নীড়ের খোজে শেষ পর্ব 

নীড়ের খোজে শেষ পর্ব 
জান্নাতুল বিথী

দুপুরের তীব্র গরমে অতিষ্ট হয়ে তাড়াহুড়ো করে ক্লাস থেকে বের হয়ে স্যারদের থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে আসি স্কুল থেকে।গেটের আছে আসতেই দেখি গেটের বাহিরে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে শৈবাল!একটু পর পর ঘড়িতে সময় দেখছে আর এদিক ওদিন তাকাচ্ছে!কাঠ ফাটা রোদে দাড়িয়ে আছে সে,তাও যেনো তার ক্লান্তি লাগছে না।আমি তার সামনে গিয়ে বুকে দুই হাত গুজে বললাম,

‘আপনি এভাবে রোদ্রে দাড়িয়ে আছেন কেনো?আল্লাহ্ খারাপ লাগছে না আপনার?এভাবে বাহিরে দাড়িয়ে অপেক্ষা না করে গাড়িতে বসলে কি হতো?’
ঠোঁট এলিয়ে হাসে শৈবাল,আমার হাতে ঠান্ডা পানির বোতল দিতে দিতে বললো,
‘ম্যাডাম আপনার জন্য অপেক্ষা করতে আমার মোটেও খারাপ লাগে না!’
ঠোঁট বাকিয়ে গাড়িতে বসে পানি খেতে খেতে বললাম,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘কাল থেকে আপনি আর আমাকে নিতে আসবেন না।আমি একা একাই যেতে পারবো।’
সে গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে আমার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বললো,
‘ঠ্যাং ভেঙ্গে দিবো ধরে ফা’জিল মেয়ে।তোমাকে এসব নিয়ে ভাবতে বলছে কেউ?নিজের চ’রকায় তেল দাও!আমার বউকে আমি নিতে আসবো তোমার বাপের কি?’
বুঝলাম সে আস্তে আস্তে বেকে যাচ্ছে,তাই কথা ঘুরানোর জন্য বললাম,
‘রাইসা কোথায়?’
‘যেখানে থাকার কথা সেখানেই আছে!’

‘ত্যাড়া কথা বলছে কেনো আজব আপনাকে কোনো কথা জিজ্ঞেস করাই বৃথা ধূর!’
আমাকে বিরক্ত হতে দেখে মিটিমিটি হাসতে থাকে শৈবাল!তাকে হাসতে দেখে ধুমম করে একটা কি’ল বসিয়ে দেই তার পিঠে।শৈবাল ব্যাথা পেয়ে আহহ শব্দ করতেই দুজনে এক সাথে হেসে দেই!এই মানুষটার সাথে জীবনের সাতটা বসন্ত কাটিয়ে ফেললাম!

ভাবতেই অবাক লাগে আমাদের বিবাহিত জীবনের সাতটা বসন্ত অতিক্রম করা হয়ে গেছে।এখনো আমার মনে হয় এই তো মাত্র সেদিন মানুষটা আমাকে গ্রাম থেকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে।সেই শুরু থেকে শৈবাল যেমন ছিলো এখনো ঠিক তেমনই আছে!শুধু আগের তুলনায় সে আমাকে যেনো বেশি ভালোবাসে,এক সময় ভাবতাম আমার প্রতি শৈবালের ভালোবাসা হয়তো এক সময় ফিকে হয়ে যাবে!কিন্তু এখন আমি ভাবি ঠিক কতোটা বোকা বো’কা চিন্তা করতাম আমি।দিন কে দিন তার ভালোবাসার রং গাঢ় হচ্ছে বৈকি হালকা না।

শৈবাল এখন পুরোপুরি বড় আব্বুর ব্যবসায় সামলায়,শৈবালের সাথে ব্যবসায়ের কাজে যোগ দিয়েছে হিমেল।সে এইবার অনার্স ৩য় ইয়ারে।সৈকত ভাইয়া পুলিশে চাকরি নিয়েছে,বউ বাচ্চা নিয়ে সে চট্টগ্রাম থাকে!এই পরিবারের সাথে আমার সম্পর্ক আগের তুলনায় আরো মজবুত হয়েছে।বর্তমানে আমি একটা প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করি।আমার আজকের এই পর্যন্ত দাড়ানো তে সব চাইতে বেশি অবধান যার তার কথা না বললেই নয়।শৈবাল প্রতিটা মুহূর্ত আমাকে সাপোর্ট করেছে।কিছু না বুঝলে নিজে বুঝিয়ে দিয়েছে,রাত জেগে আমি পড়াশোনা করলে সে আমার পাশে বসে থাকতো।ফাক্সে ফাক্সে চা এনে সামনে রাখতো যেনো ঘুম না আসে!আজ যখন আমি এই পর্যায়ে এসেছি তখন প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে শৈবালের খোচা শুনতে হয়।সে এখনো আমাকে খোচা দিয়ে বলবে,

