শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ২৩

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ২৩
তাসনিম জাহান রিয়া

রাত নয়টার মতো বাজে। শ্রেয়সী রুমের দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে। একবারের জন্যও বের হয়নি। শ্রেয়া বেগম অনেক বার খাওয়ার জন্য ডেকে গেছেন। শ্রেয়সী খাবে না বলে দিয়েছে।
শ্রেয়সী চোখে মুখে পানি দেওয়ার জন্য ওয়াশরুমে যায়। ওয়াশরুম থেকে এসে দেখে তার ফোনটা অনবরত বেজে চলেছে। মুহিব কল করছে। শ্রেয়সী কল রিসিভ করবে না, করবে না করেও কী ভেবে যেনো রিসিভ করে ফেলো।

শ্রেয়সী নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে। কী করবো? কিছুই বুঝতে পারছি না।
কী হয়েছে তোর? তোর কন্ঠস্বর এমন শোনা যাচ্ছে কেনো?
ছোট আপা এখনো বাসায় আসিনি।
ছোট আপাকে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
আম্মা ভীষণ কান্না-কাটি করছে। কী করবো?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মুহিব তুই টেনশন করিস না। তোর ছোট আপার কিছু হবে না। আমরা আছি না। একটু অপেক্ষা কর আমি আসছি।
হ্যালো শ্রেয়সী আমি তন্ময়। আমরা মুহিবদের বাড়িতে যাব আজকে রাতেই ইভার গাড়ি করে। তুই গেলে প্রিপারেশন নিয়ে আসিস।

শ্রেয়সী শুধু ড্রেসটা চেইঞ্জ করে। ব্যাগে দুইটা জামা ভরে রুম থেকে বের হয়। শ্রেয়সীকে এতো রাতে রেডি হয়ে বের হতে দেখে শ্রেয়া বেগম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
এতো রাতে তুই কোথায় যাচ্ছিস?

আম্মু মুহিবের বড় বোন মেঘলা আপুকে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
মুহিবের বোনকে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে তুই কোথায় যাচ্ছিস?
আমি মুহিবের কাছে যাচ্ছি।

আশ্চর্য ব্যাপার মুহিবের বোনকে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে তুই এতো রাতে বাইরে বের হবি? মুহিবের বোন তো গ্রামে থাকে। তুই মুহিবের কাছে গিয়ে কী করবি?
আম্মু তোমার মনে হচ্ছে না তুমি অদ্ভুত কথা বলছো। আম্মু মুহিব আমার বন্ধু। বন্ধুর বিপদে যদি বন্ধু পাশে না থাকে তো কে থাকবে? বন্ধু সুসময়ে পাশে থাকার জন্য না দুঃসময়েও পাশে থাকার জন্যও। আম্মু আমার যখন রক্তের প্রয়োজন হয়েছিল এই মুহিব আমাকে রক্তও দিয়েছিল। তোমার ভাইয়ের ছেলে কিন্তু আমাকে রক্ত দেয়নি। বরং রক্ত দিতে হবে বলে হসপিটালেই আসেনি।

আমি তো তোকে মুহিবের পাশে থাকতে নিষেধ করছি না। রাতে না গিয়ে সকালে যা।
আমি এখন যাব মানে এখনি।
নাহিন হুট করেই বলে ওঠে,
আমি শ্রেয়সীকে দিয়ে আসছি।
আমাকে কারো দিয়ে আসার প্রয়োজন নেই। আমি একাই যেতে পারবো।

তোমাদের কারো যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমার মেয়েকে আমিই নিয়ে যাব। মুহিবকে আমি নিজের ছেলের মতো দেখি। ওর বিপদে আমি অবশ্যই পাশে থাকবো। আজকে রাতে আমি আর শ্রেয়সী নাও ফিরতে পারি। আমাকে অযথা ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করবা না। শ্রেয়সী একটু দাঁড়া আমি আসছি।
মিরাজ সরকার রুমে গিয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই ফিরে আসে।
চল শ্রেয়সী।

