প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৪

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৪
লেখিকাঃ মাহযাবীন

“বাবা-মা আমাদের ডিভোর্স চাচ্ছেন”
শূন্য দৃষ্টিতে আর্শের মুখপানে চেয়ে কথাটা বলে উঠে মিয়ামি।আর্শ কিংকর্তব্যবিমূঢ়।ভুল শুনলো না তো সে? নিজের সন্দেহ দূর করবার উদ্দেশ্যে সে প্রশ্ন করে উঠলো,

-কি বললে?
-বাবা-মা চান আমাদের ডিভোর্স হোক দ্রুত।
থমকে গেলো আর্শ।মুহূর্তেই চোখদুটো রক্তবর্ণ ধারণ করলো তার।অস্থির হয়ে উঠলো সে।শরীরের শিরা-উপশিরায় বহমান রক্তও যেনো নিজের স্বাভাবিক গতি হারিয়ে অস্বাভাবিক হারে বইতে আরম্ভ করলো।এজন্যই হয়তো এমন অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে সর্বাঙ্গে।নাকি এ যন্ত্রণা একান্তই তার হৃদয়ের, যা তীব্র বেগে ছড়িয়ে পড়েছে তার সমস্ত শরীর জুড়ে!
বুঝলো না আর্শ।শূন্য মস্তিষ্কে মিয়ামিকে প্রশ্ন করে উঠলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-আমাদের বাচ্চা?
এ প্রশ্নের উত্তর তো জানা নেই মিয়ামির।তার বাবা-মা কি একবারো ভেবেছে এই অনাগত ছোট্ট প্রাণ টার কথা?এরও তো উত্তর নেই মিয়ামির কাছে।তার অসহায় হৃদয় একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো।মুখ ফুটে বলে উঠলো,
-জানি না।
আর্শের যন্ত্রণা বাড়ছে কেবল।সে নিজেকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে রেখে জিজ্ঞেস করে উঠলো,

-তুমি কী চাও?
এ প্রশ্নে আর্শের চোখের দিকে তাকায় মিয়ামি।চোখে চোখ নিবদ্ধ রেখে মনে মনে বলে ওঠে,
“যার সংস্পর্শে আমার হৃদয় বাঁচে, যার একটু দূরে গেলেই শ্বাসরুদ্ধ লাগে,তাকে আমি কী করে ছাড়ি?তুমি জানো?আমার হৃদয় নামক মরুভূমিতে এক ফোটা তৃষ্ণা মেটানো জল তুমি!এই জলের মূল্য বোঝো?কেউ কী কখনো পারে এ জল পেয়েও তা ছুঁড়ে ফেলে দিতে?”

উক্ত বাক্যগুলো হৃদয়ের গহীনেই গোপন রইলো।ঠোঁট অব্দি এলো না আর না এলো তা চোখ অব্দি।তাও এই শূন্য চোখে উত্তর খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আর্শ।তার ভেতরের যন্ত্রণা যেনো সময়ের সাথে সাথে অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।তবুও তা নিয়ন্ত্রণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে আর্শ।সে এক বুক আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে মিয়ামির মুখপানে একখানা ইতিবাচক উত্তরের আশায়।
সময় নিলো মিয়ামি।অতঃপর অভিমানের বশবর্তী হয়ে সে বলে উঠলো,

-এটাই তো ভালো হবে,তাই না?
এ উত্তর খানা যেনো মুহুর্তেই আর্শের যন্ত্রণা কয়েকশত গুণ বাড়িয়ে দিলো।ক্রোধে ফেটে পড়লো তার হৃদয়।মুখে প্রকাশ পেলো কাঠিন্যতা।রক্তবর্ণ চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো এক ফোটা যন্ত্রণা। নিজের উপর যেনো সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসলো সে। তার হাতের কাছেই এক টেবিলে রাখা ছিলো টেবিল ল্যাম্প,পানির জগ, গ্লাস।সেগুলো সব ছুড়ে ফেললো আর্শ।মেঝেতে পড়ে বিকট শব্দ হলো।ঘুম ভাঙলো মিয়ামির মা-বাবার।হতভম্ব হয়ে গেলো মিয়ামি।সে স্বপ্নেও ভাবেনি আর্শ এতোটা বেপরোয়া হয়ে উঠবে।

এ কয়টি জিনিস ভেঙে রাগ এক বিন্দুও কমলো না আর্শের।সে উন্মাদের ন্যায় মিয়ামির ওয়ারড্রবের উপর রাখা সব আসবাবপত্রও ছুড়ে ফেললো।
এ মুহুর্তেই মিয়ামির বাবা-মা এসে উপস্থিত হয় মিয়ামির রুমের সামনে।দরজা লাগানো বিধায় ভেতরে ঢুকতে পারেন না তারা।অতঃপর উপায় না পেয়ে জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে শুরু করেন।

