প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ২০

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ২০
লেখিকাঃ মাহযাবীন

দিন পেরিয়ে রাত হয়ে এলো।সারাটা দিন নিশির অবচেতন মন জুড়ে ছিলো এহসানের উপস্থিতি।বিগড়ে যাওয়া পরিস্থিতি এখন কী করে সামলে নিবে সে?আনমনা হয়েই নিজের ম্যাসেন্জারে ঢুকলো মেয়েটা।ঢুকতেই তার চোখে পড়লো এহসানের আইডি খানায় সবুজ বাতি জ্বলছে।একরাশ অস্বস্তি নিয়ে সে সিদ্ধান্ত নিলো এহসানকে একখানা খুদে বার্তা পাঠানোর।যেই ভাবা সেই কাজ।

“এহসান ভাই,আপনি হয়তো আমাকে অনেক খারাপ ভাবছেন।হয়তো ভাবছেন ছেলে দেখলেই পটে যাই টাইপ।আসলে এমনটা না।আপনি একজন ভালো টিচার,আপনার নলেজ অনেক,অনেক বুদ্ধিও রাখেন তাই আপনাকে ভালো লেগেছিলো শুধু।এটা ঐ প্রেম,ভালোবাসা নাহ।প্লিজ ভুল বুঝবেন নাহ।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এহসান পুরোটা দিন কাটিয়ে দিলো আর্শির কথাগুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতে।তাও কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়াই সম্ভব হলো না তার দ্বারা।সে যাকে নিজের জন্য পছন্দ করলো সেই মেয়েটা অন্য কারো আর অন্য একটা মেয়ে যে তাকে পছন্দ করে কিন্তু সে সেই মেয়ের হতে পারছে না।কী অদ্ভুত ভাগ্য! কেমন করে এক ত্রিভুজাকার জালে জড়িয়ে গেলো তারা?এসব ভাবনার মাঝে এহসানের মাথায় যে একটা বিষয় বার বার এসে উঁকি দিচ্ছে তা হলো,আর্শির বলা শেষ কথাটা।’

যে আপনাকে ভালোবাসে তাকে আগলে নিন।জীবন টা সুন্দর হয়ে যাবে’ এ কথাটা মোটেও ফেলে দেওয়ার মতো নয়।কেউকে ভালোবাসার থেকেও অনেক বেশি কঠিন কারো ভালোবাসার মানুষ হয়ে ওঠা।এ শহরের অলিতে-গলিতে অহরহ প্রেম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।কিন্তু সত্যিকারের ভালোবাসাটা দিনদিন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।আধুনিকতার যুগে এখন ‘এক মানুষে আসক্ত’ থাকা এক বিলাসিতা মাত্র।এ যুগে,এ মিথ্যে প্রেমের শহরে কেউ একজন সত্যিকারের ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছে তার জন্য।এর থেকে বড় পাওয়া এ পৃথিবীতে আর একটিও কী আছে?

এসব ভাবনার মাঝেই এহসান নিশির ম্যাসেজ পেলো।নিশির ইনবক্সে ঢুকে ম্যাসেজটা পড়ে মৃদু হাসলো সে।বুঝলো মেয়েটা কী পরিমাণ অস্বস্তিতে আছে।থাকবেও বা না কেন?আজ যেমন রাগ দেখিয়ে সে চলে এসেছিলো তা দেখে যেকেউই এমন অস্বস্তিতে পড়তো।এহসান ঠিক জানে না সে নিশিকে নিজের করে নেবে কিনা।কিন্তু মেয়েটাকে একটা সুযোগ তো দেওয়াই যায়!এমনটা ভেবে নিশিকে একটু স্বস্তি অনুভব করিয়ে স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্য নিয়ে এহসান লিখলো,

-ভালো লেগেছিলো?মানে এখন আর লাগে না?
-না না লাগে।মানে এজ অ্যা টিচার ভালো লাগে।
-ওওওহ,শুধু টিচার হিসেবেই ভালো লাগে।আর কিছু না?
-নাহ।
-মানে আমাকে বিয়েও করতে চাও না তুমি?
-বিয়ে?

