প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ২

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ২
লেখিকাঃ মাহযাবীন

মাঝারি আকারের একখানা রুম।যার দক্ষিণ দিকটায় এক মস্ত বড় জানালা।আর জানালার ধারেই পাতানো বিছানাটায় চুপটি করে বসে আছে মিয়ামি।জানালার ফাঁক হতে চাঁদের রুপালী আলো সরু পথে প্রবেশ করছে তার রুমে।আলোকিত করে রাখছে সমস্ত রুমটা।আর তারই দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মেয়েটি।চোখে পানি নেই,মুখশ্রীতে নেই কোনো দুঃখের ছাপ।তবুও হৃদয়ে অসহ্য জ্বালাপোড়া।

এই ‘হৃদয়’ নামক অঙ্গ টা না থাকলে হয়তো মানুষের জীবনের অনেক জটিল সমীকরণও অনেকটা সহজ হয়ে যেতো।এইযে এতো দহন, এতো শ্বাসরুদ্ধকর কষ্ট, এতো জ্বালাপোড়া হয়তো সইতে হইতো না কারো।
মিয়ামির কাছে তার বর্তমান অবস্থা টা এমন যেনো তার জীবনের সকল সমীকরণগুলো উল্টেপাল্টে জটলা পাকিয়ে উচ্চতর গণিতের যোগজীকরণের অংকগুলোর মতো জটিল রূপ ধারণ করেছে।যার আগাগোড়া সবটাই কঠিন মনে হচ্ছে তার।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

একই সময়ে নিজের কাছে নিজেকে হারতে দেখছে সে,নড়েচড়ে উঠছে তার দৃঢ় বিশ্বাস ও।এইতো প্রায় একটা বছর আগেই নিজেকে জয়ী ঘোষণা করে সে ভেবে নিয়েছিলো তার ‘আর্শ আসক্তি’ জিতে গিয়েছে।কিন্তু ক’দিন আগেই জানতে পারলো সে ভুল।আসলে তার সেই জয় ছিলো ক্ষণিকের।আর্শের ড্রাগ আসক্তির কাছে হেরে গিয়েছিলো তার প্রণয়।তাই তো আর্শ আবারও সেই ড্রাগ আসক্তিতে জড়িয়ে পরে।

নিজের হেরে যাওয়া প্রণয়ের পীড়া,নড়বড়ে বিশ্বাস ও এক সমুদ্র অভিমান নিয়ে বাপের বাড়ি আসতে না আসতেই বাবা-মা তাদের সিদ্ধান্ত শুনিয়ে দিলো, ‘তালাক’।
মনের মানুষ ছাড়া মন বাঁচে? মন না বাঁচলে মানুষ বাঁচে? আর্শ ছাড়া মিয়ামি বাঁচবে?
কই,আর্শের থেকে একটু দূরে আসলেই তো তার দম বন্ধ লাগে। তাহলে কি করে সে কাটাবে পুরো একটা দম বন্ধ জীবন? বাবা-মা কেনো বুঝেন না এ তীব্র হৃৎপীড়া?

উক্ত প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই মিয়ামির চোখ পরে তার ফোনের স্ক্রিনের দিকে।আর্শের একের পর এক কল আসতে আসতে কলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫০।
এবার যেনো একটু দয়া হলো মিয়ামির। ৫১ নম্বর কল ঢুকতেই কল রিসিভ করে কানে লাগালো সে।অভিমানে ভোকাল কর্ড দ্বারা উৎপন্ন হলো না একটি শব্দও।দু’পক্ষই নিরব রইলো খানিকক্ষণ।অতঃপর আর্শের নিস্তেজ কন্ঠস্বর কানে আসলো মিয়ামির।অপরাধী স্বরে ছেলেটা বলে উঠলো,
“একটু দেখা কর, বউ।আমার বাচ্চা টা তার পাপাকে ভীষণ মিস করছে আর তার পাপা প্রতিটা মুহূর্ত মরছে।”

গায়ে মোটা চাদর জড়িয়ে উঠোনে পেতে রাখা ছোট্ট খাটটার কিনারে বসে পা দোলাচ্ছে আর্শি।ঠোঁটে তার এক বৃহৎ হাসি।চোখমুখে ছেয়ে আছে মুগ্ধতার ছাপ।হৃদয় জুড়ে সুখানুভূতির রংধনু তার।
এতো কেনো ভালো লাগা কাজ করে ভালোবাসার মানুষটার একটুখানি কাছে গেলে?কেনো মানুষটাকে এক ঝলক দেখলেই হৃদয়জুড়ে বন্যা হয় সুখের?কেনো তার ঠোঁটের হাসিটা বুকে তীরের মতো এসে বিঁধে যেনো ঐ হাসিতেই প্রেমিক বা প্রেমিকার সর্বনাশ?

