উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১১

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১১
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

নিশুতি রাত। চারদিক নিস্তব্ধ, নির্জন। অন্ধকার ঘরে প্রহর গুনছে ঊর্মি। আলোর আড়ালে অন্ধকার তার ভীষণ প্রিয়। অন্ধকারে নিজের মুখোমুখি হওয়া যায়।
রাহাতের এই ব্যাপক পরিবর্তন মানতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। এক্সি*ডেন্ট এর প্রথম দিকের দিন গুলো ছিলো অন্যরকম। রাহাতের পুরুষালি সৌন্দর্যে ম্লান হওয়ার ছাপ।

জ্ঞান ফেরার পর স্পষ্ট মনে আছে ঊর্মির, দীর্ঘসময় মুদিত নয়ন জোড়া জাগ্রত হতেই নতমস্তকে, চিকচিক করা রক্তিম একজোড়া চোখ দেখেছিলো। রাহাতের গালে জলের ছাপ তার নৈঃশব্দ কান্নার প্রমাণ ছিলো। ঊর্মির রুগ্ন হাতটি মুঠোয় নিয়ে শব্দহীন ভালোবাসার প্রকাশ। রাতভর তার পাশে ছায়ার মতো থেকে ভরসায় আশ্বস্ত করা মানুষটি কয়েকদিনেই কেমন বদলে গেলো। চেনা মানুষের অচেনা রূপ বড্ড যন্ত্রণা দিতো ঊর্মিকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এসে একনজর দেখেই কেমন উধাও হয়ে যেত। দুটো কথা বলার প্রয়োজন মনে করেনি। হয়তো ভালোবাসা নিঃশেষ হয়ে শেষ দায়িত্বটুকু পালন করতেই তার আসা-যাওয়া ছিলো। সে হয়তো বুঝে গিয়েছিলো শুধু আত্মিক মিলনেই সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া যায়না। সম্পর্ক এগিয়ে নিতে ভালো বোঝাপড়ার সাথে সাথে সুন্দর, সুশ্রী হওয়া লাগে। শারীরিক ভাবে সক্ষমতা থাকা লাগে।

কিন্তু ভালোবাসা কি এতটা বাচবিচার করে হয়? নাকি ভালোবাসা বলতে কিছুই নেই।
যদি ভালোবাসা সত্যিই থাকতো, রাহাত কি পারতোনা তার হাত দুটো মুঠোয় পুরে শক্তি জোগাতে। মাথায় হাত রেখে আশ্বস্ত করে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার অনুপ্রেরণা জাগাতে? অথচ সে মাঝপথেই ছেড়ে বসলো। এখন আবার নতুন কিছুর আবির্ভাব ঘটাতে চাইছে। ঊর্মি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

এই যে তাকে স্বাভাবিক রূপে ফিরিয়ে আনার জন্য বাবা-মায়ের এত তোড়জোড়, তার কষ্ট সইতে না পেরে ঊষার বো*কা*মো। তাকে নিয়ে সবার ভাবনা, যত্ন গুলো ভীষণ প্রশান্তি দেয় মনে। কিন্তু কোথাও না কোথাও তার মন ঠিকই জানান দেয় আগের রূপে, আগের জীবনে ফিরলেই বাবা তাকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। ঊর্মি কতটা সুখী হতে পারবে? সদ্য ভাঙা মন নিয়ে তাকে আজীবন চলতে হবে। রাহাত তাকে যতটা ভালোবাসতে বাধ্য করেছে, ততটা ভালো কেন? তার একচিমটি পরিমাণ ও কাউকে ভালোবাসতে পারবেনা।

চোখ সয়ে যাওয়া অন্ধকারে হুট করেই মনে পড়লো সেদিনের পার্সেলের কথা। ড্রেসিং টেবিলের উপর অগোছালো পড়ে থাকা বাক্সে নজর দিলো ঊর্মি। ফোনের ফ্ল্যাস অন করে তাক করলো সেদিকে। সেদিন খুলতে গিয়েও খোলেনি। বাবা এসেছিলেন বলে পাশেই রেখে দিয়েছিলো। এখন একবার আগ্রহ জাগলো। খাটে ভর ছেড়েই হাত বাড়িয়ে বাক্সটি টে*নে নিলো। ফোনের ফ্ল্যাস জ্বালিয়ে বাক্স খুলে দেখলো।

একটা চকচকে শাড়ি। যেন নিখুঁত হাতে গড়া শাড়িটি। চোখ ধাঁধিয়ে গেলো ঊর্মির। শাড়ির সাথে ছিলো চোখে টা*না*র লম্বা একটি কাজল।
হলুদে কাগজে নিপুণ হাতে গোটাগোটা অক্ষরে লিখা,
❝প্রিয় ঊর্মিমালা
প্রিয় থেকে তোমার অপ্রিয়দের কাতারে হয়তো আমি প্রথম স্থান অধিকার করে নিয়েছি। ছন্নছাড়া এই জীবনে তোমাকে যে আমার ভীষণ প্রয়োজন।

