মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ২১

মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ২১
Tahrim Muntahana

ভোরের আলো ফুটেনি ভালো করে। আবছা আলো-অন্ধকার পরিবেশ। চৌধুরী বাড়ির দুয়ারে কড়া নাড়ছে দুই যুবক। চোখে মুখে ব্যাথার স্পষ্ট ছাপ। দরজা খুলে দেয় পান্চূ। সে অপেক্ষা করছিলো দুজনের জন্য‌ই। কোনো প্রকার বাক্য বিনিময় করে না। বসের নিখোঁজে খেই হারিয়েছে সে‌। যে যা করতে বলছে তাই করছে।

আর বাহাদুর সে তো মোটা শরীরটা কোনোরকম চালিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। বস কে না খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত সে থামবে না। সাফিন-রাফিন এসেছে। বিয়েতে আসার কথা থাকলেও কাজে আটকে গিয়েছিল, ম্যানেজ করে র‌ওনা দিয়েই বিমান থেকে নেমে খবর টা পায় তারা। মুহূর্তেই হাসিখুশি জার্নিটা বিষাদে রূপান্তর হয়। সোজা চৌধুরী বাড়িতেই চলে এসেছে তারা। কোনোরকম ফ্রেস হয়ে পান্চুকে রেখেই পুলিশ স্ট্রেশন দৌড়ায়। বন্ধুত্ব টা খনিকের হলেও বন্ডিং টা জোরালো ছিলো। হৃদয় কাঁপছে!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বেলা একটু বাড়তেই আত‌ইয়াব হৃদযা রামিয়া কে নিয়ে হাজির হয় চৌধুরী বাড়িতে। হৃদযা ঘুম থেকে উঠেই পাগলামি করছিলো আর রামিয়া বোনের জন্য ছটফট করছে রাত থেকেই। না পেরে মা কে বলে কয়েকদিনের সময় নিয়ে এসেছে। সুবাহ’র পরিবার ও উপস্থিত। নিজেদের সাধ্য মতো সাপোর্ট করছে। খুব বেশিই দরকার যে।

চারটা দিন‌ চোখের পলকেই চলে গেল। আদর সেই যে ঘরে ঢুকেছে আর বের হয়নি। কেউ ডাকলেই নানা রকম জিনিস ছুঁড়ে মারে দরজায়‌। কারোর সাহস হয় না আর। একটানা চারদিন না খাওয়ায়, দুর্বল শরীরটা একদম নেতিয়ে পড়েছে। বাইরের চেঁচামেচি শুনেও আদর নিরস বসে থাকে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে শব্দ গুলো বাড়ায় আদর ভ্রু কুঁচকে নেয়। কিছু একটা মনে হতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে।

সে নিশ্চিত হৃদান এসেছে। এক ছুটে দরজার কাছে চলে যায়। পা কেমন ঝিম ধরে আছে, মাথাটা ঘুরে আসতেই দরজায় ঠেসে দাঁড়ায়। শক্ত করে দু’বার চোখ বুজে নিজেকে ধাতস্থ করে। মনের মধ্যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আস্তে আস্তে পা ফেলে এগিয়ে যায়। সদর দরজা ঠেলে বাইরে বের হতেই ধক করে উঠে তার বুক‌। সবাই তার মতো শুভ্র কাপড় কেন পড়েছে? কয়েকবার ভাবে, উত্তর মেলাতে পারে না। ইতিমধ্যে আদর কে দেখেই সবার চোখে পানি চলে এসেছে। চারটা দিনে মেয়েটার অবস্থা কেমন হয়ে গেছে। এলোমেলো চুল, চোখের নিচে কালি, ঠোঁটের লিপস্টিক ছড়িয়ে পড়েছে আশেপাশে, শরীর থেকে ঘামের গন্ধ; পরিণতি টা সত্যি ভয়াবহ! হৃদযা-সুবাহ’র কন্দনরত মুখশ্রী দেখে আদর বলে উঠে,

হৃদ এসেছে না? আমি জানতাম আমার হৃদ আসবে। কাঁদছিস কেন তোরা? আমার হৃদ চলে এসেছে না? সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি হৃদ কে বকে দিবো।
কোনো দিক না তাকিয়েই সামনের দিক হাঁটা ধরে আদর। মৃহান‌কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে হৃদযা। এক মুহুর্তে সবটা এলোমেলো হয়ে গেলো।

