প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ২১

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ২১
লেখিকাঃ মাহযাবীন

ল্যাগেজ গুছানো শেষে ক্লান্ত শরীরখানা বিছানায় মেলে দিলো আর্শি।স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠলো বিহানের মুখশ্রী।কাল এ শহর, এ দেশ,এ দেশের মানুষগুলোকে পেছনে ফেলে এক নতুন দেশে, নতুন মানুষদের মাঝে যাবে সে।নিজের জন্য এক নতুন পৃথিবী বানাবে আর্শি।পরিবার, প্রিয়জন ছেড়ে নতুনদের নিয়ে এক নতুন আর্শি হবে সে।তারপর বুকে জমানো ক্ষত গুলো পূরণ হলে আবারও হয়তো ফিরে আসবে পরিবারের কাছে।কিন্তু এ ক্ষতটাকে আর মনে করবে না সে, একটুও না।এসব ভাবনার মাঝেই আর্শির ফোন বেজে উঠলো।তাকালো সে ফোনের দিকে।’নিশি’ নাম টা ভেসে আছে ফোনের স্ক্রিনে।আর্শি কল রিসিভ করে কানে ধরলো।নিশি বলে উঠলো,

-দোস্ত, তুই সত্যিই যাইতেছিস?
-নাহ মিথ্যা মিথ্যা যাইতেছি।
-মজা নিস না।কতো খারাপ লাগতেছে বুঝোস?
-খারাপ লাগার কী আছে?লন্ডন যাইতেছি কবরে তো আর যাচ্ছি না।
-একি কথা।কবরেও তোর সাথে যাইতে পারবো না,লন্ডনেও তোর সাথে যাইতে পারবো না। দুইটার দুঃখ একি।
-ওকে,তাইলে ঐখানে যেয়ে তোরে আর কল টল দিবো না।
-কেন?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-ভাব্বি আমি কবরে।কবর থেকে কি আর কল করা যায়?
প্রশ্ন টা করেই হেসে ওঠে আর্শি।ভালোই লাগছে তার।এই মানুষগুলো তাকে কতোটা ভালোবাসে ভাবতেই অন্য রকম প্রশান্তি হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে তার।

-হা*মি তুই কল না দিয়ে দেখাইস জাস্ট। তারপর দেখবি তোর ভাতিজারে কেমনে কিলাই তোর বাসায় যেয়ে।
কথাটা শেষ করেই রেগে কল কেটে দিলো নিশি।হাসতে হাসতে ফোন কান থেকে নামালো আর্শি।ভাতিজার কথা মনে পরতেই নিজেকে আর আটকাতে পারলো না সে।উঠে হাঁটা আরম্ভ করলো মিয়ামির কক্ষের দিকে।তার পরিচিত প্রতিটা মানুষ জানে মিয়ামি ও আর্শের ছেলে ‘আনাম’ তার ফুপ্পির জানের থেকেও বেশি প্রিয়।

কিছু দিনের জন্য ঢাকায় এসেছে বিহান।মা-বোনের সাথে কিছু দিন থেকে আবারও ফিরে যাবে সে।ঢাকায় তার দিনগুলো ভালোই যাচ্ছে।ঘুরাফেরা, খাওয়াদাওয়া।এসবের মাঝে একবার সে আর্শিদের বাড়ির সামনে দিয়েও ঘুরে এসেছে।সে জানে না সে ঠিক কেনো গিয়েছিলো।কিন্তু মনের ডাকে সায় দিয়ে একটু দেখে এসেছে জায়গা টা।আর্শিকে অবশ্য কোনো কল, ম্যাসেজ কিছুই দেয়নি সে।আর দেবেও বা কিভাবে?

