মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ২২
Tahrim Muntahana
আমি, পুষ্পিতা, আয়েশা, পাখি, আরমান একসাথে পড়তাম। বেশ ভালো বন্ধুত্ব ছিলো আমাদের। আমি আর আমার এক ব্যাচ জুনিয়র আতুশি দুজন দুজন কে ভালোবাসতাম। সবাই জানতো । পাখি আরমান কে ভালোবাসে। তবে আরমান ছিলো প্লে বয়। নেহাত কলেজ লাইফের বন্ধু বলে ছেড়ে দিতে পারিনি।
আরমান সুযোগ বুঝে পাখিকে ও নিজের প্রেমিকা বানালো। ভালোয় চলছিলো সবকিছু। আমার বিয়ের দিন আমিনা নিজের ছোট বোন রাবেয়াকে নিয়ে এসেছিলো। তার নাকি রাতাফ কে ভালো লেগে যায়। রাতাফের প্রেম ছিলো আমরিনের সাথে। আমরা পিঠাপিঠি হওয়ায় সব কথায় দুজন দুজন কে শেয়ার করতাম। পাখির সাথে রিরেশন করেও আরমানের স্বভাব পাল্টেনি। পাখির আগোচরে রাবেয়ার পিছু পিছু ঘুরতে থাকে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
রাতাফের কথা বলে এদিক ওদিক নিয়ে যেত। রাতাফ সেসবের কিছুই জানতো না। আমরা জেনেছি পরে যখন সব হাতের বাইরে চলে গেছে। একদিন পাখি ওদের দুজন কে একসাথে দেখে নেয়। পাখি ছিলো বড়লোক বাড়ির মেয়ে আরমান ছিলো মধ্যবিত্ত। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে গিয়ে সব দোষ রাবেয়াকে দেয়। পাখি ইচ্ছে মতো গালাগালি করে রাবেয়াকে। উঠতি বয়সের রাবেয়া আবেগে পড়ে রাতাফ কে ভালোবাসার কথা বলে দেয়। রাতাফ রেগে না গিয়ে ভালোভাবে বোঝায়। কিন্তু রাবেয়া মানতে নারাজ। খুব জেদি ছিলো।
জেদের বশে আমরিন কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় যা রাতাফের চোখ এড়ায় না। রেগে গিয়ে নিজেও অনেক কথা শুনায়। মেয়েটা মানতে পারেনি। ভালোবাসা না পাওয়ায় ডিপ্রেশনে গিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আয়েশাও লাপাত্তা হয়ে যায়। প্রথম কতদিন আফসোস করলেও পরে সবাই নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আতইয়াব তখন পেটে। রাতাফ সবে বিয়ে করেছে। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে আতুশি মারা গেল।
শকড টা মেনে নিতে পারছিলাম না। আমরিন নিজের মতো আতইয়াবকে মানুষ করতে লাগলেন। রাতাফ ব্যবসায়ের হাল ধরলো। আমি তখন আতুশির বিরহে পাগল প্রায়। এর মধ্যে আতইয়াবের রোগ ধরা পড়লো। এব্রুড যেতে হবে। আমি কোনো রকম ব্যবসায়ে বসলাম। রাতাফ আমরিন ছুটে গেল সিঙ্গাপুর। একবছর পর ছেলেটাকে সুস্থ করে বাড়ি ফিরলো। আমরিনের কাছে বড় হতে লাগলি তুই। কিন্তু ততদিনে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। আয়েশা ফিরে এসেছে। ব্যবসায়, তোদের নিয়ে এমন ভাবে গোছালো হুমকি দিলো আমি অপারগ ছিলাম।
তুই মা বলে ডাকতে লাগলি। রাতাফ ওরা জানতো আমি দ্বিতীয় বিয়ে করেছি কিন্তু সেটা মিথ্যে ছিলো। আমরিনের সন্তান নিতে সমস্যা ছিলো আবার দেশের বাইরে যেতে হলো। তিনটা বছর পর ওরা বাড়ি ফিরলো। ওদের সংসারে কৌশলে অশান্তি করার চেষ্টা করতো আয়েশা। কতদিন পারতো কতদিন পারতো না। এভাবে চলে গেল আরো দুটো বছর। দিন দিন জীবন টা বিষিয়ে যেতে লাগলো। না পারছিলাম কিছু বলতে না পারছিলাম সইতে। আদর এলো পেটে। রাতাফ সতর্ক হয়ে গেল। আয়েশা কিছু করতে পারে নি।
