উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ৯

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ৯
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

চারদিকের নিঝুম, নিস্পন্দতা কাটিয়ে ডান দিকে ঘোরা ঘড়ির কাঁটা নৈঃশব্দ্যর অবসান ঘটালো। ছন্দ ধ্বনিতে ঘড়ির কাঁটায় নজর দিলো উষা। সময়টা রাত্রি দশ এর ঘরে স্থির হয়েছে। পাশেই গভীর মনযোগে অফিসের কাগজপত্র ঘাটাঘাটি করে যাচ্ছে শামীম। আশেপাশে কেউ থাকতে পারে এমন ভাবনা পর্যন্ত তার চোহারায় ফোটে ওঠেনি। বেশ খানিক সময় ধরেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে রইলো উষা। ফোলা গাল দুটো নিয়ে থম মেরে রইলো। হাত বাড়িয়ে পাশ থেকে একটি কাগজ হাতে নিলো উষা। উল্টেপাল্টে দেখে জিজ্ঞেস করলো,

-“এগুলো দিয়ে কী করবেন?”
চোখদুটো স্থির রেখেই কাজে নিমগ্ন হয়ে জবাব দিলো শামীম। ছোট খাটো বাক্যে শেষ করলো উত্তর।
-“অফিসের কাজ করছি।”
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই ফুঁসে উঠলো উষা। অফিসের কাজ বাড়িতে করতে হবে কেন? আবার ছোটখাটো বাক্যে জবাব দিলো। নিজেকে দমিয়ে রেখে শান্ত সুরে ফের প্রশ্ন করলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“কী করবেন এগুলো দিয়ে, সেটা জিজ্ঞেস করেছি।”
লম্বা শ্বাস ফে*লে উষার দিকে শান্ত চোখে তাকালো শামীম। কন্ঠে গম্ভীরতা ফুটিয়ে বলল,
-“কাজ করছি উষা। পরে বিরক্ত কর।”
খা*রা*প লাগলো উষার। শব্দহীন পায়ে উঠে এলো। দরজা ধরে বেরিয়ে চলে এলো রিয়ার ঘরে। ফোনেই কারো সাথে কথা বলছিল রিয়া। উষাকে দেখেই ফোনের ওপাশের ব্যক্তিকে বলল,

-“পরে ফোন দিচ্ছি তোমায়।”
উষা বিরস মুখে বলল,
-“তোমাকেও বিরক্ত করলাম?”
রিয়া হেসে বলল,
-“বিরক্ত হবো কেন? মন খা*রা*প তোমার? ভাইয়া কিছু বলেছে?”
-“আমি নাকি বিরক্ত করছি তাকে। অফিসের কাজ বাড়ি বসে করছে। আমি শুধু এটা-ওটা জানতে চাইলাম। ওমনি তিনি বিরক্ত হয়ে গেলেন।”

রিয়া অল্প শব্দে হাসলো।
-“হয়তো কাজের চাপ বেশি। আচ্ছা ভাইয়া যখন কাজ করছে, তখন আমরা একটা কাজ করি চলো।”
-“কি কাজ?” প্রশ্ন করলো উষা।
প্রত্যুত্তরে রিয়া বলল,

-“ব্যাডমিন্টন খেলবো, চলো। প্রতি শীতে আমি আর ভাইয়ারা খেলি। এবার পরিস্থিতির কারণে কেউই খেলছেনা।”
উষার ঠোঁটের কোনে হাসি ফোটে উঠলো। উৎফুল্ল মেজাজে বলল,
-“আমি,আপু আর ভাবি ও খেলতাম। এ বছর শীতে তোমাদের বাড়ি থাকায় আর খেলা হচ্ছে না। তাছাড়া ভাবিকে মা এখন রাতে বের হতে দেবেন না।”
রিয়া বলল, “চলো।”

রেকেট আর কর্ক খুঁজে দুজনেই বেরিয়ে পড়লো। বাড়ির সামনে লাইটের আলোয় খেলার প্রস্তুতি নিলো। কোমরে ওড়না বেঁধে দুজনেই বেশ জমিয়ে তুললো খেলা।
হাতের কাজ শেষ করে রিয়ার ঘরে পা বাড়ালো শামীম। উষা হয়তো রাগ করে সেখানেই গিয়েছে ভেবে এগোলো। রিয়ার ঘর ফাঁকা দেখে বেরিয়ে আসতে নিলো।

বাইরে থেকে কারো আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। রিয়ার ঘর থেকে না বেরিয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো শামীম। সম্মুখে দৃষ্টি ফেলতেই দেখতে পেলো দুজন মানবীকে। যারা প্রফুল্লচিত্তে ব্যাডমিন্ট খেলছে। মাঝেমাঝে হৈ-হুল্লোড় করে খেলাটা আরেকটু জমিয়ে তুলছে। সেদিকেই গেলো সে। বাসা থেকে বেরিয়ে ওদের সামনে দাঁড়ালো। উষা মুখ ফিরয়ে নিতেই অগোচরে হাসলো শামীম। রিয়া বলল,

