প্রণয় আসক্তি সিজন ২ শেষ পর্ব 

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ শেষ পর্ব 
লেখিকাঃ মাহযাবীন

“আশু আমার একটা কল আসছে,আমি আসতেছি হ্যাঁ?”
আর্শি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।নিশি তৎক্ষনাৎ কিছুটা দূরে গিয়ে নিজের ফোন কানে তুললো।
নিশি দূরে যেতেই আর্শি ও বিহান দুজনেই অস্বস্তিতে পরে গেলো।বিহান তবুও চেয়ে রইলো আর্শির মুখ পানে কিন্তু আর্শি একবারের জন্যেও বিহানের দিকে তাকালো না।তাকালে যে এই মুখের মায়ায় তার হৃদয়ে ঝড় আসবে।এ ঝড়ের তান্ডব সামলাবে কি করে সে?
নিজের অস্বস্তি চেপে বিহান আমতাআমতা করে প্রশ্ন করে উঠলো,

-কেনো যাচ্ছো?
এবার চোখ উপরে তুললো আর্শি।বিহানের বিবর্ণ চেহারা পানে একবার তাকিয়ে তৎক্ষনাৎ নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সে।নিজেকে সামলে বলে উঠলো,
-তাতে আপনার কিছু যায়-আসে?
আর্শির এ প্রশ্নের উত্তর দিতে সময় নিলো না বিহান।নিস্তেজ কন্ঠে নিজেও প্রশ্ন করে উঠলো,
-কি মনে হয়?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তাচ্ছিল্যের হাসি আপনা-আপনিই আর্শির ঠোঁটে এসে জায়গা করে নিলো।সে এ হাসি ঠোঁটে টেনে রেখে বলে উঠলো,
-মনে হওয়ার কিছু আছে?আপনি তো পরিস্কার করে বলছিলেনই আমার কোনো বিষয়েই “ইউ ডোন্ট কেয়ার”।তবুও প্রশ্ন করেছেন তাই উত্তর হচ্ছে, নিজেকে নতুন করে গড়তে যাচ্ছি।
বিহান তৎক্ষনাৎ প্রশ্ন করে উঠলো,
-নতুন করে মানে আমিহীন তাই তো?
-হ্যাঁ তাই।
বিহান নিন্মস্বরেই আবারও বলে উঠলো,

-তুমিই বলেছিলে, “আর্শি অনলি বিলংস টু বিহান”।
-হ্যাঁ।এই আর্শি বিহানেরই কিন্তু নতুন আর্শি আর বিহানের থাকবে না।
-হাহ্ এমনটাই তো হওয়ার ছিলো।জানতাম তো ভালোবাসা ২ দিনের মোহ মাত্র।তোমার মোহও অবশেষে ফুরোলো।
বিহানের এমন উত্তরে আর্শির রাগ এবার সীমা অতিক্রম করলো।একটা মানুষ কি করে নিজের দোষ এতো দক্ষতার সাথে অন্যের কাঁধে দিয়ে দিতে পারে?

রাগে দাঁতে দাঁত চেপে আর্শি বলে উঠলো,
-নিজের দোষ ঢাকতে এখন আমার ভালোবাসার দোষ দিচ্ছেন?সিরিয়াসলি?এখনো আপনি আপনার ঐ আগের বিশ্বাসেই অটল?আমার জীবনের ৩ টা বছর বিনা কোনো নিশ্চয়তায় আপনাকে দিলাম তবুও?
আসলে ঘুমন্ত মানুষকে ডেকে উঠানো যায় কিন্তু যে ঘুমের ভান ধরে থাকে তাকে হাজার ডেকেও উঠানো সম্ভব না।আপনি হচ্ছেন সেই ভান ধরে থাকা ঘুমন্ত মানুষ।
বিহানের চাপা কষ্টটাও এবার রাগে পরিণত হতে আরম্ভ করলো।সে আর্শির বাহু শক্ত করে চেপে ধরলো।দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করে উঠলো,