আদর কে পান্চু আটকাতে চাইলেও আত‌ইয়াব না করে‌। মেয়েটাকে কাঁদাতে হবে। নাহলে যখন তখন কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে আদর আত‌ইয়াবের সাথে যায়। লাশের খাটে শুভ্র কাপড়ে মোড়ানো দেহটা দেখেই আদরের পা থেমে যায়। থরথর করে কেঁপে উঠে শরীর। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠে,
কার কি হয়েছে? আমার হৃদ কোথায়? কথা বলছো না কেন ভাইয়া? এ‌ই আধা টাকু পান্চু কাকু তোমার বস কোথায়? তাকে বলো আমি ডাকছি!

পান্চু স‌ইতে পারে না। বাহাদুর কে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে দেয়। কি জবাব দিবে সে? আদর উত্তর না পেয়ে হাইপার হয়ে যায়। চেঁচিয়ে বলে উঠে,
এমন করছো কেন তোমরা? এ‌ই বাহাদুর তোমার বস কোথায় ডাকো তাকে। বলো ম্যাম রেগে যাচ্ছে‌। আমার কথা‌ কেউ শুনতে পাচ্ছো না? আমার হৃদ কে এনে দাও। কোথায় আমার হৃদ?

আত‌ইয়াব হাত ধরে আদরকে লাশের সামনে নিয়ে দাঁড় করায়। এক টানে মুখের‌ কাপড় সরিয়ে ফেলে। দু’পা পিছিয়ে যায় আদর। ব্যালেন্স রাখতে না পেরে মাটিতে বসে পড়ে। তাকিয়ে থাকে অপলক। অবিশ্বাসের দৃষ্টি আত‌ইয়াবের দিকে তাকায়। চোখ বলছে সব মিথ্যা! আত‌ইয়াবের গলা ধরে আসে। বার কয়েক ঢোক গিলে শুকনো গলাটা ভিজিয়ে নেয়‌। আদর কে ধরে বলে উঠে,

তোমার হৃদ আর নেই আদর। মরে গেছে তোমার স্বামী! তোমাকে আর কেউ আদুপাখি বলে ডাকবে না। কেউ ভালোবেসে পাগলামি করবে না। তোমাকে ছেড়ে, আমাদের সবাই কে ছেড়ে হৃদান চলে গেছে। না ফেরার দেশে চলে গেছে। কাঁদো আদর, কাঁদো! চিৎকার করে কাঁদো। তুমি ডাকলে সে শুনবে না । আর কখনো তাকে দেখতে পাবে না। তোমার ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে হৃদান চলে গেছে। বেইমানি করেছে সে।

কথাগুলো চামড়া ভেদ করে হৃদয়ে লাগছে যেন‌। এ‌ই ব্যাথা ধারণ ক্ষমতার বাইরে। আত‌ইয়াবের হাত থেকে নিজের হাত ছুটিয়ে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয় আদর। এ‌ই মুহূর্তে তার আত‌ইয়াব কে সহ্য হচ্ছে না‌। আকস্মিক ধাক্কা সামলাতে না পেরে মাটিতে গড়াগড়ি খায় আত‌ইয়াব। কষ্টে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। এর থেকে মরণ ভালো ছিলো! আদর দৌড়ে হৃদানের মৃতদেহের সামনে বসে। ধাক্কা দিতে থাকে অনবরত,

এ‌ই হৃদ কি হয়েছে আপনার? উঠুন না। দেখেন ভাইয়া কি বলছে। নিষ্ঠুর কথা গুলো যে আমি সহ্য করতে পারছি না‌‌। আপনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন হৃদ। কখনো কাঁদতে দিবেন না‌, কখনো ছেড়ে যাবেন না। আজকে আপনার জবানের কি হলো? এ‌ই হৃদ দেখুন আমি কাঁদছি। আপনার হৃদয়রানীর চোখ থেকে জল পড়ছে। আপনি উঠুন না‌। আমার কষ্ট হচ্ছে‌। আমি মরে যাবো হৃদ। উঠুন না।

এরকম হাজারো আহাজারি করতে করতে ঢলে পড়ে মাটিতে‌। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। দু’চোখ মুছে ঘরে নিয়ে আদর কে শুয়িয়ে দেয় আত‌ইয়াব। পরের দিন গুলো কিভাবে কাটাবে সে জানে না। তবে সুখ যে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সে বুঝতে পেরেছে।