মেয়েটা নিজের আইডি তো ডিএক্টিভ করে রেখেছে।সেই সাথে তাকে হুটহাট কলও দেওয়া যায় না।পরিবারে কেউ যদি জানে আর্শি কোনো ছেলের সাথে এতোটা ক্লোজ যে তার ফোন নাম্বার টাও ছেলে জানে তাহলে বকা,মার যা খাওয়ার তা আর্শিই খাবে।বিহান এসব কিছু চায় না আবার তাদের কথাও কতোগুলো মাস ধরে বন্ধ আছে।এর মাঝে তার আর্শির বাড়ির সামনে যাওয়াটা আর্শি জানলে কেমন লাগতো?
বিহান হাতে দু’কাপ কফি নিয়ে নিশির রুমের দরজায় দাড়ায়।গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠে,

-আছিস?
-হ্যাঁ ভাইয়া আসো।
বিহান ঢোকে রুমে।বোনের দিকে কফির মগ এগিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
-মুখ গোমড়া কেন?
-আর্শির ফ্লাইট কাল রাতে।ও চলে যাচ্ছে ভাইয়া।
বিহান থমকে গেলো।তার হৃৎপিণ্ডটা যেনো নিজের কাজ থামিয়ে দিলো।দেহে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ।অনতিবিলম্বে জোরে এক নিঃশ্বাস নিজের মাঝে টেনে নিলো বিহান।নিশ্চল শরীর সচল করে নিলো সে।নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করে উঠলো,

-কোথায় যাচ্ছে?
-লন্ডনে।
-কেনো?
-লন্ডনে সানিয়া আন্টির পরিচিত এক বোন থাকেন।তো এইচএসসি পরিক্ষা শেষ হতে না হতেই আর্শির মাথায় ভুত উঠছে যে ও লন্ডনে পড়াশোনা করতে যাবে।আরহান আঙ্কেল আর আর্শ ভাইয়া দু’জনই তো কামাই করে।টাকা ম্যানেজ করে নিতে পারবে তারা।তাই আর্শির জিদের কাছে নত হয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর্শি আগে কিছুদিন সানিয়া আন্টির ঐ বোনের বাসায় বেড়ায়ে আসুক তারপর ও যদি চায় তাহলে ওকে ওখানেই পড়াবে তারা।এই সিদ্ধান্তের পর এ ক’মাস তাড়াহুড়ো করে ওর লন্ডনে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করেছে আর্শ ভাইয়া।

-ওহ।তা যাক কিছু দিন ঘুরে আসুক।এতে তোর মন খারাপের কি হলো?
-ও কিছু দিনের জন্য যাচ্ছে না ভাইয়া।ও ওখানেই স্থায়ী হয়ে যাবে।আমি জানি তো।ও ওর পরিবারকে ওখানে যাওয়ার পর রাজি করে নেবে।ও আর ফিরবে না।
কথাগুলো বিহানের শ্বাস আঁটকে দিচ্ছিলো।এতো খারাপ কেনো লাগছে তার?কেনো এতো ভয় হচ্ছে?কিছু কী হারানোর তীব্র ভয় হচ্ছে তার? কিন্তু কি হারানোর? আর্শিকে? নাকি এ ভয় আর্শির বুকে তার নামে জমানো ঐ অকৃত্রিম ভালোবাসাটা হারিয়ে ফেলার?

চুলে হাত খোঁপা করতে করতে মিয়ামির চোখ গেলো বিছানায় শুয়ে থাকা ছোট্ট ‘আনাম’ এর দিকে।মায়ের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে সে।এ চাহনিতে মিয়ামির মন মোমের ন্যায় গলে গেলো।ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে ছেলের দিকে এগোতে এগোতে সে বলে উঠলো,
-কী দেখছে আমার বাচ্চাটা?মাকে দেখছে?হু? মাকে দেখা হচ্ছে?

বলতে বলতেই ছেলেকে কোলে তুলে নিলো মিয়ামি।চুমুতে চুমুতে তাকে ভরিয়ে দেওয়ার মাঝেই রুমে প্রবেশ করলো আর্শি।এসেই ভাতিজাকে মিয়ামির কোল থেকে নিজের বুকে নিয়ে এসে সেও চুমুতে ভরিয়ে দিতে আরম্ভ করলো।আজ আনাম কথা বলতে পারে দেখেই হয়তো ছেলেটা চুপ করে আছে আছে নয়তো নির্ঘাত সে অনুরোধের কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ছাইড়া দেন মা-ফুপু, কাইন্দা বাঁচি’

