মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ২০

মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ২০
Tahrim Muntahana

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো সবে। সূর্যের উত্তাপ এখনো যায়নি। শুভ্রনীল আকাশে জ্বলজ্বল করা উত্তপ্ত সূর্য কে মাথায় নিয়ে আহমেদ বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে হৃদান রা। সবার মাঝেই এক আমেজ। আত‌ইয়াব নিজের সর্বস্ব দিয়ে আহমেদ বাড়ি সাজিয়েছে। বোনের বিয়ে বলে কথা! ঘন্টা খানেক আগে বাগদান সম্পন্ন হয়েছে।

গেস্টরা আতিথেয়তা গ্রহণ করে ইতিমধ্যে বাড়ির পথ ধরেছে‌। ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধুবান্ধব ও তার পরিবার শুভ মুহূর্তের সাক্ষী হতে রয়ে গেছে‌। আদরের ইচ্ছে এমন ই ছিলো। বাগদান সবাইকে নিয়ে করলেও আকদ নিজেদের মাঝেই হবে। তারমধ্যে রিপোর্টারস তো আছেই। আদরের ইচ্ছেকেই প্রাধান্য দিয়েছে আত‌ইয়াব-হৃদান। কিছুক্ষণ পরেই আকদ হবে। আদরের জন্য নিজে পছন্দ করে লেহেঙ্গা কিনেছে। বাগদানে আদর আত‌ইয়াবের দেওয়া শাড়ি পড়েছিল। আদর ভেবেছে এ‌ই শাড়ি পড়েই আকদ হবে কিন্তু নাহ বোনকে দিয়ে শপিং পাঠিয়ে দিয়েছে হৃদান। আদর বীনা বাক্যে মেনে নিয়েছে। প্রেমপুরুষের জন্য এতটুকু কষ্ট করতে পারবে না?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আদরের ঘরে অবস্থান করছে কয়েকদল মেয়ে‌। হৃদযা-সুবাহ নিজ হাতে আদর কে সাজাবে তাই পার্লার থেকে লোক আনানো হয়নি। ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিচ্ছিলো আদর‌। মধ্যে ঘন্টা খানেক সময় আছে তাই তাড়াহুড়ো নেই। কিন্তু হৃদানের কি এত ধৈর্য সয়? ছটফট করছে ছেলেটা। হৃদযা তাড়া দিতেই আদর শপিংব্যাগ টা খুললো। আগ্রহ ভরা চোখে দেখছে। লাইসেন্স প্রাপ্ত প্রেমিকের দেওয়া উপহার; কতটা মায়া জড়ানো।

শুভ্র কাপড়ের ধাঁচে গোল্ডের কারুকাজের লেহেঙ্গা দেখে হৃদযা সুবাহ ভ্রু কুঁচকালো। বিয়েতে কেউ সাদা পড়ে? অজানা এক ভয়ে হৃদযার বুকটা কেঁপে উঠলো‌। হঠাৎ এত অস্থির লাগছে কেন? সুবাহ’র চোখে মুখেও আতঙ্ক। এ‌ই মুহূর্তে সাদা ড্রেসটা কিছুতেই দুজনের পছন্দ হচ্ছে না। সুবাহ ভয় ভয় চোখে হৃদযার দিকে তাকালো। হৃদযার মুখে ভঙ্গিমায় সুবাহ বুঝে গেল ব্যাপারটা। এখানে আসতে কম ঝামেলা তো পোহাতে হয়নি।

