উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ৬

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ৬
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

দিন ও রাত্রির সন্ধিক্ষণ, গোধূলিলগ্নের কোমল রূপে ঘরে ফেরার সময়। আকাশের নমনীয় বুকে লালিমা আস্তরণ। রাহাতের বুকে হৃদয় কাঁপানো অদম্য এক ব্যথা। সে ভালোবেসে ভালোবাসাকে বেঁধে রাখতে পারেনি। সেদিনের হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়লে এখনো বুঁক কেঁপে ওঠে তার। ভীষণরকম বুকে ব্যথা চেপে লিখা ভর্তি সাদা কাগজে কলম চালিয়েছিল। তীব্র অপরাধবোধে চোখে চোখ রাখতে পারেনি সে। কৌশলে একটিবার প্রিয়তমার বেদনার্ত, ম্লান মুখে তাকিয়ে সহ্য হয়নি তার।

তাইতো চো*রে*র মতো ঊর্মির কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করলো। শেষবেলাতেও একটিবার দেখা দিলোনা।
শামীমের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সীমানা বাড়িয়ে দিয়ে কঠোর নিরবতায় আটকা পড়লো রাহাতের মন। নিজের প্রশ্নের জবাবে কোনরূপ প্রতিত্তোর না পেয়ে ফের প্রশ্নবিদ্ধ করলো শামীম।
-“তুমি কি আমায় সবটা পরিষ্কার করে জানাবে?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এক দীর্ঘশ্বাসে নিরবতার অবসান ঘটলো। রাহাতের অবসন্ন কন্ঠের জবাব,
-“আমার আর ঊর্মির মধ্যে যে ছাড়াছাড়ি ব্যাপারটা ঘটেছে, তাতে হাত রয়েছে মা আর আত্মীয় স্বজনদের।”
খুব একটা অবাক হলোনা শামীম। মৃদু শব্দে ভাইকে তাচ্ছিল্য করে হাসলো বোধহয়। তর্জনী তুলে অনমনীয় কন্ঠে অনড় হয়ে বলল,

-“দো*ষ সম্পূর্ণ তাদের ঘা*ড়ে চাপিয়ে দিচ্ছো? তোমার মতামত না নিয়ে কিভাবে বিচ্ছেদ ঘটায়? এমন সাহস কার আছে? বিচ্ছেদে সপ্তাহ না পেরোতেই তুমি ঘরে নতুন বউ তোল। একজনকে দুঃখের সমুদ্রে ভাসিয়ে, অন্যজনকে নতুন রূপে বরন কর। এতেই তোমার কথার নড়বড়ে ভাব প্রমাণ হয়।”
কথাগুলো বলার সময় শামীমের চোখেমুখে ছিল তীব্র অবজ্ঞার ছাপ। যা দেখে রাহাতের বুকে নতুন ব্যথার উদ্রেক হয়। ধরে আসা কন্ঠস্বর কেমন কাঁপা কাঁপা শোনালো।

-“আমি যে দো*ষী, এটা অস্বীকার করার সাধ্য আমার নেই। আমার সবচেয়ে বড় দো*ষ হলো নিজের প্রতি দৃঢ়তা আর আত্মবিশ্বাসের প্রবল অভাববোধ। কঠিন মুহূর্তে তার পাশে না থেকে নিজেই শতগুণ ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাওয়া। আমার ভঙ্গুরতা আমার সবচেয়ে বড় দো*ষ। অথচ এমনটা কথা ছিল না। কথা ছিল সকল পরিস্থিতিতে আজন্ম তার হাত জোড়া শক্ত করে ধরে রাখবো। আমিই হবো তার শক্তি। অথচ আমি হলাম তার দু্র্বলতার কারণ।”

শামীমের শিথিল মস্তিষ্কে কৌতুহলের ঢেউ খেলে গেলো। জানার আগ্রহ ক্রমশই বাড়লো। উৎসুক দৃষ্টি মেলে বলল,
-“এত এত ভালোবাসা, ভরসার মাঝে কি এমন শক্তি এলো যে, তোমার ভালোবাসা নড়বড়ে হয়ে পড়লো?”
আজ যেন দীর্ঘশ্বাসেরা পালাক্রমে তাড়া করে চলেছে। এছাড়া আর আছেটাই বা কী? ব্যথাতুর কন্ঠে রাহাতের কাছ থেকে দীর্ঘ জবাব। অনেকটা ব্যাখ্যার মতো।

