প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৮

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৮
লেখিকাঃ মাহযাবীন

মিয়ামি হাঁটু গেড়ে বসলো ঠিক আর্শের সামনে বরাবর।দু’হাতে খুব যত্নে তুলে ধরলো ছেলেটার অনুশোচনায় নুইয়ে পরা মুখশ্রী।রক্তিম বর্ণা চোখ জোড়া দৃষ্টি রাখলো মিয়ামির শান্ত সিক্ত চোখজোড়ায়।উভয়ই অপলক কয়েক প্রহর কাটিয়ে দিলো একে-অপরের চোখে চোখ রেখে।অতঃপর মিয়ামি শান্ত স্বরে গুছিয়ে নিজের মনের অবস্থা প্রকাশ করলো,

-একবার বিশ্বাস ভেঙে চুরমার হলে দ্বিতীয় বার বিশ্বাস করাটা ভীষণ দুঃসাধ্য লাগে।মনে ভয় ঢুকে যায়।দ্বিতীয় বার কী কেউ একি ভুলে ভাঙতে চায়?
আমিও চাই না।কিন্তু আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে চাই। একটা দ্বিতীয় সুযোগ দিতে চাই।শুধুমাত্র আমাদের এই ছোট্ট স্পন্দনের জন্য।আমার বিশ্বাস একজন প্রেমিক পুরুষ হারলেও একজন দায়িত্ববান বাবা হারবে না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আর্শ,পৃথিবীর সব বাবারা কিন্তু সন্তানের জন্য এক সমুদ্র ভালোবাসা বুকে পুষতে পারে না।কিছু কিছু পুরুষ বাবা নামেও কলংক হয়।কিন্তু আমি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে চিনি,তার চোখ পড়তে জানি।আমি জানি আমাদের সন্তান এই পৃথিবীর আলো দেখার আগেই তার বাবার এক আকাশ ভালোবাসার অধিকারী হয়ে গেছে।আর এই ভালোবাসার উপর আমার এক বিন্দুও সন্দেহ নেই।এই ভালোবাসার উপর ভরসা করেই আমি আবারও তোমাকে বিশ্বাস করতে চাই।তোমার ভালোবাসার আশ্রয়ে পুরোটা জীবন পাড় করে দিতে চাই।সব দম বন্ধ হওয়া অনুভূতি থেকে এখন আমি মুক্তি চাই আর্শ।আমি ভীষণ ক্লান্ত।

মিয়ামি কথা শেষ করতে না করতেই তার নেত্র যুগল অশ্রু বিসর্জন দিলো।তবুও নিরাশা নেই এই ক্লান্ত মুখশ্রীতে।বরং সে মুখ জুড়ে ঝলমল করতে লাগলো এক নতুন সূর্য উদয় হতে দেখার তীব্র আশা।

আর্শ নিরব রইলো খানিকটা সময়।শুধু চেয়ে রইলো মিয়ামির চোখ পানে।এইযে মিয়ামির এক একটা বাক্য আর্শের হৃদয়ে ছুরির আঘাতের ন্যায় আঘাতের ক্ষত সৃষ্টি করলো, লজ্জিত হলো সে ভীষণ,নিজের প্রতি ঘৃণা টা আরও বাড়লো তার এগুলোই কী সে নিরবে চোখে চোখে বুঝাতে চাইলো মিয়ামিকে?
নাকি বুঝার চেষ্টা করলো এক বিশ্বাস ভাঙা প্রেমিকা, একজন পরাজিত স্ত্রী, সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত এক মায়ের মনের হাল?

ক’সেকেন্ডের নিরবতা ভেঙে নড়েচড়ে উঠলো আর্শ,নাক টেনে চোখের মনি ঘুরালো আশপাশে।দুঃখকণাগুলোকে সংবরণ করে নিলো সে।নিজেকে সামলে নিয়ে নিজের বুকের মাঝখানটায় হাত রাখলো ছেলেটা।বলে উঠলো,
-এই হৃদয়ের মালিক(আল্লাহ) জানে মিয়ু কতটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা এই মানুষটা নিজেকে নিজে করেছে।জীবন থাকতে আর কখনো ঐ অন্ধকার আমাকে স্পর্শ করবে না।ওয়াদা দিলাম,এবার না প্রেমিক পুরুষ হারবে আর না একজন বাবা।