বিয়ের জন্য রঙিন ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িটা ফেলে অন্য গাড়ি করে আসতে হলো, মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে গাড়ি চেন্জ করতে হলো, তবুও কি শেষ রক্ষা হলো? কোথা থেকে এক বুলেট এসে চাকায় ঢুকে পড়লো, বিকট এক শব্দে গাড়ি থেমে গেল। ভাগ্যিস ঠিক সময়ে বাহাদুর তার টিম চলে এসেছিলো! এতজন মানুষ দেখে শত্রুপক্ষ আর এগোনোর সাহস পায় নি‌। হৃদান পাই পাই করে বলেছিলো কাউকে এসব ঘটনা না জানাতে কিন্তু হৃদযা ঠিক‌ই সুবাহ’র মুখ দেখে বুঝে ফেললো। চেঁপে ধরলো তাকে। ঘটনা শোনার পর থেকেই হৃদযা ভয়ে সিটিয়ে আছে। বাবা-ভাইদের ধরে কিছুক্ষণ নিরব কান্নাও করেছে। আবার একরাশ ভয় নিয়ে এলো সাদা লেহেঙ্গা। কিছু বলতেও পারছে না দুজন। আদর ঠিক বুঝে ফেলবে। হৃদযা ইনিয়েবিনিয়ে বলল,

আমার ভাইয়ের পছন্দ দেখেছো? বিয়েতে কে সাদা পড়ে? আক্কেল বলে কিছু নেই। আদু এটা রাখ, তোর ভাইয়া লাল টকটকে লেহেঙ্গা এনেছে ওটা পড়! বিয়েতে রঙিন পড়তে হয়!
সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকালো আদর। হৃদযা থতমত খেয়ে হালকা হাসার ভান‌ করলো। এ‌ই মুহূর্তে আদর হৃদানের ভাবনায় মত্ত থেকে চারপাশ উদাসীন ভাবে নিচ্ছে। তাই হয়তো হৃদযার চোখে সুক্ষ্ম ভয়টা চোখে লাগছে না তার। হাইরে ভালোবাসা! অন্ধ করে দেয়! আবেগ মাখা কন্ঠে বলে উঠলো,

শুভ্র হলো সচ্ছতা, বিশুদ্ধতার প্রতীক। আমাদের বৈধ জীবরের শুরুটা শুদ্ধতা দিয়েই হোক।
হৃদযা-সুবাহ বিপরীতে কিছু বলার খুঁজে পেল না। আদরের মন টা খারাপ করার কোনো ইচ্ছেই হলো না। তাই কথা না বাড়িয়ে তৈরী হতে বললো। ষোড়শী কন্যার মতো হতবিহ্বল আচরণ আদরের। ভালোবেসে নেহাত ই বয়সটা তার নিচে নেমে এসেছে। তাই তো লেহেঙ্গা জড়িয়ে ধেইধেই করে নেচে উঠতেও তার পরিবেশটা মাথায় এলো না।

এক ঝাঁক মানবির সামনেই নিজের ভেতর কার আনন্দানুভব কে হাস্য রসাত্মক, কিছুটা আবেগি ভাবে উপস্থাপন করলো। মুহূর্তেই হাসির শব্দে কলকল করে উঠলো ঘরের কোণায় কোণায়। লালাভ আভা ফুটে উঠলো গালে, আ’রক্ত গাল, এলোমেলো দৃষ্টি, চাপা আনন্দ নিয়েই ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো‌ আদর। বের হলো মিনিট দুয়েক পর। বিষ্ময়ে হতবাক সবাই। লেহেঙ্গা টা যেন আদরের জন্য‌ই বানানো।

সাদা কাপড়টাই রূপ লাবণ্য যেন ঠিকরে পড়ছে‌ তার। আদর লাজুক হেসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসলো‌। আদরের আচরণে হৃদযা-সুবাহ’র মনের ভয় প্রশমিত হয়েছে। আনন্দচিত্তে বোনের মতো বান্ধুবিকে সাজাতে লাগলো। খুব একটা সময় লাগলো না। কৃত্রিম রঙে সাজাতে নারাজ আদর; অপারগ হয়ে জুয়েলারি গুলো পড়িয়ে দিলো দুজন। চোখে কাজল, মাশকারা টেনে ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিয়ে সাজের সমাপ্তি টানলো।

