প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ২২

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ২২
লেখিকাঃ মাহযাবীন

“যদি থাকতে তুমি
বাঁচতে আমার লাগতো না কঠিন,
যদি থাকতে তুমি।
যদি থাকতে তুমি
কাটতো আমার দিনগুলো রঙ্গিন,
যদি থাকতে তুমি।।
আমার চোখে ভাসে শুধু তোমার ঐ মুখ
কানে বাজে তোমার গলার স্বর।
আমার চোখে ভাসে শুধু তোমার ঐ মুখ
কানে বাজে তোমার গলার স্বর,
তোমায় মনে পড়লে করি শুধু পাগলামি
উঠে এই মাতাল মনে ঝড়।”

গানের এ শব্দগুলো হৃদয়ে অনুভূতির ঝড় তুলছে আর্শির।এ শব্দ গুলো যেনো আর্শির মনের হালই ব্যক্ত করে যাচ্ছে।মেয়েটা ঘুমন্ত আনামকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে রেখে নিরবে নিজের দু’নয়ন হতে দুঃখ কণাগুলোকে বয়ে যেতে দিচ্ছে।নাহ,বাঁধা দিচ্ছে না সে।কিছু দুঃখগুলোকে এভাবেই বিদায় দিতে হয়।নয়তো এ দুঃখ গুলো পাহাড় সমান বোঝা হয়ে বেঁচে থাকাটা কঠিন করে তোলে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সকাল হতেই তার বিদায়ের প্রস্তুতি শুরু হবে।আগামী রাত টা সে থাকবে প্লেনে।অর্থাৎ আর কয়েক ঘন্টা মাত্র আছে তার হাতে তার পরিবারের সাথে কাটানোর জন্য।নাহ,যে মানুষ টা তাকে ভালোবাসেনি তার জন্য দুঃখ বিলাস করে এই কয়েক ঘন্টা সময় নষ্ট করবে না সে।এই রাত টা সে আনামকে দিবে।ভীষণ আদর দেবে নিজের ভাতিজাকে।তাই জন্যেই তো এক প্রকার ঝগড়া করে মিয়ামির কাছ থেকে আনামকে নিয়ে এসেছে সে।বাচ্চাটা রাতে হুটহাট উঠে যায়,তাকে খাওয়াতে হয় তাই মিয়ামি চাইছিলো না আনাম আর্শির কাছে থাকুক।আনামের জন্য শুধু শুধু আর্শির ঘুম খারাপ হোক তা মোটেও চাইছিলো না মিয়ামি।কিন্তু আর্শি নাছোড়বান্দা,আনামকে নিজের সাথে নিয়ে এসেই দম নিয়েছে সে।ভাগ্যিস আনামকে সাথে এনেছিলো সে।নয়তো এই রাতের মতো দূর্বিষহ রাত তার জীবনে হয়তো আর একটিও হতো না।

আজ রাত টা ভীষণ দীর্ঘ লাগছে বিহানের কাছে।বেদনাঘন সময়গুলো কী এমন দীর্ঘই হয়?জানে না বিহান।নিজের অদ্ভুত সব অনুভূতির জালে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পরেছে সে।একদিকে তার এতো দিনের বিশ্বাস,
‘ভালোবাসা বলতে কিছু নেই।যা আছে তা হচ্ছে ক্ষণিকের মোহ।’

অপরদিকে আর্শি আর তার বিভিন্ন স্মৃতি, আর্শির পাগলামি, আবেগ, গাঢ় অনুভূতি, যত্নসহ সবকিছুই উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে তার হৃদয়ে।হৃদয় বার বার বলছে, এই আবেগ এই অনুভূতি গুলো অমূল্য।এগুলো কুড়িয়ে নেওয়া উচিৎ, যত্নে হৃদয়ে আগলে রাখা উচিৎ।বিহানের হৃদয় বলছে এই গাঢ় অনুভূতি, আবেগ, পাগলামিগুলোকে হারিয়ে যেতে দিলে জীবনে থেকে ভীষণ দামী কিছু হারিয়ে যাবে।

এখন কি করবে সে?কীভাবে আটকাবে আর্শিকে?কোন মুখে আটকাবে?মেয়েটা থাকতে চেয়েছিলো বলেই তো তিনটে বছর তার অপেক্ষায় কাটিয়ে দিয়েছে বিনা কোনো অভিযোগে।তবুও সে এই অপেক্ষার মূল্য দেয়নি,মেয়েটার কোনো অনুভূতির মূল্য দেয়নি, মেয়েটার হৃদয় ভেঙে কয়েকশো টুকরো করে দিতেও পিছ পা হয়নি সে।তবে এখন কোন মুখে আটকাবে সে মেয়েটাকে?