রাতাফ কিছু টা সন্দেহ করায় পুলিশ কে জানিয়েছিলো। কিছুদিন ক্ষান্ত ছিলো আয়েশা। আবার শুরু হলো ওর ষড়যন্ত্র। কিছুতেই সুরাহা হচ্ছিলো না। রামিয়া এলো পেটে। আয়েশা আর সহ্য করতে পারেনি। ড্রাগস রেখে ব্যবসায়ের দুর্নাম করলো। পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। কয়েক মাস আমরিন কে এভাবেই কষ্ট দিতে লাগলো। নিজেই ছাড়িয়ে আনলো। ব্যবসায়ে বসতে দিলো আমাকে ভাইয়ের শত্রু বানিয়ে।
বার বার হুমকি দিতো আতইয়াব-আদর-ভাইকে মেরে ফেলবে। মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না আমার। তখন আমরিনের ভরা পেট। ক’দিন পরেই ডেলেভারি। খবর এলো রাতাফ এক্সিডেন্টে স্পট ডেথ। আমরিন সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় পড়ে গেল। রামিয়াকে বাঁচানো গেলেও আমরিন কে গেল না। আদর আর মা রামিয়াকে বড় করতে লাগলো। আতইয়াব তো আছেই। একমাত্র আমিই জানতাম আমার ভাই বেঁচে আছে। আমাকে দিয়ে ওদের সাথে খারাপ ব্যবহার করাতো। আদর মুখ বুজে সব সহ্য করে নিতো।
আমিই কৌশলে কটু কথা বাড়ালাম। মা মারা যাওয়ার দিন ই আমার কষ্ট সফল হলো। আদরের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো আতইয়াব। শক্ত হয়ে গেল মেয়েটা। নিজে উপার্জন করতে শিখলো। আতইয়াব ও চলে গেল বাইরে। ভাইয়ের টেনশন ছাড়া আর কোনো টেনশন ছিলো না। আতইয়াব আভা কে পাঠালো আদরের কাছে। লড়াই করতে শেখালো আদরকে। আমার শেষ চাল ছিলো যে করেই হোক সম্পত্তির উইল টা আদরের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। আতইয়াবের কাছে খবর টা পৌঁছালাম। তার পর নিজেই আদরের কাছে উইল পাঠিয়ে দিলো।
আদর আবার ফিরে এলো আহমেদ বাড়িতে, একদম অন্যরূপে। ব্যবসায় টাও নিজের দখলে নিলো। হৃদান এলো আদরের জীবনে। মেয়েটাকে হাসতে শেখালো। আয়েশার এটাই সহ্য করতে পারলো না। আবার ড্রাগসের ষড়যন্ত্র করে আদর কে ফাঁসাতে চাইলো। হৃদান ঢাল হয়ে দাড়ালো। হিয়ান খানের সত্য প্রকাশ করলো। জেলে গেলাম দুজন। আয়েশা বুদ্ধি করে আমাকে পালাতে সাহায্য করলো। ওর হাতে পড়ার আগেই হৃদান আমাকে নিয়ে গেল।
সবকিছু বললাম হৃদান কে। আতইয়াব কে দিয়ে কেস তুলে নিলো। আয়েশার পেছনেও আরো একজন আছে। ও একা এতকিছু করতে পারতো না। আমাদের কাছে কোনো প্রমাণ ও ছিলো না, রাতাফ কেও কোথায় রেখেছে আমরা জানিনা। তাই চাইলেও আয়েশার কিছু করতে পারছিলাম না। হিয়ান আয়েশা কে জানে না, আমার কথাও কেউ মেনে নিবে না। হৃদান গোপনে রাতাফ কে খুঁজতে লাগলো। আয়েশা কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছিলো। হৃদানকে মারার প্ল্যান করলো। উপর ওয়ালার রহমতে বেঁচে গিয়েছিলো ছেলেটা। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।
আমার মেয়েটাকে স্বামী হারা করে দিলো। আয়েশা ওর উদ্দশ্যে সফল হয়েছে। আহমেদ বাড়িটা নিশ্চুপ করে দিয়েছে তেমনি নিজের খায়েশ মেটাতে রিদিমাকেও মেরে দিয়েছে। চৌধুরী বাড়িটাকেও শেষ করে দিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে সবার সুখ।
কাঁদতে লাগলেন রাজীব আহমেদ। আর সবাই স্তব্ধ। আতইয়াব পান্চু বাহাদুরের সাথে যোগ দিয়েছে সাফিন রাফিন। ওদের কেউ ডেকে এনেছে রাজীব আহমেদ। এবার কাজ করলে একসাথেই করতে হবে। সাফিন হুট করেই বলে উঠলো,
রিদিমা আন্টিকে মেরে আয়েশার কি লাভ?