নিজের পর্বতসম অ*ন্যা*য়ে*র শা*স্তি হিসেবে কোটি বছর তোমার পদতলে বসে থাকা আমি মাথা পেতে নেবো।
তোমাকে ছাড়া ভালোরা আমায় ছুঁতে পারেনা, বিষন্নরা কেবল আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে। হেমন্তের ঝরা পাতার মতো নেতিয়ে পড়ছি আমি। বুকের ভেতর খাঁ খাঁ করা রোদ্দুর, বর্ষার ঘন কালো মেঘ তোমার একটু খানি সান্নিধ্যে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামাতে চায়। তুমিহীনা বুকের বাঁ পাশটা চিনচিনের ব্যথার আভাস দেয়।

তোমায় দেওয়া কষ্টগুলো আমি শতগুণ রূপে ফেরত পেতে চাই। তবে যখনই মনে হয় তুমি পাশে নেই, তখন আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে তোলা জ্বর আমায় কাবু করে। তোমার কাছ থেকে ফেরত পাওয়া কষ্টগুলো সয়ে যাওয়ার জন্য আমার তোমাকে চাই। শোন, আমার তোমাকেই চাই। চোখ ধাঁধানো রূপের প্রয়োজন নেই। আমার চোখজোড়া ভীষণ সুন্দর। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর চোখজোড়ায় তোমাকে দেখবো। আমার ভেতরটাকে কাঁপিয়ে তোলার মতো সৌন্দর্য তুমি হীনা আর কারো মাঝে নেই।

তুমি পাশে থেকে আমায় মৃ*ত্যু*স*ম যন্ত্রণা দাও, আমি সয়ে নেবো।
বিশ্বাস করো, আমি ইচ্ছেকৃত কিছু করিনি। সবটাই আমাকে বাধ্য করে করানো হয়েছে। নতুন যে মেয়েটা এসেছে? তাকে আমি তোমার ঘুমানোর স্থান, আমার এই শক্তপোক্ত বুকে জায়গা দিই নি। যে দুটো ঠোঁট তোমাকে ছুঁয়েছে, তা অন্যকাউকে স্পর্শ করেনি। যে দেহ,মন তোমাকে টে*নে*ছে, তা অন্যকাউকে টা*ন*তে পারেনি।

আমি শুধু তোমায় ফেরত পেতে চাই। আমার জন্য, তোমার জন্য, আমাদের দুজনের ভালো থাকার জন্য আমাদের দুজনের দু’জনকে বড্ড প্রয়োজন। তোমায় নিয়ে হাজার বছর সংসার করা সুখ থেকে আমি বঞ্চিত হতে চাইনা। খোদার কসম করে বলছি আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। আমার একমাত্র গন্তব্য তুমি। তোমায় ফেরত পেতে হাজারটা ধাপ আমি পার করতে রাজি।

তুমি শুধু একবার আমার বুকে ফিরে এসো। আমি তোমার হাতে খু*ন হয়ে যেতেও রাজি।
ইতি
রাহাত ❞
টুপটাপ অশ্রুপাতে কচকচে কাগজটি দুমড়েমুচড়ে ফেললো। একটু আগে যে শাড়িটি চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিলো? তার স্থান হলে মাটিতে।

তাকে কাবু করার তীব্র প্রতিবাদ জানাতে ইচ্ছে হলো।
ইচ্ছেকে দমিয়ে নিজেকে সময় দিলো ঊর্মি। চোখ বুঝে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কচি কিশলয়ের মতো আঁখি পল্লব তিরতির করে কেঁপে উঠলো। গালে জমে রইলো দু-এক ফোঁটা মুক্তো দানার ছাপ। ফোনের ফ্ল্যাস অফ করে ঘুমিয়ে পড়ার উদ্দেশ্যই শুতে গেলো সে। সাইলেন্ট ফোনের তীব্র কাঁপুনি তাকে বাঁধা দিলো।

ফোনের স্ক্রিনে দেখলো রাহাত কল করেছে। এখন এটা তার রাত-দুপুরের কাজ। সময়ে-অসময়ে ফোন করা তার অভ্যেসে পরিণত হয়েছে।
ঊর্মি রিসিভ করলোনা। কয়েকবার রিং হয়ে কল কে*টে গেলো। মিনিট দুয়েক পর টুংটাং বার্তা এলো।
❝আমি জানি তুমি ঘুমাওনি। প্রতিটি রাত তোমার কিভাবে কা*টে, আমি ছাড়া কেউ ভালো জানবেনা। প্লিজ ঊর্মি একটা বার আমায় ক্ষ*মা করে দেখো। আমি সত্যিই অনুতপ্ত।❞

