প্রণয়ের বিরহ পর্ব ২৭

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ২৭
তাসনিয়া রহমান স্নিগ্ধা

ধীর পায়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম। আসিফ রেগে হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেল একটু আগেই।ওর রাগার যথেষ্ট কারণ আছে। কিছুক্ষণ আগেই আমি ঠাস ঠাস করে বেশ কয়েকটা চ’ড় বসিয়ে দিয়েছি ওর উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের গালে।ইগো তে লেগেছে বোধ হয় খুব সেজন্য আর এক মুহূর্তও দেরি না করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে।

আমি কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। দুটো ছেলে মেয়ে স্কুল ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরছে বোধ হয়। একটা আরেকটাকে খোঁচা দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে আবার থেমে যাচ্ছে সঙ্গীর জন্য। দেখতে কত সুন্দর লাগছে! নিজের জন্য এক আকাশ সমান আফসোস হলো আমার।দুই দুইবার ভালোবেসে ঠকে এলাম।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ তাসু?’
হঠাৎ মায়ের ডাকে ঘোর ভাঙলো আমার।মা রান্নাঘর থেকে ডাকছে আমাকে, আজকে একটু রান্নাঘরে হেল্প করতে চেয়েছিলাম আমি। খুব ইচ্ছে করছিল আসিফ কে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবো কিন্তু এখন সেই ইচ্ছা টা ম’রে গেছে। এখন সবার আগে ইচ্ছে করছে ওকে নিজের হাতে বিষ খাইয়ে মে’রে ফেলতে পারলে ভালো হতো । কিন্তু আমি সেটা করতে পারবো না কারণ আজ না হোক একসময় তাকে ভালো বেসে ছিলাম আমি।তার মাসুল দিতে হবে তো আমাকে!

‘ আম্মা, পূর্ব সাহেব খুজতেছে আপনাকে। তাড়াতাড়ি বসার ঘরে চলেন।’
নিজের ঘরে বসে ডায়েরি তে মাত্র কয়েক লাইন লেখা শেষ করেছেন আম্মা তখন একটা মেয়ে এসে এই সংবাদ দিলো। আম্মা তাড়া তাড়ি করে ডায়েরিটা বন্ধ করে ট্রাংক টাতে রেখে মেয়েটার সাথে বেরিয়ে গেলেন। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ট্রাংক তালাবদ্ধ করার কথা তার মনেই রইলো না।

বসার ঘরে রাজকীয় হালে বসে আছে পূর্ব,পাশেই তূর্য ফোনে গেমস নিয়ে মেতে আছে।দিন দুনিয়ার কোন খবরই নেই ওর।গত আধ ঘন্টা হলো এসেছে, এরপর থেকে ফোনেই ডুব দিয়েছে। ওদের সামনে রূপ লাবণ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকজন সুন্দরী মেয়ে, পূর্ব আর তূর্যের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছে বহুবার কিন্তু কিছুই কাজ হয়নি।ফিরেও তাকায় না এদের দিকে। আম্মা বসার ঘরে এসে মাথায় আধ ঘোমটা দিয়ে পূর্বের সামনের সোফায় আয়েশ করে বসলেন।

‘ কি ব্যাপার পূর্ব সাহেব, হঠাৎ করে আজ অসময়ে আমার এলাকায় আপনার পায়ের ধুলো পড়লো যে? কোন সুন্দরী লাগবে কি আপনার,লাগলে বলেন এই কয়টা সব আপনার সেবায় নিয়োজিত থাকবে।'(আম্মা)
পূর্বের ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক দেখা গেল। উপহাসের হাসি হেসে পূর্ব পকেট থেকে ফোন বের করে একটা পিকচার আম্মার সামনে তুলে ধরলো। এরপর বেশ শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ এই পিকচার এ থাকা মেয়েটাকে কি আপনি চিনতে পারছেন মিসেস তারা খানম?’
ফোনের দিকে দৃষ্টিপাত করে প্রায় ভুত দেখার মত চমকে উঠলেন আম্মা। পূর্বের দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন কয়েকবার এরপর আবার ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে রইলেন।চোখ দুটো যেন কোটরে থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে তার। পূর্ব আম্মার অবস্থা দেখে আশপাশের দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েগুলো কে ইশারায় চলে যেতে বললো। এরপর ফোনটা উনার সামনে থেকে সরিয়ে নিলো। সামনের টি টেবিলে ফোনটা রেখে দিল পূর্ব, এরপর ধীরে ধীরে বললো,