-“প্রায় মৃ*ত্যু*স*য্যা*য় ঢ*লে পড়া ঊর্মিকে নিয়ে হাসপাতালে কঠিন সময় আমার। সাপোর্ট এর পরিবর্তে আত্মীয়স্বজনদের কান পড়া বেশি পেয়েছি। আত্মীয়স্বজনরা আফসোস করে বলতেন ঊর্মিকে নিয়ে আমি নাকি সংসার করতে পারবোনা। প্রতিনিয়ত তাদের মন্তব্যকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে ভাবতাম একটুখানি স্বস্তি মিললো।

তখন কিন্তু আমাকে মানসিক সাপোর্ট দেওয়ার মতো কাউকে পাশে পাইনি। নিজে নিজেকে যতটুকু ভরসা দিতে পেরেছি, ততটুকুই। হয়তো ঊর্মির অবস্থা দেখে কেউ আমায় সাহস দেওয়ার বিষয়টা মাথায় আনতে পারেনি।
সন্তানের জন্য মায়ের চেয়ে আপন কেউ হয়না। ভারি বুক হালকা করতে মাকে বেঁচে নিলাম। আমার নিয়তি কি ভীষণ নিষ্ঠুর, মা আমাকে আশ্চর্যের শেষ প্রান্তে নিয়ে ছাড়লো। তিনি বললেন, ‘হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পরই তুই ঊর্মিকে তা*লা*ক দিবি। ও আর সংসার করার যোগ্য না’।

আমি সেদিন ছিটকে পড়লাম। চরম বিরোধিতা করলাম মায়ের। শেষ পর্যন্ত মা আমায় টিকে থাকতে দিলেন না। প্রতিনিয়ত একই কথা বলে যন্ত্রণা দিয়ে গেলেন।ধীরে ধীরে আমার মস্তিষ্ক বিকল হতে শুরু করলো। একটু খানি মানসিক শান্তি খুঁজতাম সবখানে। সবার কাছেই মিলতো শুধু খাঁ খাঁ শূন্যতা। ততদিনে ঊর্মির পরিবারকেও মা জানিয়ে দিলেন ডি*ভো*র্সে*র কথা। দু’পক্ষের মনমালিন্য সৃষ্টি হলো। আমি যখন ভরসা হয়ে ঊর্মির পাশে দাঁড়াবো, তখন মা আমায় কসম দিয়ে বসলেন। আমি ঊর্মিকে না পরিহার না করলে তিনি স্বইচ্ছায় মৃ*ত্যু*কে বেছে নেবেন।

যখন আমার সবচেয়ে বেশি মায়ের সাপোর্ট দরকার ছিলো, তখন মা আমায় ছিন্নভিন্ন করে দিলেন।
তবুও আমি ঊর্মির দিকে পা বাড়াতে চাইলাম। এবার মা বেশ কোমর বেঁধেই নামলেন। শাড়ির আঁচল থেকে ছোট একটা প্যাকেট দেখিয়ে বললেন এক্ষুণি পানিতে গুলে খেয়ে নেবেন। যার জন্য আমি দায়ী থাকবো।

কাউকে জানাবো, সেই পথও মা খোলা রাখলেন না। সন্তানের কাছে সবচেয়ে আপন মা। আর এটাকে পুঁজি করেই মা এতসব করলেন। সবকিছুতেই নিজের মৃ*ত্যু ভ*য় দেখাতে লাগলেন আমায়। অবাক লাগছে এতটা মানসিক চাপে আমি কেন পা*গ*ল হয়ে যাইনি? তবে হয়তো পরিস্থিতি এমন হতোনা। ঊর্মিকে ছাড়তে হতোনা।
আমি শুধু একগাদা লিখা ভর্তি কাগজে স্বাক্ষর করেছি। কিন্তু মুখ দিয়ে বা মন থেকে কখনো তা*লা*ক শব্দটি উচ্চারণ করতে পারিনি। আমাকে চাপের মুখে ফেলেই মা স্বাক্ষর করিয়েছেন।”

