বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৬৪

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৬৪
তাসফিয়া হাসান তুরফা

ফোনের ওপাশে কথাটা শুনার পর থেকেই মাথা পুরো ভো ভো করছে! অতিরিক্ত চিন্তায়, টেনশনে অনুভূতিগুলোও যেন নিজেদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ভোতা গেছে পুরোপুরি! ভয়ে-উত্তেজনায় শ্বাস নিতে কস্ট হচ্ছে! এই মুহুর্তে মাথায় শুধু একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে ক্রমাগত, তা হলো জলদি পূর্ণর কাছে ছুটে যাওয়া!

উনাকে আমার এই মুহুর্তে দেখা বড্ড প্রয়োজন, তাকে সুস্থ দেখা প্রয়োজন। আমি আর কিছুই চাইনা। চোখ বয়ে গড়িয়ে পড়া অসীম জলধারাকে শক্তহাতে মুছে গাড়ি আসার অপেক্ষা না করেই ছুটে চললাম রাস্তায়, কোন এক সিএনজি ফাকা পেলেই ছুটে চলে যাবো হসপিটালে। অতি জোরে দৌড়ানোর ফলে এক স্যান্ডেল ছিড়ে পা থেকে খুলে গিয়েছে রাস্তায়। কিন্তু এখন সেসব দেখার সময় নেই, সামনে এক সিএনজির দেখা পেয়ে আমি সব ভুলে সেটা ঠিক করতে ব্যস্ত! সিএনজিতে চেপে বসতেই পেছন থেকে প্রিয়ার আওয়াজ এলো কানে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—এই ভাবী, দাঁড়াও। আমাকে রেখে কোথায় যাচ্ছো?
ওর কথায় সামান্য হুশ ফিরে এলো আমার! এতকিছুর মধ্যে তো এক প্রকার ভুলেই গিয়েছিলাম প্রিয়ার কথা, সিএনজিওয়ালা মামাকে থামতে বলতেই প্রিয়া একছুটে দৌড়ে চলে এসেছে এতক্ষণে। দ্রুত সে উঠে বসতেই সিনএনজি চালু হলো পুনরায়! আমাকে অস্থিরভাবে জোরে জোরে শ্বাস নিতে দেখে প্রিয়া জড়িয়ে ধরলো আমায়। নিজের কান্না ভুলে আমায় সান্ত্বনা দিতে বললো,

—একদম টেনশন করোনা তুমি। আমার বড় ভাইয়ার কিচ্ছু হবেনা দেখো? আল্লাহ আমাদের সাথে নিষ্ঠুর হবেন নাহ!
কোন কথা বলার অবস্থায় না থাকায় চুপচাপ ওকে জড়িয়ে ধরে হসপিটাল পৌঁছানোর প্রহর গুনতে লাগলাম শুধু! মনে মনে জপতে থাকলাম মহান রবের নাম, যে রব জানে আমার প্রত্যেকটা মোনাজাতে আমি কতবার তার সুস্থতার দোয়া করি প্রতিদিন! সে রব আমাকে নিরাশ করবেনা এ আশায় অবশেষে দুজনে পৌঁছে গেলাম হসপিটালের দ্বারপ্রান্তে!

হন্তদন্ত করে রিসেপশনের কাছে যেতেই চোখে পড়লো এক স্বাস্থ্যবান এক লোককে, যে কিনা ফোন হাতে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন চিন্তিত মুখে, হয়তো খুজছেন কাউকে। তার হাতে থাকা পূর্ণর ফোন চিনতে ভুল হলোনা আমার! উনার দিক এগিয়ে যেতেই বিচলিতভাবে তাকিয়ে থাকলেন আমাদের দিকে। চিন্তিত কণ্ঠে বললাম,

—ভাই, আপনি কি আমাকে ফোন দিয়েছিলেন? আপনার হাতে যে ফোন আছে এটা আমার স্বামীর। আচ্ছা, উনি কোন রুমে আছেন? আর কেমন আছেন? সেখানে একটু নিয়ে যাবেন প্লিজ? আমার খুব টেনশন হচ্ছে!
লোকটা আমাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো যেন। পূর্ণর ফোনটা আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন,

