উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ৮

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ৮
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

রাহাতের একটি বাণী পুরো বাড়িতে তোলপাড় তুলে দিলো। সকালের নাস্তার সমস্ত আয়োজন পন্ড হলো। কেউ আর কাজকর্মে মন বসাতে পারলোনা। অফিস যাওয়া হলোনা শামীমের। এতদিন দুজনের মাঝে গোপন দ্বন্ধ চললেও এবার প্রকাশ্যে মুখ খুললো লিলি। তার গলায় তীব্র অধিকারবোধ,

-“আমি এখনো আপনার বিবাহিতা স্ত্রী বর্তমান আছি। যাকে একবার তা*লা*ক দিয়েছেন, তাকে ফিরিয়ে নেওয়ার পথ আপনার জন্য খোলা নেই।”
রাহাতে চোয়াল দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে অত্যন্ত অপ্রসন্ন। ক্রুদ্ধ গলায় জোরদার জবাব,
-“এত কিছু জানো যখন, তখন এটাও নিশ্চয়ই জানো কারো সম্পর্কে অনিহা থাকার পর তার মতামতের গুরুত্ব না দিয়ে সম্পর্কে জড়ানো অনুচিত।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

লিলির চোখেমুখে আগুনের লাভা দাউদাউ করে উঠছে। নিজের অধিকার ধরে রাখতে সে এতটুকুও কার্পন্য করবেনা। দ্বিগুণ তেজি গলা তার,
-“সম্পর্ক একা আমার মতে তৈরি হয়নি। দুজনের পরিবার, আপনি – আমি তারপরই বিয়ে হয়েছে। যেখানে সম্পর্ক চিরতরে ছি*ন্ন হয়ে গিয়েছে, সেখানে নতুনভাবে সম্পর্কে জড়াতে আমিতো কোন দো*ষ দেখিনা। আর এতই যখন প্রাক্তনের প্রতি ভালোবাসা, তাহলে তা*লা*ক দিলেন কেন? মেরুদন্ডহীন, কা*পু*রু*ষ।”

বিদ্রুপের স্বরে কা*পু*রু*ষ বলায় চামড়া ভেদ করেই বেশ লাগলো রাহাতের। তবে ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে জবাব বের হলোনা। সত্যিই তো সে কা*পু*রু*ষ। যে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারেনা, অন্যের কথায় যাকে নির্ভরশীল হতে হয়। সে মানুষ হতেই পারেনা।
নাসিমা বেগমকে উদ্দেশ্য করেই লিলি বলল,

-“আমার জীবন বি*প*র্য*য়ে*র মুখে ঠে*লে দিতে আপনি দায়ী। আমি শান্তি না পেলে, আপনাকেও বিন্দু পরিমাণ শান্তি আমি দেবো না।”
দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পেলেন না নাসিমা বেগম। আজ ভেতরে কিছুটা ভ*য় ঢুকে গিয়েছে। থরথর করে কাঁপন ধরলো শরীরে। ভর সামলাতে না পেরে চেয়ার ধরেই বসে পড়লেন।
আনোয়ার হোসেন শামীমের উদ্দেশ্যে গম্ভীর স্বরে বললেন,

-“তুমি এখন যা চাইছো, তা সম্ভব না। তখন বুঝতে পারোনি ঊর্মি তোমার কাছে কী? তার হাত ছেড়ে অন্যজনের হাত ধরেছো। এখন আবার তার হাত ছাড়তে চাইছো। একবার এক একজনের হাত ধরবে আর ছাড়বে এটাতো বরদাস্ত হবেনা।”
প্রতিত্তোরে উষা তুখোড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রশ্ন করলো আনোয়ার হোসেনকে,
-“তাহলে আমার বোনের সাথে অন্যায় কিভাবে বরদাস্ত করলেন?”
সময় নিলেন না আনোয়ার হোসেন,

-“আমি চেষ্টা করেছি। সে তখন অন্ধকার জগতে ডুবে ছিলো।”
আজ যেন নাসিমা বেগমের সকল পর্দা ফাঁস হতে চললো। রাহাত অকপটে স্বীকার করে ফেললো মায়ের সমস্ত সত্যি। কিভাবে তাকে প্রতিনিয়ত মানসিক যন্ত্র*ণা দিয়ে, মৃ*ত্যু ভ*য় দেখিয়ে চাপ প্রয়োগ করেছে।
আনোয়ার হোসেন হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন। বাকহারা, বিমূঢ় ভঙ্গিতে শুধু স্ত্রীকে দেখে গেলেন। হাতের প্রথম চ*ড় বসিয়ে দিলেন রাহাতের গা*লে।

-“কু*লা*ঙ্গা*র, তুই আগে বলতে পারলিনা? ম*রে যেত এই নোং*রা মহিলা। ম*র*লে পৃথিবী থেকে একটা কীট দূর হতো। এই পরিবারের সবগুলো মানুষের জীবনে শান্তি বজায় থাকতো।”