-“ভাইয়া খেলবে?”
শামীম খানিকটা ভাবুক স্বরে বলল,
-“উমম, খেলা যায়।”
শামীমের সাথে খেলে পরপর রিয়া,উষা দুজনই ক্লান্ত হয়ে পড়লো। দুজনের অবস্থা দেখে বেশ শব্দ করেই হাসছে শামীম। উষা মাটিতে বসে পড়লো জিরিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে।

রাহাতের অপেক্ষায় জাগ্রত লিলি বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় বাতির আলোতে হৈচৈ এর শব্দ। ভালোভাবে নজর দিতেই শব্দের উৎস খুঁজে পেল।
সবার এত ভালো থাকা যেন সহ্য হলোনা তার। বিশেষ করে উষার এত হাসিখুশি মুখশ্রী তার ভালো লাগলোনা। আপন মনে আওড়ে গেলো, “খুব সুখেই আছো”।

হাত ঘড়িতে সময় দেখে রিয়া আর উষাকে বেশ তাড়া দিলো শামীম।
-” মাটিতে থেকে উঠে পড়। এভাবে বসে থাকলে ঠান্ডা লাগবে।”
রিয়া উঠে ঘরের দিকে হাঁটা ধরলো। উষার দিকে হাত বাড়ালো শামীম। তাকে উপেক্ষা করেই উষা উঠে পড়লো। ময়লা ঝেড়ে শামীমের আগেই হাঁটতে লাগলো। পাশ থেকে কাঁধের উপর হাত দিয়ে দাঁড়ালো শামীম। তার হাত ঝাড়া মে*রে সরিয়ে দিলো উষা।

-“আমি তো বিরক্ত করি, সরুন।”
সূক্ষ্ম অভিমানে খোঁ*চা দিলো উষা। বুঝতে পেরে মৃদু হাসলো শামীম। দূর থেকেই প্রখর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো লিলি।
ময়লা জামাকাপড় নিয়েই শুয়ে পড়তে নিলো উষা। শামীম টে*নে তুলে দিলো তাকে। কড়া চোখে তাকিয়ে বলল,
-“এগুলো চেঞ্জ করে, তারপর ঘুমাতে যাবে।”

বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করে উঠে পড়লো উষা। জামা হাতে ওয়াশরুমে ঢুকলো। দশমিনিটের বেশি সময় অতিবাহিত হওয়ার পরই শামীম দরজায় টোকা দিলো।
-“এতক্ষণ কী করছো?”

জবাব দিলোনা উষা। রাগ তার ক্রমশই বাড়লো। জে*দ করেই ঠান্ডা পানিতে গোসল করে নিলো। মিনিট দুয়েক পর দরজা খুলে বের হতেই শামীমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো।
উষা গোসল করেছে বুঝতে পেরেই চোখ রাঙিয়ে তাকালো শামীম। তিরিক্ষি মেজাজে কঠোর গলায় বলল,
-“ঠান্ডার মধ্যে গোসল করেছো কেন?”
উষার ত্যাড়া জবাব,

-“মনের সুখে গোসল করেছি।”
হতাশ হলো শামীম। যে বোঝেনা,তার সাথে রাগ দেখিয়েও কোন লাভ নেই। উষাকে কম্বলে মুড়িয়ে ঠান্ডায় জর্জরিত হাত জোড়া গরম হাতের কবলে চেপে নিলো। শীতল হাত জোড়া অনবরত ঘঁষে উষ্ণ করে তুললো। ভেজা চুল বালিশের উপর অবিন্যস্তভাবে ছড়িয়ে দিলো। ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে বলল,

-“রাগ কমেছে?”
উষা থমথমে গলায় বলল,
-“আমি তো বিরক্ত করি।”
-“তখন কাজ করছিলাম তো।”
-“অফিসের কাজ বাড়িতে কেন করতে হবে?”

-“আচ্ছা বাড়িতে আর অফিসের কাজ করবোনা। কিছু হিসেব-নিকেশ বাকি ছিলো। আগামীকাল যাতে বেশি চাপ না পড়ে সেজন্যই এগিয়ে রাখছিলাম।”
দু-হাতে ঝাপটে ধরে উষ্ণ বুকে মুখ গুঁজে দিলো উষা। গভীর নিদ্রায় নেত্রপল্লব মুদে এলো। অভিমানের সূক্ষ্ম দেওয়াল ভেঙে পড়লো। টুপ করে চুমু খেলো শামীমের পুরুষালি গলার ঢেউ খেলানো কন্ঠমণিতে।