‘ আমি আপনার সম্পর্কে সবকিছুই জেনে গেছি আম্মা ওরফে শাশুড়ি মা মিসেস তারা খানম।নাহ আপনি আমাকে একদম ভুল বুঝবেন না মা, আমি আপনাকে কোনো দোষারোপ বা আপনার এই পেশা সম্পর্কে কিছু মাত্র কটুক্তি করতে আসিনি। আমি এসেছি আপনাকে শুধু একবার প্রাণভরে সালাম করতে এবং আপনার থেকে দোয়া নিতে। দিবেন দোয়া আমাকে?’
এটুকু বলেই পূর্ব উঠে দাঁড়িয়ে আম্মার সামনে ঝুঁকে উনার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো।

আম্মা ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে আছেন,কি ঘটছে উনার সাথে এসব?স্বয়ং আজমীর চৌধুরী পূর্ব তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো আবার তার কাছে দোয়া চাইলো! এতো সম্মান ও কি তিনি পাওয়ার যোগ্য? পূর্ব তখনও তার সামনে দোয়া নেওয়ার জন্য মাথা নামিয়ে রেখেছে।

আম্মা পূর্বের মাথায় আলতো করে হাত রেখে শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে উঠলেন। পূর্ব আবার গিয়ে নিজের স্থানে বসে পড়ল। এরপর চললো পিন পতন নিরবতা।কারো মুখে কোন কথা নেই, তূর্য, পূর্ব মাথা নিচু করে বসে আছে আর আম্মা নিঃশব্দে কাঁদছেন। থেকে থেকে আম্মার কাঁদার শব্দ নিরবতা ভেঙ্গে দিচ্ছে কিন্তু এতে ওদের কারো কোন অসুবিধা হচ্ছে না।বেশ কিছুক্ষণ পরে পূর্ব মুখ খুললো।

‘ মা, একটু শান্ত হোন। আমরা আপনার অবস্থা টা বুঝতে পারছি। আপনি যেই কারণে এখানে এসেছেন বিশ্বাস করেন আমি বা অন্য কেউ এই জায়গায় থাকলে ঠিক এই পথটাই বেছে নিতাম,কে জানে হয়ত আরও খারাপ পথে যেতাম। আমি জানি আপনি আমার স্ত্রী স্নিগ্ধার মা। আপনার আর স্নিগ্ধা কে নিয়ে পুরো দুই মাস স্টাডি করেছি আমি,আর তারপর সমস্ত প্রমাণ বিচার করে এই সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি।'(পূর্ব)

‘ আর আন্টি, আপনি তো আমাদের জানেন কেন আমরা এই নিষিদ্ধ পল্লীর সাথে যুক্ত।আশা করছি আপনি আমাদের ভুল বুঝেননি একবার ও। এখান থেকে যে কোন মেয়েই বিদেশে পাচার হয়না সেটা আপনি আমি খুব ভালো করেই জানি। আমার বিশ্বাস আপনি জানেন আমার ভাবি কোথায় আছে,যতোই বলুক সবাই যে তাসনিয়া ভাবী কে বিদেশে পাচার করে দেওয়া হয়েছে আদতে তা কিন্তু নয়। আপনি কি প্লিজ বলবেন আন্টি,ভাবী কোথায় আছে?'(তূর্য)

