উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ২১

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ২১
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

অনবরত ঝড়ের কবলে পড়ে প্রতিটি জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠলো। তানভীর যতই ভরসা দিক না কেন, রিয়া কিছুতেই স্বস্তি পায়না। মায়ের কথা রাখতে গিয়ে তার ভাইওতো ভালোবাসার মানুষটিকে ছেড়ে দিয়েছে। কোথাও একটা তার ভ*য়, মাকে খুশি রাখার জন্য তানভীরও একসময় তার হাত ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে।
তার নিজের মা- ভাইয়ের কর্মফল হয়তো তাকেই ভোগ করতে হবে।

মায়ের সাথে দেখা করতে নানার বাড়িতে এলো রিয়া। মাকে দেখেই সে আৎকে উঠলো। তার কী মা কী হয়ে গেলো। স্বাস্থ্যবান শরীর, রূপ-লাবণ্য হারিয়ে বয়স যেন আরও দশ বছর বেড়ে গেলো। চামড়ার রং মলিন হয়ে এসেছে। ঠোঁটে আগের মতো প্রফুল্ল হাসি নেই। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো রিয়া। জীবন এতটা কঠিন কেন? সব কিছুতে এত বি*ষা*দ কেন? সমস্ত পরীক্ষা যেন তাদের জন্যই অপেক্ষা করে আছে। নাসিমা বেগম মেয়েকে বুকে চেপে বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“কাঁদছিস কেন পাগলি মেয়ে? মা তো এখনো বেঁচে আছি।”
রিয়া অস্ফুটস্বরে বলল,
-“আমি বেঁচে নেই, মা। শুধু শরীরটা আছে, অন্তরটা ম*রে গিয়েছে।”
-“এসব কি ধরনের কথা,রিয়া?”
মেয়ের চিবুক তুলে কপাল কুঁচকে ফেললেন নাসিমা বেগম। চিবুকে হাত বুলিয়ে চেহারা এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে দেখে বললেন,

-“তোর মুখে এসব কদিন থেকে? এসব দেখেতো ভালো কিছু মনে হচ্ছে। তোর বাবা ডাক্তার দেখায় নি?”
রিয়া ভেবেছিল মাকে কিছুই বলবেনা। কিন্তু এবার ফুঁপিয়ে কান্না শব্দে রূপ নিলো।
ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলল,
-“মা তোমার মেয়েকেও আজ মানুষ বাছাই করছে। আমার চেহারা নাকি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কারো বাড়ির বউ হওয়ার যোগ্য নই আমি।”
নাসিমা বেগম ক*প*ট রা*গ দেখিয়ে বললেন,
-“কে বলে এমন কথা? আমার মেয়ে খাটি হীরা। এসব সমস্যা ডাক্তার দেখালেই সেরে যাবে। মানুষের স্বভাবই অন্যের খুঁত ধরা।”

রিয়া হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলো। তার মা এমন কথা বলছে? সে তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
-“তুমি নিজেও তো খুঁত ধরেছো, মা। ভাবিও কি সুস্থ হতো না? এখন তো ভাবি অনেকটাই সুস্থ। তুমি কিভাবে পারলে তার সাথে অ*বি*চা*র করতে?

আসলে আমরা নিজের দো*ষ গুলো কখনোই দেখিনা। দেখার চেষ্টা ও করিনা। তুমি যেমন ছেলের জন্য পারফেক্ট খুঁজেছো, তেমন সবাই খুঁজবে মা। এটাই দুনিয়ার নিয়ম। আমি ভালো তো জগৎ ভালো।
লজ্জা হলেও তোমায় বলছি মা, দুই বছরের সম্পর্ক আমার। ওর নাম তানভীর। তার মাও আমাকে দেখেছে। তিনি চাচ্ছেন না, যে মেয়ের মাঝে খুঁত আছে সেই মেয়ে উনার বাড়ির বউ হয়ে যাক। একটা কথা ভাবো তো মা, ভাইয়া যেমন ভাবিকে ভালোবেসেও তোমার কথায় ছেড়েছিল তানভীর ও যদি একই কাজ করে আমার সাথে? মা হয়ে তোমার কেমন লাগবে বলোতো?