আর্শি ও আনামের এ আদুরে দৃশ্যের পানে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসলো মিয়ামি।বিছানা গুছাতে গুছাতে সে বলে উঠলো,
-খুব আসছে আদর করতে।এতোই যদি ভালোবাসতি তাইলে দেশ ছেড়ে ওর থেকে এতো দূরে যাইতি না।
-হুহ্ দেশ ছাড়তেছি শুধু তোদের কেউকে ছাড়তেছি না।তোদের তো মনের মধ্যে আঁটকে নিজের সাথে করেই নিয়ে যাবো।
আর্শির কথা শেষ হতে না হতেই তাকে জড়িয়ে ধরলো মিয়ামি।তীব্র মন খারাপ আর ভিজে উঠা চোখদুটো লুকিয়ে সে জিজ্ঞেস করে উঠলো,

-কেনো যাচ্ছিস,আশু?বিহান ভাইর জন্য?
-উহু নাহ,নিজের জন্য যাচ্ছি।এখানে থাকলে আমি কখনো একটা নতুন আমিকে খুঁজে পাবো না দোস্ত।এই আর্শির মধ্যে সম্পূর্ণটা জুড়ে বিহান।তাই আমার জন্য খুব বেশি প্রয়োজন নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলা।বুঝতেছিস?
-হু।আমি বিহান ভাইকে কাছ থেকে দেখছি,জানছি।মানুষটা ভীষণ ভালো,পরোপকারী, বুদ্ধিমান। কিন্তু সে তোর ব্যাপারেই কেনো এমন বুঝলাম না।
তাচ্ছিল্যের হাসি ঠোঁটে ফুটে উঠলো আর্শির।আনামের গালে এক দীর্ঘ চুমু এঁকে সে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো।অতঃপর বলে উঠলো,

-আমিও বুঝি না।যে নিজের মা,বোনের প্রতি এতো দায়িত্ববান, বন্ধুদের কাছে উদারতার প্রতীক, এতো দাতা, নীতিবান মানুষটাই ভালোবাসার জায়গায় এসে একটা পাথর।ভালোবাসায় তার বিশ্বাস নেই কেনো? কেনো সে আমার অনুভূতি টা কখনো অনুভব করলো না?
-জানি না,বুঝিও না।এই প্রশ্ন আমার মাথায়ও ঘুরপাক খায়।বিহান ভাই একটা ঘোলাটে চরিত্র। তাকে এক কথায় খারাপ বলা টাও অনুচিত আবার এক কথায় ভালো বলতে গেলেও সন্দেহ জাগে।যাই হোক, ছোট জীবনটা জটিল করার মানে হয় না।তুই যে তাকে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিছিস তাতে আমি তোর সাথে আছি।একদম ঠিক সিদ্ধান্ত নিছিস।যে এতো বছরে ভালোবাসতে পারেনি সে আর কখনো ভালোবাসতে পারবে না।তাই তার কথা আর কখনো মাথায় আনবি না।মুভ অন করবি।

প্রতিদিন সন্ধ্যার ন্যায় আজও সবাই একত্রে সন্ধ্যার নাস্তা করতে বসেছে।আর্শ এ সময় অফিসে থাকায় সে বাদে পরিবারের অন্যরা সবাই মিলে সন্ধ্যায় একটা সুন্দর সময় কাটায়।গল্প,হাসি-ঠাট্টা করার মাঝেই পাড় হয় সময় টা।কিন্তু আজ সবার মুখ আমাবস্যার রাতের মতো।কারো ঠোঁটে হাসি নেই,মুখে খুশির ঝলক নেই।সবার মনমরা অবস্থা দেখে ভেতরে ভেতরে আর্শিও ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে।তবুও নিজের খারাপ লাগাটা নিজের মাঝে লুকিয়ে সে সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
-এমন করতেছো কেন তোমরা? বিদেশে কয়দিন একটু ঘুরতেই তো যাচ্ছি। এতে এমন রিয়াক্ট এর কী আছে?
সানিয়া বেগম অভিমানী কন্ঠে বলে উঠলেন,