-৩ বছরেই হাঁপিয়ে গেলে?সারাজীবন আমার হয়ে থাকবা বলছিলা আর ৩ বছরেই সব শেষ? এখন ভুলতে চাও আমাকে। বাহ!
আর্শির চোখে পানি টলমল।পুরো মুখশ্রীতে ক্রোধের অগ্নি।সেও এবার ব্যর্থ হলো নিজের অভিমান দমিয়ে রাখতে।তার চোখের কোণ বেয়ে এক অবাধ্য অশ্রু কণা গড়িয়ে পড়লো।এক আকাশ অভিমান, দুঃখভরা কন্ঠে সে বলে উঠলো,
-আমার জীবনের প্রথম প্রেম আপনি বিহান।আমার সবটুকু আবেগ,অনুভূতির অধিকারী আপনি।আমার সেই কিশোরী বয়সের তীব্র আবেগ আপনি।আপনাকে নিজের সবটুকু উজাড় করে ভালোবেসেছিলাম আমি অথচ আপনি কী করলেন?

প্রথমে এমন আচরণ করলেন যেনো প্রতিটা মুহূর্তে আমার মনে হতো আপনি আমাকে ভালোবাসেন।কিশোরী মনের আবেগে ভেসে আপনাকে প্রপোজ করেছিলাম আমি।আপনি রিজেক্ট করে দিলেন।বললেন, পড়াশোনায় মনোযোগী হতে,তখনো নাকি আমার বয়স কম।তখন আপনার প্রতি সাময়িক রাগ, অভিমান হলেও পরে আপনার প্রতি শ্রদ্ধা এলো।ভাবলাম আমার ভালোর জন্যই আমার সাথে প্রেমে জড়াননি আপনি।কিন্তু দিনকে দিন আমাদের কাছে আসা বাড়তে থাকলো।

আপনার ভাব এমনই ছিলো যে আপনি আমাকে ভালোবাসেন।আমিও মনে মনে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছিলাম, মেনে নিয়েছিলাম যে আপনি আমাকে বিয়ে করবেন।কিন্তু নাহ,হুট করে বদলে যাচ্ছিলেন আপনি।আপনার কথা-বার্তা, আচরণ সব বদলে গেলো।আপনার বদলে যাওয়া আচরণ আমাকে কতটুকু পুড়িয়েছে তা আপনি আন্দাজও করতে পারবেন না।আর তারপর একদিন বললেন,আমি অন্য ছেলেদের সাথে প্রেম করলেও আপনার কিচ্ছু যাবে-আসবে না।বললেন যে, আপনি আমাকে ভালোবাসেন কিন্তু একজন স্বামীর মতো করে না।মানে হচ্ছে আমাকে বিয়ে করবেন না আপনি।

ভালোবাসেন অথচ বিয়ে করবেন না।হাও ফানি।আপনার কী আসলেও মনে হয় আমার মনটা এখনো সজীব আছে?প্রথম প্রেমে এমন ধাক্কা খেয়ে এই মন এখনো ভালোবেসে যেতে পারে?ফ্যাক্ট ইজ আই অ্যাম স্যরি বিহান বাট আপনার হয়ে থাকার মতো সাহস আর শক্তি আমার মধ্যে আর নেই।আমার মনের আর সহ্য করার ক্ষমতা নেই।
আর্শির বাহু চেপে ধরে থাকা বিহানের হাত এবার শিথিল হলো।সে আলতো করে হাত রাখলো আর্শির গালে।তার লাল হয়ে আসা চোখজোড়ায় দৃষ্টি স্থির আর্শির।বিহান নিন্ম স্বরে বলে উঠলো,

