বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৬৫

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৬৫
তাসফিয়া হাসান তুরফা

পরপর কয়েকবার মাথায় আলতো হাতের পরশ পেয়ে পিটপিটিয়ে চোখ খুলার চেস্টা করলাম। চোখ খুলে তাকাতেই হাসপাতালের রুম দেখে মনে পড়লো সবকিছু! তড়িৎ গতিতে মাথা তুলে উঠে বসতেই চোখ পড়লো বেডে শুয়ে থাকা পূর্ণর দিকে।

আমার দিকেই শান্ত চোখে তাকিয়ে আছেন। বুঝলাম এতক্ষণ ভালো হাতটা দিয়ে আলতোভাবে তিনিই ডাকছিলেন আমায়! এতক্ষণে মনে এলো – পূর্ণর সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে আবেগে আরেকদফা কাদতে শুরু করেছিলাম। তবে সেবার উনি আর থামান নি আমায়, কাদতে দিয়েছিলেন হালকা হওয়ার জন্য! সেই যে চেয়ারে বসেই নিজের দুহাতে তার ব্যান্ডেজ করা হাত মৃদুভাবে জড়িয়ে ধরে কাদতে কাদতে কখন যে তার পাশেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নিজেও টের পাইনি!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মাত্র পূর্ণর ডাকে হুশ ফিরলো,
—ঘুমের ডিস্টার্ব করতে চাচ্ছিলাম না। তবে এখন ডাক্তার আসবে আমাকে চেক করতে। নার্স এসে বলে গেলো। তাই ডাকলাম!

—আপনি কি মজা নিচ্ছেন? আমি না সত্যিই ঘুমাতে চাইনি। কান্না শেষ হতেই কিভাবে যে চোখ লেগে গেলো টের পাইনি!
—খুব টেনশন করছিলে যে আমার জন্য! এভাবে কেউ কাদে, বউ? চোখমুখের কি অবস্থা করেছো একবারো দেখেছো? অতি চিন্তায়, অতি আবেগে মানুষের মস্তিষ্ক অশান্ত হয়ে পড়ে, তখন তো বিশ্রাম দরকার। তাই তোমার ঘুম আসাটা স্বাভাবিক। লজ্জা পাওয়ার দরকার নেই।
উনার কথায় মাথা নিচু করে সায় দিলাম। আসলেও বড্ড দুশ্চিন্তায় ছিলাম। এখন একটু হালকা লাগছে। এরই মধ্যে পুনরায় তার আওয়াজ,

—তুমি যে আমাকে এত ভালোবাসো এই এক্সিডেন্ট না হলে তো জানতেই পারতাম না, তুরফা রানী! এখন তো আমার খুশিতে তোমাকে কোলে নিয়ে ঘুরতে মন চাচ্ছে। কিন্তু আফসোস আমি সে অবস্থায় নেই!
প্রথম কথাটা হাসিমুখে বল্লেও শেষাংশটুকু চোখেমুখে উদাসী ভাব এনে তিনি বললেন। তার কথার বিনিময়ে হালকা হাসলাম!

—জলদিই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবেন আপনি। এসব এখন বাদ দিন! আপনার ডাক্তার কখন আসবে? বাসায় নিয়ে যেতে হবে তো! বড়াম্মু টেনশন করছে হয়তো! আমি-প্রিয়া এখনো ফিরিনি। আপনার কথাও কেউ জানেনা হয়তো। আমি ফোন দিয়ে বলে দিচ্ছি বাসায় আপনার কথা…

—আম্মুকে ফোন দিয়োনা। এমনিতেই প্রেসারের সমস্যা আছে। যদি ফোনে আমার কথা শুনে বেশি চিন্তায় প্রেসার বেড়ে শরীর খারাপ হয়ে যায় তাহলে ভালো হবেনা। তুমি তার চেয়ে প্রান্তকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দেও। আম্মুকে আমি সরাসরি বাসায় যেয়ে সব জানাবো।

উনার কথায় যুক্তি দেখে মাথা নাড়লাম। এ অবস্থায়ও মায়ের কথা ভাবছেন! প্রত্যেকটি সম্পর্কের প্রতি তিনি সমানভাবে দায়িত্বশীল! কি চমৎকার ব্যক্তিত্ব! আমি আর কিছু বলার আগেই কেবিনে ডাক্তার ও নার্স ঢুকলেন। আমাকে কেবিনের বাহিরে যেতে বললেন পূর্ণর চেকাপ করবেন বলে। সবকিছু দেখে কখন বাসায় যেতে হবে জানাবেন তিনি। তার কথায় মাথা নাড়িয়ে এক পলক উনার দিক চেয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম!

