নীড়ের খোজে পর্ব ১০

নীড়ের খোজে পর্ব ১০
জান্নাতুল বিথী

আজ তিন দিন হলো শৈবাল বাড়িতে আছে।বড় মায়ের কাছ থেকে শুনলাম সে নাকি আর হলে থাকবে না,এখন থেকে বাড়িতেই থাকবে।আমি অবশ্যই এসব নিয়ে তার সাথে কোনো কথাই বলিনি,সে আমার সাথে প্রয়োজন ব্যাতীত কথা বলেনি এই তিন দিনে।আমার আশে-পাশে আসলে বা পা ড্রেসিং করতে গেলে তার দিকে করুন মুখে তাকালেও কাজের কাজ কিছুই হয়না।সে তার মতো ভাব নিয়ে থাকে।এখানে আমার কি দোষ বুঝতে পারছি না আমি,সে কেনো আমার উপর রে*গে আছে?সত্যিই কি রে*গে আগে?

বেডের উপর বসে গা*লে হাত দিয়ে এসবই ভাবছি।হঠাৎ পাশে কিছুর শব্দ হতেই চমকে উঠি আমি।পাশ ফিরে দেখি শৈবাল বসে আছে ডিভানে।ড্রেসিংটেবিলের উপর একটা বই শব্দ করে রেখে তার পর সে বসে পড়ছে।আমার কেনো জানি মনে হলো সে আমার দৃষ্টি আকর্ষন করতে শব্দ করে বইটা রেখেছিলো,ভেবেই নিঃশব্দে হেসে ফেলি আমি।অতঃপর হাসি থামিয়ে কিছুটা কা*ন্না কা*ন্না ভাব করে তাকে বললাম,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘শুনুন,আপনি আমার সাথে কথা বলেন না কেনো ঠিক করে?’
‘ঠিক করে কিভাবে কথা বলতে হয় জানা নেই আমার,জেনে তারপর বলবো।’শৈবাল বলল।
তার কথাটা শুনে বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে ফেলি আমি।এই মানুষটা ত্যাড়া ভাবে কথা বলছে কেনো?
‘এভাবে বলছেন কেনো?আমি কি করছি?ওইটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট ছিলো।আমি কি ইচ্ছে করে গিয়ে রাস্তায় শুয়ে পড়েছিলাম নাকি?’

‘আমি তো সেসব নিয়ে কথা বলিনি।তাহলে সেসব টানছো কেনো?’
‘আজব,আপনি শুধু শুধু রা*গ করছেন।’
‘আমি কেনো রা*গ করবো?রা*গ করতে হলে যে অধিকার লাগে সেই অধিকার কি আমার আছে?’

শৈবালের এমন গা ছাড়া ভাবে কথা বলতে দেখে চোখ টল*মল করে উঠে আমার।একদিকে তার কথা শুনে কান্না পাচ্ছে অন্যদিকে প্রচুর রা*গ ও হচ্ছে।সে এভাবে কথা বলছে কেনো?ভেবেই রাগে দুঃখে বেড থেকে নামতে গিয়ে পায়ে চাপ পড়ায় ব্যা*থায় ক*কিয়ে উঠি আমি।আমাকে ব্যাথা পেতে দেখে সে তাড়াতাড়ি করে উঠে এসে আমার পেছনে একহাত দিয়ে পিঠ জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে আমার এক হাত ধরে বসাতে বসাতে বললো,

‘পাগল নাকি তুমি?এভাবে এই পা নিয়ে কেউ উঠে দাড়ায় নাকি?এতো কমন*সেন্সের অভাব কেনো তোমার?’
কথাটা শুনে নাক টানতে টানতে আমি বললাম,
‘আপনার তো খুব কমনসেন্স আছে তাহলে আমার সাথে এমন ব্যবহার করছেন কেনো?’
আমাকে কাদতে দেখে সে ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।আমি তখনো বসে বসে কান্না করছি,
‘এভাবে কান্না করছো কেনো তোমার কি জামাই মারা গেছে?’

‘জামাই মারা যায়নি তো জামাই ঠিক ভাবে কথা বলেনা আমার সাথে।’
‘চুপচাপ বসে থাকো,আসছি আমি।’
বলতে বলতে সে উঠতে নিলেই আমি তার কোমড়ের পাশের শার্টের কিছুটা অংশ টেনে ধরে করুন চোখে তাকে বলি,
‘প্লিজ আমার সাথে এমন করবেন না।আমার খারাপ লাগছে তো।’
শৈবাল কিছু না বলে আমার পাশে বসে চুল গুলো কানের পেছনে গুজে দিয়ে বললো,

‘আমি তো তোমার উপর রাগ করিনি তুহা।আমার নিজের প্রতিই রাগ লাগছে তোমাকে সঠিক ভাবে প্রটেক্ট করতে পারছি না আমি বলে।তোমার সব দায়িত্ব নিয়েও সেই দায়িত্ব আমি সঠিক ভাবে পালন করতে পারছি না সেসব ভাবলেই নিজের প্রতি রাগ লাগছে আমার।তোমার সাথে কথা বলতে গেলে কিভাবে না কিভাবে বলি ঠিক নেই।তাই প্রয়োজন ছাড়া কথা বলিনি।’
আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি শৈবালের দিকে।সে কি সুন্দর করে সব দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়ে যাচ্ছে।অথচ সে ইচ্ছে করলেই বলতে পারতো “তুহা ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা দিয়ে হাটলে তো এক্সিডেন্ট হবেই।তুমি কোনদিন নিজেকে নিয়ে একটু সিরিয়াস হবে বলবে?আমাকে এতো প্যারা দিচ্ছো কেনে?”

