প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৭

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৭
লেখিকাঃ মাহযাবীন

বিছানায় আধশোয়া হয়ে চকলেটে একের পর এক কামড় বসাচ্ছে বিহান।চোখ তার টিভির দিকে।গভীর মনোযোগ নিয়ে থ্রিলার মুভি দেখায় ব্যস্ত সে।এমন সময় তার ফোনে টুং শব্দ হলো।খানিক বিরক্ত হলো সে।ফোন হাতে নিয়ে দেখলো এক অপরিচিত মেয়ের ম্যাসেজ।অপরিচিতা লিখেছে,

“হাই,কেমন আছো?”
বিহান রিপ্লাই করলো,
“ভালো”
এর বেশি কিছু বললো না সে।অপরিচিতা পুনরায় প্রশ্ন করলো,
“কি করো?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এবার বিহান বেশ অনেকটা বিরক্তই হলো।একে তো অপরিচিত, তার উপর অনুমতি ছাড়াই ‘তুমি’ সম্বোধন, কথা বলায় অনাগ্রহী বুঝার পরও তার আবার প্রশ্ন করা সবটাই চরম বিরক্তির।তবুও ভদ্রতা বজায় রাখলো বিহান।সুন্দর করে একখানা খুদেবার্তা পাঠালো,
“আমি একটু ব্যস্ত আপু,পরে কথা হবে।”

এতোটুকু লিখে মেয়েটার ইনবক্স থেকে বের হয়ে আসলো বিহান।তার চোখ পড়লো আর্শির আইডিতে।মেয়েটা অফলাইন,এক্টিভ ছিলো ঘন্টাখানেক আগে।বিহান ভাবলো,কতদিন তাদের কথা নেই তাই বলে কী স্মৃতিতেও নেই?অবশ্যই আছে।কিছু মানুষ জীবনে না থাকলেও হৃদয়ে থেকে যায় অনন্তকাল।আর্শিও বিহানের কাছে ঠিক এতোটাই বিশেষ।মেয়েটা যদি জীবনে নাও থাকে তবুও হয়তো থেকে যাবে হৃদয়ের খুব গোপন এক চিলেকোঠায়।

বিহান একবার ভাবলো মেয়েটাকে ম্যাসেজ দিবে। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার ইচ্ছে টা মরে গেলো তার।কথা হলেই তো তাদের ঝগড়া হয়,মেয়েটা অভিযোগ করে তার বদলে যাওয়া আচরণ নিয়ে, এতে মেজাজ খারাপ হয় তার।হ্যাঁ আসলেই পরিবর্তন এসেছে তার মাঝে। আর এ পরিবর্তন টা খুবই দরকারও ছিলো।আর্শির অনুভূতি দিন দিন বেসামাল হচ্ছে তা বেশ বুঝতে পারে বিহান।সে জানে এটা আর্শির নিজের জন্যই ক্ষতিকর।নিজেকে হারিয়ে মেয়েটা দিন দিন ডুবছে বিহানে।যা অনুচিত।কেউকে ভালোবাসতে গিয়ে কখনোই নিজেকে হারাতে হয় না।কারণ দিন শেষে মানুষ নিজেই নিজের,অন্য কেউ সারাজীবন পাশে থাকে না বা থাকতে পারে না।

এসব ভেবেই বিহান দূরত্ব বাড়াতে চাইছে তাদের মাঝে।নাহয় আর্শির এই মাত্রাতিরিক্ত অনুভূতি তাদের নামহীন সম্পর্ক ও আর্শির নিজের জীবন উভয়েই জন্যই ক্ষতিকর রূপ নিয়ে বসবে।
এসব ভাবতে ভাবতে হাত থেকে ফোনটা বিছানায় নামিয়ে রাখলো বিহান।এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,

“নিজেকে সামলে নেও আর্শি,সামলে নেও নিজের পবিত্র অনুভূতিগুলো, কিশোরী মনের সবটুকু আবেগগুলো,সদ্য যৌবনের কামনা-বাসনাগুলো।একজন বড্ড ভুল মানুষকে ঘিরে স্বপ্ন বুনছো তুমি।”

হৃৎপিন্ড ভীষণ বিপদে আছে।সে ভাবছে, “কেন ভাই, কেন তোর অন্য একটা মানুষকে এতো ভালোবাসতে হবে?তোদের ভালোবাসার চক্করে আমাকে অলিন্দ, নিলয়ের সংকোচন-প্রসারণের গতি বাড়াতে হয়, নিজের কাজ বাদ দিয়ে ঢোল পিটানোর কাজ নিতে হয়।আমাকে কী মিউজিসিয়ান মনে হয় তোদের?লাব-ভাব কি কোনো রোমান্টিক গানের নাম নাকি?আর আমি কী গায়ক?”