বাহিরে আসতেই হাস্যোজ্জ্বল রায়হান ভাই ও প্রিয়াকে চোখে পড়লো। আমায় দেখে দুজনই মিটিমিটি হাসছে। আড়চোখে ওদের দিক তাকিয়ে ইতস্তত হাসার চেস্টা করতেই প্রিয়া হাসতে হাসতে বললো,
—ঘুম ভালো হয়েছে, ভাবী?

ওর কথায় অক্ষিদ্বয় বড় হলো, আমতা আমতাভাবে কিছু জিজ্ঞেস করতেই রায়হান ভাইয়ের আওয়াজ,
—তুমি যেয়ে অনেকক্ষণ আর আসছিলে না। মাঝখানে একটা নার্স এসেছিলো ডাক্তার আসবে বলতে। মহিলাটা তখনি তোমায় ডাকতে চেয়েছিলো কিন্তু পূর্ণ ডাকতে দেয়নি। পরে নার্স বের হয়ে আসতেই আমরা ভেতরে যেয়ে দেখা করে আসি ওর সাথে। তুমি কি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ছিলে! এজন্যই বোধহয় ডাকতে চাইছিলোনা পূর্ণ।
রায়হান ভাইয়ের কথায় আরেকদফা লজ্জায় পড়লাম! অসুস্থ জামাইকে দেখতে এসে নিজেই ঘুমিয়ে গেছি এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কি আছে? আমার মুখ দেখে হালকা হেসে প্রিয়া বললো,

—এত লজ্জা পেয়োনা থাক। আমরা বুঝি অনেক ধকল গিয়েছে তোমার উপর। ইটস ওকে!
—আচ্ছা। তারপর বলো, তোমাদের দুজনের মধ্যে সব ঠিক হয়েছে? আর আপনি কি অবশেষে ওর ভুল ভাঙতে পেরেছেন?
রায়হান ভাইয়ের দিক তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম। বিনিময়ে উনি ইতিবাচক মাথা নাড়লেন। অতঃপর মুখে বললেন,

—ম্যাডাম যে এত ছোট কারণে মনে রাগ পুষে থাকবে জানতামই না! আসলে যেই মেয়েটাকে বিয়ের দিন তোমরা আমার সাথে দেখেছিলে ওটা আমার কাজিন, সমবয়সী। আমার ছোটবেলার বেস্টফ্রেন্ড। বন্ধু ও বোন হিসেবে ফ্যামিলিতে সবচেয়ে ক্লোজ! এজন্যই স্পেশাল বলেছিলাম ওকে। প্রায় ৮ বছর পর দেখা হয়েছে ওর সাথে এজন্যই ওকে সময় দিচ্ছিলাম। ওরা স্কুলে থাকতেই বিদেশ সেটেল হয়, এরপর দেশে তেমন একটা আসেনি, বিয়েশাদি করে ওখানেই সেটেল হয়ে গেছে।

এ বছর এতদিন পর দেশে আসলো তাও রাইসার বিয়ের অনুষ্ঠানে। সবমিলিয়ে ওর সাথে এতদিনের সুখ-দুঃখের গল্প শেয়ার করছিলাম! এটাই সেদিন প্রিয়াকে বলতে গিয়েছিলাম ওর কলেজছুটির পর কিন্তু ও তো না শুনেই চলে গেলো!
—আমি কি জানতাম ও আপনার বোন? যেভাবে আমাকে ইগ্নোর করে ওর সাথে গল্প করছিলেন আমি তো ভুল ভাবতেই পারি!

—ভুল ভেবেছিলে বলেই তো তোমায় বুঝাতে গিয়েছিলাম রে বাবা। কিন্তু তুমি…
—আপনি কিন্তু আবারো আমার সাথে ঝগড়া করছেন?
রায়হান ভাইকে মাঝপথে থামিয়ে মুখ ফুলিয়ে বললো প্রিয়া। সেদিক চেয়ে ফোস করে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি! হতাশ মুখে প্রিয়ার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আমার দিক চেয়ে বললেন,
—বুঝলে তো? এই হচ্ছে মেয়ে মানুষ। ঠিক আছে, সরি। সব দোষ আমার! এখন খুশি?