—এসে গেছেন আপনি? ভাইয়ের ফোনটা ফেরত দেওয়ার জন্যই ছিলাম এতক্ষণ! আসলে আমি একটু তাড়ায় আছি, আমার দোকান খোলা রেখে চলে এসেছি তো। তাই এখন আমাকে যেতে হচ্ছে। কিন্তু চিন্তা করেন না আপু, রাস্তায় ভাইয়ের চেনাপরিচিত একজন সময় থাকতে তাকে নিয়ে এসেছে হাসপাতালে। এমনকি সে টাকাও দিয়ে দিসে হসপিটালে, সময় থাকতে চিকিৎসা হওয়ায় বেশি কিছু হয়নি। আল্লাহ বাঁচায় দিছে! আমি তো একদম ভয় পেয়ে গেছিলাম।

লোকটার কথায় মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম! আল্লাহর দরবারে লাখ শুকরিয়া আদায় করলাম পূর্ণকে ভালো রাখার জন্য! লোকটার প্রতিও কৃতজ্ঞ হলাম আমাকে জানানোর জন্য। একেতো উনি আমাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছেন আবার তার মধ্যে ফোনটা ফেরত দেওয়ার জন্য অপেক্ষাও করছিলেন। যেখানে উনি চাইলেই সুযোগের সদব্যবহার করে দামী ফোনটা নিয়ে পালিয়ে যেতে পারতেন!

আসলেই দুনিয়াতে ভালো মানুষ বেচে আছে বলেই এ নিষ্ঠুর পৃথিবীটা এখনো টিকে আছে! লোকটাকে ধন্যবাদ দিতেই উনি চলে গেলেন। একিসাথে রিসেপশনিস্ট এর থেকে পূর্ণর কেবিন নাম্বার শুনে আমি ও প্রিয়া দ্রুতকদমে ছুটে চললাম সেদিকে! উদ্দেশ্য এখন উনাকে দেখা, একিসাথে সেই মানুষটাকে খুজে ধন্যবাদ দেওয়া যিনি আজ আমার জীবনের এত বড় এক উপকার করলেন!

যথারীতি কেবিনের সামনে আসতেই সামনের মানুষটাকে দেখে পাজোড়া থেমে গেলো আমার! কেবিনের সামনে চিন্তিত মুখে পায়চারি করছেন রায়হান ভাই। চোখমুখ কুচকে এলোমেলো পায়ে হাটছেন। উনাকে দেখে আমার পাশে এসেই থেমে গেলো প্রিয়া! তার চোখেমুখেও বিশ্বাস, আমার মতো সে-ও এই জায়গায় রায়হান ভাইকে আশা করেনি! আমাদের চিন্তাভাবনার মধ্যেই হঠাৎ করে রায়হান ভাইয়ের চোখ পড়লো আমাদের দিকে! দুজনকে এখানে এ সময় দেখে এগিয়ে এলেন দ্রুতকদমে। আমার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলেন,

—তোমরা এখানে কিভাবে? আর তোমার এ অবস্থা কেন, তুরফা? পূর্ণর কথা জেনেছো? কে জানালো?
—যে-ই জানাক, আপনি এখানে কিভাবে এলেন সেটা বলুন আগে। আমার বড় ভাইয়া কেমন আছে এখন? তাড়াতাড়ি বলুন টেনশন হচ্ছে!

আমায় বলার সুযোগ না দিয়েই রায়হান ভাইয়ার হাত ঝাকিয়ে বলে উঠলো প্রিয়া। আমাদের দুজনের পানে চেয়ে তিনি এক বড় শ্বাস নিয়ে বললেন,

—অফিস করে ফিরছিলাম বাসায় তাড়াতাড়িই আজ। রাস্তায় জ্যাম ছিলো, বসে ছিলাম। সামনে শুনি এক্সিডেন্ট হয়েছে ট্রাকের সাথে এক গাড়ির। কি মনে করে যেন গাড়ি থেকে বের হয়ে দেখতে চলে গেলাম সেখানে, এন্ড গেস হোয়াট! গাড়িতে পূর্ণ ছিলো, হুশ ছিলোনা ওর। ওকে দেখেই তো চমকে গিয়েছিলাম প্রচন্ড। তারপর তড়িঘড়ি করে কাছের এই হসপিটালে নিয়ে আসি। কিন্তু তোমরা এই খবর পেলে কিভাবে? আমি তো কাউকে জানাইনি। পূর্ণর জ্ঞান ফিরার অপেক্ষা করছিলাম!