চুলগুলো একসাইড খোঁপা গেঁথে কয়েকটা কৃত্রিম লাল গোলাপ বসিয়ে দিলো; মাথায় উপর সাদা জর্জেটের উড়না। সাদার মাঝে কৃত্রিম লাল গোলাপ টা নিকষ কালো আঁধারে ঢাকা আকাশে চাঁদের হাতছানির মতো লাগছে। আহা রূপ! কি সুন্দর! আদর নিজেকেই কয়েকবার ঘুরে ঘুরে দেখলো। নাকের উপর হীরের ছোট নুসপিন টা জ্বলজ্বল করছে, বাম হাতের তর্জনী আঙুলে হৃদানের পড়িয়ে দেওয়া আংটি। ইশশশ কেমন ব‌উ ব‌উ লাগছে।

অদ্ভূত দ্যোতি ছড়াচ্ছে যেন। হৃদযা-সুবাহ বার কয়েক প্রশংসা করে ক্ষান্ত হলো। হাসাহাসির মাঝেই পেরিয়ে গেল আধা ঘন্টা। দরজায় নক পড়লো, শরীরে ঈষৎ কম্পন টের পেল আদর। আর কিছুটা সময় মাত্র! ঘরে ঢুকে থমকালো আত‌ইয়াব। মুগ্ধ চোখে বোন কে পরখ করলো। ঠোঁটের সেই মিষ্টি হাসিটাই যে সাজ কে অনন্য রূপ দিয়েছে! ললাটে ঠোঁটের ছোঁয়া দিয়েও ক্ষান্ত হলো না আত‌ইয়াব, শক্ত করে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো আদরকে।

শরীর তার অসাড় হয়ে যাচ্ছে কেমন, বোন টা পরের ঘরে চলে যাবে; হুহু করে উঠলো বুকটা। বোনকে এত খুশি দেখে ইমোশনাল করতে চাইলো না সে। হাত ধরে ঘর থেকে বের হলো। ভাইয়ের দিকে প্রশ্নাত্মক চাহনী দিয়ে তাকিয়ে আছে। আত‌ইয়াব মাথা নেড়ে সায় জানালো; আদরের আনন্দ টা যেন দ্বিগুন হলো। তার ইচ্ছে মতোই তাহলে সব হচ্ছে। সিঁড়ির কাছে আসতেই থেমে গেল আদর। ও‌ই সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে আছে তার বড়‌আব্বু; আত‌ইয়াবের সিনিয়র স্যার রূপে। দৌড়ে গিয়ে জাপটে ধরতে ইচ্ছে করলো কিন্তু সম্ভব না। রাজীব আহমেদ হাত বাড়িয়ে দিতেই আদর মিষ্টি হেসে হাতে হাত রাখে। বাবা-ভাইয়ের হাত ধরে রাজকন্যা নামছে। নতুন উদ্যমে নতুন অধ্যায়ে পা দিতে!

থমকে গেছে হৃদস্পন্দন। শিথিল হয়ে গেছে শরীর। চোখে মুখে মুগ্ধতা বিরাজ করছে। অপলক তাকিয়ে আছে হৃদান। রাজকীয় বেসে রাজকন্যা নেমে আসছে যেন! আদরের দৃষ্টি নিম্নে সিঁড়ির দিকে। ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে আসছে। নিচের দিকে তাকিয়েও হৃদানের প্রখর দৃষ্টি উপলব্ধি করতে পারছে সে। বক্ষপট ক্রমানয়ে গতিশীল আকার ধারণ করছে। হৃদপিন্ড ধড়াস ধড়াস করে লাফাচ্ছে। রন্দ্রে রন্দ্রে উত্তাপ ছড়িয়ে যাচ্ছে।