-আই অ্যাম স্যরি।আই অ্যাম রিয়েলি স্যরি।আমি আসলে ভালোবাসা জিনিসটায় কখনো বিশ্বাস করতে পারিনি।আমার আসে-পাশে অনেক কপোত-কপোতী দেখেছি,ভালোবাসার নামে বিছানায় যেতে দেখেছি,আজ একটা কাল আরেকটা এভাবে ভালোবাসা বদলাতে দেখেছি।এগুলো সেই স্কুল জীবন থেকেই দেখে আসতেছি।আস্তে আস্তে কিভাবে যে এই জিনিসটায় এতো অনিহা,ঘৃণা আর অবিশ্বাস জমে গেলো নিজেও বুঝিনি।নিজের অজান্তেই বিশ্বাস করে নিছিলাম ভালোবাসা শুধু ক্ষণিকের মোহ,মায়া।

তোমার ভালোবাসাটা আমার ভাল্লাগতো আর্শি।আমার প্রতি তোমার যত্নগুলো, পাগলামিগুলো ভাল্লাগতো।কিন্তু কখনো তা স্বীকার করিনি মুখে।ভাবতাম আমাকে পেয়ে গেলেই তোমার ভালোবাসা শেষ হয়ে যাবে।আমি তোমার ভালোবাসাটা হারাতে চাইনি।আমি তোমাকে হারাতে চাই না আর্শি।তোমার এই পাগলাটে ভালোবাসা আমি চাই,সারাজীবন চাই।
আর্শি নিরব,নিস্তব্ধ, নির্বিকার তার চাহনি।তার চোখের কোণ বেয়ে একাধারে অশ্রু বিন্দুগুলো বিসর্জিত হচ্ছে।বিহানের আঙুল ছুঁলো সে অশ্রু বিন্দু। ছেলেটা সযত্নে মুছে দিলো এ দুঃখ কণাগুলো।আর্শি নিজের চোখজোড়া বুঁজে নিলো।বিহান অপলক চেয়ে রইলো বন্ধ এ দু’নয়ন পানে।কয়েক প্রহর এভাবেই কাটলো।অতঃপর আর্শি চোখ মেলে বিহানের থেকে কিছুটা সরে এলো।দু’হাতে নিজের সিক্ত দু’নয়ন মুছে নিয়ে সে বলে উঠলো,

-আমি গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেই দেশে ফিরবো বিহান।একজন আর্কিটেক্ট হয়েই ফিরবো।এই পাঁচ বছরে আমাদের কোনো যোগাযোগ হবে না।আমরা শুধু একজন আরেকজনের অনুভবে থাকবো।ভালোবাসা বলে যদি সত্যিই কিছু থেকে থাকে তাহলে সেই ভালোবাসার জোরেই আমরা এই পাঁচ বছর কোনো ধরনের যোগাযোগ ছাড়াই একজন-আরেকজনকে অনুভব করবো, একজন-আরেকজনের হয়ে থাকবো।

যদি আমাদের মধ্যে কেউ একজন অন্য কারো প্রতি আকর্ষিত হয়ে যাই তাহলে মেনে নিবো, তার মাঝে ভালোবাসা ছিলো না।এই পাঁচ বছর যেহেতু আমাদের কোনো যোগাযোগ হবে না সেহেতু কোনো শারীরিক চাহিদার ব্যাপার তো থাকবেই না সেই সাথে ভালোবাসা যে দুই দিনের নাহ তাও প্রমাণ হয়ে যাবে।এই পাঁচ বছর যদি আমরা দু’জনই দু’জনের হয়ে থাকতে পারি তাহলে দু’জনের মধ্যে কারো মাঝেই আর কোনো সন্দেহ বা কোনো প্রশ্ন থাকবে না। বলেন, রাজি?