—একটা ভাই জানিয়েছেন, যিনি উনার ফোন গাড়ির পাশে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। যেহেতু আমার নাম্বার শুরুতে ছিলো তাই ভাগ্যক্রমে আমি জানতে পেরেছি। আর সাথে সাথেই ছুটে চলে এসেছি। সঙ্গে যেহেতু প্রিয়া ছিলো তাই সে-ও এসেছে আমার সাথে।
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে জোরে জোরে শ্বাস নিলাম। খানিকক্ষণ বাদে কাপা কাপা গলায় বললাম,
—উনার সত্যিই কিছু হয়নি তো, রায়হান ভাই? ঠিক আছেন না উনি? আমায় সত্যি করে বলবেন প্লিজ? উনাকে না দেখা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিনা আমি!

রায়হান ভাই বিস্মিতভাবে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন আমার দিক কিছুক্ষণ। খানিকবাদে হালকা হেসে বললেন,
—পূর্ণ ঠিক আছে, তুরফা। বেশিকিছু হয়নি ও গাড়ি সময়মতো ঘুরিয়ে নেওয়াতে। তবুও ট্রাকের কোণায় লেগে এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে। যার ফলশ্রুতিতে শুধু এক হাতে, এক পায়ে আর মাথায় মোটা করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে! রক্তপাত হওয়ায় ভয় পেয়ে গিয়েছিলো রাস্তার মানুষেরা, তবে ডাক্তার বলেছে সময়মতো আনা হয়েছে বলে এখন ভয়ের কিছু নেই। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই পুরোপুরি ঠিক হওয়ার কথা!

রায়হান ভাইয়ের কথায় আঁতকে উঠলাম! এতগুলো ব্যান্ডেজ, খুব রক্তপাত হয়েছে! তার মানে নিশ্চয়ই অনেক ব্যাথা লেগেছে উনার? তার হাসিমাখা মুখ চোখে ভাসতেই ঠোঁট দিয়ে চেপে কান্না থামিয়ে রাখার চেস্টা করলাম। তবুও অশ্রুদ্বয় নির্লজ্জের মতো গড়িয়ে পড়লো দু’চোখ বেয়ে! হুহু করে ডুকরে কেদে উঠলাম আমি। এদিকে প্রিয়াও নিঃশব্দে কাদছে। রায়হান ভাই আমাদের কাদতে দেখে বিচলিত হয়ে পড়লেন। চিন্তিত ভংগীতে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,

—এভাবে কেদোনা। তোমার পূর্ণর কিচ্ছু হয়নি, পাগলি। ঠিক আছে সে! পূর্ণ যদি উঠে দেখে তুমি আমার সামনে এভাবে কাদছো তাহলে আমাকে এসেই মারতে পারে! এত কস্ট করে ওকে এখানে নিয়ে আসার পর এখন তুমি আমাকে ওর হাতে মার খাইয়ে নিতে চাও?
রায়হান ভাইয়ের কথায় চোখ মুছে জোরপূর্বক হাসলাম। উনি যে আমায় হালকা করতে চাইছেন বুঝছি। নাক টেনে কান্নামিশ্রিত হেসে তাকে বললাম,

—আপনাকে কিভাবে ধন্যবাদ দিবো আমার জানা নেই, রায়হান ভাই। আপনি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় উপকার করেছেন আজ। আমি আজীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো! থ্যাংক ইউ সো মাচ!

—ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করোনা, তুরফা। পূর্ণ কি আমার কেউ হয়না? নিজের হবু শালাবাবুর জন্য এটুক করা তো আমার কর্তব্য। কিন্তু কেউ আমাকে বুঝতেই চায়না। ভুল বুঝে শুধু!
শেষের কথাগুলো প্রিয়ার দিক তাকিয়ে বললেন তিনি। প্রিয়া মুখ নিচু করে মাটির দিক চেয়ে আছে। আমি কিছু বলার আগেই এক নার্স বেরিয়ে এলো পূর্ণর কেবিন থেকে। আমাদের উদ্দেশ্য করে বললো,
—পেশেন্ট এর জ্ঞান ফিরেছে। এখন রেস্ট নিচ্ছে। আপনারা চাইলে দেখা করতে পারেন। তবে একজনের বেশি এলাউ করা হবেনা!

