প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৫

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৫
লেখিকাঃ মাহযাবীন

বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে চলছে আর্শি।বিহান কী আসবে তাকে দূর থেকেই একটু খানি বিদায় দিতে?
না চাইতেও কেনো জানি এখানে বিহানের উপস্থিতি খুব করে চাইছে আর্শি।ঢাকায় ফিরার আগে একটা বার শুধু এক পলক এর জন্য হলেও সে বিহানকে একটু খানি দেখতে চায়।মনে এ আশা নিয়ে একবার নিজের ফোনটায় একটু চোখ বুলালো আর্শি।নাহ,নেই বিহানের তরফ থেকে কোনো ক্ষুদে বার্তা।

বাস স্ট্যান্ডে টং এর দোকানের অভাব নেই।হাড়কাঁপা শীতের সকালে গরম গরম ধোঁয়া উড়া চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার মতো প্রশান্তি মোটামুটি কেউই হাত ছাড়া করতে চায় না।সানিয়া বেগম ও আরহান সাহেবও লোভ সামলে উঠতে না পেরে দু’কাপ দুধ চায়ে চুমুক বসাতে ছুটলেন টং এর দোকানে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আর্শি একা দাঁড়িয়ে রইলো ২-৩টে ব্যাগ সাথে নিয়ে।প্রিয় মানুষটাকে এক পলক দেখার লোভ টা এই শীতের মাঝে গরম চায়ে চুমুক দেওয়ার থেকে একটু যেনো অধিকই ঠেকলো আর্শির কাছে।
শীতে হাতে হাত ডলছে মেয়েটা আর চারিদিকে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে বিনা বিরতিতে।
বাস আসার সময় হয়ে গেছে।যেকোনো সময় চলে আসবে।
সময় পাড় হবার সাথে সাথে মন খারাপ ক্রমশ বাড়ছে আর্শির।বিহানের দেখা মিলবার আশা যেনো সে ছেড়েই দিচ্ছে ধীরে ধীরে।

অবশেষে তার ক্লান্ত নেত্রযুগল নুইয়ে পড়তেই বাসের শব্দ কানে আসে তার।ঐ তো বাস আসছে, আশেপাশের সবার হৈ-হুল্লোড় শুরু হয়ে গেছে।চারিপাশে একই ধ্বনি, “এই বাস আসছে,বাস আসছে”।
আর্শি তার যায়গায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো।পেছন থেকে তার বাবা-মা ছুটে এলো।ব্যাগগুলো সব ঠিকঠাক আছে কিনা তা দেখে নিয়ে তারাও দাঁড়ালো বাস এসে থামবার অপেক্ষায়।

থামলো বাস,একে একে যাত্রী উঠছে।উঠলো আর্শিরাও।জানালার ধারের সিটটায় বসে শেষ বারের মতো আশপাশ টায় চোখ বুলালো আর্শি।নেই বিহান।কোথাও নেই।আসেনি সে।আজকের পর দু’জন দু’টো আলাদা শহরে থাকবে।যেখানে দুজনের মাঝের দুরত্ব হবে কয়েক হাজার কিলোমিটার।চাইলেই আর সম্ভব হবে না ক্ষণিকের জন্যও দেখা করার।না বিহান সচারাচর যায় ঢাকায় আর নাহ আর্শি আসে এ শহরে।তাই দু’জনের আর দেখা হওয়ার সম্ভাবনা এখন শূন্য।আর যদি দেখা হয়ও তাও ১-২ বছরের আগে সম্ভব নাহ।

এগুলো তো জানে বিহান।তাহলে কেন এলোনা সে? আর্শিকে বিদায় দিতে আসতে কী একটুও ইচ্ছে হলো না বিহানের?ইচ্ছে হলো না একটু দেখার?
এইযে আর্শি শহর ছাড়ছে, এতে কী একটুও হৃদয় পুড়ছে না বিহানের?আলাদা হচ্ছে দু’জনের শহর এতে কী কোনো অনুভূতিই তৈরি হচ্ছে না বিহানের হৃদয়ে?এতো হৃদয়হীন কেনো এই পুরুষ?

এসব ভাবতে ভাবতেই সিটে মাথা এলিয়ে দিলো আর্শি।বুঁজে নিলো সে নিজের চোখজোড়া।বাস তার নিজের গতিতে চলতে আরম্ভ করেছে।আর্শিও বিভোর হলো তার নিস্তব্ধ দুঃখবিলাসে।খুব লুকিয়ে এক ফোঁটা অশ্রু কণা চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরলো।আর্শি আটকালো না।

এক স্মৃতি মনের কোণে উঁকি দিলো।বিহানের সাথে পরিচয় হবার পর গ্রামে এর আগেও একবার এসেছিলো আর্শি।যেদিন আসলো সেদিন বাসে থাকা অবস্থাতে বিহানের সাথে তার কথা হয়েছিলো পুরোটা জার্নি জুড়ে। ছেলেটা বলেছিলো,
“বাস স্ট্যান্ডে আসবো পিক করতে?”