রাহাতের জলে টইটম্বুর চোখজোড়া আবেশে মুদে এলো। বেদনার একফোঁটা জল চিবুক স্পর্শ করলো।
শামীম এবার প্রচন্ড অবাক হলো। হতবিহ্বল হলো মায়ের কর্মকান্ডে। নিজেকে অপরাধী মনে হলো, সত্যিই তো! সে নিজেও তো সেই দুর্বিষহ সময়টাতে রাহাতের কাঁধে হাত রেখে বলেনি ‘আমি তোমার সাথে আছি ভাই’।
ভাইয়ের শক্তি হয়ে দাঁড়ায়নি সে। কেবল নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করেছে।
আমরা প্রত্যেকে আপন দৃষ্টিতে নিজ জায়গায় সঠিক হলেও অন্যের দৃষ্টিতে সবাই স্বা*র্থ*লো*ভী। অন্যের দৃষ্টিতে আমাদের সত্যিকারের সত্তা প্রকাশ পায়।

সেদিন ভাই কতটা নিঃসঙ্গতা অনুভব করেছে, তা কেবল সে নিজেই বলতে পারবে। আমরা বলে থাকি ‘আপনার ভেতরকার কষ্ট আমি উপলব্ধি করি’।
আসল সত্যি এটাই যে, যার ব্যথা সে ছাড়া দুনিয়ার কারো হৃদয়কে সেই ব্যথা স্পর্শ করতে পারেনা।
এতো এতো উত্তর আর ভাইয়ের প্রতি সহানুভূতির মিশেলেও কিন্তু থেকে যায়। মনের মাঝে উঁকি দেওয়া প্রশ্নটি জমিয়ে না রেখে প্রকাশ করে ফেলে।

-“তাহলে সপ্তাহ না পেরোতেই পূনরায় বিয়ের কারণ কী?”
রাহাত তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
-“মাকে আমিও সহজভাবে নিয়েছিলাম। তিনি আমাদের ডি*ভো*র্সে*র আগে থেকেই লিলিকে ঠিক করে রেখেছিলেন। সেই প্রথমবারের মতো এবারেও রূপসী খুঁজে বের করলেন।

মায়ের কারণে লিলির সাথে দেখা করতে রাজি হলাম। তাকে সবটা খুলে বলার পর তার চেহারার আকৃতি দেখে ভাবলাম মেয়েটা বুঝদার। এই বিয়েতে রাজি সে হবে না। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়েই পরদিন মা জানালেন সব ঠিকঠাক। বিয়ের কথা পাকা।

তখন নিজের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে এলো। মায়ের প্রতি জে*দ আর অভিমান থেকেই নিজের সব ইচ্ছে, আকাঙ্খা, অনুভূতি জলাঞ্জলি দিয়ে বিয়ে করলাম। আমার মূল্যই তো মায়ের কাছে নেই।

প্রথমদিনই লিলি জানালো ‘সে আমার কাছে স্বাভাবিক জীবন চায়। যেমনটা আর-দশটা বৈবাহিক সম্পর্ক চলে।
এসব থেকে বাঁচতেই পরদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে ঢাকার বাইরে চলে গেলাম। সবাইকে জানালাম কাজের জন্য অফিস থেকে পাঠাচ্ছে। মি*থ্যে বলেছিলাম। অফিস থেকে পাঠায়নি, বরং আমি নিজেই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চলে গিয়েছিলাম। দুদিনের অতিরিক্ত ছুটি মঞ্জুর না হওয়ায় আবার ফিরতে হলো। বাড়ি ফিরেও জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হলো আমায়। কেন আমি তাকে ফোন দিলাম না, কেন তার ফোন তুললাম না। সে নিয়ে বেশ চেঁচামেচি ও হলো লিলির সাথে।”
শামীমকে বেশ চিন্তিত দেখালো।

-“তাহলে এখন কী করবে তুমি? একদিকে ভাবি অন্যদিকে তোমার দ্বিতীয় স্ত্রী। দুজনের সাথেই অ*ন্যা*য় হচ্ছে।”
রাহাত কঠিন চোয়ালে জবাব দিলো,
-“যার জন্য এতকিছু হলো, তাকেই ভুগতে হবে। আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।”
-“আশা করবো এবার নিজের বিবেক খাটিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। অন্যের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল হবেনা।”