-হ্যাঁ বিয়ে।আমরা যাকে পছন্দ করি তাকে তো বিয়েই করতে চাই তাই না?তুমি তো শুধু আমাকে টিচার হিসেবেই পছন্দ করো এর বেশি কিছু তো না।তাইলে থাক,তোমার আমাকে বিয়ে করতে হবে নাহ।আমি অন্য কেউকে খুঁজে নিবোনে যে আমাকে টিচারের থেকে একটু বেশি পছন্দ করবে।
এহসানের কথায় আপনা-আপনিই গালে লাল আভা ফুটে উঠলো নিশির।এহসান কী তাহলে চাইছে যে সে স্বীকার করে নিক,সে একটু না অনেকখানি পছন্দ করে ফেলেছে তাকে?
নিশি লাজুক হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে রেখেই লিখলো,

-হু খুঁজে নিয়েন।
-ঠিক তো?পরে কিন্তু বলবা না যে তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি।
-ডু ইউ লাইক মি এহসান?
-লিসেন নিশি,মিথ্যা বলবো না।আমি তোমাকে আসলে ওভাবে দেখিনি কখনো।কিন্তু আজ আর্শি যখন বললো তোমার বিষয়টা,যখন বুঝালো তোমার অনুভূতিটা সত্য তখন মনে হলো তোমাকে নিয়ে নাহয় একটু ভাবি।কারণ তুমি যদি সত্যিই আমাকে ভালোবেসে থাকো তাহলে আমি চাই না এই ভালোবাসা টা হারাতে।তোমার ভালোবাসা অনুভব করতে করতেই নাহয় একদিন আমিও ভালোবেসে ফেলবো তোমাকে।কি বলো?চলবে?

-ভালোবাসেন বা না বাসেন, এইযে আপনি আমার অনুভূতির সম্মান করলেন,মূল্যায়ন করলেন এতোটুকুও আজকাল মানুষ করতে জানে না।আপনার এই এথিকসগুলোই খুব ভাল্লাগে।

যেখানে খুশির বর্ষণ হওয়ার কথা ছিলো সেখানে এক সমুদ্র চোখের পানি উপস্থিত হলো।পরিবারের প্রতিটা মানুষের চোখে আজ শ্রাবণ।কপালে তাদের চিন্তের ছাপ।মুখে কোনো শব্দ নেই।নফল নামাজেও ব্যস্ত আছেন ক’জন।
হসপিটালে মিয়ামির বেডের পাশে বসে আছে আর্শি।পাথর রূপ নিয়েছে তার আবেগ।তাই তো চোখ শুকনো,ফ্যাকাশে বিবর্ণ মুখশ্রী,মুখে রা নেই,শান্ত নির্বিকার চাহনি তার।ক্লান্ত চোখে সে শুধু চেয়ে আছে তার বান্ধবীর মুখশ্রী পানে।কখন চোখ মেলবে মেয়েটা?কখন বাংলা সিমেনার অতি আবেগী নায়িকাদের মতো ঢং করে বলে উঠবে, ‘দোস্ত তোর ভাইরে ডাক,ওরে দেখার জন্য আমার কইলজাটা ফাইট্টা যাইতেছে’?

দীর্ঘশ্বাসটাও বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো না আর্শির। ভাগ্য এতো নিষ্ঠুর কেনো তার সাথে?
যেখানে প্রেমে সন্ধি হতে পারতো সেখানে হলো চিরবিচ্ছেদ।হৃদয়ে গভীর এ ক্ষত নিয়ে বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই পরিবারে নেমে এলো এক দূর্বিষহ সময়,এক ঘন কালো আমাবস্যা।নিজেকে তবুও শক্ত রাখার চেষ্টা করছে মেয়েটা।বহু কষ্টে পাথরের রূপ নিয়েছে তার আবেগ।তবে এ পাথর ভীষণ দূর্বল।একটা ভরসার হাত কাঁধে পেলেই হয়তো এ পাথর গলে সমুদ্র হবে।কিন্তু এই ভরসার হাতটা নেই,নেই কোনো শক্ত আশ্রয়।আজ নিজেকে ভীষণ একা অনুভব করছে আর্শি।না চাইতেও অবাধ্য মনে এক প্রশ্ন উদয় হলো তার।ভাবলো, “আজ বিহান তার পাশে থাকলে কী সে এতোটা একা হতো?”