কিন্তু সে এসব না বলে সব দোষ নিজের উপর চাপাচ্ছে।এই মানুষটাকে আমি যতো দেখি ততোই মুগ্ধ হই!এই মুগ্ধতা কখনো শেষ হওয়ার নয়।শৈবাল উঠে গিয়ে ফাস্টএইড বক্স টা এনে নতুন করে পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে পা টা খুব যত্ন সহকারে টানটান করে মেলে দিয়ে তার নিচে একটা বালিস দিয়ে রাখে।

তার এই কাজ গতো তিন দিন ধরেই অব্যাহত রয়েছে।প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠার পর আমাকে ধরে নিয়ে ওয়াশরুমে দিয়ে আসতো,ফ্রেস হয়ে বেরর হলে আবার খুব যত্ন করে বেডে বসিয়ে দিতো।নিচ থেকে গিয়ে নাস্তা নিয়ে আসতো।পড়ার সময় বই গুলো সামনে এগিয়ে দিতো,কিছু না বুঝলে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতো।আর আমি মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম,শৈশব থেকে এতো অত্যাচার পেয়ে একসময় এতো কেয়ারিং একজন জীবন সঙ্গী পাবো ভাবিনি।ভেবেছিলাম বাকী জীবন টাও অবহেলায়ই কেটে যাবে।আগে কখনো কষ্ট পেলে কান্না করতাম না।আর এখন অল্প সুখেই চোখে পানি চলে আসে।

‘তুমি বসে একটু রেস্ট নাও আমি এখনি আসছি।’
‘কোথায় যাচ্ছেন?’
কথাটা শুনে শৈবাল দুষ্টু হেসে বললো,
‘চোখে হারাচ্ছো নাকি স্বামীকে?তোমার পাশে শুয়ে থাকবো নাকি সারাদিন সারা রাত?’
তার কথাটা শুনে আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলি,

‘ছিহঃ নেগেটিভ ভাবছেন কেনো?’
‘যাহ বাবা নেগেভিট ভাববো কেনো?আমার বউ আমাকে চোখে হারাচ্ছে সেটা তো সত্যিই।তাই আমার ভাবনাটাও পজেটিভ।’
‘হুহহহ বলছে আপনাকে,বেশি বুঝেন আপনি।’
আমার কথা শেষ হতেই শৈবাল কি যেনো বিরবির করতে করতে চলে যায় রুম থেকে।

বসে বসে পড়ছি আমি,আমার পাশে হিমেল বসে আছে।সে বায়না করছে আজ আমার সাথে পড়তে বসবে।কিছু না বুঝলে আমি তাকে বুঝিয়ে দিবো!তাই সে আমার সাথে বসেই পড়ছে!পড়ছে কম কথা বলছে বেশি,তার জন্য আমি পড়ায় মনোযোগী হতে পারছি না।কিন্তু তারপরো চুপচাপ হ*জম করছি।

ভালোই লাগছে আমার বেশ।এতো দিন জ্বালানোর মতো কেউ ছিলোনা আর এখন যে আছে তাকে খুব সহজেই সহ্য করছি আমি।একটুও বিরক্ত লাগছে না আমার।বরং মনের মাঝে আলাদা একটা শান্তি বয়ে যাচ্ছে।একটু পর দরজা ঠেলে শৈবাল রুমে ঢুকে।তার হাতে দুইটা পলিথিন।এসেই একটা হিমেলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

‘এই নে ধর এটা নিয়ে বড় মার হাতে দে।’
‘আইসক্রিম ভাইয়া?ওয়াও!’
খুশিতে নাচতে নাচতে হিমেল রুম থেকে বের হয়ে যায়।আমি তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছি।শৈবাল আমার পাশে ধাম করে বসে বললো,
‘নাও ধরো এটা।’
আমি হাতে নিতে নিতে বললাম,

‘কি করবো এটা আমি?’
‘হাতে নিয়ে বসে থাকো।আর নাহলে ইচ্ছে হলে খেতে পারো।’
তার ত্যাড়া কথায় আমি চোখ মুখ কুচকে ফেলে পলি খুলে দেখি তার মধ্যে দুইটা আইসক্রিম আর ফুসকা।আমি আইসক্রিম দুইটা বের করে তার দিকে একটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,

নীড়ের খোজে পর্ব ৯

‘খাবেন?’
‘যে আইসক্রিমের জন্য এক্সিডেন্ট হলো তারই খাওয়া উচিত এটা,আমার না!!’

নীড়ের খোজে পর্ব ১১