মিরাজ সরকার শ্রেয়সীকে নিয়ে বের হয়ে যায়। বাসার সামনে থেকে একটা অটোতে ওঠে বসে। মুহিবদের হলের সামনের চায়ের দোকানের সামনে নামে। মুহিবকে দুইপাশ তন্ময় আর মিহান ধরে বসে আছে। মিরাজ সরকার মুহিবের সামনে দাঁড়াতেই মুহিব ছলছল চোখে মিরাজ সরকারের দিকে তাকায়। মিরাজ সরকার মুহিবের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
আংকেল আমার বাবা নেই। মা আর বোন একা গ্রামে থাকে। আপাকে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আম্মা একা একা কী করে আপাকে খোঁজবেন? আমাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই।

কে বলেছে তোমার কেউ নেই? আমরা আছি না। যার এমন বন্ধুরা আছে তার কী আর কারো প্রয়োজন আছে? তোমার এমন কিছু বন্ধু আছে যারা পৃথিবী উল্টে গেলেও তোমার পাশে থাকবে। আমাদের এখন মুহিবদের গ্রামে যাওয়ার জন্য রওনা হয়ে যাওয়া উচিত।
ইভা গাড়ি নিয়ে আসলেই আমরা বেরিয়ে যাব। আংকেল আপনিও যাবেন?
মিহানের প্রশ্নে মিরাজ সরকার আলতো হেসে বলে,
আমি তোমাদের পাশে সবসময় আছি। তোমরাও তো আমার সন্তানের মতো। তোমাদের বিপদের মাঝে একা ছেড়ে দেই কীভাবে?

কিয়ৎক্ষণের মাঝেই ইভা চলে আসে। ইভার সাথে নিতুও চলে আসে। নিতুকে দেখে তন্ময় বলে ওঠে,
তুই একা কেনো নিতু? প্রিয়ন্তি আসেনি?
প্রিয়ন্তি তো হলে নেই। প্রিয়ন্তিকে সন্ধ্যাবেলায় তার বাবা এসে নিয়ে গেছে। আমরা কেউ প্রিয়ন্তিকে এই ব্যাপারে জানায়নি। প্রিয়ন্তিকে জানানোর বিষয়টা মাথায় ছিলো না।
ইভা তাড়া দিয়ে বলে ওঠে,

এতো কথা বলার সময় নেই। সবাই গাড়িতে ওঠ। আংকেল আপনিও বসুন। আমাদের এখনি রওনা দিতে হবে আর যত দ্রুত সম্ভব মুহিবদের গ্রামে পৌছাতে হবে।

সবাই যখন মুহিবদের গ্রামের বাড়িতে পৌছায় তখন বাজে রাত একটা। সবাই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। গ্রামের প্রতিটার বাড়ির আলো নেভানো। মুহিবদের ছোট ঘরটাই শুধু আলো জ্বলছে। অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হেঁটে সবাই এসে মুহিবদের বাড়ির সামনে দাঁড়ায়। গুনগুন করে কান্নার আওয়াজ সবার কানে আসছে। মুহিবের মা হাজেরা খাতুন একটা ছোট লাইট নিয়ে বারান্দায় বসে গুনগুন করে কাঁদছে। হাজেরা খাতুন মুহিবকে দেখেই দৌড়ে আসে।

মুহিব তুমি আইছো? দেহো না তোমার আপা এহনো বাড়িত আহে নাই। কতো মানুষরে কইলাম আমার মেঘলাডারে একটু খুঁইজা দিতে। কেউ গেলো না। রাইত-বিরাতে বাইরে থাকবো এমন মাইয়া আমার না। মেঘলা আমারে কইয়া কোনহানো যায় না।