ভেতরে ভেতরে অসহ্য অনুভূতি হওয়ায় জোরে এক নিঃশ্বাস ছাড়লো বিহান।বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে দাঁড়ালো বারান্দায়।অসহ্য সব অনুভূতি থেকে রেহাই পেতে সে একটুখানি গান শোনার সিদ্ধান্ত নিলো। নিজের ফোনের ইউটিউবে গিয়ে প্রথমেই যে গানটা নজরে পরলো তার সেই গানটিই ছাড়লো।গান বাজতে আরম্ভ হলো।বিহানও নিজের মনকে একটু শান্ত করার চেষ্টা করলো।কিন্তু এ গানের ক’টা লাইন যেনো হৃদয়ের ক্ষতগুলোকে স্পর্শ করে গেলো,

“ভালোবাসা বাকি আছে তোমারও আমার কাছে,
যা চেয়েছো দিতে আমি পারি না
আমারও সময় ডালে ফুরিয়ে এসেছে পাতা,
এত প্রেম কাছে এসে এল না
যদি কোনদিন তুমি দু’হাত দিয়ে ঝিনুক কোড়াও,
নেই আমি সেই অল্প ভাঙ্গা গল্প গুলোয়,
কার সাথে বল শব্দ ছুঁড়ে ফিরব বাড়ি?
মাঝরাতে আমি তোমার কথা বলব কাকে?”

একটি পরিবার যেনো একটি সূত্রে গাঁথা থাকে।পরিবারের প্রতিটি মানুষের হৃদয় ভালোবাসায় পরিপূর্ণ একটা বাঁধনে বাঁধা থাকে।এ বাঁধন পৃথিবীর সবথেকে মজবুত বাঁধনগুলোর মাঝে অন্যতম।তাই তো পরিবারের কোনো একটা সদস্য কষ্ট পেলে সেই কষ্ট টা পরিবারের অন্যদের হৃদয়েও ছড়িয়ে পড়ে। আধ্যাত্মিক এক মায়ার সংযোগ এ।

মেয়ে কাল বাড়ি ছেড়ে,আপন ছেড়ে,দেশ ছেড়ে পাড়ি জমাবে বিদেশের মাটিতে।কেমন এক অদ্ভুত ভয় ও বিচ্ছেদের পীড়ায় গাছের মরা পাতার ন্যায় বিছানায় পড়ে আছে দু’টো শরীর।ঘুম নেই দু’জনের একজনের চোখেও।বাবার হৃদয়ে শ্রাবণ হলেও চোখ মরুভূমি আর মায়ের হৃদয়ে বন্যা ও চোখে শ্রাবণ।
নির্ঘুম রাত কাটছে ভাইয়েরও।হৃদয়ে বোনকে নিয়ে অম্বর সমান দুশ্চিন্তা।নিজের ছোট বোনকে এভাবে একা ছাড়াটা কী ঠিক হচ্ছে?

হৃদয়ে দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো আর্শ।শূন্য আকাশে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখে নিজের মনকে নানান বুঝ দিতেও আরম্ভ করলো সে।এমন সময় হটাৎ দু’টো কোমল হাত পেছন থেকে আঁকড়ে ধরলো তাকে।তার পিঠে মাথা ঠেকিয়ে বলে উঠলো,
-পাখির ছোট্ট বাচ্চাটা যখন একটু বড় হয় তখন মা পাখি তার বাচ্চাকে উড়তে শিখানোর জন্য উপর থেকে বাচ্চাকে নিচে ফেলে দেয়।প্রথম এক, দু’বার বাচ্চা পাখিটা নিচে পরে ব্যাথা পায় কিন্তু এর পর থেকে সে নিজেকে ব্যাথা থেকে বাঁচানোর জন্য ঠিকই ডানা ঝাপটানো শিখে যায়,শিখে যায় দূর আকাশে নিজের মতো করে উড়ে বেড়াতে।বুঝেছো?