এক মুহুর্তও বিলম্ব করলো না ক্লান্ত মানবী।পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করলো সে তার মানুষটার প্রতি।বিশ্বাস, ভরসা, আস্থা ব্যাতিত ‘ভালোবাসা’ শব্দটা যেনো এক কৌতুক।যেখানে বিশ্বাস, ভরসা,আস্থা থাকে না সেখানে ভালোবাসা থাকে না,থাকা সম্ভব না।এই ভালোবাসার জোরেই তো মিয়ামি এতোটা বিশ্বাস রাখে এই মানুষ টার প্রতি।এবার মানুষ টা এ বিশ্বাস ভাঙতে দিবে না,একদম নাহ।এই ভরসা বুকে চেপে সে সিক্ত চোখ ও ঠোঁটে এক চিলতে হাসি নিয়ে লুটিয়ে পড়লো নিজের চিরশান্তির,নির্ভরতার আশ্রয়স্থলে।

আর্শ তার যত্নে মাখা স্পর্শে নিজের বুকে আরও নিবিড়ভাবে আঁকড়ে ধরলো তার স্ত্রীকে।কতগুলো দিন না এ যেনো কতগুলো বছর পর তারা উভয়ই খুঁজে পেলো তাদের প্রশান্তিময় কিছু বুকভরা নিঃশ্বাস।

“দোস্ত, তোর ভাবি আজ ঢাকা দিয়ে আসতেছে আমার সাথে দেখা করতে।কয় ঘন্টার জন্য এক রুম একটু খালি করে দিতে পারবি?”
দুপুরের রান্নায় ব্যস্ত বিহান।একার সংসার তার।মা-বোন থাকে শহরে।নিজের ঘরে নারীও সে,পুরুষ ও সে।কামায় ও সে,রাঁধে ও সে।সে নিজেই নিজের।এ অবশ্য তার ভালোই লাগে।স্বাধীন জীবন তার।কোনো বাড়তি ঝামেলা বলে কিছু নেই জীবনে, বিন্দাস।

রান্নার মাঝেই তার ফোনে উক্ত খুদেবার্তা এসে হাজির হলো।তার ছোট বেলার বন্ধু রায়ান এই বার্তা প্রেরক।বিহান এ খুদেবার্তায় চোখ রেখে মৃদু তাচ্ছিল্যের হাসি ঠোঁটে টেনে নিলো।মনে মনে বলে উঠলো,
“এই হচ্ছে আজকালকার ভালোবাসা।ক’মাস প্রেম তারপর বিছানায় একজন আরেকজনকে সন্তুষ্ট করা।একসময় মন উঠে গেলে ব্রেকাপ।এখানেই শেষ নাহ!

ক’দিন পর আবারও একি কাহিনি শুধু পরিবর্তন হয় বিছানার সঙ্গী।”
ভাবনা হতে বেরিয়ে আসলো সে।ভাবলো ‘না’ বলে দিবে।কিন্তু পরমুহূর্তেই ভাবলো, এতে লাভ নেই।সবাই জানে তার বাসায় সে একাই থাকে।সুতরাং না বলে পাড় পাওয়া সম্ভব না যেমনটা আজ পর্যন্ত পায়নি সে।রুম ডেটের জন্য তার বাসাটাই যেনো এক আদর্শ হোটেল নামে খ্যাতি পেয়েছে তার বন্ধু মহলে।

টেবিলে বইখাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।পড়া তো দূরের কথা,গুছিয়ে রাখতে পর্যন্ত ইচ্ছে হচ্ছে না আর্শির।পড়াশোনা থেকে হুট করে এভাবে মন উঠে গেলো কেনো তার? এ প্রশ্নের জবাব পায় না সে।শুধু এতোটুকু জানে,মানসিক শান্তিটা তার নেই।মানুষের জীবনে কতই তো ঝড়-ঝঞ্ঝা থাকে,তার জীবনে তো এমন কিছুই নেই।তবুও কেনো বুকের মাঝে এমন শূন্য অনুভূতি?

কেনো এতো এতো ভালো থাকার মাঝেও তার মন ভালো নেই।মনের এ কেমন অসুখ?শুধু মাত্র একটা মানুষের অনুপস্থিতি কারো হৃদয়কে এতোটা শূন্যতা দিতে পারে তা জানা ছিলো না আর্শির।ছেলেটার স্মৃতি যখন ভীষণ পোড়ায় তাকে, আত্মসম্মান রক্ষার্থে একখানা খুদে বার্তা প্রেরণ করায় ও যখন তীব্র নিষেধাজ্ঞা থাকে তখন নেত্র যুগল অশ্রু বিসর্জনে মত্ত হয়।দম বন্ধ হয়ে আসে তার।নিশ্বাস নেওয়াটাও এতো কষ্ট? এতো কঠিন?