আম্মা কান্না বন্ধ করে পূর্ব তূর্য দুজনের কথাই শুনলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তিনি। সেই মেয়েটা যে তার মেয়ে তাসুই ছিল এটা তিনি ও জেনেছেন গত মাসে। তখন থেকেই পুরো ডায়েরি জুড়ে শুধু মেয়েকে নিয়ে লিখেছেন, মেয়েটা যেন ভালো থাকে সেটা চেয়ে আসছেন। ধীরে ধীরে বললেন,

‘ ও কোথায় আছে আমি ও জানি না। সেদিন লাল রায় কে শেষ করে ও পালিয়ে যায় জানালা ভেঙ্গে। কাকতালীয় ভাবে হলেও আমার অর্ধেক কাজ আমার মেয়েটা করে দিয়েছিল, জানি না এখন সে কোথায় পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে আমার ভয়ে।’

‘ আচ্ছা ঠিক আছে মা, আমরা এখন আসছি।আজ তো ওদের আসার তারিখ।একটু পরেই হয়তোবা ওরা এখানে চলে আসবে।ওরা আসার আগেই আমাদের সটকে পড়তে হবে নাহলে ওরা আমাদের দেখে নিলে সব শেষ হয়ে যাবে!’
বলতে বলতেই পূর্ব আর তূর্য উঠে দাঁড়ালো। এমন সময় বাইরে গাড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল।দিপ্তী উল্কার বেগে ঘরে এসে জানালো বড় সাহেবের গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে বাইরের আঙিনায়। আম্মার মুখ শুকিয়ে গেলো।

‘ আপনারা তো আজ না চাইতেও ধরা পড়ে গেলেন মনে হচ্ছে, আপনাদের গাড়ি যদি ওরা দেখে নেয় তাহলে?'(আম্মা)
‘ আমরা আজ গাড়ি আনিনি।পায়ে হেঁটে এসেছি। চিন্তা করবেন না আপনি ওদের অতিথায়ন করুন, আমরা নিরাপদে সরে যাবো। ওরা কিচ্ছু টি টের পাবে না।’

পূর্ব তূর্যের হাত ধরে ঘর থেকে দৌড়ে বের হয়ে গেল। আম্মা বসা থেকে উঠে তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে এলেন।বড় সাহেব এখনও গাড়ি থেকে নামেননি।যাক বাঁচা গেল, পূর্ব এতক্ষণে লুকিয়ে চলে যেতে পেরেছে হয়তো। বাড়ির অধিকাংশ মেয়ে হুড়মুড় করে বাইরে বেরিয়ে এলো। সুন্দর করে সেজেছে ওরা সবাই।বড় সাহেবের চোখে ভালো লাগানো চাই, নাহলে টাকা বাড়বে না যে! কয়েকটা মেয়ে শরবত হাতে নিয়ে দাড়িয়ে রইল গাড়ির সামনে। সহসাই গাড়ির দরজা খুলে গেল। বাইরে বেরিয়ে এলো তাদের বহু প্রতীক্ষিত সেই বড় সাহেব!

আম্মা বাইরের বসার ঘরে দাঁড়িয়েই ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
‘ বাপের পাপ বাড়িয়েছে আনোয়ার চৌধুরী আর তার পাপ কমিয়েছে আজমীর চৌধুরী! প্রকৃতির কি অদ্ভুত লীলা খেলা!’

মেসে যাওয়ার জন্য সবকিছু গুছিয়ে নিলাম। দেখতে দেখতে কিভাবে যে দুই মাস কেটে গেল খেয়ালই করিনি। হালকা নীল রঙের থ্রি পিস পরে রেডি হয়ে নিলাম।লাগেজ টা নিয়ে বের হবো এমন সময় মা টিফিন বক্স হাতে ধরিয়ে দিলো।
‘ আজ তো গিয়েই আর রান্না করতে পারবি না।রাতে খেয়ে নিস কেমন?’
‘ আচ্ছা মা। এখন আসি তাহলে, দোয়া করো আমার জন্য!’

