শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ২৫

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ২৫
তাসনিম জাহান রিয়া

আমরা সবাই জানি প্রিয়ন্তির মা মারা গেছেন। প্রিয়ন্তি নিজেই আমাদের সেই কথা বলেছিল। তাহলে প্রিয়ন্তি আমাদের মিথ্যা বলেছিল? কিন্তু কেনো?
এতো হাইপার হয়ো না। সবটা বলবো বলেই তো তোমাকে এখানে নিয়ে আসলাম। সবকিছু তোমার জানা প্রয়োজন। প্রিয়ন্তি মিথ্যা বলেছিল তবে সেটা আমার কথায়। এই সত্যিটা সবসময় আমি সবার কাছ থেকে আড়াল করার চেষ্টা করেছি।
শ্রেয়সীর ফোনটা বেজে ওঠে। শ্রেয়া বেগম কল করছেন।

ফোনটা আমার কাছে দাও।
শ্রেয়সী নিজের ফোনটা এগিয়ে দেয়।
আসসালামু আলাইকুম ভাবি। আমি প্রিয়ন্তির বাবা।
জ্বী আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি ভালো আছেন তো?
শ্রেয়সী আমার সাথেই আছে। সময় মতো আমি ওকে বাসায় পৌছে দিব। আপনি একদম টেনশন করবেন না। রাখি তাহলে। আসসালামু আলাইকুম।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমার বিয়েটা হয় আমি ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায়। আমার বিয়ের প্রতি কোনো কালেই কোনো আগ্রহ ছিল না। আমার সব আগ্রহ ছিল পড়াশোনার প্রতি। বিয়ে, সংসার এসব আমার কাছে অসহ্য লাগতো।
আমাকে একরকম ধরে বেঁধেই বিয়ে করানো হয়। আমার বাবা অসুস্থ ছিলেন। উনার ইচ্ছে মারা যাওয়ার আগে ছেলের বউ দেখে যেতে চান।

বাবার ইচ্ছেতেই আমার আর প্রিয়ন্তির মার বিয়ে হয়।
বিয়ের আগে আমি প্রিয়ন্তির মাকে দেখিনি। ইনফ্যাক্ট বিয়ের পরও দেখিনি। আমি তখন ঢাকা থেকে পড়াশোনা করতাম। বিয়ে শেষ হবার পর পরই আমি ঢাকা চলে আসি। বউ নিয়ে বাসায় যান বাবা আর অন্যান্য আত্নীয়-স্বজনরা।

আমি একরকম রাগ করেই বাসায় যাওয়া বন্ধ করে দেই। এখনকার মতো তখন এতো ভালো ফোন যোগাযোগ ছিল না। মাস দুয়েক পর একদিন বিকালে খবর আসে বাবা ভীষণ অসুস্থ। হুট করে কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। যতই রাগ করিনা কেনো বাবা তো। সেদিন রাতের ট্রেনেই রওনা দেই। পৌছাতে পৌছাতে ভোর রাত হয়ে যায়। দরজায় কড়া নাড়তেই প্রিয়ন্তির মা দরজা খুলে দেয়। সেটাই ছিল আমাদের প্রথম দেখা। আমাদের না আমার প্রথম দেখা। প্রথম দেখায় প্রেমে পড়া বা ভীষণ পছন্দ হওয়ার ব্যাপারটা হয়নি। বরং আমি বিরক্ত হয়েছিলাম। প্রিয়ন্তির মায়ের বয়স তেরো কী চৌদ্দ। লম্বা একটা ঘোমটা দিয়ে দরজা খুলে দিয়েছিল।

আমাকে দেখে তাড়াহুড়ো করে চলে যেতে গিয়ে শাড়ির কুঁচিতে পা দিয়ে পড়ে গিয়েছিল।
আমি ওকে তুলিনি বরং বিরক্ত হয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিলাম। আমি পৌছানোর ঘন্টা তিনেক পড়েই বাবা মারা যান। বাবা মারা যাওয়ার দুই দিন পরেই আমি ঢাকায় ফিরে আসি। ঢাকায় এসে আমি ব্যস্ত সময় পার করতে থাকি। দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে যায়। এর মাঝে প্রিয়ন্তির জন্ম হয়। প্রিয়ন্তির জন্মের দেড় বছর পর আমি একটা কলেজে চাকরি নিয়ে কিশোরগঞ্জ চলে যায়। তুমি কী বিরক্ত হচ্ছো?
না আংকেল আপনি বলুন।