অসহায় হয়ে পড়লেন নাসিমা বেগম। যে প্রিয় স্বামীর কাছ থেকে সারাজীবন ভালোবাসা পেয়ে এসেছেন, তার মুখেই আজ নিজের মৃ*ত্যু কামনা। চোখের কোনে জল ভিড় জমালো। সন্তানরা ও মুখ ফিরিয়ে নিলো। বুকে চিনচিন ব্যথার আভাস পেলেন। সৌন্দর্যে অন্ধ হয়ে একসাথে কতগুলো জীবন বিপর্যয়ে ফেললেন। লিলিকে এই বাড়িতে নিয়ে আসার কাজেও তার হাত সর্বোচ্চ। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন রূপই হলো সবকিছু।
রাহাত কাঁপা স্বরে বলল,

-“আমি আর নিতে পারছিনা বাবা। ঊর্মিকে ছাড়া আমি ভালো নেই। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।”
-“তুই ম*রে গিয়েই সবাইকে শান্তি দে।”
উষা গর্জে উঠলো,
-“আমার বোন কোন সস্তা পণ্য নয়। তার সম্মান আছে। ইচ্ছে হলেই তাকে কেনা-বেচা যায় না। আমি চাইবোনা আপনার মতো অ*মা*নু*ষের জীবনে আমার বোন ফিরে আসুক।”

রাহাত প্রত্যাশিত দৃষ্টিতে চাইলো শামীমের নিরব চোয়ালে। প্রতিত্তোরে শামীম তাকে নিরাশ করলো। শামীমও আজ তার পক্ষে কথা বললোনা। নির্লিপ্ত গলায় জবাব দিলো,
-“উষা আমার স্ত্রী, তাকে নিয়ে সব ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আমার আছে। ওর বোন নিয়ে কথা বলার অধিকার আমার নেই। তাই তার বোনের ব্যাপার তার উপরই আমি ছেড়ে দিলাম। উষা আর তার পরিবার ছাড়া কেউ তার বোনের ভালো বুঝবেনা, চাইবে ও না। যদি চাইতো, তবে তার জীবনটা ন*র*কে ঠে*লে দিত না।”

উষার হাতেই শামীমের ফোন ছিলো। উষা ফোন বাড়িয়ে দিয়ে জানালো অফিস থেকে ফোন এসেছে।
এতক্ষণ অফিসের কথা ভুলেই বসেছিলো শামীম। আধাঘন্টা পেরিয়ে গিয়েছে অফিস টাইম। শামীম কোনোভাবে অজুহাত দিয়ে জানালো ” কিছু সমস্যায় পড়েছি। এক্ষুনি আসছি স্যার।”

শামীমের পর একে একে প্রত্যেকে নিজের কাজে গেলো। জায়গাটি মুহূর্তেই খালি হলো। একা পড়ে রইলেন নাসিমা বেগম।
কারো নাস্তা করা হয়নি বিধায় শামীমের নাস্তা ঘরে নিয়ে গেলো উষা। দ্রুত তৈরি হতে হতেই শামীম বলল,
-“এখন খাওয়ার সময় নেই। আমি দুপুরে খেয়ে নেবো। তুমি খেয়ে নাও।”
উষা নিজ হাতে শামীমের মুখের কাছে নাস্তা তুলে বলল,

-“আপনি তৈরি হতে থাকুন। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”
এত ঝড় ঝাপটার মাঝেও শামীমের মনে প্রশান্তি বয়ে গেলো। তৃপ্ত হেসে উষার কপালে গভীর চুম্বন করে বলল,
-“আমি কখনোই তোমার হাত ছাড়বোনা, উষা।”
উষার চোখে পানি। ধরা গলায় বলল,

-“আমার আপুর জীবনটাই কেন এমন হলো? সবার সাথে বে*য়া*দ*বি করলে আমি করেছি। সে তো ভালো মেয়ে। ভালোদের সাথেই কেন সবসময় খা*রা*প*টা হয়?”
শামীম চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
-“না কেঁদে আমাকে খাইয়ে দাও, নিজেও খাও।”
শামীমের দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে নিজেকে স্বাভাবিক করে খাইয়ে দিলো। শামীম বের হওয়ার আগে উষা তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,

-“যদি আপুর মতো আমার জীবনেও এমন পরিস্থিতি আসে, তবে আমি আগে আপনাকে খু*ন করবো।”
শামীম নিঃশব্দে হেসে বলল, “আচ্ছা। আমি আজই তলো*য়ার কিনে আনবো।”
শামীমের দুষ্টুমি বুঝতে পেরে তাকে ছেড়ে ঠে*লে বের করে দিলো উষা।

আনোয়ার হোসেন রে*গে*মে*গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন। উদাস ভঙ্গিতে বসে রইলো রিয়া। কাঁধে কারো স্পর্শ টের পেতেই ফিরে তাকালো। উষা দাঁড়িয়ে আছে। নরম স্বরে বলল,
-“কিছু খেয়ে নাও আপু। বাবা বেরিয়ে গেছেন, ভাইয়াও বেরিয়েছেন। আম্মাকে ডেকে তার সাথে খাবার খেয়ে নাও। পারলে ভাবিকেও ডেকে নাও। আমি খাবার দিচ্ছি।”
রিয়া নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে বলল,

