প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৩

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৩
লেখিকাঃ মাহযাবীন

শরীরে কম্পন উঠা শীতের রাতে মিয়ামির বাড়ির সামনে বেশ কয়েকঘন্টা যাবত দাঁড়িয়ে আছে আর্শ।স্ত্রী ও তার মাঝে বেড়ে ওঠা নিজের অংশটাকে এক ঝলক দেখার তীব্র মনোবাসনা তার।

এইতো ক’দিন আগেই সে জানতে পেরেছে তার একটা ছোট্ট অংশ পৃথিবীর আলো দেখবে খুব শীগ্রই।জানতে পারার পর থেকেই এক অদ্ভুত প্রগাঢ় মায়া অনুভব করে সে সেই ছোট্ট জানটার জন্যে।যে এখনো পৃথিবীতেই আসেনি তার জন্য এমন মায়া, ভালোবাসা তৈরি হওয়াটা খুব অদ্ভুত লাগে আর্শের কাছে।তার কাছে এ যেনো এক অলৌকিক বিষয়।প্রথম যেদিন জানলো তার অংশ পৃথিবীতে আসবে সেদিন থেকে,ঠিক সেই মুহুর্ত থেকে সে ভালোবেসে ফেলেছে সেই ছোট্ট জানটাকে।মরিয়া হয়ে আছে নিজের বাচ্চাটাকে কাছ থেকে অনুভব করার জন্যে, এক ঝলক দেখার জন্যে,একটুখানি আদর দেওয়ার জন্যে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মাঝে মাঝে ভীষণ হিংসে হয় আর্শের।সে ভাবে, মায়েরা কত সৌভাগ্যবতী।এইযে বাবারা ছটফট করে তার ছোট্ট অংশকে একটুখানি অনুভব করার জন্য, অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয় ৯-১০ টা মাস।মায়েদের তো এই ছটফটানি অনুভব করতে হয় না।এই ব্যাকুলতা কতখানি অসহনীয় তা তো তারা জানেই না।বরং বাচ্চার অস্তিত্ব,তার ধীরে ধীরে বেড়ে উঠা সবটাই মায়েরা সেই শুরু থেকেই অনুভব করতে পারে।তাদের মাঝেই বেড়ে ওঠে তাদের অংশ।
৫১ নম্বর কলটা মিয়ামি ধরার পর আর্শ অনুমতি পেয়েছিলো নিজের অভিমানীর দেখা পাওয়ার।এখন অপেক্ষা মিয়ামির আগমনের।

এ অপেক্ষা খুব একটা দীর্ঘ হলো না।মিয়ামিদের বাসায় গেটের কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় হটাৎ এক শব্দ কানে আসে আর্শের।কেউ খুবই সাবধানে গেটের তালা খুলছে।আর্শের বুঝতে অসুবিধা হলো না এটা কে।সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।

মিয়ামি তালা খুলে ইশারা করতেই আর্শ ঢুকলো বাড়ির ভেতর।এক নজর চাইলো নিজের স্ত্রীর পানে।অবাধ্য মনের বাধ্য হয়েই কোনোকিছুর পরোয়া না করে সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নিজের অর্ধাঙ্গীনিকে।পৃথিবী সবটুকু সুখ যেনো এ মুহূর্তেই আবদ্ধ ছিলো।

এই একটুখানি জড়িয়ে ধরায় হৃদয়ে উথাল-পাতাল শুরু হলেও অভিমান কমলো না অভিমানীনির।তার ক্রুদ্ধ হৃদয় নিষ্ঠুর হয়ে উঠলো।আর্শের বাহু বন্ধন হতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালালো।কিন্তু এক জোড়া বলিষ্ঠ হাতের বাঁধন হতে মুক্ত হতে পারলো না সে।কোনো শব্দ করলেই বাড়ির কেউ না কেউ টের পেয়ে যাবে। ফলে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতেও সময় নেবে বলে মনে হয় না মিয়ামির।তাই কোনো শব্দ করলো না সে।শুধু নিঃশব্দে আর্শকে নিজের থেকে সরানোর যথাসাধ্য চেষ্টা অব্যাহত রাখলো।

হৃদয় খানিক শান্ত হতেই হাতের বাঁধন সামান্য শিথিল করলো আর্শ।চাইলো মিয়ামির মুখ পানে।ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
“খুব নাহয় রাগ জমেছে তাই বলে না খেয়ে থাকবা?গলুমলু মুখটা এমন শুকায়ে ফেলবা?শুকায়ে হাড্ডি বের হয়ে গেলে কী আমি কামরায়ে মজা পাবো?”