বিহান নিরব রইলো খানিকক্ষণ।অতঃপর সম্মতি দিয়ে মাথা নাড়ালো।আর্শি তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আলতো করে নিজের মাথা রাখলো বিহানের বুকে।তার দুচোখ আবারও জলে টইটম্বুর।সে নিজের আবেগ চেপে মনে মনেই বলে উঠলো,

“জানি না এই বিচ্ছেদই আমাদের চির বিচ্ছেদ কিনা।জানি না পাঁচ বছর পরও আপনার হৃদয়ে আমি থাকবো কিনা। জানি না আমার প্রণয় আসক্তিতে আপনি আসক্ত থাকবেন কিনা।একবুক অনিশ্চিতা সাথে নিয়ে যাচ্ছি আমি,প্রিয়।কিন্তু নিজের সবটুকু প্রণয় আপনাতেই সমর্পিত করে যাচ্ছি।এই পাঁচ বছরের অপেক্ষা আমাদের দু’জনেরই হোক বিহান, এই বিচ্ছেদ টা ক্ষণিকেরই হোক,পাঁচ বছর পর আবারও আপনার বুকে আমারই ঠাঁই হোক।”

দূর থেকে বিস্ময়ভরা চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে দুটো নয়ন।আর্শি আর তার নিজের ভাইয়ের মাঝে কিছু চলছিলো?অথচ সে একটুও টের পায়নি? বিষয়টা অবিশ্বাস্য লাগছে নিশির।তবুও মনে মনে সে ভীষণ খুশি।আর যাই হোক তার ভাইয়ের জীবনে আর্শির মতো একটা মেয়ে এসেছে এর থেকে বেশি আর কী চাই?তবে মনের এক কোণে এক সূক্ষ্ম অভিমানও উঁকি দিচ্ছে তার।আর্শি কেনো কিছু জানালো না তাকে?পরমুহূর্তেই নিশি ভাবলো, হয়তো কোনো কারণ ছিলো।তাই তার উচিৎ হবে সেদিনের অপেক্ষা করা যেদিন আর্শি নিজে থেকে তাকে বলবে। এর আগে সে নিজে কোনো প্রশ্ন করবে না।একটুও না।

পাঁচ বছরের কঠোর পরিশ্রমের অবশেষে অন্ত হলো।আন্ডার গ্রাজুয়েট থেকে গ্রাজুয়েট সম্পূর্ণ হওয়ার সফর পূর্ণ হলো।বুকে জ্বলতে থাকা অপেক্ষার আগুনও নিভবে এবার।প্রিয় মানুষগুলোর সাথে সন্ধিও হবে এবার, বিচ্ছেদের পীড়া থাকবে না আর।হৃৎপিন্ডটাও হয়ে আছে উতলা ভীষণ।আসন্ন এই মুহূর্তের জন্যে আর্শির হৃদয় আর অপেক্ষা করতে রাজি নয়।
বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ পেলো আর্শির কদমের।এ দেশের শীতল বাসাত ছুঁলো আর্শির শরীর,খোলা চুলও যেনো আনন্দে নেচে উঠলো।

মেয়েটা দ্রুত কদম ফেলে এগিয়ে যেতে লাগলো।চেহারায় আনন্দ, চিন্তা,অস্থিরতা ফুটে আছে তার।গত পাঁচ বছর ধরে এই দিনটারই তো অপেক্ষায় ছিলো সে।এবার আর তর সইছে না তার।কতক্ষণে সে দেখবে প্রিয় মুখগুলোকে?এতোগুলো দিন তো শুধু ভিডিও কলে দেখে গিয়েছে আজ সে বাস্তবে অনুভব করবে, ভালোবাসা ও আদর কুড়াবে।
এক বুক উত্তেজনা হৃদয়ে জমে আছে মেয়েটার।সেই সাথে জমে আছে এক আকাশ ভয়ও।সব আপন মানুষগুলোর সাথে ভিডিও, অডিও কলে যোগাযোগ বজায় রাখলেও একজন আছে যে ভীষণ আপন এই মনের।কিন্তু তার সেই মানুষ টার সাথেই কোনো ধরণের যোগাযোগ তো ছিলো না তার।এই প্রিয় মানুষটা তাকে মনে রেখেছে তো?নাকি ভুলে গেছে? আজ এখানে মানুষ টা আসবে তো তাকে দেখতে?