তানভীর আমায় ভালোবেসেও যদি দূরে ঠে*লে দিতে পারে, তাহলে অন্যরা তো আরও আগেই নাক ছিটকাবে। যদি এই শ্বে*ত রোগ ভালো না হয়? আমার পুরো শরীরে যদি ছড়িয়ে যায়? সবাই তখন নিশ্চয়ই আমাকে দেখে নাক ছিটকাবে, কটাক্ষ করবে। হয়তো বাড়ি ভর্তি মেহমান, হৈ-হুল্লোড়ের মাঝে ও আমাকে বাসার এক কোণে ভাঙা আসবাবপত্রের মতো পড়ে থাকতে হবে। আমার মুখ দেখতে চাইবেনা কেউ। হুট করে চোখ পড়লেই হয়তো আমাকে দু-চারটে কথা শুনিয়ে দেবে। নিজেকে আড়াল করে চলতে হবে। এমনটাইতো হয়ে আসছে।

কোন একটা মানুষ অন্ধ, পঙ্গু, কালো কিংবা তার কোন একটা খুঁত আছে। মানুষ তাকেই কথা শোনায়৷ অথচ এসবে তার কোন হাত থাকেনা। সৃষ্টিকর্তাই তাকে এভাবে সৃষ্টি করেছেন।
যেটাতে মানুষের হাত থাকে, সেটা হলো চরিত্র। মানুষ চাইলে নিজেকে শ্রেষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী করে তুলতে পারে, আবার চাইলে নর্দমার কিটের চেয়েও অধম কোন ব্যক্তিত্বে পরিণত হতে পারে। আশেপাশের মানুষগুলো কিন্তু তাদের কথা শোনায় না, বরং সালাম দিয়ে চলে। আর নি*র্দো*ষ দের পায়ে পিষে মা*রে।”

নাসিমা বেগমের মুখ ছোট হয়ে গেলো। আবার তিনি ভুলে গেলেন নিজের অ*ন্যা*য়ে*র কথা।
রিয়া আবারও বলল,
-“যদি তানভীর তার মায়ের কথায় বাধ্য হয়ে আমার জায়গায় অন্যকাউকে ঘরে তোলে, তবে আমি ম*রে যাবো মা। হয়তো আ*ত্ম*হ*ত্যা করে ফেলতে পারি।”
কলিজায় মোচড় দিয়ে উঠলো নাসিমা বেগমের। ধ*ম*কে বললেন,

-“এসব কী ধরনের কথা? কারো জন্য কেউ ম*রে যায় না।”
-“ম*রে মা, শুধু সবাই দেখতে পায়না। মানুষের অভাবে এক একটি হৃদয় ম*রে যায়। ভাবির কষ্ট আমি আজ বুঝতে পারছি। কারো কষ্ট কেউ উপলব্ধি করতে পারেনা, যতক্ষণ না তারা সেই একই পরিস্থিতিতে পড়ে। আর কত পা*ষা*ণ হবে, মা?”
মেয়ের বেলায় এসে আর সহ্য করতে পারছেন না নাসিমা বেগম। অথচ ঊর্মির বেলায় ঠিকই নি*ষ্ঠু*র হতে পেরেছেন। দিশেহারা লাগছে, অনবরত চিন্তায় ঠান্ডার মাঝেও শরীর ঘেমে উঠছে।

তানজিনার শরীর সুস্থ হতেই উষা শামীমের সাথে বাড়ি ফিরে এলো।
রাহাতকে এখন ঠিকঠাক বাড়িতে দেখা যায়না। আজ বিকেলে বাসায় ফিরে হুট করেই লিলিকে বলল,
-“আমার ঘরে এসো।”

এতগুলো দিন গেস্ট রুমে থাকার পরও রাহাতের মুখে শোনেনি ‘ঘরে এসে থাকো’। আজ কী এমন বলবে? সবটা কি স্বাভাবিক হবে? ভাবতে ভাবতেই হাত-পা কাঁপা-কাঁপি শুরু হলো লিলির। এক পা বাড়ায় তো দু’পা পিছিয়ে যায়, এমন দ্বিধাদ্বন্দ কা*টি*য়ে নিঃশব্দে প্রবেশ করলো।
রাহাত লিলির অপেক্ষায় ছিল। তাকে প্রবেশ করতে দেখে দীর্ঘশ্বাস গোপন করে গম্ভীর গলায় বলল,
-“আমার তোমাকে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। কারণ আমাদের পরবর্তী জীবনের প্রতিটি প্রদক্ষেপ ভিন্ন হবে। ভোর হবে নতুন কিছু দিয়ে।”

বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম হাতুড়ি পেটার শব্দ হলো লিলির। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় আছে সে।
রাহাত আর তার মাঝে কথোপকথন হলো। একেবারে গোপনীয় কথোপকথন।
বিকেলে বেরিয়ে রাতেও আজ তাড়াতাড়ি ফিরেছে সে। অনেক কাজ বাকি তার।