নাবিল আর আমরা একই ভার্সিটি ছিলাম। কিন্তু ডিপার্টমেন্ট আলাদা। আয়েশা নাবিল কে ভালোবাসতো। কিন্তু রিদিমা-নাবিলের বিয়ে অনেক আগেই হয়ে গেছে। মৃহান তখন এক বছরের। কেউ জানতো না এই ব্যাপারটা। রাবেয়া আত্মহত্যা করার পর নিজেও দিশেহারা হয়ে পড়েছিলো। সুযোগ বুঝে সব প্রতিশোধ একসাথে নিয়েছে।
আবার নিশ্চুপ। কি বলবে? কিই বা বলার আছে? ভালোবাসা না পেয়ে কেউ যে ভালোবাসার মানুষটিকে এমন ভাবে কষ্ট দিতে পারে জানা ছিলো না। কই সাফিন-রাফিন তো সরে এসেছে। আরো কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। পাঁচজন বসে নিজেদের মতো পরিকল্পনা করে যে যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই আতইয়াবের মনে হলো আদরের কথা। ছুটে গেল ঘরের দিকে। অনেকটা সময় হয়ে গেছে। আদর নেই! চমকে গেল সবাই। বুঝতে বাকি নেই আদরের কানে সবই পৌঁছে গেছে। রাগের বশে না জানি কি করে। আতইয়াব সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আদরের পেছনে ছুটলো। যেতে না দেরি হয়ে যায়।
চিকচিক করছে সূর্য। আকাশ আলো করে নিজের রাজশাসন দেখিয়ে চলছে। প্রকৃতি একটু খানি বাতাসের জন্য ছটফট করলেও বাতাসের যেন তাড়া নেই। গরমে কোণঠাসা অবস্থা। গাড়িতে বসে আছে আদর। একটু পর পর চোখ ভিজে যাচ্ছে সমান তালে। গাড়ি চালাতে সমস্যা হলেও বাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে জলটুকু মুছে নিয়ে দ্বিগুন বেগে ছুটছে সে। মাথায় ঘুরছে রাজীব আহমেদের প্রত্যেকটা কথা। তার বাবা বেঁচে আছে! সব কিছুর পেছনে তার বড়আম্মু দায়ী!
যাকে ছোট বেলা থেকে এতটা আপন ভেবে এসেছে সেই আসল কালপ্রিট! রাজীব আহমেদের কটু কথাই এত কষ্ট লাগেনি আদরের যতটা এখন লাগছে। রাজীব আহমেদের কটু কথা তো সে ছোট থেকেই শুনে এসেছে কিন্তু বড় আম্মুর এমন রূপ তো দেখি নি! হৃদানের রক্তাক্ত শরীর টা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই গাড়ি থামিয়ে দেয় আদর। আকস্মিক গাড়ি থামানোর জন্য ঝুঁকে পড়ে সামনের দিক। খানিক ব্যাথাও পায় কপালে।
আমলে নেয় না, মনের ক্ষতের কাছে শরীরের ক্ষণ কিছুই না। গাড়ি থেকে বের হয়, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। পাশে থাকা মনিহারি দোকান থেকে না বলেই পানির বোতল নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নেয়। মাথা ঘুরছে, শার্টের উপরে থাকে নরম ব্লেজার খুলে ফেলে। রক্তাক্ত কিছু মুহূর্ত ঘুরতে থাকে মাথায়। হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠে আদর। আশেপাশে থাকা কিছু মানুষ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়। যখনি চিনতে পারে দৃষ্টির ধরণ পাল্টে যায়। আফসোস, মায়া দৃষ্টিতে দেখে যায় আদরের আত্মচিৎকার। কেউ কেউ হাতে থাকা ইলেকট্রিক ডিভাইসের সৎ ব্যবহার করতেও ভুলে না। হাইরে ডিজিটাল দুনিয়া অন্যজনের কষ্টেও এরা হাল ছাড়ে না!