এয়ারপোর্টের বাইরে কদম রাখতেই আর্শির চোখে পড়লো এক কালো শার্ট ও কালো ডেনিম প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক।চোখে তার কালো সানগ্লাস।গাড়ির সাথে ঠেক দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা।বার বার নিজের হাত ঘড়িটা দেখছে সে।

আর্শির কদম ঠিক নিজের জায়গাটায় থমকে গেলো।দৃষ্টিও স্থির সেই পুরুষের পানে।হৃৎপিণ্ড টাও যেনো সংকুচিত-প্রসারিত হওয়া থামিয়ে দিলো।চোখটা আপনা-আপনিই ভিজে উঠলো।
বিহানের অশান্ত দৃষ্টি হটাৎ আঁটকে গেলো এক রমনীতে।এ রমনীর মুখে ফুটে ওঠা আনন্দ, আবেগের ছাপ দেখে হেসে ফেললো সে।বুঝলো মেয়েটার মনের হাল।তার মনের হালও যেনো উথালপাতাল।কাঙ্ক্ষিত মুখটা এতো বছর পর দেখে তার হৃদয়েও যেনো সুখের জোয়ার।তার এতো বছরের অপেক্ষা অবশেষে শেষ হলো!

নিজেকে সামলে নিয়ে মেয়েটার দিকে এগোতে আরম্ভ করলো বিহান।এগোতে এগোতে সে বলে উঠলো,
-সো মিস.আর্কিটেক্ট আর্শি ম্যাম,প্লিজ এদিকে আসুন।আপনার জন্য গাড়ি ও ড্রাইভার দু’জনেই প্রস্তুত।
আর্শি এক মুহুর্তও বিলম্ব করলো না।নিজের ল্যাগেজ, ব্যাগ সব ফেলে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো সে বিহানকে।আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে মনের সব আবেগ অশ্রু রূপে বিসর্জন দিতে আরম্ভ করলো সে।বিহানের ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠলো,হৃৎপিণ্ড টাও নিজের গতি বাড়িয়ে লাব-ডাব সংগীত আরম্ভ করে দিলো।
দু’টো হৃৎপিণ্ড একে-অপরের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের গতি বাড়িয়ে চলছে যেনো তারা পাল্লা দিয়ে একে-অপরকে বলছে,

“ভালোবাসি প্রিয়,একটু না অনেক বেশি ভালোবাসি”
দু’টো হৃদয়ের তৃষ্ণা মিটলো না,চাইলো না একে-অপরের থেকে দূরে আসতে কিন্তু চোখেরও বায়না একে-অপরকে দেখার।চোখের আবদার রাখলো বিহান-আর্শি।একটু সরে এসে তারা তাকালো একে-অপরের আবেগপূর্ণ নয়নে।দুজনের নয়নই সিক্ত,আবেগে পরিপূর্ণ।কয়েক প্রহর নিরবতায় কাটলো।দু’নয়নের তৃষ্ণা মিটলো খানিক।তবে হৃদয়ে এখনো অনুভূতির জোয়ার তীব্র।

আর্শি থেমে থেমে বলে উঠলো,
-আপনি এসেছেন বিহান।আপনি সত্যিই এসেছেন।
বিহান বিলম্ব করলো না।মেয়েটাকে নিজের বক্ষমাঝে চেপে ধরে নিজের চোখজোড়া বুঁজে নিলো সে।ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি টেনে রেখে নিম্ন স্বরে বলে উঠলো,
-আসতেই হতো।অজান্তেই যে তোমার #প্রণয়_আসক্তিতে বাঁধা পড়ে গেছি তা বুঝেছিলাম তখন আর অনুভব করে গেছি পাঁচটা বছর।
ঠোঁটে বিজয়ের হাসি আর্শির।চোখমুখে তৃপ্তির ছাপ।সে সরে এলো বিহানের থেকে।ছেলেটার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে উঠলো,