এলোমেলো বইগুলো থেকে দৃষ্টি সরায় আর্শি।বিরক্ত লাগছে তার সবকিছু।এই মিয়ামিটাও বাপের বাড়ি গিয়ে উঠে বসে আছে।নাহয় এখন তার কাছে ছুটে যেতো সে।এক অম্বর বিষাদের মাঝে অন্তত এক চিলতে সুখ খুঁজে পেতো।এখন এটাও সম্ভব না।

অপরদিকে,বিহানের সাথে তার সুন্দর সব স্মৃতি উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে হৃদয়ের এক কোণে।সুন্দর সেই নামহীন সম্পর্ক টার হুট করে ফ্যাকাশে, বিষাক্ত হয়ে যাওয়াটা মনে পড়তেই চোখে দুঃখ জমা হলো তার।ডায়রি কোলে রেখে কলম নিলো সে নিজ হাতে।নিজের কল্পনায় এক শহর আঁকলো।সেই শহরের বর্ণনা দিয়ে লিখলো ক’লাইন।লাইনগুলো,

“আপনার ও আমার একটা শহর হোক।এ শহর ভালোবাসাময়,প্রেমের হোক।রাগ,অভিমান, অভিযোগের যেনো মেলে না ঠাঁই। আর মিললেও একটু খানি অভিমান আকাশ সমান আদর দিয়ে গলানো হোক।রাগ,অভিমান,অভিযোগ সবটা অধিকারের সাথে অনেকটা কাছে টেনে,একটুখানী ব্যাখ্যা দিয়ে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়া হোক।আমাদের শহর টা ভালোবাসাময়, প্রেমের হোক।এ শহরে স্বপ্ন,আশা ভাঙ্গার বিকট শব্দ না হোক।এ শহরের বাতাসে বিচ্ছেদের হৃদয় পোড়া বিশ্রী গন্ধ না থাকুক।আপনার ও আমার, আমাদের একটা ভালোবাসাময়, প্রেমের শহর হোক।”

এক প্লেট খাবার হাতে মিয়ামির সামনে বরাবর বসে আছে আর্শ।এক এক লোকমা তুলে খাইয়ে দিচ্ছে সে নিজের স্ত্রীকে।বহু প্রতীক্ষার পর আজ মেয়েটা স্বেচ্ছায় খাচ্ছে।নিজের জন্য, নিজের বাচ্চার জন্য। নাহয় এতোদিন তো শুধু বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই মুখে তুলতো সে।
খাবার মাঝে আর্শকেও জোর করে খাওয়াচ্ছে মিয়ামি।আর্শ যে এ ক’দিন ঠিক মতো খায়নি তা ছেলেটার শুকনো মুখটাই সাক্ষ্য দিচ্ছে।

খাবার শেষে হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় আধশোয়া হলো আর্শ।মিয়ামিকে নিজের বুকে টেনে নিলো সে।মাত্রাতিরিক্ত প্রশান্তিতে চোখ বুজে নিলো মিয়ামি।প্রাণ ভরে কিছু নিঃশ্বাস নিজের মাঝে টেনে নিলো।এ সময় হুট করে আর্শ প্রশ্ন করে উঠলো,
“আব্বু-আম্মুকে (মিয়ামির বাবা-মা) কীভাবে মানাবো?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো মিয়ামি।আর্শের বুকে আরো নিবিড়ভাবে মাথা গুঁজে সে বলে উঠলো,
“কঠিন হবে কিন্তু অসম্ভব নাহ।”

এতোটুকু বলে একটু থামলো সে।পুনরায় বলে উঠলো,
“আচ্ছা তুমি কী সন্ন্যাসী ক্যাটাগরিতে চলে গেসো?মানে এতো দিন পর তোমার প্রেমিকার কাছে আসলা আর একটুও প্রেম উতলায়ে পরলো না তোমার? মা হচ্ছি দেখে কী আমাকে আর প্রেমিকা মনে হয় না তোমার? বয়স বেড়েছে আমার?মহিলা হয়ে গেছি?”

এমন প্রশ্নে মৃদু হাসলো আর্শ।মিয়ামি বিছানায় শুইয়ে তার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে নিম্ন স্বরে বলে উঠলো,
“এটা কী ঠিক হলো মিয়ু?এমন হাড়কাঁপানো শীতের সকালে গোসল করতে পারবা তো?”
বলেই চোখ মারলো ছেলেটা।মিয়ামির মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো দুষ্টুমি।সে দু’হাতে আর্শের গলা আঁকড়ে ধরে দুষ্টু কন্ঠে বলে উঠলো,

“নো ওয়ারিস মিস্টার।গরম পানিটা আপনাকে দিয়েই করাবো।”
উক্ত বাক্যখানা বলা শেষে মিয়ামি নিজেও চোখ মারলো।

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৭

[নানুভাইর অস্থায়ী নার্সের চাকুরী নিয়েছি।মাস গেলে কোনো বেতন নেই,লস প্রোজেক্ট!😒
এই লস প্রোজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত আমি☹️]

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৯