ফোনের লোকেশন ট্রেক করে আতইয়াব আদর কে খুঁজে চলছে। গাড়ির স্পিড এতটা দিয়েছে তার এই বয়স পর্যন্ত এভাবে গাড়ি চালায় নি। আজ রেকর্ড ভেঙেই ফেলেছে। আদরের গাড়ি দেখেই থেমে যায় সে। তারউপর ভিড়। কলিজা কেঁপে উঠে আতইয়াবে। কিছু হলো না তো? এগিয়ে যায় ভিড় ঠেলে। বোন কে রাস্তায় বসে এভাবে কাঁদতে দেখে বুকের ভেতর ধক করে উঠে। ছলছল করে উঠে দু’চোখ। নিজের বোনের সামনে বসে পড়ে। ভরসার হাত পেয়ে আদর হামলে পড়ে আতইয়াবের বুকে। পড়ে যেতে নিয়েও সামলে নেয় নিজেকে।
আমার হৃদ কে মেরে ফেলেছে ভাইয়া। আমাকে বিধবা করে দিলো। আমার হাসিটা কেড়ে নিলো ভাইয়া। আমার সব শেষ করে দিলো। আমাকে জিন্দা লাশ বানিয়ে রেখেছে। আমাকে মেরে ফেলো না ভাইয়া, আমি আর পারছি না। আমার হৃদকে এনে দাও না ভাইয়া। তোমার পায়ে পড়ি আমি। আমার হৃদকে কে এনে দাও। হৃদ আমার সাথে বেইমানি করেছে। আমাকে দেওয়া কথা রাখেনি। স্বার্থপরের মতো নিজে চলে গিয়ে বেঁচে গিয়েছে, আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। লাগবে না উনাকে আমার, আমার মৃত্য লাগবে। আমাকে মেরে ফেলো। আমি মরে যেতে চাই। আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ভাইয়া। আমার হৃদ কে আসতে বলো না ভাইয়া, এনে দাও না আমার হৃদকে।
এতটা হাইপার হয়ে গেছে যে কি বলতে কি বলে ফেলছে নিজেই বুঝতে পারছে না আদর। শেষের কথাগুলো বলতে বলতেই আতইয়াবের কোলে ঢলে পড়ে। চমকে যায় আতইয়াব। চোখের পানিটুকু মুছে কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে শুধু। দৃশ্য টুকুও ক্যাপচার হয়ে যায়। ভাইরাল হয়ে যায় নেট দুনিয়ায়। আহা আফসোস! হায় ভালোবাসা!
গতরাতের তুলনায় আজকের রাতটা মনে হয় একটু বেশী নিস্তব্ধ। গভীর রাতের আকাশ জুড়ে তারকারাজির রাজত্ব। সাথে রাজার মুকুট নিয়ে আছে চন্দ্রপ্রভা। ঘুটঘুটে অন্ধকার কামরা। জানালা বিহীন ঘরটায় জোৎস্নার আলো পৌঁছানোর কোনো ফাঁক নেই। এই অন্ধকারে মানুষ হারিয়ে গেলে হয়তো পাওয়া মুশকিল ই হবে।
চেয়ারের সাথে শক্ত করে বাঁধা একজন মানুষ। চোখ খুলে যখন অন্ধকার দেখেছে তখন থেকেই সে চুপ করে আছে। চিৎকার করেও যে কাজ হবে না সে বুঝতে পেরেছে; অযহত গলা ব্যাথা করে লাভ নেই। মিনিট পাঁচেক যেতেই দরজা খোলার শব্দ হয়, নড়েচড়ে উঠে লোকটি। কে আটকে রেখেছে ধারণা করা মুশকিল। মাথার উপর থাকা বাতিটা জ্বলে উঠতেই চোখ বন্ধ করে নেয় সে। পিটপিট করে চোখ খুলে সামনের মানুষ টাকে দেখে চমকে উঠে। তবে প্রকাশ করে না। আদর শব্দ করে হেসে দেয়। হিসহিসিয়ে বলে উঠে,
বড়আম্মু খুব কষ্ট হচ্ছে? এই কে আছিস বাঁধন খুলে দে। আমার বড় আম্মুর কষ্ট হচ্ছে। এভাবে বেঁধে রেখেছিস কেন?
আয়েশা কেঁপে উঠে আদরের কন্ঠস্বর শুনে। মুহূর্তেই বুঝে যায় তার করা সব প্ল্যান ফাঁস হয়ে গেছে। আদর আবার বলে উঠে,
আমারো কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার বড়আব্বু বাবার কষ্টের কথাগুলো মনে হতেই কষ্ট হচ্ছে, বাবা থাকতেও এতিম আমরা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে, এত সব কষ্টের কারণ তুমি ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে, আমার হৃদ আর নেই ভাবতেই চাইনা এটা তবুও ভাবনাতে চলে আসে; কষ্ট হয়, সব কষ্টের একটাই কষ্ট! মৃত্য পর্যন্ত তুই এই অন্ধকার ঘরে আটকে থাকবি। বাঁচতে চাইবি পারবি না, মরতেও পারবি না। ক্ষণে ক্ষণে তোকে কষ্ট দিবো। তবেই না হবে কষ্টের কষ্ট!