-ভালোবাসা আছে,বিহান?ভালোবাসা বলতে কিছু হয়? ভালোবাসা বলতে কিছু না-ই থাকলে আপনি এই পাঁচটা বছর আমাকে অনুভব করতে পারতেন?পারতেন আমাকে অনুভবে রাখতে? মানুষ বলে না, চোখের আড়াল হলে মনেরও আড়াল হয়? আমরা তো চোখের আড়ালে ছিলাম তাহলে মনের আড়াল হলাম না কেনো? কোন এমন কারণ বা অনুভূতির জোরে আপনি এই পাঁচ বছরে অন্য নারীর হননি বা আমি অন্য কোনো পুরুষের হতে পারিনি?
বিহান নিজের মস্তক নত করলো,ঠোঁট কামড়ে মৃদু হাসলো।অতঃপর এক হেঁচকা টানে আর্শিকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।আর্শি গাল আলতো হাতে স্পর্শ করে সে বলে উঠলো,

-ভালোবাসার জোরে।হ্যাঁ,ভালোবাসা আছে।ভালোবাসা কোনো দুই দিনের মোহ বা মায়া নাহ।ভালোবাসা একটা ভয়ংকর অনুভূতি যা এক জীবনে শেষ হয় না বরং দিনের পর দিন নিজের তীব্রতা বাড়ায়।ভালোবাসা মোহ,মায়া,শারীরিক চাহিদা সবকিছুর উর্ধ্বে।ভালোবাসা এক পবিত্র অনুভূতির নাম।আই লাভ ইউ আর্শি।
-এজ অ্যা হাসবেন্ড?
হেসে ফেললো বিহান।আর্শির কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে নিন্ম স্বরে বলে উঠলো,
-ইয়েস।

তৎক্ষনাৎ চারিপাশ হতে করতালির শব্দ ভেসে এলো।বিহান ও আর্শি চমকে একে অপরের থেকে সরে এলো।তারা তাকালো চারিদিকে।অসংখ্য লোকজন তাদের ঘেরাও করে রেখেছে,অনেকে ভিডিও করছে।এতো মানুষের মাঝে পরিচিত কিছু মুখ দেখতে পেয়ে থমকে তাদের দিকে দৃষ্টি স্থির করে দাঁড়িয়ে রইলো আর্শি।একরাশ ভয়, অস্বস্তি এসে জায়গা করে নিলো তার হৃদয়ে।
সানিয়া বেগম, আরহান সাহেব, আর্শ ও মিয়ামি গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।এসবে বিহানও অস্বস্তিবোধ করতে আরম্ভ করলো।দু’জন একে-অপরে এতোটাই মত্ত ছিলো যে তাদের মাথায়ই ছিলো না যে তারা পাবলিক প্লেসে আছে।ভীষণ লজ্জাও অনুভব করছে আর্শি-বিহান।
এমন থমথমে পরিবেশে মিয়ামি জোরে শিশ্ বাজিয়ে বসলো।উচ্চ স্বরে বলে উঠলো,

-রুক কিয়ু গেয়ি?যা সিনরান জি লে আপনি জিন্দেগী।
আর্শি-বিহানসহ পুরো পরিবার মিয়ামির দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো।মিয়ামি আর্শের দিকে তাকিয়ে চোখ মারলো।ওমনি উপস্থিত সবাই হেসে উঠলো।
আর্শি দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো বান্ধবীকে।প্রথমেই প্রশ্ন ছুড়লো,
-আনাম কোথায়?