হৃৎপিণ্ডের অভিযোগ শুনে চুপ রইলো না মস্তিষ্কও।সে বলে উঠলো, “ভাই তুই একা না।আমার উপর ও কী কম চাপ পরে?এর ভালোবাসার চক্করে আমারও তো হরমোন নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।নিউরনে যে ঝড় ওঠে তা সামলাতে হয়,শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাওয়ার হুকুম দিতে হয়, হুকুম দিতে হয় শিহরণের অনুভূতি জাগানোরও।হুহ্, কত কাজ আমার! ভালোবাসবে এ শরীরের অধিকারী মানুষ আর খাটতে হয় আমাদের।কি অবিচার!!”

মস্তিষ্ক ও হৃৎপিন্ডের ক্রিয়াকলাপে অস্থির হয়ে আছে দুই মানব-মানবী।তীব্র গরমে একজন মানুষ যদি টানা ২৪ ঘন্টা পানি পান না করে তৃষ্ণায় ছটফট করতে থাকে আর হুট করে তার সামনে পানি এনে রাখা হয় তবে কেমন হবে সেই মানুষটার প্রতিক্রিয়া? নিশ্চয়ই সে উন্মাদের ন্যায় সেই পানি কেরে নিয়ে পান করবে।তখন ঠিক কেমন শান্তি অনুভূত হবে সেই মানুষটির?

মিয়ামি ও আর্শের মনের অবস্থা ঠিক এমন।উভয়ই যেনো প্রেমে উন্মাদ এখন,বেপরোয়াও বটে।
আর্শের বুকে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে মিয়ামি।চোখ ভিজে একাকার তার।তবুও তৃষ্ণার্থ হৃদয়ে এক টুকরো তৃপ্তি আকাশে মেঘের মতো ছেয়ে আছে।সে ঠোঁটে তৃপ্তির ছাপ ফেলে জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে ওঠে,
“কেউকে এক পলক দেখার তৃষ্ণা বুকের ভেতর এমন তীব্র ঝড় তোলে?”

উত্তরে কিছু বললো না আর্শ।নিজের সর্ব শক্তি দ্বারা হৃদমাঝারে আঁকড়ে ধরলো সে তার স্ত্রীকে।পারছেনা যেনো নিজের হৃৎপিণ্ডে এই মানবীকে শুষে নিতে। খুব যত্নে তাকে সেথায় আগলে রাখতে। মিয়ামিও যেনো মিশে যেতে চাইছে আর্শের মাঝে।উভয়ই মিলেমিশে একাকার হতে চাইছে যাতে কারো সাধ্যে না কুলায় তাদের আলাদা করা।

দুই ব্যথিত হৃদয়ের অধিকারী মানব-মানবীর দু’জোড়া আঁখি ভিজে আছে দুঃখকণায়।অনর্গল দুঃখ কণাগুলো চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।কোনো বাঁধা নেই তাদের।কারণ বাঁধাদানকারী মানব, মানবী নিজেরাই আজ বেসামাল।
তীব্র তৃপ্তির ঘোর একটু কমলো, মনে পরলো বিষাদে ভরা সকল স্মৃতি।অভিমান, অভিযোগও ধীরে ধীরে জাগ্রত হতে আরম্ভ করলো।হটাৎ-ই মিয়ামির কান্নাও জোরালো হলো।জড়ানো কন্ঠে সে প্রশ্ন করে উঠলো,

“কেনো ফিরে গেলে তুমি ড্রাগস এর নেশায় আর্শ?কেনো? আমি কী কোনো কমতি রেখেছিলাম তোমাকে সুস্থ করার চেষ্টায়? নাকি আমার প্রণয় দূর্বল ছিলো?কেনো ফিরে গেলে তুমি সেই অন্ধকারে?কেনো আর্শ?”
উত্তর নেই আর্শের কাছে।অপরাধবোধের আগুনে প্রতিমুহূর্ত জ্বলেপুড়ে সে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।তার এ যন্ত্রণাগুলো, অনুশোচনাগুলো কেনো মিয়ামিকে স্পর্শ করছে না?কেনো তার চোখ দেখে মিয়ামি উপলব্ধি করতে পারছে না তার অসহায়ত্ব, নিজের ভুলে সে যে কতোটা লজ্জিত, নিজের কাছে সে নিজে কতোটা ঘৃণিত? কেনো বুঝতে পারছে না মিয়ামি?
মনে অভিমান জমলো খানিক।নিজের প্রতি বাড়লো ঘৃণানুভূতি।আর্শ শিথিল করলো তার বাহুবন্ধন।এক হাতে মিয়ামির মুখ উঁচু করে তুলে ধরলো।মিয়ামি চোখ মেলে তাকালো।তার চোখে চোখ রাখলো আর্শ।নিম্ন স্বরে বলে উঠলো,

-খারাপ কিছুর সাথে জড়িয়ে যাওয়া ভীষণ সহজ মিয়ু।কিন্তু খারাপের থেকে বেরিয়ে আসা শতগুণ বেশি কঠিন।আমি এই কঠিন কাজটা করার সাহস পেয়েছিলাম তোমার হাত ধরে,আমাদের প্রণয়ের আসক্তিকে অবলম্বন করে।কিন্তু ঐযে শতগুণ কঠিন!