হৃদানের পাশে দাঁড় করানো হলো। চোখ তুলে তাকালো আদর। তীক্ষ্ম দৃষ্টি মেলে প্রেম পুরুষ কে পরখ করতে লাগলো। সাদা কাপড়ের ধাঁচে গোল্ডেনের সুক্ষ কারুকাজ, সাদা পাজামা, মাথায় নামাজ টুপি, হাতে ঘড়ি, স্নিগ্ধ মুখে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোকটি, দৃষ্টি তাকে ঘিরেই। মুহূর্তেই মনে হয় হৃদপিন্ডের সংকোচন-প্রসারণ থেমে গেল। এলোমেলো দৃষ্টি ঘুরিয়ে লোকটির দৃষ্টিচ্ছেদ করার চেষ্টা করলো। নাহ, লোকটি এক‌ই ভঙ্গিমায় তাকিয়ে আছে। আশেপাশের মানুষ যে মুখ টিপে হাসছে খেয়াল নেই। আত‌ইয়াব হালকা কেশে হৃদানের দৃষ্টি ঘুরানোর চেষ্টায় উদ্যত হলো। সফল হলো, একপলক সবার দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকে হালকা হাসলো সে। আদরের ঠোঁটের কোণেও লাজুক হাসি ফুটে উঠলো।

দুজন কে পাশাপাশি বসিয়ে জলদি হাতে কাজি কাগজপত্র গোছাতে লাগলো। অনুমতি নিয়ে আওড়াতে লাগলো কিছু শব্দ। কবুল বলার সময় এলো। আদরের দিকে নিস্ফলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কবুল বলে দিলো হৃদান। এবার এলো আদরের পালা। পাশেই বসে আছে আত‌ইয়াব। শক্ত করে আদরের এক হাত ধরে আছে। মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে রাজীব আহমেদ। হৃদান চাতক পাখির মতো চেয়ে র‌ইলো আদরের মুখপানে।

আদরের কান্না পেল না; চোখ বুঝে বাবা-মায়ের মুখটা মনে করার চেষ্টা করলো। সফল হলো; কেঁপে উঠলো ঈষৎ। একপলক রাজীব আহমেদের দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে কবুল শব্দ উচ্চারণ করলো। একবার নয় তিন বার! পবিত্র শব্দ উচ্চারণ করে একেঅপরের বৈধতার লাইসেন্স পেয়ে গেল। চোখ বুজে বসে আছে হৃদান। চোখ তার লাল হয়ে আছে। হাইরে ভালোবাসা; প্রাপ্তিতেও চোখের জল বাঁধ মানে না!

সবার সামনেই আদরের ডান হাত আঁকড়ে ধরলো হৃদান। প্রশান্তিতে চোখ বুজে এলো আদরের। চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো দু’ফোটা তপ্ত জল। ভালোবাসার অনুভূতি অনবদ্য! অনন্য সুন্দর!
বিদায়ের সময়। আদর কে কাঁদার কোনো সুযোগ ই দেয়নি হৃদান। প্রেয়সী কি বুঝে না; চোখের জল প্রেমপুরুষের বুকে জ্বালা ধরায়, রক্তক্ষরণ হয়। আত‌ইয়াবের সাথে কিছু কথা সেরে আদর কে নিয়ে গাড়িতে বসে। গাড়ির দরজা বন্ধ করে একপ্রকার লুফে নেয় বুকের মাঝে।

এ‌ই মুহূর্তটার অপেক্ষায় ছিলো এতক্ষণ। বৈধ স্পর্শের শুভক্ষণ এলো সবে। আদর চুপটি করে মিশে র‌ইলো হৃদানের বাহুতে। বুকের টিপটিপ শব্দ কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে আদরের। ভালো লাগায় ছেয়ে যায় মন। এভাবে কতক্ষন ছিলো আদর জানে না; সময় টা যেন খুব তাড়াতাড়ি চলছে। ইতিমধ্যেই গাড়ি চলতে শুরু করেছে। ঝাঁকুনি তে আদর বুঝতে পারে, কান্নারা দলা পাকিয়ে আছে কেমন। জানালা দিয়ে আহমেদ বাড়িটা দেখে নেয় এক পলক। ছলছল করে উঠে নয়ন। তপ্ত শ্বাস ফেলে সিটে মাথা এলিয়ে দেয়। ঠিক তখনি এক গভীর স্পর্শ টের পায় আদর।