প্রিয়া কিছু বলার আগেই হুহু করে হেসে উঠলাম আমি। দুজনের দুস্টুমিস্টি খুনসুটি দেখতে বেশ মজা লাগছিলো! ভালোই মানায় তাদের একসাথে। আমার হাসির মাঝেই ডাক্তার বেরিয়ে এলেন ভেতর থেকে। তাকে রায়হান ভাই জিজ্ঞেস করলেন কখন পূর্ণকে বাসায় নিতে পারবো, ডাক্তার জানালেন দু-এক ঘণ্টা পরেই ডিসচার্জ করে দিবে উনাকে, এরপর বাসায় নিয়ে যেতে পারবো। এছাড়াও ওষুধ সময়মত দিতে পরামর্শ দিলেন। ডাক্তার যেতেই রায়হান ভাই ওষুধের প্যাকেট বের করতে করতে বললেন,

—এগুলো নেও। একটু আগেই কিনে এনেছি।
—থ্যাংকস, ভাইয়া। এগুলো কখন কিনতে গেলেন?
—তুমি যখন পূর্ণর কাছে ঘুমোচ্ছিলে, নার্স ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিয়ে এসব ওষুধ কিনতে বললো। তো প্রিয়াকে সাথে নিয়েই গিয়েছিলাম। আর তোমার জন্য আরেকটা জিনিস এনেছি। এটাও ধরো!
কথাটা বলে রায়হান ভাই ওষুধের সাথে আরেকটা ব্যাগ হাতে ধরিয়ে দিলেন। সেটা খুলতেই একজোড়া স্যান্ডেল চোখে পড়েলো। বিস্মিত চোখে তাদের দুজনের দিক তাকাতেই প্রিয়া বললো,

—অবাক হয়োনা। আমি দেখেছি তোমার স্যান্ডেল ছিড়ে গিয়েছিলো। এভাবে বাসায় যাবে? বড়ভাইয়া দেখলে বকা খেতে! তাছাড়াও আমার তোমার পায়ের মাপ তো একি তাই সামনের স্যান্ডেলের দোকান থেকে কিনেছি এটা। থ্যাংকস দিতে হবেনা। তুমি আমার জন্য কম করেছো নাকি? সে তুলনায় এটা শূন্য! এখন স্যান্ডেলটা পরে নেও জলদি!
প্রিয়ার কথায় একরাশ ভালোলাগা ছেয়ে গেলো মনে! বাসার সবাই আমার কত খেয়াল রাখে! স্যান্ডেলটা পড়লাম পায়ে, মাপ ঠিক হয়েছে। অতঃপর তিনজন মুচকি হেসে অপেক্ষা করতে লাগলাম পূর্ণকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার!

পূর্ণকে রাতে বাসায় নিয়ে আসার পর বড়াম্মুর একদফা কান্নাকাটি হয়ে গেছে! তাকে সবাই মিলে বুঝাতে বেশ কিছুক্ষণ লেগেছে যে পূর্ণ ঠিক আছেন, তবুও ছেলের চোখেমুখে আদর করে মমতার পরশ বুলিয়ে বহুকস্টে শান্ত হয়েছে মায়ের মন! বড়াব্বুও বেশ চিন্তিত ছিলেন বলা যায়! বকা দিয়েছেন নিজের খেয়াল না রাখার জন্য।

খানিক পরেই অবশ্য বারবার সময়মতো ওষুধ খেতে বলছেন, অতঃপর ঠিক না হওয়া পর্যন্ত পূর্ণর জন্য অফিসের নাম মুখে নেওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করে রুম থেকে বের হয়েছেন! এসব শেষে পূর্ণকে রেস্ট করতে দিয়ে রুম থেকে চলে গেলো সবাই। এতক্ষণে বেশ রাত হয়েছে বলা চলে! উনার মাথার নিচে ভালোভাবে বালিশ ঠিক করে দিয়ে আমিও ফ্রেশ হতে চলে গেলাম!
ফ্রেশ হয়ে জামাকাপড় বদলে রুমে আসতেই দেখি পূর্ণ উশখুশ করছেন বিছানায় শুয়ে। তার কাছে এগিয়ে বিছানায় বসে বললাম,

