প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৬

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৬
লেখিকাঃ মাহযাবীন

“মিয়ু কোথায় আর্শ?ওর চিন্তায় পুরো অস্থির হয়ে ছিলাম।আরও ক’দিন থেকে আসতাম কিন্তু ওর জন্যই আর থাকলাম না।এ সময় ওকে একা রাখা তো মোটেও উচিৎ না।কই ও?ডাক তো তারাতাড়ি।ওকে দেখে একটু চিন্তামুক্ত হই।”

উত্তরে কিছু বললো না আর্শ।চুপচাপ ব্যাগগুলো সব বাড়ির ভেতরে এনে সাইড করে রাখতে ব্যস্ত সে। আর্শি ও আরহান সাহেব এসেই ক্লান্ত শরীরে নিজেদের কক্ষের দিকে গমন করেছেন।কিন্তু সানিয়া বেগম এর বিপরীত। তিনি আগে নিজের পুত্রবধূকে দেখবেন তারপর অন্য কিছু। এতোদিন কম দুশ্চিন্তা তো করেনি সে।নেটওয়ার্ক প্রবলেম, ব্যস্ততা ও মানুষ-জনের হৈ-হুল্লোড়ের জন্যে আর্শ-মিয়ামির সাথে কথা বলাটাও হয়ে ওঠেনি তার।এজন্যে এখন যেনো মিয়ামিকে না দেখলে তার আর চলবেই না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আর্শের নিরব থাকার বিষয় টা খানিক অস্বাভাবিক ঠেকলো সানিয়া বেগমের।ব্রু কুঁচকালেন তিনি।সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠলেন,
-মিয়ু বাড়িতে নেই?
এ প্রশ্নে আর্শ চাইলো তার মায়ের দিকে।কেমন নিষ্প্রাণ এ চাহনি!মায়ের হৃদয় যেনো কেঁপে উঠলো।অনতিবিলম্বে তিনি এগিয়ে গিয়ে আর্শের গালে মৃদু হাত ছোঁয়ালেন।চিন্তিত কন্ঠে প্রশ্ন করে উঠলেন,

-কি হয়েছে বাবা তোর?কোনো সমস্যা? ঝগড়া হয়েছে নাকি মিয়ুর সাথে?”
মায়ের প্রশ্নে পাথুরে রূপ নেওয়া দুঃখগুলো বিগলিত হলো যেনো।লালচে চোখে অশ্রু জমলো।আর্শ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তার মাকে।থেমে থেমে বলে উঠলো,
-ভেতরটা ভীষণ শূন্য শূন্য মনে হচ্ছে, মা।যেনো এক বিরাট মরুভূমির মাঝে আমি এক পথ হারানো পথিক যার চারিদিকে কোথাও কেউ নেই।

চিন্তায় মুহূর্তেই কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করলো সানিয়া বেগমের।তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না কী হয়ে গেলো ক’দিনের মাঝেই?কেনো তার ছেলে এগুলো বলছে?
নিজেকে যথাসম্ভব সামলে রেখে সানিয়া বেগম আর্শের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে জিজ্ঞেস করে ওঠেন,

-কী হইছে বাবা?একটু খুলে বল।দেখ জীবনে বিপদ, বালা-মুসিবত, সমস্যা এগুলো আসবেই।কখনো কখনো জীবন টা অনেক কঠিন ও মনে হবে।তখন সবথেকে বেশি দরকার হচ্ছে নিজের মনোবল ধরে রাখা।পরিস্থিতি যত কঠিনই হোক তার মোকাবেলা করতেই হয় তাও দৃঢ় ও শক্তভাবে।আর স্রষ্টার সাহায্য চাইতে হয়।ব্যাস!

এখানে ভেঙে পড়ার কিন্তু কোনো অপশন তোর কাছে নেই,আর্শ।বুঝেছিস?ভেঙে পড়ার মতো কোনো অপশন নেই আমার ছেলের কাছে।আমি আমার সন্তানকে এতোটা দূর্বল করে গড়ে তুলিনি যে আমার সন্তান একটা কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতেই ভেঙে পড়বে।ভুল বলেছি?

মায়ের কথায় নির্জীব,নিষ্প্রাণ হৃদয় যেনো সজীব হয়ে উঠলো আর্শের।মনোবল বৃদ্ধি পেলো তার,সাহস সঞ্চয় হলো।ভাবলো হ্যাঁ,ভেঙে পরা বারণ তার।ভেঙে না পরে শক্ত ভূমিকা পালন করতে হবে তাকে।নিজের একটা ভুলের জন্য সে তার ভালোবাসা,তার ছোট্ট অংশকে হারাতে দিবে না। ফিরিয়ে আনবেই নিজের স্ত্রী, সন্তান অর্থাৎ নিজের হৃৎস্পন্দন।
নিজেকে সামলে নিয়ে আর্শ তার মায়ের থেকে সরে আসে।ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে বলে ওঠে,