কলিংবেলের শব্দে দরজা খুললো তানজিনা। বাইরেই একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বাক্স টাইপ কিছু।
-“জি কি চাই?”
প্রত্যুত্তরে লোকটি বলল,
-“ম্যাম একটা পার্সেল এসেছে।”
ভ্রু কুঁচকে গেলো তানজিনার। প্রশ্ন করলো,
-“কিসের পার্সেল? কার নামে এসেছে।”
-“জি নাম দেওয়া আছে ঊর্মিমালা।”

ঊর্মি কিছু অর্ডার করেছে ভেবে তানজিনা জিনিসটা রিসিভ করে লোকটিকে বিদায় জানালো। ঊর্মির ঘরের দিকে এগোলো সে।
সারাদিন হাঁটাচলা বিহীন একটি কক্ষে বসে থাকা ছাড়া আর কোন কাজ নেই ঊর্মির। কাজের ফাঁকে ফঁকে মা, ভাবি এসে গল্প করে যায়। কাজ শেষে বাবা আর ভাই ও এসে দেখা করে যায়। তানজিনার হাতে বাক্স দেখে কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলো ঊর্মি,

-“তোমার হাতে কী ভাবি?”
-“তোমার পার্সেল।”
ঊর্মি অবাক হলো।
-“কিন্তু আমিতো কিছু অর্ডার দিইনি?”
তানজিনাকেও অনেকটা অবাক হতে দেখা গেলো।
বলল,

-“উপরে তো কারো নাম লিখা নেই। তুমি বরং খুলে দেখ। আমি যাচ্ছি।”
জিনিসটা খুলবে কি খুলবেনা ভেবে পরক্ষণেই খোলা শুরু করলো ঊর্মি। নামের দিকে আর খেয়াল করলোনা।

রাত যখন গভীর হলো, নিজ মর্জিতে হেলেদুলে বাড়ি ফিরলো রাহাত। লিলি জেগেই ছিলো। রাহাতের মুখোমুখি হয়ে প্রশ্ন করলো,
-“কোথায় ছিলেন এতরাত পর্যন্ত?”

লিলিকে উপেক্ষা করেই জামাকাপড় হাতে গোসলে চলে গেলো রাহাত।
ক্রুদ্ধ হয়ে কাঁচের গ্লাস ফ্লোরে ছুঁড়ে মা*র*লো লিলি। ওয়াশরুম থেকেই গ্লাস ভাঙ্গার বিকট শব্দ পেলো রাহাত। বিশেষ গুরুত্ব দিলোনা সে। নির্বিকার রইলো। ধীরেসুস্থে গোসল নিয়েই বের হলো। আলাদা কম্বলের নিচে একপাশ হয়ে শুয়ে ঊর্মি আর তার পুরোনো দিনের ছবিগুলোতে হাত বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফে*ল*লো।

সবকিছুই শান্ত ভাবে পরোখ করলো লিলি। আচমকা রাহাতের হাত থেকে ফোন কেঁড়ে নিলো। কিছু বুঝতে না দিয়েই সজোরে ছুঁড়ে মা*র*লো। ফোনের প্রতিটি পার্ট আলগা হয়ে পড়লো। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো রাহাতের। চোখের সফেদ অংশ রক্তিম আভায় রাঙা হলো। দপদপ করে ফুলে উঠলো কপালের রগগুলি।
ফোনের দিকে তর্জনী ঠেকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্নবিদ্ধ করলো লিলিকে,

-“এটা কী করলে তুমি?”
রাহাতের চেয়ে দ্বিগুণ রাগ নিয়ে লিলি বলল,
-“দূরে থেকেও আমার জায়গা দখল করে আছে ওই মেয়ে। কী আছে ওই প*ঙ্গু মেয়ের মধ্যে?”
এই পর্যায়ে ক্রো*ধ দমিয়ে রাখতে পারলোনা রাহাত। স*জো*রে চ*ড় বসিয়ে দিল লিলির গালে। আঙ্গুল তুলে শাসিয়ে বলল,

-“ডোন্ট ক্রস ইওর লিমিট। ঊর্মি তোমার জায়গা দখল করেনি, বরং তুমি তার জায়গা দখল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছো। দ্রুত কাঁচ পরিষ্কার করবে। এত সাহস কোথা থেকে পাও তুমি?”
ফোনের প্রতিটি পার্ট খুঁজে নিজের জায়গায় চলে গেলো রাহাত। গালে হাত দিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইলো লিলি। এতটা মনে জায়গা দখল করে আছে মেয়েটা?

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ৮

(আপনারা সবটা খুব দ্রুতই জানতে চাচ্ছেন। কোন চরিত্রের মনে কী আছে সেটা এক পর্বে ক্লিয়ার করে দিলে তো একদিনেই গল্প শেষ। একটু সময় দিন আমায়। হ্যাপি রিডিং)

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১০