-ওর নানু বাসায় রেখে আসছি।তোর অপেক্ষায় সেই সকাল থেকে বসে আছে সে।
মিয়ামিকে ছেড়ে ভাই,মা,বাবা সবার দিকে ভীত চোখে তাকাচ্ছে আর্শি।কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরার সাহস তার আর হচ্ছে না।আর্শিকে অবাক করে দিয়ে পুরো পরিবার হেসে ফেললো।সানিয়া বেগম মেয়ের কাছে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন মেয়েকে।মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন,

-বড় হয়েছিস আশু।এখন একজন আর্কিটেক্ট তুই।জীবনে একটা পর্যায়ে চলে এসেছিস।এ সময় নিজের জন্য জীবনসঙ্গী পছন্দ করার অধিকার তোর আছে।ভয়ের কিচ্ছু নেই।আর বিহানকে তো আমরা চিনি।অসম্ভব ভদ্র ছেলে।
নিজের কথা শেষ করে সানিয়া বেগম সরে আসলেন নিজের মেয়ের থেকে।আর্শি এবার আরহান সাহেব ও আর্শের দিকে প্রশ্নবোধক চোখে চেয়ে আছে।আরহান সাহেব ও আর্শও হাসি টেনে রেখে আর্শিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।আরহান সাবেহ মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলে উঠলেন,

-ভয় পাচ্ছিস কেন পাগলি।তোর মা ঠিক বলেছে।আমরা এখন সে যুগে নেই যখন কোনো বিচারবিবেচনা ছাড়াই বাবা-মা সন্তানের পছন্দ মেনে না নিয়ে তাদের উপর জোর খাটাতেন।আমরা এ যুগের যেখানে বিচারবিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।সেটা ভিন্ন বিষয় যে, যদি বিহানের জায়গায় কোনো অশিক্ষিত,অভদ্র ছেলে পছন্দ করতি তাহলে একটা থাপ্পড়ও মাটিতে পড়তো না।
আবারও হাসির গুনগুন শব্দ চারিপাশে ভেসে উঠলো।এসবের মাঝেই সানিয়া বেগম বিহানের দিকে তাকিয়ে তাকে ডেকে উঠলেন,

-বিহান বাবা,এদিকে এসো।
বিহান মাথা নিচু রেখে এগিয়ে এলো।সানিয়া বেগম ঠোঁটে দুষ্টু হাসি টেনে রেখে বিহানের কান আলতো করে মুচড়ে ধরলেন।বিহান ব্যথায় শব্দ করে উঠলো।সানিয়া বেগম বলে উঠলেন,
-ডাক্তার হয়ে তলে তলে টেম্পু চালানো হ্যাঁ?
সানিয়া বেগমের এমন প্রশ্নে সবাই সমান তালে উচ্চ শব্দে হেসে উঠলো।

সমাপ্ত

[কেমন লাগলো গল্পটা?
সত্যি বলতে শেষ পর্বে এসে আমার একটুও লিখতে ইচ্ছে হচ্ছিল না।রাইটিং ব্লকে পড়েছি নাকি জানি না।কিন্তু খুব জোর করে লিখেছি।লেখায় মনই বসাতে পারছিলাম না।তাই আমি যেভাবে গল্পটার ইন্ডিং চাচ্ছিলাম সেভাবে দিতেও পারিনি।কিন্তু অনেক চেষ্টা করেছি সুন্দর করে লেখার।আপনাদের ভালো লেগেছে তো?😔]
[আচ্ছা আরেকটা কথা।এ গল্পে আর্শি বিহানের যে কাহিনি টা ছিলো তা ৮০-৯০% বাস্তব।কিন্তু শেষে যে ওদের মিল টা দিলাম তা অবাস্তব।না আর্শি অপেক্ষা করা বন্ধ করেছে আর না বিহান অবহেলা করা।বাস্তব বিহানটা মানুষ হিসেবে ভীষণ ভালো বলেই ধারণা করা যায় কিন্তু প্রেমিক হিসেবে জঘণ্য।সবার মতো আমিও আর্শিকে উপদেশ দেই, ‘ছেড়ে দেও এই অপেক্ষা’]

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ২২