হাসতে হাসতে ঘর ছেড়ে বের হয় আদর। আদর যেতেই পান্চু বাহাদুর ঘরে ঢুকে। হাতে পলিথিন, ভেতরে তেলাপোকা। ছেড়ে দেয় আয়েশার গায়ে। শুরু হয় চিৎকার। চিৎকারের শব্দ কানে আসতেই আদর গাড়ি স্টার্ট দেয়। চৌধুরী বাড়িতে এসে গাড়ি থামায়। ড্রয়িং রুমে বসেছিলেন নাবিল চৌধুরী, মৃহান ও আতইয়াব। হৃদযা-সুবাহ রান্না ঘরে। আদর ইচ্ছে করেই নাবিল চৌধুরী কে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে সোফায়।
কারোর মুখেই কোনো কথা নেই, নিরবতায় যেন সব বুঝিয়ে দিচ্ছে। ওদের কে ছেড়ে রান্না ঘরে চলে যায় আদর। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই হালকা শব্দ করে কেঁদে দেয় হৃদযা-সুবাহ। কতটা দিন পর এরকম সময় এলো। কিছুক্ষণ থেকে আদর নিজের ঘরের দিকে হাটা ধরে।
মাঝপথে থেমে গিয়ে রামিয়ার রুমের ভেতর ঢুকে পড়ে। ঘুমোচ্ছে রামিয়া। চোখের কোণ ঘেসে শুকিয়ে যাওয়া জলের দাগ। কপালে চুমু খায় আদর। সে জানে রামিয়ার চোখের জলের কারণ। কাজ করছিলো রাফিন-সাফিন। আতইয়াবের দেওয়া কাজ ই করছিলো। এমন সময় আদর কে দেখে ওরা অবাক হয়। রাফিনের চোখ দুটো কেমন চিকচিক করে উঠে, তার প্রথম ভালোবাসা আদর। চাইলেও প্রথম ভালোবাসা ভোলা যায় না। আদর মুচকি হাসে। আজ অকারণেই আগের মতো হাসছে সে।
একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি মি. রাফিনের কাছে। আমার বোন টা আপনাকে খুব ভালোবাসে। জানিনা আপনার মনে আমার বোনের জায়গা আছে কিনা তবে একটু চেষ্টা করে দেখবেন। আমার অবর্তমানে একটু আগলে রাখার চেষ্টা করবেন।
রাফিনের ইতস্তত চাহনী ফেলে ঘর ছাড়ে আদর। রামিয়ার কথা হতেই রাফিনের বুকে চিনচিন ব্যাথা করে। সে জানে এই ব্যাথার কারণ। মেয়েটা আস্তে আস্তে যে মনে জায়গা করে নিচ্ছে। নিজের ঘরে ঢোকার আগে ড্রয়িং রুমে বসে থাকা আতইয়াব কে ডেকে বলে উঠে,
ভাইয়া একটু ঘুম পাড়িয়ে দিবে?
আতইয়াব হাসি মুখে মেনে নেয়। কোলের উপর মাথা রেখে চুলে বিলি কেটে দিতে থাকে। অনেকটা সময় চলে যায়। হৃদযা খেতে ডাকে। চলে যায় আতইয়াব। গভীর ঘুমে মগ্ন আদর ঘোরের মাঝেই বিড়বিড় করে কিছু বলে আবার ঘুমিয়ে যায়।
রাত একটা। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। কিছুক্ষণ পর পর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মৃদু বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে। আবার রক্তে রাঙানো শুভ্র লেহেঙ্গায় নিজেকে সাজিয়েছে আদর।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে নিজেকে কাজল লিপস্টিকে সাজিয়ে মাথায় শুভ্র উড়না টা দিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে নিলো। ঘর টায় তৃষ্ণার্ত চোখ নিয়ে কয়েকবার নজর বুলালো সে। একটা ছবি আকড়ে ধরে কয়েকবার চুমু খেলো। এভাবে তৃষ্ণা মেটানো যায়?
মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ২১
এলোমেলো পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল সে। চৌধুরী বাড়ির সদর গেট পেরিয়ে বেরিয়ে গেল আদর। নির্জীব হয়ে গাড়ি চালিয়ে ব্রিজের উপর থামলো। প্রায় দুপ্রহর সময় চলে গেছে। গাড়ি থেকে নেমে এলোমেলো পায়ে দাঁড়ালো ব্রিজের কিনারায়। এখনো ব্রিজটা ঠিক করা হয়নি। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়ডিড় করে মুচকি হাসলো আদর। অপলক তাকিয়ে রইলো পানির দিকে। যেন তাকে কেউ ডাকছে!