‘আমি একটা অ’পয়া অ’লক্ষী মেয়ে,আমার দ্বারা কিছুই হবে না শৈবাল!যে মেয়ে পাবলিকে সান্স পায়নি সে আর জীবনে কি হতে পারবে?’
আমাকে কপি করে আমার কথাই ব্যঙ্গ করে শোনায় আমাকে।তার এসব কথা শুনলে মাঝে মাঝে রাগ হয় তো আবার মাঝে মাঝে হেসে ফেলি।আজ যেখানে আছি আমি তা তো একমাত্র শৈবালের সাপোর্টেই।আমি যখন যা চাইতাম তখন তাই পেতাম,এটা যেনো আমার জন্য এক একটা নিয়ম হয়ে যাচ্ছে দিন কে দিন।হিমেল মাঝে মাঝে বলবে,
‘আপু তুমি তো দেখছি দিন দিন রাইসার থেকেও ছোট হয়ে যাচ্ছো।একদিনে তোমার যতো আবদার তা আমাদের রাইসা তিন দিনেও করে না।’

তখন তার সাথে শৈবাল ও তাল মিলাতো।আমি যখন কাদো কাদো গিয়ে বলতাম,
‘কেনো তোমার হিংসে হয় বুঝি এখন আমাকে?আল্লাহ্ কি দিন কাল আসলো আমার এখন আমার মায়ের পেটের ভাইও আমাকে হিংসে করে।’
কথাগুলো নিচক মজার ছলে বললেও সে তড়িঘড়ি করে এসে আমাকে বলতো,
‘এমা ছিঃ ছিঃ আপু,আমি তোমাকে হার্ট করতে চাইনি।আমি মোটেও সেসব ভেবে কথাটা বলিনি!’

তারপর আমার মন ভালো করার জন্য উঠে পড়ে লাগতো।এখনো মাঝে মাঝে শৈবাল অফিস থেকে আসতে দেরি হলে আমি আর হিমেল আইসক্রিম খেতে বেরিয়ে পড়ি।কোনো কোনো সময় শৈবালের সাথে গভীর রাতে বের হয় শহরের নির্জন অলি গলিতে হেটে বেড়াই!সে আমি বলতেই পাগল,গত সাত বছরে কখনো সে অফিসের কাজে দূরে কোথাও গেলেও রাত কাটাতো না।যতো দূরেই হোক কাজ শেষ হলেই তার বেরিয়ে পড়ে।আমি এই স্কুলে জয়েন করেছি এক বছর হলো,এই এক বছরে এমন কোনো দিন ছিলো না আমি স্কুলে আসছি আর শৈবাল নিতে আসেনি আমাকে।যতো ব্যস্তই থাকুক সে আমার জন্য এক্সট্রা সময় সে বের করে নিবেই।তার এসব পাগলামী দেখে মাঝে মাঝে আমি অনেক তৃপ্তি পাই।ভালো লাগার পরশ ছুয়ে যায় মনে।

গাড়ি ব্রেক করায় পড়তে পড়তেও নিয়ে নিজেকে সামলে নেই,সামনে তাকিয়ে দেখি আমাদের ছোট্ট সোনা মনি মাঝ রাস্তায় দাড়িয়ে।বাড়ি থেকে হালকা দূরে আছি আমরা,হয়তো আমাদের আসতে দেরি দেখে রাইসা রাস্তায় চলে আসছে!কিন্তু কেউ তার সাথে আসেনি তার উপর সে একা দাড়িয়ে দেখে কিছুটা ভড়কে যাই আমি।শৈবালের দিকে তাকিয়ে দেখি সে রে’গে ততক্ষনে গাড়ি থেকে নেমে নিয়েছে!আমি তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে রাইসার দিকে এগিয়ে যাই।
‘সমস্যা কি তোমার কতো দিন তোমাকে নিষেধ করছি এভাবে রাস্তায় এসে কারো জন্য অপেক্ষা করবে না।কথা কানে যায় না তোমার?’

