শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ২৪

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ২৪
তাসনিম জাহান রিয়া

বিধ্বস্ত মেঘলাকে দেখে মুহিবের হাত-পা অবস হয়ে আসছে। মেঘলা পড়ে যেতে নিলে
নিতু ধরে ফেলে। মেঘলার জামার বেশির ভাগ অংশই ছেড়া। গলায়, ঘাড়ে, হাতে-পায়ে অসংখ্য নখের আঁচড়। মেঘলার মাথা থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। শ্রেয়সী একটা চাদর দিয়ে মেঘলাকে ঝাপটে ধরে। মেঘলা নিজের শরীরের সম্পূর্ণ ভর ছেড়ে দেয় নিতু আর শ্রেয়সীর ওপর। আস্তে আস্তে চোখ বুঁজে আসছে মেঘলার। ইভা আলতো করে মেঘলার গালে থাপ্পড় দিয়ে বলে,

এই মেঘলা আপু, আপু।
মেঘলা সাড়া দেয় না। হাজেরা খাতুন দৌড়ে ঘর থেকে আসে। মেঘলার এমন অবস্থা দেখে কান্না-কাটি শুরু করে দেয়। আশেপাশের বাড়ির মানুষ এসে জমা হয় মুহিবদের উঠোনে। মেঘলাকে দেখে সবাই কানাঘুষো করছে।
আপা এখন কান্না-কাটি বন্ধ করুন। আমাদের এখন মেঘলাকে নিয়ে হসপিটালে যাওয়া উচিত। মুহিব এভাবে বসে থাকলে চলবে না। উঠো তুমি। মেঘলাকে নিয়ে হসপিটালে যেতে হবে।
মিরাজ সরকারের কথায় মুহিবের টনক নড়ে। মেঘলাকে দ্রুত কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে বসে। একে একে সবাই গাড়িতে ওঠে বসে। তন্ময় ঘরে তালা লাগিয়ে হাজেরা খাতুনকে নিয়ে গাড়িতে ওঠে বসে। ইভা দ্রুত ড্রাইভ করতে শুরু করে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মুহিবদের উপজেলার হসপিটাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে হসপিটালের এম্বোলেন্স করে ময়মনসিংহে নিয়ে আসে।
একটা প্রাইভেট হসপিটালে মেঘলাকে ভর্তি করা হয়। পুলিশকে ইনফর্ম করা হয়েছে। ঘন্টা দুয়েক পড়ে মেঘলার অবস্থার উন্নতি হলে মিরাজ সরকার বাসায় চলে যান। উনার প্রেসার বেড়ে গেছে। বয়স বাড়ে নুইয়ে পড়েছেন। এখন আর শরীর এতোটা দখল সহ্য করতে পারে না।

শ্রেয়সীর ফোন অন করতেই অনুপমের কল আসে। শ্রেয়সী খেয়াল করে নাই তার ফোনটা কখন বন্ধ হয়ে গেছে। শ্রেয়সী ফোন রিসিভ করতেই অনুপম অস্থির হয়ে বলে ওঠে,
এই শ্রেয়সী তুমি কোথায়? তোমার ফোন বন্ধ কেনো? এতো অভিমানী কেনো তুমি? রাগ করে একটু বকা দিতে পারবো না তোমাকে?

অনুপম আমি হসপিটালে।
হসপিটালে? তুমি হসপিটালে কেনো? কী হয়েছে তোমার?
আমার কিছু হয়নি অনুপম। মেঘলা আপু মানে মুহিবের বড় বোন হসপিটালে ভর্তি।
শ্রেয়সী এক এক করে সব ঘটনা খুলে বলে।