পরম যত্নে কারো অধর তার অধরে বিচরণ করছে। চোখ বড় বড় আকার ধারণ করে, হাত দিয়ে ঠেলতে গিয়েও পারে না। আঁকড়ে ধরে হৃদান, আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে আসে আদরের। আঁকড়ে ধরে হৃদানের ঘাড়, চুল মুঠি করে সামান্য দূরত্ব টুকুও গুঁচিয়ে দেয় সে। চলতে থাকে গাড়ি, অনুভূতি গুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠে, ভাসতে থাকে অনন্য এক সুখের সাগরে। গড়িয়ে যায় সময়!

অন্তরীক্ষ শান্ত! চন্দ্রপ্রভা আড়ষ্টবিহীন বিরাজমান। রাস্তার দু’পাশের নিয়ন আলোয় চারপাশ হলদেটে ভাব। কিছুক্ষণ পর পর বেওয়ারিশ কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। গাড়ির জানালা ভেদ করে চন্দ্রপ্রভার এক ছিটে আলো পড়ছে হৃদানের চাঁদের উপর। স্নিগ্ধ মুখশ্রীটাই অনন্য এক জ্যোতি খেলা করছে। মায়াময়ী মেয়েটি তার সকল অনুভুতির পরোয়া না করে তার‌ই বক্ষ গভীর ঘুমে মগ্ন। শান্ত পরিবেশে প্রেমপুরুষের বক্ষে ঘুমানোর সুযোগ টা একদম লুফে নিয়েছে যেন।

কিন্তু মেয়েটি কি জানে তার এ‌মন রূপ দেখে কেউ একজন ভেতরে ভেতরে বারবার মরে যাচ্ছে? অম্লজানের ঘাটতি গুলো যেন বেশ চোখে পড়ছে। অপলক মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে হৃদান। সবাইকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে হৃদান চলছে অজানা গন্তব্যে। যার খবর সে ছাড়া কেউ জানে না। সরু রাস্তা ধরে ছুটছে গাড়ি। ড্রাইভারের স্থানে পান্চু বসে আছে। আজ আর কোনো গার্ড নিয়ে আসেনি।

হৃদানের মতে একপ্রকার শত্রুর চোখে ধুলা দিয়েই সে একান্তে সময় বের করেছে। গুরুত্বপূর্ণ একটা দিনে আদরের উচিত মায়ের কবর টা দর্শন করা। অথচ মেয়েটি জানতো‌ও না তার মা’কে কোথায় শায়িত করা হয়েছে! ভাবনায় ব্যস্ত হৃদানের শরীর হঠাৎ করেই কেঁপে উঠে। ধরধর করে ঘামতে শুরু করে সে। ভুল করেছে, বড্ড বেশিই ভুল করেছে সে। গাড়িটা হঠাৎ করেই থেমে গেছে। কারণ ইতিমধ্যেই হৃদানের জানা।

ঘুমে মগ্ন প্রেয়সীর মুখশ্রী চোখে পড়তেই হৃদানের বুকে চিনচিনে ব্যাথা হয়। তার হেয়ালির জন্য পুরো জীবনটাই বুঝি শেষ হয়ে যাবে। একসাথে পথ চলা এখানেই সমাপ্তি হবে বুঝি! আদরের মাথা সিটে নেতিয়ে দিয়ে পকেট থেকে রিভলবার টা বের করে। অতি সন্তর্পণে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। সামনে দন্ডায়মার চারটি গাড়ির দিকে ছোট দৃষ্টি মেলে তাকায় হৃদান। নিজেকে নিয়ে ভয় সে করে না! পান্চুকে ইশারা দিয়ে এগিয়ে যাবে হুট করেই বিকট শব্দ হয়। থেমে যায় হৃদান; ভয় চোখে গাড়ির দিকে তাকায়। আদরের ঘুম ছুটে যায়; ভয়ে লাফিয়ে উঠে।।