আকাশে অন্ধকারের ভীড় নামলো মন্থর গতিতে। চারদিকে মাগরিবের আযান পড়তেই দুই ভাই নিচে নেমে গেলো।
উষাকে নিয়ে এসে শার্ট চেঞ্জ না করেই রাহাতের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো শামীম। সারাদিনের ব্যবহৃত ময়লা শার্টের টপ বোতাম খুলে নিচের দিকে হাত রাখতেই স্থির হয়ে গেলো। চিকন দুটো হাত এসে ঠেকলো বোতামের উপর। নিজ থেকেই শামীমের শার্ট ছাড়িয়ে দিলো উষা।

তার কথা আমলে নিয়েছে ভেবে ক্ষীণ হাসলো শামীম।
এখানে আসার আগেই তাকে অনেক বুঝিয়েছে অল্পতে মাথা গরম যেন না করে। কেউ কিছু বললে যেন চুপ থাকে। গুরুতর কিছু হলেও যেন নিজে প্রতিত্তোর না করে শামীমকে জানায়। বিকেলে আসার পর থেকে কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন হয়েছে।

অন্য একটা শার্ট গায়ে জড়িয়ে উষার ললাটে গভীর চুম্বন করেই বেরিয়ে গেল শামীম। মসজিদের অজুখানা থেকে অজু করে নেবে।

মাগরিবের নামায শেষ করেই চোখ বন্ধ করে খাটে এসে বসলো উষা। বিকেলের কথা মনে পড়ে গেল। বাড়ির কারো সাথেই উষার সম্পর্ক ভালো নয়। সেজন্যই একাকী সময় কাটাতে ছাদের পথে রওনা হলো। কয়েক সিঁড়ি বাকি রেখেই দাঁড়িয়ে পড়লো দুই ভাইয়ের কথপোকথনে। যদিও আড়ি পেতে শোনা উচিত কাজ নয়। তবুও রাহাতের এমন সিদ্ধান্তের রহস্য জানতে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। আযান পড়ার সাথে সাথেই ওদের আগে সে নেমে গেলো।
এতদিনের দৃশ্যপট যেন মুহুর্তেই পাল্টে গেলো।

খেয়ে এসে শামীমের আগেই শুয়ে পড়লো উষা। মশারী টা*না*লো না। দু-একটা মশা কানের পাশে গুণগুণ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিরক্ত হয়ে দাঁতে দাঁত চেপেই উষা বলল,
-“এত তাড়াবার পরও যাচ্ছে না। অশিক্ষিত মশার দল।”

শামীম ঘরে প্রবেশ করেই শুনতে পেলো। তার খুব হাসিও পেলো। কৌতুকের স্বরে বলে বসলো,
-“কাল থেকে তোমার সাথে ভার্সিটিতে নিয়ে যেও। শিক্ষিত মানুষের সাথে থেকে মশাও শিক্ষিত হয়ে যাবে।”
উষা বলল,
-“আপনি শিক্ষিত মানুষ হয়ে কিভাবে অশিক্ষিত মশা চাষ করেন? এদের দু-একটা ক্লাস নিতে পারেন না?”
শামীম ও মজা করেই বলল,

-“সেই ক্লাসটা মশার না নিয়ে, আপনার নেওয়াই বেটার হবে আমার জন্য।”
উষা মুখ বেঁকিয়ে বলল, “হু”।
শামীম শোয়ার পর উষা নিজ থেকেই তার হাতে মাথা রাখলো। অল্প হেসে শামীমও তাকে আলিঙ্গনে কাছে টে*নে নিলো।

সকাল সকাল রাহাত কি নিয়ে মায়ের সাথে রাগারাগি করলো জানতে পারলেনা উষা। নাসিমা বেগমের অশান্ত, বিধ্বস্ত রূপ দেখে মনে মনেই হাসলো। মুখে আগের মতো লেগে থাকা হাসিটা নেই। চোখেমুখে মলিনতার ছাপ। আগের সেই সুশ্রী আর নেই। কি নিয়ে যেন সারাক্ষণ আ*ত*ঙ্কে থাকেন।

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ৫

উষা মনে মনে আওড়ালো, “আমি যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছি, সেটা আপনার সন্তানই পূরণ করবে। আপনার মানসিক শান্তি হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার অপেক্ষায় আমি। আপনার ছেলে যতই নিঃস্ব হোক না কেন? এরকম একটা অবস্থায় আমার বোনের হাত ছেড়ে ঠিক করেনি। সে ও এর ফল ভোগ করবে।”

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ৭