“উহুউউউ,জার্নিতে চেহারার যে অবস্থা তা আপনার দেখা লাগবে না”
ঠোঁটে হাসি নিয়ে এই উত্তর খানা লিখে ছিলো সে।
তারপর সেবার ঢাকায় ফিরে আসবার সময় আর্শি বিন্দু পরিমাণ আশা করেনি বিহান তাকে বিদায় দিতে আসবে।আর্শিকে চমকে দিয়ে সেবার দূর থেকেই আর্শিকে দেখে বিদায় দেয় বিহান।
কী সুন্দর ছিলো সে সময়গুলো।না চাইতেই পেয়ে যেতো কতশত বিশেষ মুহূর্ত।কিন্তু এখন মরিয়া হয়ে চেয়েও তার প্রাপ্তি টা শূন্যের কোঠায়ই রয় বেশির ভাগ সময়।

এমন টাই কী সব ক্ষেত্রে হয়?প্রথমে পুরুষেরা স্বপ্ন দেখায় অতঃপর নারীরা যখন সে স্বপ্ন আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায় ঠিক তখনই কী রূপ বদলায় পুরুষ? তখনই কী বাড়ে অবহেলা?যত্নশীল পুরুষটা কী হটাৎই বেপরোয়া হয়ে ওঠে?অহংকার ছোঁয় আকাশ?নারীর মূল্য কী তখন থাকে তার চরণে? কেনো হটাৎ করে খুব পরিচিত মানুষ টা হয়ে ওঠে এমন অচেনা?

এটাই কী নিয়ম এই বিচিত্র পৃথিবীর? কোথাও কী কোনো সংবিধানে লেখা আছে, এক বুক ভালোবাসলে এক সমুদ্র দুঃখ কুড়িয়ে নিতে হয়-ই?ঠিক এ জন্যই কী হুমায়ুন ফরিদি স্যার বলেছিলেন যে, ভালোবাসার অপর নাম যন্ত্রণা?
তাহলে প্রথম দিকে কেনো এতো সুখ দেয়?প্রথমে সুখের লোভ দিয়ে পরে কেড়ে নেয় সবটা।দিয়ে যায় যন্ত্রণাময় বিষাক্ত নিঃশ্বাস।এ কেমন নিষ্ঠুরতা?

প্লেটে ভাত বেড়ে নিয়ে মিয়ামির কক্ষে প্রবেশ করেন মেহরিন বেগম।দেখেন মিয়ামি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে জানালার ধারে।মেয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। এক লোকমা খাবার তুলে ধরলেন মেয়ের সামনে।নিম্ন স্বরে বলে উঠলেন,
“হা কর”

মিয়ামি এক পলক তাকালো তার মায়ের দিকে।ভেতরে ভেরতে কেমন হাঁপিয়ে উঠছে সে।কোনো কাজ না করেও যেনো ভীষণ ক্লান্ত সে।তাই আর ইচ্ছে হলো না কোনো বাকবিতন্ডায় জড়াতে।ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়েই খাবার মুখে তুললো সে।
কয়েক লোকমা খাবার খাইয়ে মেহরিন বেগম মৃদু কেশে গলা পরিস্কার করে নিলেন নিজের।খানিক সময় নিয়ে বলে উঠলেন,

-মিয়ু,সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?দেখ তোর বাবা কিন্তু তার জীবন থাকতে তোকে আর্শের কাছে ফিরতে অনুমতি দিবে না কখনো।যত দ্রুত সম্ভব সিদ্ধান্ত নে।
-সিদ্ধান্ত নেওয়ার কিচ্ছু নেই মা।আমি আমার স্বামীকে তালাক দিবো না।
-আর্শ ড্রাগস নেয় মিয়ু।বুঝতে পারছিস তুই? তুই একজন নেশাখোরের সাথে জীবন পাড় করবি?

উত্তরে আলতো হাসলো মিয়ামি।জানালার কাছ থেকে সরে এসে বিছানায় বসলো।মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
-অদ্ভুত না মা? একটা সময় ছিলো যখন কিছু স্বামীরা প্রতিরাতে মদ খেয়ে এসে বউ পিটাতো, একের অধিক বিয়ে করতো, পরকীয়া করতো, স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা তো দূরের কথা সহানুভূতিও কাজ করতো তাদের।অথচ সে সময় মেয়েদের বলা হতো স্বামীর বাড়ি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছাড়তে হয় না, স্বামীর বাড়ির মাটি আঁকড়ে ধরে বাঁচতে হবে যত কষ্টই হোক না কেনো!