পরিস্থিতি বেগতিক দেখে মিয়ামি দিশেহারা হয়ে পরলো।মাথায় এলো,সর্বপ্রথম প্রয়োজন আর্শকে সামলানো।এরপর বেশি কিছু ভাবার সময়-সুযোগ হলো না মিয়ামির।সে ছুটে গেল আর্শের কাছে।ছেলেটার শার্টের কলার ধরে খিঁচে নিজের কাছে নিয়ে এলো।অনতিবিলম্বে তার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবালো নিজের।

হটাৎ মিয়ামির এমন কাজে হতবাক আর্শ।প্রথমে নিজেকে সামলাতে তার সময় লাগলো খানিক।তবে সমস্ত শরীরজুড়ে ছড়িয়ে পড়া যন্ত্রণারা যেনো শান্ত হলো এবার।তার সর্বাঙ্গ জুড়ে বয়ে গেলো প্রেমের সুবাস।
সে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরলো মিয়ামিকে।আরও খানিক ডুবলো মিয়ামির ঠোঁটে।

এমতাবস্থায় মিয়ামি বুঝলো আর্শের উন্মাদনা এখন স্বাভাবিক পর্যায়ে।প্রায় সাথে সাথেই সে সরে আসলো আর্শের থেকে।
দরজায় ক্রমাগত আঘাত করেই চলেছেন মেহরিন বেগম ও তার স্বামী।চিন্তায় ঘাম ছুটে গিয়েছে দু’জনেরই।এমন সময় রুমের ভেতর থেকে আসা মিয়ামির উচ্চ কন্ঠস্বর কানে আসে তাদের।

“আর একবারো দরজা টাকাবে না তোমরা।কি শুরু করছো?আমার রুমে কি আমি আমার ইচ্ছা মতো কিছু করতে পারবো না?রাগ উঠলে জিনিস ভাঙতে পারবো না?নাকি এতেও তোমাদের অনুমতি নিতে হবে?এর জন্যও কি আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবা?”

মিয়ামির কথায় দমে গেলেন স্বামী-স্ত্রী উভয়ই।মেয়ের মনের অবস্থা বোঝেন তারা।তাদেরও তো কষ্ট হচ্ছে। কোন বাবা-মা চাইবে তার সন্তানের সংসার ভাঙুক? তারাও তো চায় না।কিন্তু কোন ভরসায় তারা তাদের একমাত্র মেয়েকে এক ড্রাগ অ্যাডিক্টেডের সংসার করতে দিবে?এতো খারাপ দিন তো তাদের আসেনি।নিজের সন্তানকে সারা জীবন রাজরানী করে রাখার মতো তৌফিক তো স্রস্টা তাদের দিয়েছেন। তাহলে কেনো করবে মিয়ামি একজন নেশাখোরের সংসার যেখানে তার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই!

দরজায় হওয়া শব্দ বন্ধ হতেই মিয়ামি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।কিছুক্ষণ আগের সেই ভয়ংকর পরিস্থিতির কথা ভাবতেই শিউরে উঠলো সে।আর্শ শান্ত মেজাজের হলেও তার উন্মাদনা কতটা ভয়ংকর তা বিগত ১ বছরে বেশ টের পেয়েছে মিয়ামি।সে জানে আজ আর্শ ও তার বাবা মুখোমুখি হলে ৩য় বিশ্বযুদ্ধ এখানেই সংঘটিত হতে সময় নিতো না।কারণ এ সংঘর্ষ দুই মেয়ে-জামাই ও শশুরের মাঝে নয় বরং দু’জন বাবার মাঝে হতো।এক বাবা যে নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে শঙ্কিত,অপর বাবা যে নিজের অনাগত সন্তান হতে বিচ্ছেদের পীড়ায় উন্মাদ।

এসব ভাবতে ভাবতেই মিয়ামির চোখ পরে আর্শের দিকে।ছেলেটা তার ওয়ারড্রবের সাথে ঠেক দিয়ে বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে তার পানে চেয়ে।চোখ এখনো লাল হয়ে আছে।মুখে নেই কোনো প্রতিক্রিয়া। কেবল যেনো এক ব্যথিত মানব মূর্তি সে।

ছেলেটার মুখ পানে চেয়ে কেমন এক মায়া কাজ করলো মিয়ামির।কিন্তু পরমুহূর্তেই তার মনে পরলো আর্শের করা কিছুক্ষণ আগের সব কান্ড।মুহূর্তেই রাগ চড়াও হলো তার মাথায়।এগিয়ে গেলো আর্শের ধারে।দু’হাতে কলার চেপে ধরলো তার।দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,