বর্ষার শুরু। চারপাশ পানিতে থৈ থৈ করছে। মুষলধারে বৃষ্টির প্রকোপে নেতিয়ে পড়েছে প্রকৃতি। একটানা সারাদিন বৃষ্টি হয়ে কিছুক্ষণ হলো বিরতি নিয়েছে। হয়তো রাতের গভীরতা মেপে আবার শুরু হবে। কেটে গেছে একটা মাস। সময়ের যে অপেক্ষা করার কেউ নেই। নিজের ঘরের বেলকনিতে বসে আছে আদর। আজ আবারো নিজেকে সাজিয়েছে হৃদানের রক্তে রাঙানো শুভ্র লেহেঙ্গায়। দিন দিন পাগলামি যেন বেড়েই চলছে। হাসি খুশি মেয়েটা রুক্ষ, প্রাণহীন হয়ে গেছে। ভালোবাসার এক অমূল দৃষ্টান্ত যেন আদর-হৃদান। একজন ভালোবাসা কে বাঁচাতে মৃত্যু কে বরণ করে নিয়েছে আরেকজন ভালোবাসার বিরহে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। সুখ যেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে!

আপনি কথা রাখেননি হৃদ। ছেড়ে দিয়েছেন হাত। চলে গেছেন বহু দূরে। আমার অভিমানটা মেনে নিতে পারলেন না? আপনি তো জানেন আপনার আদুপাখি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারে না। এ‌‌ই আপনার ভালোবাসা? আমি কিন্তু আপনার উপর খুব রেগে আছি। আদর আহমেদের রাগ সম্পর্কে জানেন তো! হাজার মানাতে আসলেও কাজ হবে না। আমাকে আর পাবেন না। হারিয়ে ফেলেছেন!

হৃদ আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? কতদিন দেখি না আপনাকে। চোখের তৃষ্ণাও মেটেনা। কত কত মুখ দেখি তবুও কেন আপনাকে খুঁজি? কেন ভেঙে পড়ি? যে মেয়েটার মুখে হাসি ফুটালেন নিজেই তার চোখের জলের কারণ হলেন। কেন করলেন হৃদ? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ফিরে আসুন না প্লিজ!

নিরন্তর অন্তরীক্ষে দৃষ্টি রেখে অভিযোগ করে চলছে আদর‌। চোখে তে আগের মতো বৃষ্টি নামে না। ফিরে পাওয়ার আকুলতা গ্রাস করে না বরং একটু একটু করে বাঁচিয়ে তুলছে। কঠিন খোলশের আড়ালে নিজের ভালোবাসাকে লুকিয়ে রেখেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে প্রবেশ করে আদর। এক পলক সারা ঘরে নজর বুলিয়ে নেয়।

পুরো ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হৃদানের স্মৃতি। সম্পূর্ণ দেয়াল জুড়ে দুজনের ছবি। প্রতিটা মুহূর্তের স্মৃতিকে ঘিরে ঘরটা প্রাণ পেয়েছে শুধু ঘরের মানুষ টাই নির্জীব। প্রতিটা ছবির আদলে হাত বুলায় আদর যেন হৃদান কে স্পর্শ করছে। যেতে থাকে সময়। ঘড়ির কাঁটা যখন ভোর চারটায় গিয়ে থামে; গুটিসুটি মেরে মেঝেতে নেতিয়ে পড়ে আদর। এ‌ই একমাস সে মেঝেতেই কাটিয়েছে। বিছানায় ঘুমানোর সাহস তার হয়নি। স্মৃতি গুলো মে ঘুমাতে দেয় না।

তুমি আমার ফোন তুলছো না কেন হিয়া?
বড্ড বেশি সাহস বেড়েছে তোমার। এক টা মাস কোনো যোগাযোগ রাখো নি।
হিয়া তাচ্ছিল্য হাসলো কথাটি শুনে। শক্ত চাহনীতে একপলক সামনে বসা নিজের মায়ের দিকে তাকালো‌। কাটকাট গলায় বলে উঠলো,

