর প্রচুর জ্বল উঠেছিলো।আমি কি করবো ভাবতে ভাবতেই শৈবাল হাজির হয়।

নীড়ের খোজে পর্ব ৮

তারপর সেই তোর সারা রাত সেবা যত্ন করে জ্বর নামাইছিলো।আমাকে রুমে চলে যেতে বলার পর কোনো উপায় না পেয়ে চলে গেছিলাম আমি।ভোর রাত্রে নাকি তোর জ্বর কমেছিলো।সারারাত ছেলেটা এক দন্ডও ঘুমাতে পারেনি।’

নীড়ের খোজে পর্ব ১০