টেনশন করো না। মুহিবের বোন একদম ঠিক হয়ে যাবে। টাকার প্রয়োজন হলে আমাকে অবশ্যই বলবে। জানি তোমরা থাকতে আমার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার প্রয়োজন হবে না।
তোমরা ছাত্র মানুষ নিজে ইনকাম করো না। বাসা থেকে এতো টাকা নিলে ব্যাপারটা ভালো দেখাবে না। আমার কাছে টাকা চাইতে কোনো রকম অস্বস্তিবোধ করবে না। আমি বিকালে আসবো হসপিটালে। এখন একটা জরুরি কাজে আটকে পড়েছি তাই আসতে পারছি না। রাখছি এখন। মুহিবের খেয়াল রেখো আর নিজেরও।

শ্রেয়সী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মুহিবের আত্নসম্মানবোধ কঠোর। তাদের কাছ থেকেই টাকা নিতে চায় না সেখানে অনুপম তো কেউ না। মেঘলাকে আই সি ইউতে রাখা হয়েছে। মুহিব দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চেয়ারে বসে আছে। নিতু আর ইভা হাজেরা খাতুনকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। শ্রেয়সী মিহানের পাশে গিয়ে বসে। আই সি ইউর দিকে তাকিয়ে বলে,

সারা পৃথিবীর কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করতে পারলেও আমাদের কাছ থেকে তুই নিজেকে আড়াল করতে পারবি না মিহান। তুই মেঘলা আপুকে ভালোবাসি, তাই না?
আমি তো চেয়েছিলাম সে আমার না হয়েও সুখে থাকুক। তার এমন পরিণতি আমি যে মেনে নিতে পারছি না।

তিনটার দিকে মেঘলাকে কেবিনে সিফট করা হয়। মেঘলার এখনো জ্ঞান ফিরেনি। মাথার আঘাতটা বেশ জোরালো ছিল। শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে।
হাজেরা খাতুন কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে গেছেন। মেঘলাকে কেবিনের সিফট করতেই তন্ময় আর ইভা হাজেরা খাতুনকে এক প্রকার জোর করেই ইভাদের বাসায় নিয়ে গেছে। এর মাঝে মুহিবের বড় বোন, বড় বোনের জামাই আর মেজো বোন আর মেজো বোনের জামাই এসে উপস্থিত হয়। মুহিবের বড় বোন এসেই মেঘলার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। উতলা হয়ে বলে ওঠে,

মুহিব আমার মেঘলা কেমন আছে?
মুহিব এক পলক সবার দিকে তাকায়। মুহিব আলী সাহেবকে দেখে আন্দাজ করে নেয় উনি নিজের ইচ্ছেয় এখানে আসেনি। তার বড় আপার কথায় বাধ্য হয়েই এসেছেন এবং এসে ভীষণ বিরক্তবোধ করছেন। যেই বিষয়টা মুহিবের মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। তার ছোট আপাকে নিয়ে কেউ বিরক্তবোধ করছে সেটা সে মানতে পারছে না। সে তো কাউকে আসতে বলেনি এখানে। মুহিবের ইচ্ছে করছে মুখের ওপর জবাব দিতে। এই কাজট সে করতে পারবে না। তাই নিজের ইচ্ছেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে বলে,

ভালো।
আলী সাহেব স্বাভাবিক গলায় জিঙ্গেস করেন,
এসব কী করে হলো? কারা এমনটা করেছে জানা গেছে?
না। ছোট আপার জ্ঞান ফিরে না আসা পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না।
মুহিবের মেজো বোন এদিক ওদিক তাকিয়ে জিঙ্গেস করে,
আম্মা কোথায়? আম্মাকে দেখছি না যে?