“কুহেলির মা?ও কুহেলির মা?শুনতিছো?”
সবে মাত্র চুলোয় ভাত বসিয়েছেন কুহেলির মা অর্থাৎ কবরী বেগম।স্বামীর ডাকে তৎক্ষণাৎ তিনি বেরিয়ে এলেন রান্নাঘর হতে।শাড়িতে হাত মুছতে মুছতে বলে উঠলেন,
-কি হইছে গো?ডাকতিছেন যে?

-শোনো,জরুরী কথা।কুহেলির বিয়ের বিষয় ডা ভাইবে দেহিছো?
-ভাবছি।
-তা কি মত তোমার? আইজ বেইন্নেবেলা(সকালে) শীতলের সাথে দেহা হইছিলো। ও আবার কইলো এহন এইসব না ভাবাই ভালো।

-শীতলের আর কত হইছে বয়স?ও কী-ই বা বুঝে?আপনি আবার ওর কাছে বলতি গেলেন ক্যান? মাইনষের নজর ভালো নাকি? কারো ভালো কারো সইহ্য হয়? আমাগো ভালো ডা আমাগোই বুঝা লাগবে।
স্ত্রীর কথায় খানিকক্ষণ নিরব রইলেন কামরুল সাহেব।কি জানি ভাবলেন। অতঃপর বলে উঠলেন,
-ঢাকা দিয়া আইজ কল আইছিলো।তারা কয়দিনির মধ্যিই আসতি চাতিছে।এক কাজ করো,মাইয়ার সাথে কথা কও।ও কী চায় তা শুনতি হবে আগে।

আর কথা বাড়ান না কবরী বেগম।স্বামীর কথায় সম্মতি দিয়ে কেবল মাথা নাড়ালেন।
সামান্য দূর হতে কেউ একজন শুনলো তাদের কথোপকথন।দাঁড়ালো না আর।কথোপকথন শেষ হতেই সে ব্যক্তি ছুটলো নিজের কক্ষের দিকে।ঠোঁটে তার এক ছোট্ট হাসি।কক্ষে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিলো সে।দরজায় ঠেক দিয়ে দাঁড়িয়ে চোখ বুঁজে নিলো নিজের।তার কানে বেজে উঠলো,

“আইজ বেইন্নেবেলা শীতলের সাথে দেহা হইছিলো। ও আবার কইলো এহন এইসব না ভাবাই ভালো।”
মুহুর্তেই ঠোঁটের হাসি প্রশস্ত হলো।এ হাসির মালকিন কুহেলি।মনে মনেই সে নিজেকে প্রশ্ন করে উঠলো,
“শীতল ভাই আমার কথা রেখেছেন? কেনো রাখলেন? উনিও কী তাহলে চান যে এ বিয়েটা যেনো না হয়? কেনো চান? এমন নয় তো যে উনিও মনে মনে?”

আর ভাবলো না কুহেলি। এর থেকে বেশি ভাবতে ভীষণ ভয় হয় তার।আশা ভেঙ্গে যাওয়ার মতো কষ্ট টা সে সইতে চায় না।তাই এতো উঁচু আশা সে রাখতেও চায় না নিজের অন্তরে।

“স্যরি স্যরি স্যরি।
ঘুম ভাঙেনি তাই দেখা করতে আসতে পারলাম না।মাত্র একটা কল কেন দিসো?আরো কয়েকটা দেওয়া গেলো না?”
বিহানের এ ম্যাসেজ খানা চোখে পড়লো আর্শির।পরমুহূর্তেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো সে নিজের।এই মানুষটার কাছে যদি তার গুরুত্ব থাকতোই তাহলে তাকে আর কল করে জাগাতে হতো না।বরং সে নিজ দায়িত্বেই উঠে যেতো।

দেখা করার জন্য যে উত্তেজনা আর্শি নিজের মাঝে অনুভব করছিলো তার সামান্য পরিমাণও যদি বিহান অনুভব করতো তাহলে হয়তো এক নির্ঘুম রাত আর্শি ও বিহান উভয়েরই হতো, আর্শির একার নয়।এসব ভাবতেই চোখ সামান্য জ্বলতে আরম্ভ করলো আর্শির।হয়তো হৃদয়ের মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরতে চাইছে।কিন্তু অনুমতি পেলো না।আর্শি নিজের অভিমান নিজের মাঝেই চেপে রাখলো।