এসব ভাবতে ভাবতেই ঠোঁটের হাসিটা আরও খানিক বৃহৎ করে নেয় আর্শি।চোখ বুঁজে স্মৃতিচারণ করে আজ সকালের।ঐযে বিহানের সাথে হওয়া দেখা, এক আবেগমাখা কথোপকথনের পর বিহানের বাইকে চড়া,বাইকে চড়ার সময় বিহানের কাঁধে আলতো করে হাত রাখা।আহা! ভালোবাসার মানুষটার শরীরে এই প্রথম স্পর্শ, একটুখানি ছোঁয়া আর এক সমুদ্র অনুভূতি।
তারপর বাইকে উঠতেই বিহানের পেছনে ফিরে আর্শির দিকে তাকিয়ে চিন্তিত কন্ঠে বলে ওঠা,

“কাপড়ের দিকে খেয়াল রাখো,চাকায় না পেঁচিয়ে যায়”
উক্ত উক্তি খানা মনে পড়তেই ভালোলাগা বেড়ে যায় আর্শির।মনে মনেই সে প্রশ্ন করে ওঠে,
“এর নামই কী যত্ন না?”

নিজের প্রশ্নের উত্তর আর খুঁজলো না আর্শি।হৃদয়ের ভালোলাগাগুলোকে বড় যত্নে কুড়িয়ে রাখছে সে।
এরই মাঝে বিহানের ম্যাসেজ আসে তার ফোনে।সব সময়ের মতোই সাধারণ কথোপকথন চলছে তাদের। বিহানের ম্যাসেজের উত্তর দিতে দিতেই হটাৎ আর্শির হৃদয় এক আবদার করে বসলো।অবাধ্য, লোভী মনটা আরো একবার তার ভালোবাসার মানুষটার সান্নিধ্য চায়।চায় আরেকটা বার কাছ থেকে দেখতে, আরেকটা বার একটু ছুঁয়ে দিতে,আরেকটা বার এমনই সুখানুভূতি কুড়াতে।
বিলম্ব করলো না আর্শি।হৃদয়ের আবদার রাখতে বিহানকে ম্যাসেজ দিয়েই বসলো,

“কাল আসবেন দেখা করতে?”
“কেনো?”
“ইচ্ছা”
“আচ্ছা”
“সত্যিই আসবেন???????”
“কল দিও সকালে”
আর্শির আনন্দ যেনো সীমানা ভুলে বসলো।ঠোঁটে বিশ্বজয়ের হাসি টেনে চোখ বুজে নিলো সে।মনে মনে নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে বসলো,
“এতো সুখ কেন ভালোবাসায়?”

রাতের অন্ধকার বিদায় নিয়ে ভোরের আগমন হতেই প্রায় সকল মুসলিম ঘরে ঘরে সব পুরুষেরা লেপের উষ্ণতা ছেড়ে কাঁপতে কাঁপতে ওজু সেরে মসজিদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।
ব্যাতিক্রম নন কুহেলির বাবা কামরুল সাহেবও।প্রতিদিনের ন্যায় আজও তিনি মাটির রাস্তা ধরে হেঁটে চলছেন মসজিদের উদ্দেশ্যে।এমন সময় হটাৎ সেথায় উপস্থিত হয় শীতল।কামরুল সাহেবের কাছে এসে সে বলে ওঠে,

-আসসালামু আলাইকুম চাচা,ভালো আছেন?
-আরে শীতল বাপজান নাকি?ওয়া আলাইকুমুস সালাম।এতো ভোরে তো তোমারে হারিকেন দিয়া খুঁজেও পাওয়া মুশকিল। তা আজ এতো সহজে সাক্ষাৎ পাইলাম যে?
শীতল ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি টেনে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে ওঠে,

-না মানে চাচা ঘুম ভেঙে গেসিলো তাই ভাবলাম নামাজ কাজা না করি।
-তুমি নামাজ পড়ো নাকি শুক্রবার ছাড়া?
কামরুলের এহেন প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে পরে শীতল।কী উত্তর দেবে ভেবে না পেয়ে নিরব রয় সে।শীতলের অবস্থা বুঝে মুচকি হাসেন কামরুল সাহেব।ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে বলে ওঠেন,