শত দ্বিধাদ্বন্ধ দূরে ঠেলে বার্তা ওপেন করলো।
সরাসরি ফোন দিলো রাহাতের নম্বরে। রিসিভ করেই রাহাত কথা বলার সুযোগ পেলোনা। ঊর্মির কঠোর স্বর তাকে রুখিয়ে দিলো। কাঠকাঠ গলায় জানতে চাইলো,
“তুমি কী চাও, বলোতো?”
রাহাতের নির্লিপ্ত জবাব,

-“তোমাকে।”
বিপরীতে ঊর্মির আরেকটি তীরের ঘা দেওয়া জবাব,
-“আমি চাই না।”
তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করলো রাহাত। ঊর্মির চেয়ে তার ব্যথা বেশি নয়। তবুও কোথাও একটা সহ্য করার ক্ষমতাটা তার নেই। রাহাত একটু অগোছালোভাবে হাসলো বোধহয়। শ্রান্ত, অবসন্ন, নিস্তেজ হয়ে আসা গলায় শুধালো,

-“আমি আজীবন তোমাকে চেয়ে যাবো।”
কল কে*টে গেলো। একতলা বাড়িটির বারান্দায় তাকিয়ে থাকা চোখজোড়া নত হয়ে এলো। আরও মিনিট দশেক অপেক্ষা করে বাড়ির পথে পা বাড়ালো রাহাত। প্রতিরাত দেরি করে বাসায় ফেরার একমাত্র কারণ এই বাড়ির মেয়েটি, তার প্রশান্তি।

বাড়িতে যেন নিয়মিতভাবে ঝা*মে*লা হওয়া চাই। বাড়ির পুরো নিয়মটাই যেন বদল ঘটলো। প্রথম থেকেই ঝ*গ*ড়া-বিবাদ নিয়ে যে বউয়ের রেকর্ড ছিলো? সেই রেকর্ড রীতিমতো বড় বউ ভেঙে গুঁড়ো করে দিয়েছে। সর্বদা শান্ত থাকা বউটাও আজ শাশুড়ীর সাথে উচ্চবাচ্য করছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার বিবাদ সামলাতে না পেরে শাশুড়ীকেই দো*ষী করলো লিলি। নাসিমা বেগমের বাজখাঁই গলা শোনা যাচ্ছে,

-“সংসার গড়ে দিয়েছি, স্বামীকে আঁচলে বাঁধতে পারোনা। কেমন মেয়ে তুমি? তোমার লজ্জা হওয়া উচিত।”
প্রত্যুত্তরে লিলির উগ্রকন্ঠ,
-“লজ্জা আপনার হওয়া উচিত। না নিজে মানুষ হতে পেরেছেন, আর না ছেলেকে মানুষ করতে পেরেছেন। ছিঃ! সেই মহিলার আবার বড় গলা।”

লিলিকে সাপোর্ট দিয়ে দাঁড়ানোর মতো এই বাড়িতে কেউ নেই ভেবে সর্বশক্তি দিয়ে হাত ওঠালেন। থেমে যেতে হলো নাসিমা বেগমকে। সেই হাত রোধ করলো লিলি নিজেই। জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
-“একদম গায়ে হাত তোলার স্পর্ধা দেখাবেন না। আমাকে আপনি পেটে ধরেননি। তাই ইচ্ছে হলেই যাচ্ছে তাই করতে পারেন না।”

লিলি বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেলো।
নাসিমা বেগম সাহস সঞ্চার করেও যেন করতে পারছেন না। সর্বদা তটস্থ হয়ে থাকছেন। স্বামী, সন্তান সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। উষাকে নিজ কর্ম দ্বারা শ*ত্রু বানিয়েছেন। আজ লিলিও তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। অপ*মানে, লজ্জায় ঘর ছেড়ে বের হলেননা।

শামীম কাজে থাকবে জেনেও উষার মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি চাপলো। ফোন হাতে মেসেজ করলো,
“আমার জান্স কী করে?”
মিনিট পাঁচেক পরই ফিরতি বার্তা এলো টুংটাং শব্দে। বার্তা ওপেন করেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল উষা। শামীম লিখেছে,

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১০

“কাঁথা সেলাই করি। বাড়ি আসার সময় তোমার জন্যেও একগাদা কাঁথা সেলাইয়ের অর্ডার নিয়ে আসবো। আপাতত কাজ না থাকলে ডাল-চাল একত্র করে গুণতে শুরু কর।”
উষা দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
-“ব্যাটা আনরোমান্টিক।”

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১২