বিয়েটা হলেও আমাদের কোনোদিন সংসারটা হয়নি। প্রিয়ন্তির মাকে আমি মেনে নিতে পারিনি কখনোই। ও পড়াশোনা করেছিল সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত। আমার ওয়াইফ স্কুলের গন্ডিও পার করতে পারেনি। এটা ছিল আমার জন্য অস্বস্তিকর। আমি কখনো কোথাও ওকে নিয়ে যেতাম। সবার সামনে ওর পরিচয় দিতে লজ্জা করতো। মাস শেষে টাকা তুলে দিতাম ওর হাতে। এতটুকুই ছিল আমার দায়িত্ব।

সংসার কীভাবে চলছে না চলছে সেগুলো আমি কখনোই দেখিনি। ও একাই বয়ে চলেছিল আমাদের সংসারের ভার। প্রিয়ন্তি মাকে আমি অবহেলা করি। আমার অবহেলা সহ্য করতে না পেরে ওর মা রোজ রাতে কাঁদতো এসব দেখেই বড় হচ্ছিল প্রিয়ন্তি। আমি বাসায় কিছু টিউশনি করাতাম। ঐ ব্যাচের একটা ছেলের সাথে প্রিয়ন্তির মার ভীষণ ভাব হয়। সবকিছু আমার চোখের সামনেই হয়েছিল তবু আমি ছিলাম নিরব। কারণ প্রিয়ন্তির মার ব্যাপারে আমি বরাবরই ছিলাম উদাসীন। একদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠে দেখি প্রিয়ন্তির মা নেই কোথাও। একটা কাগজে লিখে গেছে।

ও আমার সাথে থাকতে চায় না। কারণ আমার সাথে সে সুখী না। তার সুখের সন্ধান সে পেয়ে গেছে। এতকিছুর পরও প্রিয়ন্তির আমার প্রতি বা তার আম্মুর প্রতি কোনো অভিযোগ ছিল না। তবে আমি জানি তার মনের কোথাও না কোথাও আমার জন্য এক টুকরো অভিমান জমা আছে।

আমি তার আম্মুকে অবহেলা না করলে হয়তো তার জীবনটা অন্য রকম হতো। আমি প্রিয়ন্তির কোনো চাহিদা অপূর্ণ রাখিনি। একা হাতে মানুষ করেছি। সমাজের কোনো কঠোরতা ওকে ছুঁতে পারেনি। হয়তো মায়ের ভালোবাসাটা দিতে পারিনি। ওর মায়ের প্রতি ওর অভিযোগ নেই কেনো জানো? যার চলা যাওয়াতেও আমার কোনো ভাবান্তর হয়নি। সে আমার সাথে থাকলে যে কোনোদিন ভালো থাকতো না এটা প্রিয়ন্তি বুঝতে পেরেছিল। তোমাকে এতকিছু বলার কারণ জানো কী?

জ্বী না।
তোমাদের বন্ধুদের মাঝে প্রিয়ন্তি সব থেকে বেশি পছন্দ করে তোমাকে। আমার পর যদি কাউকে সব থেকে বেশি ভালোবেসে থাকে সেটা তুমি। নাহিনকে ভালোবেসে থাকলেও তোমার থেকে বেশি না। তুমি হচ্ছো ওর জীবনের ফাস্ট প্রায়োরিটি আর নাহিন সেকেন্ড প্রায়োরিটি। ওদের সম্পর্কের কথা আমি শুরু থেকেই জানতাম তোমাকে না বলার একটা কারণ প্রিয়ন্তির ছিল।

তোমার ভাইয়ের সাথে ওর সম্পর্ক আছে এটা শুনে যদি ওর সাথে তুমি সম্পর্ক নষ্ট করে দাও। ও সবকিছু সহ্য করতে পারলেও কারো অবহেলা সহ্য করতে পারে না আর কাছের মানুষের কাছ থেকে তো একদমি না। প্রিয়ন্তি আমাকে সবকিছু বলেছে। প্রিয়ন্তির কথা শুনে বুঝতে পেরেছি তুমি প্রিয়ন্তিকে ইচ্ছাকৃতভাবে ইগানোর করোনি। কিন্তু প্রিয়ন্তির অবচেতন মন ভাবছে তুমি ওকে ইচ্ছাকৃতভাবে ইগনোর করেছো।

প্রিয়ন্তির একটা মানসিক সমস্যা আছে। ওকে কেউ অবহেলা করলে ও ডেসপারেট হয়ে যায়। যেকোনো ভাবে সবকিছু আগের মতো করতে চায়। সব ঠিক করতে গিয়ে আরো এলোমেলো করে ফেলে। খারাপ ব্যবহার করে। ঐ এক্সিডেন্টটা ওর ছোট মনে ভীষণ প্রভাব ফেলেছিল। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করার কারণ?

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ২৪

জ্বী। আমার একটা প্রশ্ন আছে।
বল।
আন্টি মানে প্রিয়ন্তির মা এখন কোথায় আছে?
যতটুকু জেনেছো সেটাই বেশি। তাই এর থেকে বেশি জানতে চেয়ো না।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ২৬