-তোমাগো মতো তাগড়া যুবকেরা নামাজে আসলে জম্মের ভালো ঠেহে।মনে হয় কিয়ামত এহনো দূরে।মেলা ভালো ঠেকতিছে তোমারে নামাজে আসতে দেইহে।
ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো শীতলের। মনে স্বস্তি অনুভব করলো সে।ভাবলো,এখন থেকে নামাজ ধরার চেষ্টা টা অন্তত সে করবে।

কয়েক সেকেন্ড কেটে গেলো নিরবতায়।দু’জন হেঁটে চলছে যে যার মতো পাশাপাশি।শীতল দ্বিধা নিয়েই নিন্ম স্বরে কামরুল সাহেবকে প্রশ্ন করলো,
-চাচা,শুনলাম কুহুর বিয়ের কথা ভাবতেছেন?
ব্রু কুঁচকালেন কামরুল সাহেব।পাল্টা প্রশ্ন করে উঠলেন,
-তুমি কোহানতে শুনছো?
প্রশ্ন এড়িয়ে শীতল বলে উঠলো,

-ব্যাপার টা যদিও আপনার ব্যক্তিগত তাও চাচা একটা কথা বলবো,এখন অন্তত এই চিন্তা কইরেন না।কুহুর তো এখনো বিয়ের বয়স হয় নাই।
হাঁটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়লেন কামরুল সাহেব।চোখমুখ জুড়ে ফুটে উঠলো চিন্তের ছাপ। তিনি চিন্তিত কন্ঠে বলে উঠলেন,
-হ বাপজান,কুহেলি এহনো ছোটো এতে সন্দেহ নাই।কিন্তু ঢাকা দিয়া ভালো একখান প্রস্তাব আইসে।এমন ভালো প্রস্তাব ফিরাইয়ে দিতিও ইচ্ছা করতিছে না।কুহেলি তো সেইরাম ছোটও না,মোটামুটি তো বোঝে আর ছেলে পক্ষ দেইহে পছন্দ করলি পরে নাহয় একটু সময় চাইয়ে নিলাম।মানে ১-২ বছর আরকি।

উত্তরে বলার মতো যেনো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না শীতল।কিংবা হয়তো সে খুঁজছেই না।কোথা থেকে যেনো এক আচমকা ভয় এসে চেপে ধরেছে তাকে।এমন গলা-বুক শুকিয়ে আসছে কেনো তার?কী হারানোর এতো ভয় হচ্ছে তার?

এক বোতল আখের রস হাতে কুহেলি এসে দাঁড়ালো আর্শির নানু আছিয়া বেগমের সামনে।হাতের বোতল টা আছিয়া বেগমের দিকে এগিয়ে দিয়ে সে বলে উঠলো,
“দাদী,আম্মা আপনার জন্যি পাঠাইছে”

কাজের ব্যস্ততায় প্রথমে কুহেলির উপস্থিতি টের না পেলেও কুহেলির কন্ঠস্বর কানে আসতেই তার দিকে তাকায় আছিয়া বেগম।ঠোঁটে বড় হাসি টেনে সে বলে ওঠে,
-বয় কুহু, এদিক মোটে আসিস-টাসিস না। কাহিনী কি?
-কিছু না দাদী, এমনিই।আর্শি আপু কই?
-ঘরেই তো।যা ঘরে যাইয়ে দেহা কইরে আয়।

অনুমতি মিলতেই ঘরে ঢুকলো কুহেলি।জোরে ডাকলো আর্শির নাম ধরে। প্রথম ডাকেই সাড়া মিললো।
আর্শির কক্ষে ঢুকতেই কুহেলি দেখলো আর্শি বোরকা পড়ে বসে আছে। ব্রু কুঁচকালো সে।প্রশ্ন করে উঠলো,
-কোথাও যাবা আপু?
ফোনের স্ক্রিন হতে দৃষ্টি উঠিয়ে কুহেলির দিকে তাকালো আর্শি।ঠোঁটে এক উদাসীন হাসি টেনে বলে উঠলো,

-ভাবছিলাম হাঁটতে যাবো।এখন নাও যেতে পারি হয়তো।
-কেনো?
-এমনিই।
-মন খারাপ তোমার?ঠোঁটের হাসি ডা এইরাম মলিন কেন?
এ প্রশ্নে হাসি প্রশস্ত করে আর্শি।বলে ওঠে,
-কই না তো।মন তো ভালোই।

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ১

আর্শির কথায় খুব একটা বিশ্বাস করতে পারলো না কুহেলি।তবে আর কোনো প্রশ্নও করলো না সে।মনের অবস্থা তারও কী খুব ভালো?কই না তো।সেও তো কেউকে কিছু বলতে পারে না।এই মন খারাপ তো তার একান্তই নিজের।

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৩