আম্মা তোমার মুহিব আসছে না। এই যে দেখো আমার বন্ধুরা। এখন আর কারো প্রয়োজন নেই।
মুহিব আমাদের এখন দাঁড়িয়ে থাকা উচিত না। তোমার আপুকে খোঁজতে বের হওয়া উচিত। তোমার আপু যে স্কুলে চাকরি করতো সেই স্কুল থেকেই আমাদের খোঁজা শুরু করা উচিত। খোঁজে না পেলে সকালে পুলিশের কাছে গিয়ে কমপ্লেইন করবো।

মিরাজ সরকারের কথায় সবাই সায় দেয়।
মামুনিরা তোমরা আপার কাছে থাকো। ছেলেরা সবাই মুহিবের সাথে চল।
মিরাজ সরকারের কথার বিপরীতে ইভা বলে ওঠে,
আমরা এখানে থাকবো কেনো? আমরাও আপনাদের সাথে খুঁজতে বের হবো।
মিহান মৃদু রাগ দেখিয়ে বলে,

সবকিছু নিয়ে জেদ করা ভালো না ইভা। তোকে বুঝতে হবে এটা শহর না গ্রাম। গ্রামের পরিবেশ এতো সুবিধাজনক না। তোরা আন্টির সাথে থাক। সাবধানে থাকবি। আন্টি ওদের একটু দেখে রাখবেন।
মুহিব চলে যেতে গিয়েও কিছু একটা ভেবে থেমে যায়।
আম্মা তুমি ওদের নিয়ে ঘরে যাও। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না।

সবাইকে ঘরের ভিতর ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা আটকে দেয়। অতঃপর ফিসফিস করে বলে,
আম্মা তিনটা মেয়ে আছে তোমার সাথে। একটু সাবধানে থাকবে। আমরা না আসলে
দরজা খুলবে না। তোমরা কেউ ঘর থেকে বের হবে না। কেউ ডেকে মরে গেলেও আমরা আসার আগে দরজা খুলবে না। আমি এসে ডাক দিলে তবেই দরজা খুলবে।

ভোর রাতের দিকে মুহিবরা ফিরে আসে। এর মাঝে মেম্বারের বাড়িতে গিয়ে এক দফা চিৎকার চেঁচামেচি করে এসেছে মুহিব। মুহিবের ধারণা মেঘলার নিখোঁজ হওয়ার পিছনে মেম্বারের হাত। মেম্বারের অনেকদিন ধরেই মেঘলার ওপর নজর ছিল। মেম্বার তার বাড়িতেই ছিল তাই মুহিব আর কিছু করতে পারেনি।

মুহিব এসেই বারান্দায় ধপ করে বসে পড়ে। সবাই রাতে না ঘুমিয়ে এতোটা পথ জার্নি করে ভীষণ ক্লান্ত। হাজেরা খাতুন কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে গেছেন। মুহিবকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কেউ কিছু খোঁজে পাচ্ছে না। মিহান মাথা নিচু করে মুহিবের পায়ের কাছটাই বসে আছে। মুহিব মিরাজ সরকারের হাতটা মুঠো বন্দি করে বলে,
আংকেল আপাকে কোথাও খোঁজে পাচ্ছি না কেনো? গ্রামের একটা কোনাও বাদ রাখেনি খোঁজার। আপা কোথাও নেই। আমার আপা তো না বলে কোথাও যায় না।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ২২

আমাদের এখন থানায় কমপ্লেন করা উচিত। পুলিশের সাহায্য ছাড়া মেঘলাকে খুঁজে বের করা সম্ভব না। আমার মেম্বার লোকটাকে সন্দেহ হচ্ছে। ঐ লোকটার তাকানোর স্টাইল সুবিধার না।
মিরাজ সরকারের কথার মাঝেই একটা মেয়ে হেলেদুলে হেঁটে এসে মুহিবদের উঠোনে দাঁড়ায়। মেয়েটাকে দেখে সবাই চমকে ওঠে। মেঘলা দাঁড়িয়ে আছে বিধ্বস্ত অবস্থায়।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ২৪