হাসি ফুটে উঠলো আর্শের ঠোঁটে।তার মনে হলো তার হৃদয় থেকে একটা বড় বোঝা নেমে গেছে।এই জিনিসটা তার মাথায় কেনো এলো না?কেনো বুঝলো না জীবনে একটা উঁচু স্থানে যেতে হলে নিজের লড়াইটা মানুষের নিজেকেই করতে হয়।পরিবার শুধু এক অনুপ্রেরণা মাত্র কিন্তু সফলতার রাস্তায় মানুষের নিজেকেই হাঁটতে হয়, পরে যেতে হয় আবার নিজেকেই উঠে দাঁড়াতে হয়।
আর্শ মিয়ামির হাত ধরে টেনে তাকে নিজের সামনে এনে দাঁড় করলো।দু-হাত তার কোমরে রেখে টুপ করে এক চুমু এঁকে দিলো মেয়েটার নাকে।নিম্ন স্বরে বলে উঠলো,

-ধন্যবাদ মিয়ু।
হাসলো মিয়ামি।আর্শের গলা আঁকড়ে ধরে এগিয়ে গেলো ছেলেটার কাছে।নিজের ঠোঁট ছোঁয়ালো আর্শের কানে।তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে নিম্ন স্বরে বলে উঠলো,
-তোমার ছেলে কিন্তু আজ তার ছোট মায়ের কাছে।
নিজের চোখজোড়া বুজে নিলো আর্শ।বুঝলো নিজ স্ত্রীর ইশারা।মিয়ামির কন্ঠের মাদকতাটাও অনুভব করলো সে।মৃদু হাসি ঠোঁটে ফুটে উঠলো তার।সে ধীর গতিতে এগিয়ে মেয়েটার কাঁধে ঠোঁট ছোঁয়ালো।মিয়ামি কেঁপে উঠলো।আর্শের ঠোঁট কাঁধ ছেড়ে গলায় এলো,গলা হতে বুকে।মাদকতা ক্রমান্বয়ে বাড়তে আরম্ভ করলো উভয়ের হৃদয়ে।

কেটে গেলো নির্ঘুম রাত।সেই সাথে চোখের পলকেই যেনো সূর্যাদয় থেকে সূর্যাস্তের সময় ঘনিয়ে এলো।এতো দ্রুত কিভাবে পাড় হয়ে গেলো সময়?মানুষ যে সময়টা খুব করে ধরে রাখতে চায় সেই সময় টা কি এভাবেই নিজের গতি বাড়িয়ে পালিয়ে যায়?দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন সানিয়া বেগম।এয়ারপোর্টে মেয়ের সাথেই বসে আছেন তিনি ও তার পুরো পরিবার।ফ্লাইটের এখনো এক ঘন্টা বাকি।সবাই বসে বসে দুঃখ বিলাসে ব্যস্ত, শান্তির ঘুম শুধু আনামের।
হটাৎ আর্শির ফোনটা বেজে উঠলো।নিস্তব্ধ পরিবেশে শব্দ দূষণ হওয়ায় সবার নজর কেন্দ্রীভূত হলো আর্শির দিকে।আর্শি সেদিকে খেয়াল না দিয়ে কল রিসিভ করে কানে ধরলো।ফোনের ওপাশ হতে নিশির কন্ঠস্বর শোনা গেলো।
“দোস্ত কই তুই?আমি এয়ারপোর্টের বাইরে দাঁড়ায় আছি।”

আর্শির ঠোঁটে এক বৃহৎ হাসি জায়গা করে নিলো।সে ভাবেনি নিশি আসবে।অভাবনীয় কিছু যত্ন,কিছু ভালোবাসা হৃদয়ে এক অতুলনীয় প্রশান্তি, তৃপ্তি এনে দেয়।যেমনটা নিশির উপস্থিতি আর্শির হৃদয়ে এনে দিয়েছে।
আর্শি আর কিছু বললো না,বিলম্ব না করে সে ছুটলো এয়ারপোর্টের গেটের দিকে।এই প্রিয় মুখগুলো বাস্তবে,কাছ থেকে তার আর দেখা হবে কিনা তা নিয়ে এক অম্বর অনিশ্চয়তা।তাই যাওয়ার পূর্বে এই প্রিয় মানুষগুলোকে কাছ থেকে অনুভব করে যেতে চায় সে।

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ২১

আর্শির কদম থমকে দাঁড়ালো।নিশির হাসিমাখা মুখ টার পাশেই আরেকটা পরিচিত মুখ।সে মুখে হাসি নেই।সারাটা রাত নির্ঘুম কাটানোর ছাপ ভেসে আছে সে মুখে।ঠোঁটের কোণে হাসি নেই।চোখে এক অদ্ভুত বেদনা ফুটে আছে।আর্শির দৃষ্টি আঁটকে গেলো এ চোখজোড়ায়।তার হৃদয় তীক্ষ্ণ সূঁচালো পীড়া অনুভব করতে আরম্ভ করলো।মানুষ টা কেনো এলো এখানে?এতো কষ্টে নিজেকে যতটুকু সামলে নিয়েছিলো তা সব আবারও বেসামাল হয়ে গেলো।নিজেকে কি করে ঠিক রাখবে সে এখন?

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ শেষ পর্ব