—কি হয়েছে আপনার? ঘুম ধরছেনা?
উনি কিছু না বলে চুপচাপ চেয়ে রইলেন শুধু। তাকে নিশ্চুপ দেখে আবারো শুধালাম,
—কিছু বলবেন? কোন সমস্যা? না বললে বুঝবো কিভাবে? বলুন না!
—এখন বলা যাবেনা তো!
অতি ধীর গলায় বলে উঠলেন পূর্ণ। তার কথায় আগামাথা ধরতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম,
—মানে? তাহলে কখন বলবেন?

—কিছু না। ঘুমাও তো, তুরফা। আমাকেও ঘুমাতে দেও। কত ঘুম ধরেছে আমার! ডিস্টার্ব দিচ্ছো কেন?
কথাগুলো বলেই চোখ বন্ধ করলেন তিনি। তার কথায় বেকুব সেজে গেলাম! এতক্ষণ চোখেমুখে ঘুমের রেশমাত্রে নেই, আমি জিজ্ঞেস করতেই দুচোখে ঘুম উড়ে এলো তার! এই পল্টিবাজ লোকটাকে নিয়ে আর পারা গেলোনা! তার থেকে চোখ সরিয়ে আমিও শুয়ে পড়লাম! একটা সুন্দর ঘুমের আসলেও বড্ড প্রয়োজন এখন!

গালে পরপর কয়েকবার হালকা হাতের চাপড় অনুভব হতেই ভ্রু কুচকে গেলো! প্রায় সাথে সাথেই পূর্ণর কথা মনে এলো হঠাৎ! হসপিটালেও তো এভাবেই ডাকছিলেন। উনার আবার খারাপ লাগছেনা তো? এক ঝটকায় চোখ খুলে শোয়া থেকে উঠার চেস্টা করতেই তার ভারী আওয়াজ,

—লাফিয়ে উঠছো কেন এভাবে? শুয়ে থাকো!
উনার কথায় ঘুমুঘুমু চোখ মেলে চাইলাম তার দিকে। উঠতে বলছেনা তাহলে জাগালেন কেন আজব? পুনরায় বিছানায় শুয়ে পড়েই তাকে ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বললাম,

—তাহলে ডাকলেন যে? কিছু লাগবে আপনার?
—হ্যাঁ, তোমাকে লাগবে। কাছে এসো।
—কিহ? মানে?
—এত প্রশ্ন করছো কেন? চুপচাপ যা বলেছি তাই করো, তুরফা।
হঠাৎই উনি চাপা স্বরে ধমকে উঠতেই অবুঝের ন্যায় কোনোরকম এগিয়ে গেলাম তার দিকে। কাছে যেতেই ভালো হাতটি দ্বারা আলতোভাবে আমার গাল স্পর্শ করলেন তিনি। চমকে উঠে তার চোখের দিকে তাকাতেই কোমল কণ্ঠে পূর্ণর আওয়াজ,

—হ্যাপি বার্থডে, তুর পাখি। তোমার সব দুঃখ আমার হোক, আমার সব সুখ তোমার হোক!
নির্জন রাত্রির নিশ্চুপ কক্ষে যেন প্রতিধ্বনিত হলো তার বিমোহিত কণ্ঠস্বর! স্তব্ধ বিমুঢ় আমি অবাক চোখে চেয়ে রইলাম শুধু! কম্পিত কণ্ঠে কোনভাবে শুধালাম,

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৬৪

—এ-এজন্যই কি আজকের মধ্যে তাড়াহুড়ো করে ঢাকায় ফিরছিলেন আপনি?
উনি নিরুত্তর রইলেন, নিশব্দে হালকা হাসলেন। যে হাসির কম্পন বুকে ঢেউ তুললো আমার! মানুষটা পাগল! বড্ড বেশিই পাগল! বিমোহে পলকহীনভাবে কতক্ষণ ধরে শুধু দেখেই গেলাম তাকে! আচমকাই অনুভব করলাম চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া একফোঁটা অশ্রু! কিন্তু এ জল যে সুখের অশ্রুজল! হঠাৎ করেই সবকিছু রুপকথার ন্যায় মনে হতে লাগলো আমার!

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৬৬