বের হয়ে এলাম বাসা থেকে।দুই মিনিট পরেই রিকশা মিলে গেল। রিকশাওয়ালা মামাকে মেসের ঠিকানা দিয়ে চুপচাপ বসে আছি। চাঁপা একটা উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।হুট করে মেসে উঠার একদম ইচ্ছে ছিল না কিন্তু বাসায় ও থাকা সম্ভব না আমার পক্ষে। বাসায় থাকলে যখন তখন বের হওয়া যাবে না,আর বের হতে না পারলে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল গুলো শুধরে নিতে পারবো না।এমন সময় একটা কল এলো আমার ফোনে।পিক আপ করতেই ওপাশ থেকে একটা মেয়েলি কণ্ঠ ভেসে এলো,

‘ ম্যাম, আপনি যেই ছেলেটার নাম্বার পাঠিয়ে ছিলেন সেটা ট্র্যাক করা গেছে মাত্র ই। নাম্বারটা ঠিক যেখানে যেখানে যাচ্ছে সেগুলো সব আপনাকে আমি মেসেজ করে জানিয়ে দিতে থাকবো।’
‘ আচ্ছা। ধন্যবাদ মিলি!’
‘ স্বাগতম,ম্যাম।’

কল কেটে গেল। একটু নিশ্চিন্ত হলাম এবার। আসিফকে ট্র্যাক করা গেছে এখন আর কোনো চিন্তা নেই। এবার দেখি ও কি করে আমার ক্ষতি করে?দুই মাস আগে যেদিন ওকে আমি চ’ড় মে’রে’ছিলাম সেদিনই ও আমাদের বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল।যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিল এর শেষ ও দেখে ছাড়বে।ওর কথায় আমি রাজি হইনি তাই নাকি এবার তার ভয়ঙ্করভাবে মূল্য দিতে হবে আমাকে।

আমি জাস্ট ইগনোর করেছিলাম ওকে কিন্তু সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই টের পেয়েছিলাম ও ঠিক কতটা ভয়াবহ লোক।তাই কল সেন্টারের লোকদের সাথে যোগাযোগ করি আর ওকে ট্র্যাক করতে বলি। কিন্তু তখন থেকেই ওর নাম্বার বন্ধ ছিল যেটা একটু আগেই অন হয়েছে। জঘন্য লোক একটা। মিষ্টি মিষ্টি কথায় স্মৃতি হারানোর নাটক করলো কতক্ষন, এরপর বাজে প্রস্তাব করে বসলো।কি ভেবেছিল ও কেঁদেছি বলেই কি আমি সেই আগের মতই বোকা রয়ে গেছি?

কিন্তু আমার একটা বিষয়ে এখনও খটকা লাগে,আসিফ অহেতুক এতো দিন আমাদের বাড়িতে ছিল কেন? আমি নেই,তামু নেই সবাই জানে ও পৃথিবীতে নেই তাহলে ঠিক কি কারণে আমাদের বাসায় এতদিন পরে ছিল ও?এর কারণ কি শুধুই আত্মীয়তা নাকি অন্য কিছু?আর আমাকে নিয়ে ওর প্রস্তাব টা? সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে একটা আরেকটার সাথে। তবে এটুকু বুঝতে পারছি যে আসিফ কোনো বড়সড় বেআইনি চক্রের সদস্য।

প্রণয়ের বিরহ  পর্ব ২৬

ওকে বেশ কয়েকবার গোপনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছি,রাত একটা নেই দু’টো নেই বাতি জ্বলতো ঘরে।আর আমার ঘর ঝাড়া মোছা করতে গিয়ে কয়েকটা বেশ সুন্দরী মেয়েদের অশ্লীল ছবি পেয়েছিলাম খাটের নিচে।প্রত্যেকটা ছবির পিছনে লেখা ছিল ‘ ইটস্ বুকড্’ ।হ্যান্ড রাইটিং দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম ওগুলো আসিফ লিখেছে। কিন্তু কেন তা মাথায় ঢুকলো না কিছুতেই!

প্রণয়ের বিরহ  পর্ব ২৮