এতক্ষণ এ কথাটারই অপেক্ষা করছিলাম যেন! রায়হান ভাইয়ের দিক তাকাতেই উনি চোখের ইশারায় কেবিনে যেতে বললেন আমায়। দ্রুতকদমে এগিয়ে সেদিকে চলে গেলাম। কেবিনে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দেওয়ার সময় কাচের ভেতর দিয়ে এক চমৎকার দৃশ্য চোখে পড়লো। মান-অভিমান ভুলে রায়হান ভাইয়ের কাছে এগিয়ে গেছে প্রিয়া, তার বুকে মাথা রেখে কাদছে! তিনিও পরম যত্নে প্রেয়সীর মাথায় হাত বুলিয়ে এটা-সেটা বলে তাকে শান্ত করার প্রচেস্টায় আছেন! এত মন খারাপের মাঝেও ভালো হয়ে গেলো মন! এটাই তো ভালোবাসা, যেখানে দুঃসময়ে হাজারো অভিমানের মাঝেও কিছু না বলেই দুটো হৃদয় এক হয়ে যায়! প্রকৃত ভালোবাসা সত্যিই সুন্দর!

শান্ত-নিশ্চুপ কেবিনে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম। সামনের শুভ্র রঙের বিছানায় হাসপাতালের ড্রেস পড়ে শুয়ে আছেন পূর্ণ। জ্ঞান ফিরলেও চোখজোড়া বন্ধ করে রেখেছেন। ভ্রুযুগলের মাঝখানে সূক্ষ্ম ভাজ, হয়তো ব্যাথায় কুচকে আছে। সুদর্শন মুখশ্রী ব্যাথায় জর্জরিত, ভারী ভারী নিঃশ্বাস ফেলছেন। সবসময় গম্ভীর মানুষটাকে একটু বেশিই গম্ভীর লাগছে এখন। তার কস্ট দেখে আত্মা কেদে উঠলো আমার! কাছে যাওয়ার সাহস যেন হচ্ছিলোনা! এই যে কেবিনের ঢুকার সময় বারবার নিজেকে শান্ত করা, তার সামনে ভেঙে না পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম – সেটা পাল্টে গেলো মুহুর্তেই!

মুখে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ নিশব্দে কেদেও কাজ হলোনা, বাধ সাধলো হিচকি। এক পর্যায়ে কাদতে কাদতে হিচকি উঠে গেছে আমার! সেই শব্দে ভ্রুজোড়া আরেকটু কুচকে গেলো উনার! আচমকা পিটপিট করে চোখ খুললেন পূর্ণ।
মাথা হালকা ঘুরিয়ে আমার দিক চাইলেন। সাথে সাথেই কৃষ্ণ চোখজোড়ায় বিস্ময় ছেয়ে গেলো উনার! উনাকে এভাবে তাকাতে দেখে কান্নার রোল বেড়ে গেলো আমার! উনি চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ শ্বাস নিয়ে পুনরায় চোখ খুললেন। মাথা সোজা করে ভাঙা কণ্ঠে বললেন,

—এভাবে কাদছো কেন, তুমি? বেঁচে আছি আমি। মরিনি এখনো। কাছে এসো, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে কস্ট হচ্ছে!
উনার বলতে দেরি, আমার যেতে দেরি হলোনা। তেড়ে এগিয়ে গেলাম তার দিকে! বেডের কাছে যেতেই আমার দিক পূর্ণদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন উনি। এদিকে আমি তার হাতের ব্যান্ডেজ, কপালের ব্যান্ডেজ ছুয়ে দেখতে ব্যস্ত! সাদা ব্যান্ডেজে লেগে থাকা রক্তের ছাপ বুকের মাঝে ক্ষত সৃষ্টি করছে যেন! টুপটুপ করে উনার মুখে কয়েক ফোটা পানি পড়তেই শক্ত গলায় বলে উঠলেন তিনি,