শৈবালের ধ’ম’ক খেয়ে আমার চার বছরের ছোট্ট মেয়ে টা ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দেয়।আমি গিয়ে তাকে বুকে আগলে নিয়ে শৈবালকে বললাম,
‘আহা ব’কছেন কেনো মেয়েটাকে?ওর এখনো সেসব বুঝার মতো বয়স হয়েছে নাকি?’
‘তুমি যেমন হাতে পায়ে নাচো তোমার মেয়েও তোমার থেকে কম যায় না।’
কথাটা বলে রা’গে ফুসতে ফুসতে সে হাটা ধরে বাড়ির পথে।এদিকে আমি রাইসার কান্না থামানোর জন্য নানা ধরনে কথা বলে অতঃপর কান্না থামিয়ে একটা স্বস্থির নিশ্বাস ফেলি।ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই দেখি শৈবাল সবাইকে কথা শুনাচ্ছে রাইসা এভাবে বাহিরে যাওয়ার জন্য।তখন ছোট মা বললো,

‘শৈবাল রাই মা এতক্ষন আমাদের কাছেই ছিলো,কখন যে সবার চোখ ফাকি দিয়ে বের হইছে খেয়ার করিনি কেউ।’
আমিও শৈবালকে শান্ত হতো বলি,কারন এখানে সত্যিই কারো দোষ নেই!রাইসা অনেক দুরন্ত একটা মেয়ে।বাপ চাচাদের হলে আর কাউকেই লাগে না।সারাক্ষণ হিমেলের গলা জড়িয়ে বসে থাকে।তাদের এতো ভাব দেখলে আমারই হিংসে হয়।শৈবাল হিমেলের সাথে তার যে সম্পুর্ক তা আমার সাথেও গড়ে উঠেনি।বাড়ির প্রান এখন রাইসা,সে যদি কোনো ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন আমার চাইতেও বেশি শৈবাল সহ বাড়ির বাকীরা অস্থির হয়ে পড়ে।মাঝে মাঝে তাদের এতো অস্থিরতা দেখে মৃদু হাসি আমি।

রাত্রে খাওয়া দাওয়া করে রুমে এসে দেখি শৈবালের বুকে রাইসা ঘুমিয়ে আছে!শৈবাল এক হাত দিয়ে রাইসাকে বুকে আগলে রাখছে আরেক হাত দিয়ে অফিসের কাজ করছে।অথচ তখন মেয়েকে কি রা’ম ধ’ম’ক টাই না দিলো।আমি গিয়ে শৈবালের পাশ ঘেসে বসে ল্যাপটপে উকি দিয়ে দেখি।আমাকে দেখে সে ল্যাপটপ টা বন্ধ করে টেবিলে রেখে শুয়ে পড়ে রাইসাকে একপাশে শুইয়ে দেয় নিজের এক হাতের উপর।আরেক হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
‘নাও বউ ঝটপট্ আমার বুকে এসে শুয়ে পড়।’
আমি শৈবালের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বললাম,

‘শৈবাল!’
‘হু!’
‘আপনি কি জানেন আপনি বিরাট বড় একটা অ’পরাধ করেছেন?’
‘কি করছি?’
‘আপনি কখনো আমাকে ভালোবাসি বলছেন?’
কথাটা শুনে মুচকি হাসে শৈবাল,আমাকে বুকের সাথে শক্ত করে চেপে রেখে বললো,
‘দুজন যখন বুড়ো হয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে হাটবো তখন বলবো!’

আমি আর কথা না বাড়িয়ে শৈবাল কে আর রাইসাকে জড়িয়ে ধরি।শৈবার আমাকে কখনো না বললেও আমি জানি সে আমাকে ঠিক কতোটা ভালোবাসে।তার ভালোবাসাতেই তো বেচে আছি এখনো,বেচে আছে আমাদের ছোট্ট প্রানটা।ভালোবাসারা সুন্দর,এই ভালোবাসা কখনো পুরিয়ে না যাক।

সমাপ্ত

[এই যে জনগন’স আপনাদের আর কষ্ট করে নাইস নেক্সট কমেন্ট করতে হবে না।যারা প্রথম থেকে আমার পাশে আছেন তাদের সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ।সব সময়ই এভাবেই আমার পাশে থাকবেন আশা করি।নীড়ের খোজে গল্পটার জন্য আপনাদের আর অপেক্ষা করতে হবে না কষ্ট করে।সবাই সবার অনুভূতি জানিয়ে যাবেন অবশ্যই।ভালোবাসা সবাইকে🖤]

নীড়ের খোজে পর্ব ১৮