-জীবনে একটা রাতও আমাদের ছাড়া বাড়ির বাইরে থাকছিস?তোরে কখনো নিজের চোখের আড়াল হইতে দিছি আমি?এতো বছর আমার এতো যত্নে পালা মেয়ে আমার ঘর ছেড়ে অন্যের ঘরে উঠবে।ওখানে কে খেয়াল রাখবে তোর?তুই থাকতে পারবি আমাদের ছাড়া?জীবনে থাকছিস কখনো?
-ওহহো মা,এতো সেন্টি খাইয়ো নাহ।অনেক কিছুই মানুষকে জীবনে একটা না একটা সময় প্রথমবার করতে হয়।তারপর ধীরে ধীরে সে ঐটায় অভ্যস্ত হয়।এটা নরমাল।
আর্শির কথা খুব একটা প্রভাব ফেললো না সানিয়া বেগমের উপর।তিনি ভেজা কন্ঠে আরহান সাহেবের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,

-সন্তান যা চাবে তা সব ওদের দিতে হবে?ও বিদেশ যেতে চাইলো আর আপনি অনুমতি দিয়ে দিলেন? ওখানে আল্লাহ না করুক ওর কিছু হলে কি করবেন?
-আহা সানিয়া,সুমি আছে না?সুমির পুরো পরিবার আছে ওখানে।ওরা আর্শির পুরো খেয়াল রাখবে।তুমি এতো টেনশন করা বন্ধ করো তো।মেয়ে আমার বিদেশে যেয়ে পড়াশোনা করবে এ তো গর্বের।এতে ওকে বাঁধা দেবো কেনো?

বারান্দায় দাঁড়িয়ে সন্ধ্যের শীতল হাওয়া গায় মাখছে বিহান।দূর আকাশে চাঁদের উপস্থিতিও দেখা যাচ্ছে।এ চাঁদের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে বিহান।হটাৎ এক স্মৃতি উঁকি দিলো তার হৃদয়ে।এক পূর্ণমার রাতে আর্শি তাকে বলেছিলো,
“একটা জ্যোৎস্নামাখা রাত আমার আর আপনার হোক।এক খোলা জায়গা,ঘাসের সমাহার।ঘাসের উপর আপনি আর আপনার বুকে আমি।আপনি পূর্ণিমার চাঁদ দেখে মুগ্ধ হবেন আর আমি মুগ্ধ হবো আপনাকে দেখে।”
স্মৃতি মনে পড়তেই মৃদু হাসলো বিহান।তৎক্ষনাৎ কানে ভেসে এলো নিশির বলা উক্তি গুলো।

“ও চলে যাচ্ছে ভাইয়া”
“ও ওখানেই স্থায়ী হয়ে যাবে।ও আর ফিরবে না।”
বিহান অনুভব করলো তার অসহ্য লাগছে।যে অনুভূতি এতো বছরে তার হয়নি তা এখন হচ্ছে।আর্শিকে পুরোপুরি হারিয়ে ফেলার ভয় হচ্ছে তার।সে জানে তার যথেষ্ট টাকা আছে।সে চাইলেই লন্ডনে যেতে পারবে।কিন্তু তাও আর্শির এই দেশ ছেড়ে যাওয়াটা তাকে অনুভব করাচ্ছে যে আর্শি তাকে ছেড়ে যাচ্ছে।

আর্শি তাকে ছেড়ে গেলেও তার কেনো এমন অসহ্য লাগছে?সে তো জানে ভালোবাসা বলে কিছু নেই।সে তো জানে সব দুই দিনের মোহ।সে তো জানে তাকে পেয়ে গেলে আর্শি আর তাকে ভালোবাসবে না কারণ নিষিদ্ধ জিনিসেই মানুষের ঝোঁক সব থেকে বেশি।আর্শির ও তার প্রতি ঝোঁক এজন্যই এতো বেশি।তাকে পেয়ে গেলে তো পাওয়া হয়ে গেলো,বিশেষত্ব হারিয়ে গেলো তখনও কী মেয়েটা এভাবেই তাকে ভালোবাসবে?

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ২০

অবশ্যই বাসবে না।এসব জানে বিহান।তাই তো সে কখনো সাড়া দেয়নি আর্শির ভালোবাসায় কিন্তু ভেতরে ভেতরে আর্শির ভালোবাসা অনুভব করেছে সে,উপভোগ করেছে,ঐ ভালোবাসা টাকে সে নিজেও হয়তো ভালোবেসেছে।আর্শি কেনো ওভাবেই ভালোবেসে গেলো না?কেনো চলে যাচ্ছে মেয়েটা?তার যে কষ্ট হচ্ছে মেয়েটা কি তা বোঝে?

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ২২