আমার ভালোবাসাকে মেরে ফেলেছো তুমি। তারপরেও কি করে আশা রাখো?
সম্পূর্ণটাই একটা ভুল হিয়া। আমাদের প্লেন হৃদান এভাবে উল্টে দিবে ভাবেনি। শুধুমাত্র তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমরা হৃদান কে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম। আদরের দিকেই ছুড়া হয়েছিলো গুলিটা কিন্তু হৃদান কৌশলে আদর কে সরিয়ে দিলো।

মায়ের কথায় হিয়া হু হু করে কেঁদে উঠে। হিয়ার মায়ের মন নরম হয়। বুকে টেনে নেয় মেয়েকে। মায়ের ছোঁয়া পেয়ে হিয়া আহাজারি করতে থাকে,
এতটা দিন ভালোবেসেও হৃদান কে পেলাম না মা‌। তোমাদের একটা ভুলে আমি শেষ হয়ে গেলাম। মরে গেল হৃদান। আমাকে নিঃশেষ করে দিলে।

আমরা খুব চেষ্টা করেছিলাম আম্মু‌। লোক জড়ো হ‌ওয়ার আগেই আমাদের লোক পানিতে নেমেছিলো। তন্ন তন্ন করেও খুঁজে পায়নি‌। তখন খুঁজে পেলে হয়তো বাঁচানো যেত‌। ভাগ্যে এমন ছিলো রে মা। মুভ অন করো।
মায়ের কথায় হিয়া চুপ হয়ে যায়। গুটিসুটি মেরে মায়ের বুকেই পড়ে থাকে। চাইলেই মুভ অন করা যায়? হঠাৎ করেই হিয়ার সব রাগ আদরের উপর গিয়ে পড়ে। আদর কে বাঁচাতেই হৃদানের গুলি লেগেছে। আদর ই তার হৃদান কে মেরে ফেলেছে।

আমি আদর কে ভালো থাকতে দিবো না। শেষ করে দিবো ওকে‌। ওর জন্য‌ই আমার হৃদান মরে গেছে‌‌। ছাড়বো না আমি ওকে‌।
হিয়ার মা হাসলেন। আদর কি আদোও ভালো আছে? হাহাহা! ভালো নেই, কেউ ভালো নেই! চৌধুরী বাড়ির, আহমেদ বাড়ির কেউ ভালো নেই!

অপরাহ্ন। ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে। মৃদু বাতাস ও ব‌ইছে। রাজীব আহমেদের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে আদর। সোফায় বসে আছে আত‌ইয়াব, পান্চু-বাহাদুর। রাজীব আহমেদ আজ তাদের ডেকেছে। আদর ও যে আসবে ভাবেনি। আদর কে ভালোভাবে শুয়িয়ে দিয়ে আত‌ইয়াব দের নিয়ে তিনি অন্য ঘরে চলে যায় রাজীব আহমেদ।

সবাই কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হয়েছে। এখন‌ই মুখ্যম সময়। তবে রাজীব আহমেদ কে চিন্তিত দেখাচ্ছে। ছেলে কি তাকে বিশ্বাস করবে? না করলেও তাকে চেষ্টা তো করতে হবে। আত‌ইয়াব বাবার মুখের দিক তাকিয়ে আছে। শোনার অপেক্ষাতেই আছে হয়তো।

আমি আজ তোমাদের কিছু সত্য বলবো। জানিনা বিশ্বাস করবে কিনা তবে আমাকে বলতে হবে। হৃদানের কথা শুনে চেপে গিয়েছিলাম তোমাদের থেকে। প্রমাণ সহ বলবো বলে‌। হুট করেই একটা দুর্ঘটনা হয়ে গেল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থাকায় বলিনি। এখন সময় এসেছে সব বলার।
রাজীব আহমেদের গলা ধরে আসছে। হৃদান নেই কথা টি ভাবতেই তার কলিজা পোড়ায়‌। তিন জন‌ই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কি বলবে রাজীব আহমেদ?

মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ২০

তোমার মা তোমার জন্মের সময়‌ই মারা গেছেন আত‌ইয়াব! যাকে তুমি এতদিন মা বলে জেনে এসেছো সে তোমার মা নয়!
বিষ্ময়ে দাঁড়িয়ে গেছে আত‌ইয়াব। কি বলছে লোকটা? রাজীব আহমেদ মলিন হাসলেন‌। নিজের মতো‌ই বলতে লাগলেন। এক চরম সত্যের মুখোমুখি হলো তিনজন মানুষ। সত্যটা কি?

মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ২২