আর এখন দেখো মেয়েকে একটু মানিয়ে নিয়ে চলা লাগলেই কিছু কিছু বাবা-মায়েরা সংসার ছেড়ে বেরিয়ে আসতে জোর করে,উৎসাহিত করে।
বলে একটু থামলো মিয়ামি।জিহ্বা দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে পুনরায় বলতে আরম্ভ করে,
-দুটোই কিন্তু খারাপ। অত্যাচার সহ্য করে, আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে সংসারে পরে থাকা যেমন অনুচিত তেমনই ছোট ছোট বিষয় যা ঠিক করে নেওয়া যায়,কষ্ট হলেও মানিয়ে নেওয়া যায়, মেনে নেওয়া যায় এমন সবের জন্য সংসার ভাঙাও অনুচিত।

কথাগুলো বলে থামে মিয়ামি।মায়ের কাছে গিয়ে তার হাত জোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে ওঠে,
-মা আর্শ কী আমাকে কম ভালোবাসে?কম সম্মান করে?ও কী আমি ছাড়া অন্য কোনো নারীর দিকে কখনো তাকায়?ও কী কখনো আমার গায় হাত তুলছে?কিংবা ও কী কখনো তোমাদের অসম্মান করছে?তাহলে কেনো আমি আমার স্বামীকে তালাক দিবো?এটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

আর ড্রাগসের ব্যাপার টা?ও পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে ড্রাগস এ আসক্ত হয়ে পড়ছিলো।তারপর আমাদের বিয়ের পর ও সম্পূর্ণ ছেড়ে দেয় ড্রাগস নেওয়া।৬ টা মাস টানা ও কোনো ড্রাগস নেয়নি।কিন্তু ৬ মাস পর ওর আবার শরীরে কাঁপুনির মতো হয়,নেশা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তাই ওকে নাকি আবারও ড্রাগস নিয়ে হয়েছিলো।আর এটা স্বাভাবিক মা।ড্রাগস আসক্তি এক বারেই সম্পূর্ণ ছাড়ানো যায় না।অবশ্য অনেকের একবারেই হয়ে যায় আবার অনেকের এই আসক্তি আবার ফিরে আসে।আর্শের টা একবার ফিরসে।কিন্তু আর ফিরবে না মা।আমার বিশ্বাস আর ফিরবে না।কেনো জানো?কারণ!

কথা টা অসম্পূর্ণ রেখে মিয়ামি নিজের পেটে হাত রাখে।ঠোঁটে ছোট্ট এক মলিন হাসি টেনে বলে ওঠে,
-তোমার নানি/নাতনির চিন্তাই ওর জন্য ঐ রাস্তা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিবে।একজন মানুষ যতই খারাপ হোক,একজন বাবা তো খারাপ হয় না তাই না মা?একজন বাবা তো চাইলে তার সন্তানের জন্য জানও দিতে পারে, পারে না? বলো না মা?আর্শও তো পারবে তার সন্তানের জন্য নিজেকে এই ড্রাগস থেকে দূরে রাখতে।পারবে না?

প্রশ্নগুলো করতে করতেই কেঁদে ফেলে মিয়ামি।এ প্রশ্নগুলো যেনো সে নিজের মাকে করছে না বরং নিজে নিজেকেই করছে।যে অনিশ্চয়তায় মেয়েটা ভেতরে ভেতরেই পুড়ছে ভীষণ তা না চাইতেই যেনো বেরিয়ে এলো।

[ অনেকেই দেখলাম শীতল-কুহেলির কাহিনিটা এড করায় অসন্তুষ্ট।মানে এক গল্পে তিনটে কাহিনি পড়তে গিয়ে অনেকেই প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলছেন।তাই শীতল-কুহেলির কাহিনিটা আর লিখবো না।আমারও ভর্তি পরিক্ষার চাপ শুরু হচ্ছে।

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৪

তাই ভাবলাম থাক, শীতল-কুহেলি নিয়ে পরে লিখবো,অন্য কোনো এক নতুন গল্পে♥️
আর প্রণয় আসক্তি সিজন ০২ লেখাই হচ্ছে আর্শি ও বিহানের পরিণতি দেখাবার উদ্দেশ্যে।তাই আর্শ-মিয়ামিকে বাদ দিয়ে ওদের নিয়েও একটু ভাবেন আপনারা😬]

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৬