-“তুমি খেতে বলছো? খাবার কি গলা দিয়ে নামবে, বলো?”
-“তুমি জানো, আমি ডাকলে তারা দুজনের একজনও খেতে আসবেনা। তাছাড়া আমি কখনোই ডাকতে যাবো না। নিজেও খেয়ে নাও, আম্মাকেও ডাকো।”
রিয়া বিরস বদনে জবাব দিলো,

-“আমি দেখছি কি করা যায়। তুমি খাবার দাও।”
উষা খাবার বেড়ে রিয়ার হাতে দিলো। সে এক প্লেট খাবার লিলির ঘরে দিয়ে অন্য প্লেট হাতে মায়ের ঘরে ঢুকলো। খাওয়াতে পারলোনা মাকে। পরাজিত হয়ে ফিরে এলো। সকাল গড়িয়ে দুপুর হচ্ছে। এখনো দুপুরের রান্না হয়নি। উষা বুঝতে পারছেনা তার কী করা উচিত। তাই নিজে নিজেই ইচ্ছে মতো রান্না করে নিলো। দুপুরেও একই ব্যাপার ঘটলো। নাসিমা বেগম খেলেন না। লিলি ঘর থেকেই বের হয়নি। তাই বলা যাচ্ছে না সকালের খাবার খেয়েছে কি-না? রিয়াও আর দুপুরে খায়নি। এমন পরিস্থিতিতে উষা নিজেও খেতে পারলোনা।

দাঁতের ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফিরলো সন্ধ্যের আগে। বাবা আর ভাইয়া সাথে গিয়েছিলেন। মা ভাবির কাছেই ছিলো। ভাবি দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বেবি আসার কথা শোনার পর থেকেই আশিকের মাঝে অনেক পরিবর্তন লক্ষ করেছে ঊর্মি। আগে তানজিনার কোন খোঁজ-খবরও থাকতোনা। এখন নিয়মিত নিজে বসে থেকে খাবারের ব্যাপারে তদারকি করে। খাবার নিশ্চিত করে তারপই বাসা থেকে বের হয়।

উষাটাও শামীমের সাথে মানিয়ে নিয়েছে। এত এত ভালোর মাঝেও ঊর্মির ভালো থাকা হয়না। রাহাত কি নতুন বউকে তেমনি ভালোবাসছে? যেমনটা তাকে বেসেছিলো? নাকি তারচেয়ে বেশি ভালোবাসছে। নিজের বিছানা, নিজের ঘর, সবচেয়ে বড় কথা তার মানুষটাকেই দখল করে আছে অন্যকেউ। প্রতিটি উষ্ণ স্পর্শ উপভোগ করছে মানুষটির বুকে মাথা রেখে।

বিছানা খামছে ধরলো ঊর্মি। আর কিছু ভাবতে পারছেনা। হাঁসফাঁস করে উঠলো ভেতরটা, হৃদযন্ত্রে অনিয়ন্ত্রিত জ্বলন সৃষ্টি হলো। মুঠোফোনের শব্দে চমক কাটলো তার। সেই অপরিচিত নম্বর। রিসিভ করতে মোটেই ইচ্ছে করলোনা। দুবার রিং হওয়ার পরই তৃতীয়বার রিসিভ করলো। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলোনা ঊর্মি। ক্রন্দনরত ভাঙা গলায় বলল,
-“হ্যালো।”

অবাক করার বিষয় ঘটলো আজ। এতদিন পর ওপাশ থেকে জবাব এলো। কাঁপা কাঁপা স্বর। চমকে উঠলো ঊর্মি। তার বিন্দুমাত্র কষ্ট হচ্ছে না রাহাতকে চিনতে।
-“ঊ…র্মি!”

হাত থেকে ফোন ঝরে পড়লো। তড়াক করে উঠলো হৃদয়। জবাব দিতে পারলোনা ঊর্মি। দু-চোখ জুড়ে মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। উল্টো হয়ে পড়ে থাকা ফোন থেকে ক্রমশ বিচলিত শব্দ শোনা যাচ্ছে,
-“ঊর্মি, ঊর্মি, ঊর্মি কাঁদবেনা তুমি। কষ্ট হচ্ছে আমার।”

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ৭

আজ উষার মতোই জে*দ চেপে বসলো। ঘৃ*ণা হলো মানুষটির প্রতি। ব্যথা দিয়ে কষ্ট পেতে বারণ করছে। সুইচ অফ করে দিলো ফোনের। দু*হা*তে চুল খামছে ধরে ছটফটিয়ে উঠলো। দু’ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে কিছু শব্দগুচ্ছ বারবার উচ্চারণ করলো, “বে*ই*মা*ন! প্র*তা*র*ক! নিষ্ঠুর, একজনের সাথে ফূর্তিতে মেতে আমাকে আবার ক*ষ্ট দিতে চাইছে, অপ*মান করছে।”

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ৯