হটাৎ মিয়ামির চোখের পাপড়ি মৃদু নড়ে উঠলো।ঠোঁট নাড়িয়ে ধীর কন্ঠে সে বিরবির করে ডেকে উঠলো,
‘আর্শ’
আর্শি চমকে উঠলো,অবাক চাহনি নিয়ে ক’সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো মিয়ামির পানে।মিয়ামি ধীর কন্ঠে এই একই শব্দ বারংবার উচ্চারণ করতে লাগলো।আর্শি বিচলিত হয়ে উঠলো।হাত রাখলো মিয়ামির গালে।বান্ধবিকে আলতো ছুঁয়ে উত্তেজিত কন্ঠে ডেকে উঠলো,
-মিয়ু?দোস্ত?ঠিক আছিস?
এবার পুরোপুরি নিজের চোখ খুললো মিয়ামি।আশপাশ দেখে অস্থির হয়ে উঠলো মেয়েটা।বিচলিত কন্ঠে প্রশ্ন করতে আরম্ভ করলো,

-আর্শ কোথায় আশু?ওকে ডাক।ও কোথায়?আমার আর্শ কোথায় আশু।ওকে ডাক প্লিজ,ওকে ডাক।
কথাগুলো বলতে বলতে মিয়ামির উত্তেজনা বাড়তে লাগলো,অস্থির হয়ে উঠতে লাগলো সে।মিয়ামিকে অস্থির হতে দেখে আর্শি কি বলবে, কি করবে সব গুলিয়ে ফেললো,জোরে চেচিয়ে নার্স ডাকলো।
আর্শির গলার আওয়াজ পেয়ে একে একে পরিবারের সবাই মিয়ামির ক্যাবিনে ঢুকে পড়লো।সাথে নার্সও।মিয়ামি যেনো এগুলোর কিছুই পাত্তা দিলো না।তার পাগলামি বাড়লো।বারে বারে চেচিয়ে একই প্রশ্ন করতে লাগলো,
“আমার আর্শ কোথায়?”

নার্স ব্যস্ত মিয়ামিকে সামলানোতে আর পরিবারের সবাই স্তব্ধ,সবার চোখে আতঙ্ক।এমন পরিস্থিতির সাথে তারা কেউই পূর্ব-পরিচত নয়।
পরিস্থিতি বেসামাল হওয়ার মাঝেই ক্যাবিনের দরজা খুলে কেউ একজন ঢুকলো।তার মাথায়,হাতে,পায় ব্যান্ডেজ করা।পায়ে তীব্র ব্যাথা নিয়ে হাঁটার ফলে ক্ষত জায়গা হতে ব্লিডিং হয়ে ব্যান্ডেজ ভিজে গেছে।তবুও সেদিকে নজর নেই এ যুবকের।সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়ে দাঁড়ালো মিয়ামির সামনে।তাকে দেখতে পেয়েই নিস্তব্ধ রূপ নিলো পুরো কক্ষ।মিয়ামির পাগলামি কমে গেলো।সে অপলক ক’সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো এ যুবক পানে। অতঃপর নেতিয়ে পড়লো বেডে।ঠোঁটে তার এক চিলতে হাসি আর তার দৃষ্টি সে যুবকে নিবদ্ধ।হটাৎ মিয়ামি তার দু-হাত হাত উঁচু করলো।সামনে দাঁড়ানো যুবক অনতিবিলম্বে মিয়ামির খুব কাছে এলো।শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো মিয়ামির হাত।বলে উঠলো,

-এইতো তোমার আর্শ, মিয়ু।এইযে আমি।
হাসি প্রশস্ত হলো মিয়ামির।চোখের কোণ বেয়ে টুপ করে গড়িয়ে পড়লো এক বিন্দু অশ্রু কণা।আর্শ খুব যত্নে এ দুঃখ কণা মুছে দিলো।পুনরায় বলে উঠলো,