এতোটুকু বলে থামলো আর্শ।তার গলা শুকিয়ে যেনো কাঠ হয়ে আছে।কথা আঁটকে আঁটকে যাচ্ছে। তবুও জিহ্বা দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে পুনরায় বলতে আরম্ভ করলো,
-অফিসের কাজে বাইরে যেতে হয়েছিলো সেদিন।সাথে ছিলো এক কলিগ।অফিসের গাড়িতে শুধু আমরা দু’জনই। অন্য কেউ নেই। তার নেশা উঠলো। পকেট থেকে কিছু বের করে খেলো।সে হয়তো ভেবেছিলো আমি বুঝবো না।
সে মুহূর্তে আমার মাঝে কিছু একটা হলো। নেশা উঠে গেলো।মৃদু কাঁপুনি শুরু হলো শরীরে।মন বলে উঠলো, একবার একটু খেলে কিচ্ছু হবে না।আজই একটু খাই আর কখনো খাবো না।

ওটাই ছিলো আমার সব থেকে বড় ভুল।ব্যাস! একবারই করবো ভেবে কোনো খারাপ কাজে মানুষ জড়ালে কখনোই সেটা শুধু মাত্র একবারে শেষ হয় না।কখনো না।বরং “শুধু একবার” এটাই সবথেকে বড় ফাঁদ যাতে মানব মন ঠিকই ফেঁসে যায়। আমি ফেঁসে গিয়েছিলাম মিয়ু।নিজেকে আটকাতে বহু চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ঐযে “শুধু একবার” একটু খেলে কিচ্ছু হবে না,এই ফাঁদে পা দিয়ে দিয়েছিলাম।

সবটা বলে থামে আর্শ।খানিকটা সরে দাঁড়ায় সে মিয়ামির থেকে।নুইয়ে নেয় নিজের মাথা।চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পরে এক বিন্দু অনুশোচনা।নিম্ন স্বরে সে একটি শব্দ উচ্চারণ করে ওঠে,
“স্যরি”

আর কিছু বলার শক্তি খুঁজে পেলো না আর্শ।নিজের প্রতি ঘৃণা, অনুশোচনা সব যেনো গলা চেপে ধরে আছে তার।
হুট করে হাঁটু গেড়ে বসে পরলো সে।মিয়ামির পেটের কাছে কিছুটা এগিয়ে গেলো।দু’হাতে মেয়েটার কোমড় জড়িয়ে ধরে কপাল ঠেকালো পেটে।চোখ হতে অনুশোচনা নাক বেয়ে গড়িয়ে পরছে তার। ধীর স্বরে একই বাক্য বারংবার আওড়াতে আরম্ভ করলো ছেলেটা,
“স্যরি বাবা,স্যরি,স্যরি,স্যরি”

ঘুম নেই সানিয়া বেগমের চোখে।দুশ্চিন্তা ঘিরে আছে তাকে।আর্শ-মিয়ামির মাঝে কি হয়েছে? নিশ্চয় বড় ধরনের কোনো ঝামেলা।নাহয় তাদের অনুপস্থিতিতে হটাৎ মিয়ামি নিজের বাবার বাড়িতে কেন যাবে?আর আর্শ তো এ অবস্থায় তাকে নিজের চোখের আড়াল হতে দিতেই নারাজ,সেখানে বাবার বাড়িতে যেতে দেওয়াটা ভীষণ অস্বাভাবিক।তবে কি হলো বাচ্চাদের মাঝে?আর্শ কি নিয়ে এতোটা ব্যথিত?ছেলেটার চোখই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে সে ভেতরে ভেতর কতখানি ভেঙে পরেছে।নিজের ছেলের এমন হৃৎপীড়া মা হয়ে তিনি কি করে সহ্য করে নেবেন?

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৬

নাহ,মিয়ামি ও আর্শ উভয়ের সাথেই কথা বলবেন তিনি।বিষয় যত জটিলই হোক তা সে ঠিক করবার আপ্রাণ চেষ্টা করবে।তবুও নিজের বাচ্চাদের এ পরিস্থিতিতে পড়ে থাকতে দেবেন না তিনি।

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৮