—তুমি কি কান্না বন্ধ করবে? এখানে এলে কিভাবে তুমি? কে বলেছে তোমায় আসতে?
উনার কথায় বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম! কাদবো না তো কি করবো আমি? তার এরুপ অবস্থা দেখে কি হাসবো? কই আমি তার জন্য চিন্তায় মরে যাচ্ছিলাম এতক্ষণ আর উনি এরকম অবস্থায়ও আমাকেই বকছেন! রাগে ফুসে উলটোপথে ঘুরে চলে যেতে ধরতেই ওড়নায় টান পড়লো। ফিরে দেখি ব্যান্ডেজ করা হাতের মুঠোয় সেটাকে আলতোভাবে চেপে ধরে আছেন পূর্ণ। আমাকে ফিরতে দেখে বললেন,

—তোমাকে কান্না থামাতে বলেছি। যেতে বলেছি একবারো? সবসময় দু-লাইন বেশি কেন তুমি?
একটু পর নরম সুরে নিচু গলায় বললেন,
—শরীরের ক্ষতগুলোর চেয়েও বেশি কস্ট দিচ্ছে তোমার চোখের এই পানিগুলো। থামাও এগুলোকে, আমার সামনে এভাবে কাদবেনা কখনো!
উনার নরম গলা শুনে মনে সাহস সঞ্চার হলো আমার, সাথে তরতর করে বেড়ে উঠলো রাগ। রাগী গলায় প্রশ্নের ঝুলি খুলে বসলাম তার সামনে,

—আগে বলুন আপনার এক্সিডেন্ট কিভাবে হলো? আর এ সময় ফিরছিলেনই বা কেন? আপনার না কাল ফেরার কথা ছিলো? ফিরছিলেন ভালো কথা কিন্তু এত জোরে ড্রাইভ করছিলেন কেন? কতবার মানা করেছি তাও তো শুনবেন না। আমার কথার কোন গুরুত্বই নেই আপনার কাছে, তাই না? আপনার কিছু হলে যে আমি শেষ হয়ে যেতাম সেটা মাথায় আছে আপনার? আপনি একটা খুব খারাপ লোক, বুঝেছেন? আমি আর কথাই বলবোনা আপনার সাথে!

—আমি অসুস্থ, বউ। তোমার এত প্রশ্নের জবাব দেওয়ার এনার্জি বা অবস্থা কোনোটাই নেই আমার কাছে। সব উত্তর পরে পেয়ে যাবে! কই তুমি এ অবস্থায় আমার আদর-যত্ন করবে, উল্টো তুমিই আমার উপর রাগ দেখাচ্ছো!
উনার কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরেসুস্থে বসলাম বেডের পাশে রাখা চেয়ারটাতে। ব্যান্ডেজের উপর আসা তার চুলগুলোকে সরিয়ে দিয়ে মাথায়, গালে আলতোভাবে কয়েকটা চুমো দিতেই হাসি হাসি মুখে চেয়ে রইলেন আমার দিকে। ভালো হাতটা দিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন,

—অসুস্থ অবস্থায়ও আমার সুযোগ নিচ্ছো, তুর পাখি? অনেক দুস্টু হয়ে গেছো দেখছি। নট ফেয়ার!
উনার কথায় শত দুঃখের মাঝেও হাসি খেলে গেলো আমার ঠোঁটের কোণে! মনে হলো যেন এতক্ষণে প্রাণ ফিরে এলো আমার! এটাই তো আমার পূর্ণ, যাকে আমি সুস্থ চেয়েছিলাম, ভালো চেয়েছিলাম। ফিরে চেয়েছিলাম নিজের কাছে! উনাকে যে আমি কতটা ভালোবাসি হয়তো তার এ অবস্থা না দেখলে
কখনো পুরোপুরি উপলব্ধি করতাম নাহ!

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৬৩

আজ আমি ক্ষণে ক্ষণে অনুভব করেছি এ মানুষটাকে ছাড়া আমি কতটা অসহায়। পূর্ণকে ছাড়া আমার জীবনটাই অসম্পূর্ণ! আমার ভালো থাকার জন্যও উনার ভালো থাকা চাই!

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৬৫