-এতো দ্রুত ছেড়ে যাচ্ছি না তোমাকে বুঝলে?একসাথে আমাদের ছোট্ট জানটার বড় হওয়া দেখতে হবে তো।
আর্শের শব্দ গুলো কানে আসতেই ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি উঠলো মিয়ামির।সে হাত রাখলো নিজের পেটে।মুহুর্তেই হাসি বিলীন তার।বাচ্চা কোথায় তার?তৎক্ষনাৎ মিয়ামির মনে পড়লো তার পাগলামির কথা,মনে পড়লো সিঁড়ি থেকে তার পরে যাওয়ার কথা।হৃৎস্পন্দন যেনো থেমে গেলো মেয়েটার।শ্বাস টাও আটকে গেলো বুকে।জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে সে ভীত কন্ঠে থেমে থেমে প্রশ্ন করে উঠলো,

-আমার বাচ্চা? আমার ছেলে কোথায় আর্শ? ও ঠিক আছে?
আর্শ আস্বস্ত গলায় বলে উঠলো,
-একদম ঠিক আছে আমাদের ছেলে।প্রি-ম্যাচুউর বেবি আমাদের মিয়ু। তাই ওকে ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে।এক মাস পর ও আমাদের কোলে থাকবে, আমাদের হৃদয়ের খুব কাছে থাকবে,খুব কাছে।

গাড়িতে নিশি।তার পাশেই এহসান ড্রাইভ করছে।তাদের উদ্দেশ্য হসপিটালে পৌঁছানো।মিয়ামি,আর্শ ও তাদের ছোটুকে এক নজর না দেখলে নিশির কোনোভাবেই স্বস্তি হচ্ছিলো না।এহসানকে এ খবর জানাতেই এহসান বললো সে নিশিকে নিয়ে যাবে হসপিটালে।ব্যাস, আর কে আটকায় নিশিকে?এহসান যদিও একবার ভেবেছিলো হসপিটালের ভেতর গিয়ে সেও আর্শিকে একটু দেখে আসবে কিন্তু পর মুহূর্তেই ভাবনা পাল্টে নিলো সে নিজের।এখন সে শুধু নিশিকে নিয়ে ভাববে,আর্শিকে নিয়ে নাহ।তাই হসপিটালের বাইরেই দাঁড়াবে সে।নিশির দেখা করা শেষ হলে মেয়েটাকে সাথে নিয়ে আবার ফিরে যাবে।
মধ্য পথে কল এলো বিহানের।নিশি কল রিসিভ করে ফোন কানে তুললো।বিহান প্রশ্ন করে উঠলো,

-কিরে বাইরে নাকি তুই?
-হ্যাঁ ভাইয়া,হসপিটালে যাচ্ছি।মিয়ামি আর আর্শের এক্সিডেন্ট হয়েছে।বাচ্চাটাও প্রি-ম্যাচিউর।খুবই কঠিন সময় পাড় করতেছে আর্শিরা।

হৃদয় ধক করে উঠলো বিহানের।আর্শি নামটা শুনতেই কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি ঘিরে ধরলো তাকে।কষ্ট হচ্ছে তার।কষ্ট হচ্ছে এই ভেবে যে মেয়েটা একই সাথে কতগুলো ঝড় সামলে নিচ্ছে নিরবে।বিহান অনুভব করলো তার হৃদয়ের কোনো এক কোণে তীব্র অপরাধবোধ কাজ করছে,খারাপ লাগা কাজ করছে।ভালোবাসা দেওয়ার বদলে সে মেয়েটাকে দিলো বিরহ।আর এখন এই ভাঙা হৃদয়ে আপন মানুষগুলোর কষ্ট ভাগ করে নিচ্ছে মেয়েটা।খুব কী একা লাগছে মেয়েটার?খুব করে কাঁদার জন্যও তো একটা নিজস্ব জায়গা লাগে যা এখন নেই আর্শির কাছে।কার সাথে নিজের দুঃখ ভাগ করবে সে?তার পুরো পরিবারই তো এখনে দুঃখে নিমজ্জিত।নিরবে বিহান এও ভাবলো,একবার কী একটা ম্যাসেজ সে দেবে মেয়েটাকে?

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ১৯

বিহানের তরফ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে নিশি জিজ্ঞেস করে উঠলো,
-কি হলো ভাইয়া?কিছু বলো।
-হু,আচ্ছা যা তুই।আর্শির কাছে বসিস কিছু সময়।দেরি হলেও চিন্তার কিছু নেই।আমি মাকে বলে দিবো।
-আচ্ছা ভাই, লাভ ইউ।

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ২১