-আই লাভ ইউ মা।
উত্তরে হাসেন সানিয়া বেগম।জিজ্ঞেস করে ওঠেন,
-এখন বল কি হইছে?
-বলবো।কিন্তু আজকে না,কালকে।তুমি এখন ফ্রেশ হতে যাও।আর মিয়ু একদম ঠিক আছে,ওর বাবার বাসায় আছে।শীগ্রই ওকে নিয়ে আসবো,চিন্তা করো না।

বারান্দার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আছে মিয়ামি।দৃষ্টি তার খোলা আকাশ পানে।কানে একাধারে বেজে যাচ্ছে মায়ের কিছু বিষাক্ত উক্তি।
“ড্রাগসের ভয়াবহতা কি এক দিনে,দুই দিনে প্রকাশ পায় মিয়ু?ড্রাগস নিতে নিতে একটা মানুষ মানসিক রোগীতে পরিণত হয়ে যায় তা তুই জানিস?দেখ আমি জানি আর্শ ভালো ছেলে, এমন ছেলে যার চরিত্রে একটাও দোষ নেই।মানলাম ও ওর বন্ধুদের বিশ্বাস করে ঠকছে।মানলাম সঙ্গদোষে ও নেশা ধরছে।কিন্তু এটা তো মিথ্যা না যে ও নেশাখোর?

একজন নেশাখোর কখনো কারো আপন হয় না।কেন জানিস?কারণ এরা মানসিক রোগীতে পরিণত হয়ে যায় ধীরে ধীরে। একটা উন্মাদ, পাগল আর নেশাখোরের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।একটা পাগল যেমন রাস্তায় বিনা কাপড়ে চলতে পারে তেমনই একজন নেশাখোরের নেশা উঠলে সে উন্মাদ হয়ে এমন কান্ড ঘটিয়ে বসতে পারে যা একজন স্বাভাবিক মানুষ কখনো করবে না বা করার কথা ভাববে না।কেনো সংবাদ শুনিস না?কয় বছর আগে এক ড্রাগস অ্যাডিক্টেড মেয়ে তার নিজের বাবা-মাকে নিজে খুন করে ফেলেছিলো না?বল কোন স্বাভাবিক সন্তান এমন করে?”

চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো মিয়ামি।সে শুনতে চায় না এসব।একটুও শুনতে চায় না।দমবন্ধ লাগছে মিয়ামির।শরীর টাও কেমন জানি করছে তার।মাথা টা কেমন যেনো ঘুরছে,দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।চোখেও যেনো সব ঘোলাটে দেখছে সে।
কোনোরকম নিজের কক্ষে এসে বিছানায় বসলো মিয়ামি।হাতের কাছে থাকা ফোনটা তুলে কোনো এক নাম্বার ডায়াল করে কানে তুললো সে।একবার রিং হতেই ফোনের ওপাশের মানুষটা হুড়মুড়িয়ে কল রিসিভ করলো।
মিয়ামি এক দন্ডও বিলম্ব করলো না।বলে উঠলো,

-আর্শ,একটু আসবা?একটু?
বলে খানিক থামলো মিয়ামি।মুহুর্তেই চোখ বেয়ে অনর্গল পানি গড়িয়ে পরতে আরম্ভ করলো তার।কাঁপা কাঁপা কন্ঠে মিয়ামি পুনরায় বলে উঠলো,
-আমার কেমন জানি লাগতেছে আর্শ, দম বন্ধ হয়ে আসতেছে। কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কেনো হচ্ছে জানি না।মনে হচ্ছে তোমাকে এখনই একটু দেখতে না পারলে মরে…

মিয়ামির কথা শেষ হওয়ার আগেই কল কেটে গেলো।মিয়ামি ফোন ফেলে কাঁদতে লাগলো।হটাৎ কি হলো তার? কেনো এমন দম বন্ধ হয়ে আসা অনুভূতি শুরু হয়েছে? কেনো আর্শের একটুখানি উপস্থিতি অনুভবের জন্য এতোটা উতলা হয়ে উঠেছে তার হৃদয়!

এমনটাই কী হয়?ভালোবাসার মানুষটার থেকে দূরত্ব বাড়ার সম্ভাব্যতা দেখা দিলে হৃদয় কী এভাবেই প্রতিক্রিয়া দেখায়?এটাই কী তার সুস্পষ্ট প্রতিবাদ? এভাবেই কী সে জানান দেয় যে ভালোবাসার মানুষ টাকে ছাড়া হৃদয় নামক বিচিত্র এক অঙ্গ ভালো থাকতেই পারে না।এজন্যই কী শত হৃৎপীড়া সহ্য করে হলেও মানুষ তার ভালোবাসাকেই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়?