আম্মাকে নিয়ে গেছে আমার বান্ধবী।
তন্ময় খাবার নিয়ে হাজির হয় হসপিটালে।
মুহিব, মিহান চল খাবি।
নিতুর কথার পৃষ্ঠে মুহিব জবাব দেয়,
তোরা খাওয়া-দাওয়া করে আয়। আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।
শ্রেয়সী রাগী স্বরে বলে,

তোকে ছাড়া খাব আমরা? খেতে ইচ্ছে না করলেও খেতে হবে। না খেয়ে তুই অসুস্থ হয়ে গেলে তোকে কে দেখবে? আপনারা একটু বসুন। আমরা খেয়েই চলে আসবো। গতকাল রাত থেকে আমাদের খাওয়া হয়নি। মুহিব আর মিহান তোরা না গেলে আমি এখন মাইর দিব।
মিহান আর মুহিবকে জোর করে নিয়ে যায় খাওয়ার জন্য।

বিকেলের দিকে সবাই এক পলক দেখার সুযোগ পেয়েছিল। এর পর পরই মেঘলাকে আবার আই সি ইউতে নিয়ে যাওয়া হয়। মাঝখানে মেঘলার শারীরিক অবস্থার একটু উন্নতি হলেও এখন আবার অবনতির পথে।
সন্ধ্যার দিকে প্রিয়ন্তি তার বাবাকে সাথে নিয়ে এসে হসপিটালে উপস্থিত হয়। হসপিটালে এলেও কারো সাথে কোনো কথা বলেনি। মুহিবের বড় বোন, মিহান, মুহিব আর প্রিয়ন্তিই হসপিটালে রয়ে গেছে। আর সবাই বাসায় চলে গেছে। ইভা হাজেরা খাতুনকে বিকালে নিয়ে এসে আবার জোর করে নিজের বাসায় নিয়ে গেছে।

শ্রেয়সী।
প্রিয়ন্তির বাবার ডাকে ভরকে যায় শ্রেয়সী। শ্রেয়সী বাসায় চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই প্রিয়ন্তির বাবা ডেকে ওঠে। প্রিয়ন্তির বাবার সাথে শ্রেয়সী কখনো কথা বলেনি। দেখা হলে সালাম দেওয়ার বাইরে আর কোনো কথা আর কখনো হয়নি।
জ্বী আংকেল।
তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।
জ্বী বলুন।
এখানে না। একটু আমার সাথে চল।
প্রিয়ন্তির বাবা শ্রেয়সীকে নিয়ে একটা কফি শপে আসে। দুইটা কফি অর্ডার দেয়।

তোমাদের অপছন্দের ব্যক্তিদের মাঝে হয়তো সবার ওপরে আমার স্থান। আমি তোমাদের সামনে নিজেকে তেমন ভাবেই প্রেজেন্ট করেছি। প্রিয়ন্তি আমাকে দেখে ভয় পেলেও আমাকে কিন্তু সবকিছু খুলে বলে। আমার এই বাইরের আবরণটাকে প্রিয়ন্তি ভয় পেলেও ভিতরের আমিটাকে প্রিয়ন্তি নিজের বন্ধু মনে করে। যেখানে নিজের সব ভালো লাগা, খারাপ লাগা ঢেলে দেয়। আমি নিজেকে পরিবর্তন করেছি প্রিয়ন্তির জন্য।

আমার এই কঠোরতার জন্য প্রিয়ন্তিকে যেনো কেউ কোনো কটু কথা বলতে না পারে। প্রিয়ন্তিকে তোমাদের সাথে মিশতে দেওয়ার অন্যতম কারণ কী জানো? প্রিয়ন্তি তোমাদের সাথে থাকলে ওকে কোনো বিপদ ছুঁতে পারবে না। আমি তো সবসময় ওর পাশে থাকতে পারবো না। এই সমাজের কঠোরতা থেকে এতো বছর প্রিয়ন্তিকে আগলে রেখেছি। তোমাকে আজকে কিছু কথা বলবো। এই কথাগুলো আমি জীবনে কারো সাথে কখনো বলিনি। তুমি কী বিরক্ত হচ্ছো?

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ২৩

জ্বি না আংকেল। আপনি বলুন।
তোমরা জানো প্রিয়ন্তির মা মারা গেছেন। কিন্তু উনি এখনো জীবিত।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ২৫