হৃদান কে না পেয়ে ভয়টা আরো দ্বিগুন হয়। মুখ চেপে কেঁদে উঠে‌। ছোট্ট ছোট্ট করে হৃদ ডাকছে‌। পাশে চোখ যেতেই হৃদান কে দেখে নেমে দাঁড়ায়‌। ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে। নিয়ন আলোয় চারপাশ স্পষ্ট। বুদ্ধিমতী আদরের বলে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। দন্ডায়মান ব্রিজের চারপাশ দেখে নেয়; নিচে প্রবাহিত হচ্ছে ভরা স্রোতের নদী। কোথায় আছে বুঝতে পারে না আদর। কিছু বলার সুযোগ ও হয় না তার, ঠাস করে একটা শব্দ হয়, বুলেট এসে সোজা হৃদানের বুকের কয়েক‌ ইঞ্চি উপরে লাগে। স্তব্দ হয়ে যায় আদর, সময় টাও যেন সেখানে থেমে যায়।

হৃদানের দেহ নিস্তেজ হয়ে আসতেই চিৎকার করে উঠে আদর। চোখের বাঁধ এবার ভেঙেছে। সাদা ড্রেসটাই হৃদানের রক্তে লাল হয়ে গেল। চিৎকার করে কাঁদছে আদর। হৃদান সময় ব্যয় করে না আদর কে নিয়ে পেছনে সরে আসে। গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে পান্চুকে গাড়ি ঘুরাতে বলে। নিজে বসার সুযোগ হয়ে না তার আগেই তুমুল বেগে একটি গাড়ি এসে উড়িয়ে দেয় হৃদানের দেহ। ব্রিজের খামগুলোর সাথে বারি খেয়ে নিস্তেজ দেহ টা স্রোতের মাঝেই বিলীন হয়ে যায়। নিস্ফলক চাহনী তে একবার দেখেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে আদর। পান্চুর কানে হৃদানের একটা কথায় বাজছে,
আমার প্রাণের দায়িত্ব তোমার পান্চু!

দিশেহারা হয়ে গাড়ি ছুটায় পান্চু। নয়নযুগলে জলের প্রভাবে বারবার বিঘ্ন ঘটে, বাম হাত দিয়ে মুছিয়ে নেয়। কমফোর্ট জায়গায় এসেই পান্চু বাহাদুর কে ফোন দেয়। বলতে পারে না কিছু, বাহাদুর বুঝে নেয়। নিজের টিম নিয়ে একরাশ‌ উৎকুন্ঠায় ছুটে আসে। মনে একটাই প্রশ্ন ঠিক আছে তো সব!

ম্রিয়মান সূর্য টা অভিমান ভুলে পূর্বাকাশে ফুটে উঠেছে‌। দূর থেকে আসা পাখির কলকাকলি জানান দিচ্ছে আঁধার কেটে ভোরের আগমন হয়েছে। জাগতিক নিয়মানুসারে সবার জীবন ই চলছে‌। শুধু থেমে গেছে কয়েকটা জীবন; জীবনের মানে। এ‌ই যে কাল রাত থেকে হৃদান‌ কে খুঁজার কাজ চলছে। কত দূর পর্যন্ত ডুবুরি রা গিয়েছে; নেই! এত স্রোতের মাঝে নিস্তেজ দেহ আটকে থাকে? ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে আছে চৌধুরী পরিবার।

ব্রিজের এক কোণায় বসে আছে আদর‌। গায়ে এখনো সাদা লেহেঙ্গা। সাথে যোগ হয়েছে অর্ধাঙ্গের রক্ত! মাথার উড়না এক সাইট পড়ে আছে, খোঁপায় ঠেসে দেওয়া ফুল গুলোর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। চারদিক মানুষে ভরপুর! একের পর এক ছবি সোশাল মিডিয়াতে প্রকাশ হচ্ছে। ক্যাপশনে আফসোসের শেষ নেই! কেউ কেউ আদরের জন্য কষ্ট অনুভব করছে, এখন তার কি হবে ভেবে আফসোস করছে; অনেকেই চোখের জল ফেলে উপর ওয়ালার কাছে প্রার্থনা করেছে । কি দৃশ্য! রিপোর্টারস রা লাইভ করে সবার নিকট খবর পৌঁছে দিচ্ছে। দৃশ্যগুলো অন্যজনের কাছে মজার, কৌতুহলের হলেও আপনজনদের জন্য মৃত্য সমতুল্য।