কফি হাতে এক উপন্যাসের বই নিয়ে বসলো আর্শি।অবসরে সে উপন্যাসে ডুবতে পছন্দ করে।তবে এর থেকেও বেশি পছন্দ করে বিহানের সঙ।অবসরে হোক বা চরম ব্যস্ততায় ছেলেটার একখানা খুদেবার্তা যেনো সব কিছুর উর্ধ্বে।
বই খোলার আগে আর্শি একবার তাকালো তার ফোনের দিকে।নাহ নেই কোনো নোটিফিকেশন। ক’মাস ধরে একটা বিষয় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে আর্শি।

তা হচ্ছে বিহান একটু একটু করে কেমন যেনো পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।তাদের কথা এখন আগের তুলনায় অনেক কম হয়।মাঝে মাঝে বিহান আগের মতোই খুব কাছের বন্ধুর মতো করে তার সাথে কথা বলে কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই তার আচরণ রুক্ষ।দিন দিন উপেক্ষা, অবহেলাও বেড়েই চলছে।কারণ বুঝতে পারে না আর্শি।বিহানের ধীরে ধীরে বদলে যাওয়াটা তার হৃদয়ে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করছে।যার যন্ত্রণা অসহনীয়।তীব্র এক ভয়ও কাজ করে আর্শির ভেতর।বিহানকে হারিয়ে ফেলার ভয়।প্রায়ই এমন প্রশ্ন জাগে,বিহানের জীবনে সে আছে তো এখনো নাকি নেই? তার জায়গাটা কী অন্য কারো হয়ে বসলো?বিহান অন্য কোনো মেয়েতে মুগ্ধতা খুঁজে নিচ্ছে না তো?

এসব ভাবতেই বুকে এক চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করে আর্শি।এক দীর্ঘশ্বাস বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে তার।কিন্তু পরমুহূর্তেই সবটা লুকিয়ে নেয় সে।যেনো লুকোতে চায় নিজের কাছ থেকেও।হৃদয়ে অসহ্য জ্বালাপোড়া হলেও সে শক্ত কন্ঠে নিজেকে নিজে বলে ওঠে,
“বিহান আমার না হলেও আমি মেনে নেবো।একটুও ভাঙবো না,একটুও মচকাবো না।আমার সহ্য ও ধৈর্য্য ক্ষমতা অনেক বেশি আলহামদুলিল্লাহ।আমি সব সহ্য করে নেবো।”

কল কেটেই হাওয়ার বেগে ছুটলো আর্শ।এক সেকেন্ড বিলম্বও যেনো তার প্রাণ কেঁড়ে নেবে এমন অবস্থা। সে চাইলো না কারো পানে,কেউকে কিছু বলেও গেলো না।শুধু ছুটলো।রাতে সবাই নিজ নিজ কক্ষে থাকায় এতে কোনো সমস্যাও হলো না।৫ মিনিটের পথ যেনো সে ৫ সেকেন্ডে অতিক্রম করলো।এসে পৌঁছালো মিয়ামির বাসার নিচ পর্যন্ত।

প্রথমে দারোয়ানকে বুঝিয়ে-পড়িয়ে,জোর করে বকশিস দিয়ে সিঁড়ি অব্দি এলো আর্শ তারপর দারোয়ানের কাছ থেকে মিয়ামিদের বাড়ির কাজের মেয়ের নাম্বার নিলো।যত দ্রুত সম্ভব কাজের মেয়েকে বুঝিয়ে, মানিয়ে দরজা খুলালো।ব্যাস,আর কে আটকায় তাকে!বেপরোয়া ছুটলো মিয়ামির কক্ষের দিকে।
দারোয়ান চাচা ও কাজের মেয়ে মিলি দু’জনেই আর্শকে ওভাবে দৌড়ে যেতে দেখে হেসে উঠলো।ঠোঁটে হাসি নিয়ে দারোয়ান চাচা বলে উঠলেন,

-দেখ এই হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর আসল মহব্বত।
এ কথায় ঠোঁটের হাসি বিলীন হলো মিলির।সে মন খারাপের স্বরে বলে উঠলো,
-হ চাচা।মিয়ামি আপাও কম ভালাবাসে না।কিন্তু হের বাপ-মা কেন যে এগো আলাদা করতে চাইতাছে?
-কে জানে কার নজর লাগলো পোলাপানডির উপর।আল্লাহ সহায় হোক।
দরজায় খট্ করে মৃদু শব্দ হতেই সেদিকে তাকালো মিয়ামি।জলে টইটম্বুর চোখ, রক্তিম মুখশ্রীতে হাসি ফুটে উঠলো মুহূর্তেই।ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে এ এক আলোর রশ্মি,এক বুক প্রশান্তি।

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৫

[একটু কষ্ট করে মন্তব্য করবেন কিন্তু সবাই♥️
খুব কম সময়ে লিখেছি তাই ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে, দুঃখিত]

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৭