চাপা অভিমানে ভেতরে ভেতরেই পুড়ছে মেয়েটা,বাইরে তো ঠিকঠাক, ফিটফাট।
প্রথমে ম্যাসেজ খানা উপেক্ষা করতে চাইলো সে।কিন্তু করলো না।সে চাইছে না যে বিহান বুঝুক তার কষ্টটা।বুঝলে হয়তো সে ছোট হয়ে যাবে বিহানের কাছে।তাই সিদ্ধান্ত নিলো সে বেপরোয়া ভাবেই কথা বলবে।তার কষ্ট, অভিমান টা নাহয় তার পর্যন্তই থাক।এক তরফা ভালোবাসা হলে এমন কতো কিছুই তো লুকিয়ে নিতে হয়।

এক তরফা ভালোবাসায় কি অধিকার থাকে?অভিযোগ থাকে?
কই না তো।এক তরফা ভালোবাসায় যেটা সবথেকে বেশি থাকে সেটা হলো অসংখ্য লুকোনো অভিমান।

অন্ধকার কক্ষের খোলা জানালা ভেদ করে রাস্তার হলদে নিয়ন আলো ঘরে প্রবেশ করছে।সেই সাথে প্রবেশ করছে শীতল হাওয়া।এই হাওয়ায় দুলছে মিয়ামির কেশ।মেয়েটার দৃষ্টি অবনত।মুখ হয়ে আছে ভার।রাগ,ক্ষোভ, অভিমান, দুশ্চিন্তা, অনিশ্চয়তা এমন সব অনুভূতি মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে তার অন্তর জুড়ে।কেমন শূন্য শূন্য অনুভব করছে সে।কি করা উচিৎ তার এখন?কি করবে সে?অভিমানে গাল ফুলিয়ে রাখবে?নাকি অভিযোগের ঝুড়ি খুলে বসবে?

উহু,এতে সমাধান নেই।মা-বাবা যেকোনো সময় তালাকের কাগজ নিয়ে হাজির হবে,তার সই চাইবে।আর এমনটা হওয়ার আগেই পরিস্থিতি সামলে নিতে হবে।বাপের বাড়ি ও শশুর বাড়ি উভয়কেই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে হবে তার।।বাবা-মা শেকড় হলেও স্বামী, সন্তানকে তুলনা করা যায় ফলমূল, পাতা,কান্ডের সাথে।না মিয়ামি শেকড় উপরে ফেলা গাছ হতে চায় আর নাহ সে ফলমূল,পাতা বিহীন এক মরা গাছে রুপান্তরিত হতে চায়।

এসব ভাবনার মাঝেই হটাৎ মিয়ামি তার গালে এক ঠান্ডা হাতের স্পর্শ অনুভব করে।সাথে সাথে সামান্য কেঁপে উঠে সে। দৃষ্টি উঠিয়ে তাকায় নিজের সামনে বরাবর।এক জোড়া অপরাধবোধে সিক্ত চোখে চোখ পরে তার।নিরব মিয়ামির আরও কাছে এসে বসে আর্শ।এক হাত দ্বারা মিয়ামির হাত চেপে ধরে সে নিম্ন স্বরে বলে ওঠে,

-আমি খুব চেষ্টা করেছিলাম মিয়ু।বিশ্বাস করো, খুব চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পারিনি নিজেকে আটকাতে।টানা ৬ মাস পর ওভাবে নেশা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে তা আমি কল্পনাও করিনি।বিশ্বাস করো আমি রেগুলার ড্রাগস নেইনি।অনেক সামলাইসি নিজেকে কিন্তু পুরোপুরি ছাড়তেও পারিনি এই অভিশপ্ত আসক্তি।আমি আমার ওয়াদা রাখতে পারিনি।আর এই অপরাধবোধ স্লো পয়সনের মতো আমাকে ধীরে ধীরে শেষ করে দিচ্ছে,মিয়ু।আমি সত্যিই ভীষণ অনুতপ্ত।

এতোটা সময় নিরব মূর্তির মতো বসে রইলেও এবার যেনো অনুভূতির সঞ্চার ঘটলো মিয়ামির মাঝে।চোখ জোড়া সিক্ত হয়ে উঠলো মুহুর্তেই।ভেজা গলায় সে বলে উঠলো,
-আমার প্রণয়,চেষ্টা বা সাধনাতেই হয়তো ত্রুটি ছিলো আর্শ।তাই তো পরাজয় টা আমার প্রণয়-আসক্তির হলো।

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ২

[ভীষণ ব্যস্ততায় কয়টা দিন কাটলো।ইন শাহ আল্লাহ এতো দেরি হবে না আগামী পর্বগুলোতে।
নিজেদের মন্তব্য জানাতে ভুলবেন না যেনো পাঠক মহল♥️]

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৪