-তোমাকে এই বাড়িতে ঢুকতে দেওয়াই আমার ভুল হইছে।বের হও আমার বাসা দিয়ে,এক্ষনি।
ব্যথিত মুখশ্রীতে আর্শ ঠোঁটে ছোট্ট একটা বাঁকা হাসি টেনে নিলো।এক হাতে মিয়ামির কোমর চেপে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো এবং অপর হাতের তিন আঙ্গুল দ্বারা চেপে ধরলো মেয়েটার গাল।চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো,

-আমার শিরায় শিরায় তুই মিশে আছিস,মিয়ু।স্বয়ং স্রস্টা ছাড়া আর কারো সাধ্য নেই যে আমার থেকে তোরে আলাদা করবে।আলাদা করার চেষ্টাও যদি কেউ করে তাহলে এক নতুন আর্শের সাথে পরিচয় হবে সবার।যে আর্শের একটাই রূপ আর তা পশুর থেকেও হিংস্র।তাই তালাক শব্দ ভুলেও মাথায় আনিস না।আর যদি আনিসই তাইলে কসম, আগে তোরে খুন করবো তারপর নিজেরে।বিশ্বাস কর মিয়ু আমার হাত কাঁপবে না।

চোখের পলকে শেষ হলো পুরো একটা সপ্তাহ।বেরানো শেষে সময় হলো প্রিয়জন ছেড়ে প্রয়োজনের পথে রওয়ানা হওয়ার।আগামী কাল সকালেই আর্শি ও তার বাবা-মা রওয়ানা হবেন ঢাকার উদ্দেশ্যে।এতে সবারই মন খারাপ।আর্শির নানু ক্ষণে ক্ষণে চোখ ভিজাচ্ছেন।

শত মন খারাপের মাঝেও ঠোঁটে হাসি টেনে বাস্তবতা মেনে নিয়ে স্বাভাবিক থাকতেই হয়।এখানেও সবাই তাই-ই করছে।মন খারাপ লুকিয়ে পিঠা উৎসবে মেতে উঠেছেন সবাই।মাগরিবের নামাজ শেষ করে বড়রা সবাই বসেছেন হরেকরকমের পিঠা বানানোর প্রস্তুতিতে।ছোটরা তাদের কাছে বসে গল্পে মেতে আছে।এ এক আনন্দমুখর সন্ধ্যা।

সাধারণত গ্রামে শীতের সময় বেশির ভাগ ঘরেই আলো নেভে এশার নামাজের পর পর।৭-৭ঃ৩০ এর মধ্যেই প্রায় সব ঘরগুলোতেই বিছনা প্রস্তুত থাকে শুধু তাতে গা এলিয়ে দিতে যতক্ষণ।এরপর ৮ টা বাজতেই সব ঘুমাঘুম।চারিদিকে নিরব, নিস্তব্ধ পরিবেশ। ঘড়ির কাটা ঘুরার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে শীতানুভূতি।
তবে আজকের রাতটা অন্যান্য রাতের থেকে ভিন্নভাবে উপভোগ করছে আর্শির নানাবাড়ির সবাই, সেই সাথে আরো কয়েকঘরের মা-বোনেরা।যারা আর্শিদের প্রতিবেশী ও সুখের সময়ের বন্ধু।

কুহেলি ও তার ছোট বোন উত্তরী আর্শির গা ঘেঁষে বসে আছে।সম্পর্কে আর্শির মামাতো বোন তারা।তিন জনে বসে সেই সন্ধ্যা থেকে গল্পে মত্ত।এবার সব পিঠে বানানো শেষ হতেই যে যার মতো উঠে গেলো নিজের পছন্দমতো পিঠে খাবার উদ্দেশ্যে।
আর্শি ও উত্তরী খাওয়া শুরু করলেও কুহেলি এখন অব্দি মুখে পিঠা তুললো না।বিষয়টা লক্ষ্য করলো আর্শি।জিজ্ঞেস করে উঠলো,

-কিরে তুই খাচ্ছিস না কেন?
-আপু আমার না ভালো লাগছে না।আমি বাটিতে করে বাসায় নিয়ে যাই আমার টা?
-নিলে নিবি।তোর ইচ্ছা।জিজ্ঞেস করা লাগে?

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৩

উত্তরে মৃদু হেসে সযত্নে একটা বাটিতে শীতলের সবথেকে পছন্দের পিঠা ‘কুলি পিঠা’ গুলোকে তুলে নিলো কুহেলি।অতঃপর সবার দৃষ্টি এড়িয়ে কেউকে কিছু না বলেই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরলো সে।

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৫