রাতের খাবার শেষ করে সবাই ঘুমাতে গেলো। রান্নাঘরের কাজ সেরে উষা ঘরে ফিরলো। শামীম তার অপেক্ষায় জেগে রইলো। কম্বলের নিচে ঢুকেই ঠান্ডা হাত জোড়া শামীমের শরীরে লাগিয়ে মিটিমিটি হাসলো। চোখ ছোট করে তাকালো শামীম। বলল,
-“এর প্রতি*শোধ আমি দ্বিগুণ হারে নেবো।”
উষা ব্যঙ্গ করে বলল,
-“দ্বিগুণ হারে নেবো, হুহ। আমি কি বসে থাকবো নাকি?”
-“সেটা সময়ই বলে দেবে।”

উষাকে পেছন থেকে দুহাতের ভাঁজে বন্দি করে নিলো। উষার হুট করেই মনে হলো সে বেশ তাড়াতাড়িই শামীমের প্রতি ঝুঁকে গিয়েছে। অথচ তার ব্যক্তিত্বের সাথে এমনটা ঘটার কথা ছিলোনা। হয়তো পবিত্র সম্পর্কগুলোতে আল্লাহ আবেগ, ভালোবাসা, মায়া সবটাই বাড়িয়ে দেন।

সময়টা মধ্যরাত। পাকা মেইন রোডে শাঁ শাঁ শব্দে ছুটে চলেছে বাস, ট্রাক। পেছনে ফেলে যাচ্ছে দানবীয় আকৃতির বিল্ডিং, বড় বড় গাছ। রাহাতের জীবনও খানিকটা এমনই। সেও কিছু একটা পেছনে ফেলে ছোটার চেষ্টা করছে।
সবাই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, রাহাত তখন কোন একটি বাসের জানালায় মাথা ঠেকিয়ে রইলো। বাসের যাত্রীদের মধ্যে কেউই জেগে নেই সে ছাড়া।

জীবন যুদ্ধের খেলা থেকে পালিয়ে বাঁচতে এই উদ্বেগ তার। লিলিকে কখনোই তার মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। সেদিন লিলির অতীত জানার পরও তার প্রতি কোনো ধরনের অনুভূতি কাজ করেনি তার। ভেতর থেকে কোন সহানুভূতি আসেনি। শুধু এতটুকুই মনে হয়েছে মেয়েটার সাথে এমনটা না হলেও পারতো। রাহাত শুধু তার আর ঊর্মির ভবিষ্যত নিয়ে ভেবেছে। সামনে তাকিয়ে সে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পেলোনা।

মনে হয়েছে আমি এবার বাঁচতে চাই। বিয়ে হয়েছে ভেবে বাধ্য হয়ে লিলিকে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলনা। আর না দু’জনের ভবিষ্যত ভালো কিছুর সন্ধান দিতো। ঊর্মিও তার কাছে ফিরতে চায়না। আর নিজেকে বিসর্জন দিতে পারলোনা। আর কত স্যাক্রিফাইস করবে সে? মানুষ যখন একবার বুঝে যায় আপনি স্যাক্রিফাইস করেছেন, তখন তারা এই আশায় থাকে যে এবারও আপনিই স্যাক্রিফাইসটা করুন।

তাইতো আজ ছুটে চললো অজানা গন্তব্যে। তার লিখিত দুটো চিঠি জমা হলো। একটি তার কক্ষে, অপরটি ডাক বাক্সে।
আজ বেশ আফসোস হচ্ছে।
ইশ! সেদিন যদি মাকে মানাতে না পেরে এভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে যেত। তবে জীবনে কতটাই না সুখী হতো। মায়ের মনে যখন ভয় ঢুকে যেত ছেলে হারানোর, তখন হুট করেই ফিরে এসে সবটা ঠিক করে নিতে পারতো। এসব এখন কেবল আফসোস।

রাহাতের কথা অনুযায়ী সত্যিই ভোর হলো নতুন কিছু দিয়ে। কিছুদিন আগের মতো একই রকম ঘটনা ঘটলো। সকালে নাস্তার টেবিলে সবাই উপস্থিত থাকলেও রাহাত নেই। বেশ বিরক্ত হলেন আনোয়ার হোসেন। আর কত চুপ থাকবেন তিনি। কারো মাঝেই কোন কিছু ঠিক করার তাড়া নেই। এদিকে লিলি যে গেস্ট রুমে এতগুলো দিন কা*টি*য়ে দিলো সে খবরটুকু আনোয়ার হোসেনের অজানা। আজ রাহাতের সাথে খোলাখুলি কথা বলবেন। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট করে সময় পেরিয়ে গেল। রাহাত ঘর থেকে বের হলোনা। পরক্ষণেই আনোয়ার হোসেন লিলিকে বললেন,

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ২০

-“রাহাতকে ডেকে নিয়ে এসো।”
লিলি রাহাতের ঘরে প্রবেশ করার খানিকক্ষণ বাদেই তাকে ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখা গেলো। হাতের ভাঁজে এক টুকরো সাদা কাগজ।

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ২২