নাবিল চৌধুরী ছেলের খবর নিতে না পেরে মিনি স্ট্রোক করেছেন‌। বর্তমানে হসপিটালে রাখা হয়েছে। মৃহান চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে ব্রিজের উপর; পাশেই সুবাহ তার হাত আঁকড়ে ধরে আছে। ভরসা যোগাচ্ছে। কিন্তু হায়! এমন সময়ে এসব চলে? শতবার মন ভেঙে যাচ্ছে তবুও বুকভরা আশায় চেয়ে আছে‌। কখন খুঁজে পাবে ভাইকে!
হৃদযা! সে তো এ‌ই দুনিয়ায় আছে বলে মনে হয় না। আত‌ইয়াবের বুকে মাথা রেখে চোখ ছোট ছোট করে দেখছে সব। আত‌ইয়াব নিজেও ভেতর থেকে ভেঙে পড়েছে। তাদের সম্পর্ক টা ঝগড়ার হলেও মধুর ছিলো; অর্ধাঙ্গিনী , বোন সবমিলিয়ে তার বুকের ভেতর যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে কাউকে দেখাতে পারছে না। নিজের শরীর অসাড় হয়ে আসতে চাইছে তবুও কোনো রকম নিজেকে সামলে রেখেছে। কি দুর্বিষহ পরিবেশ!

রামিয়ার পাশে বসে আছে কান্চু। বড় ভাইয়ের মতো আগলে রেখেছে। দুজনের চোখের পানি শুকিয়ে দাগ সৃষ্টি হয়েছে। সবার দৃষ্টিই আদরের দিকে; মেয়েটা জ্ঞান ফেরার পর যে বসেছে আর উঠেনি; একটা কথাও বলেনি, না কেঁদেছে। ভয়টা তো এখানেই। মেয়েটা বাঁচানো যাবে না! আত‌ইয়াব হৃদযা কে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে আদরের কাছে গেল। পান্চুর বুকে মাথা রেখে নদীর দিক তাকিয়ে আছে সে।

পান্চুর দিকে তাকিয়ে বড্ড মায়া হলো আত‌ইয়াবের। কতটা বছর কাজ করেছে‌। আত‌ইয়াব কে দেখেই পান্চু সরে বসলো; আদর কে আগলে নিলো আত‌ইয়াব। কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেল না সে। চুপ করেই র‌ইলো। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে সন্ধ্যা এসেছে। পশ্চিমে সূর্য ডুবে যাচ্ছে লাল আভা ছড়িয়ে। ভিড় কমে এসেছে। ডুবুরি রা চলে গিয়েছে। ব্রিজটাতে বসে আছে শুধু আদর-আত‌ইয়াব! কয়েকহাত দূরে পান্চু-বাহাদুর! কিছু কিছু রিপোর্টারস এখনো রয়ে গেছে।
আত‌ইয়াব দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদর কে কোলে তুলে নিলো; তবুও নির্জীব আদর।
কতটা শকড পেলে মানুষ এমন হতে পারে!

রাত গড়িয়ে তিনটার কোটায় ঠেকেছে। গভীর ঘুমে মগ্ন সবাই। দূরের ঝোপঝাড় থেকে ভেসে আসছে নিশাচরের ডাক। আহমেদ বাড়ির গুমোট, নিস্তব্ধ পরিবেশে একটু বেশীই ভয়ংকর লাগছে রাতটা। জানালার ধারে বসে আছে আদর। দৃষ্টি শূণ্যে! আত‌ইয়াব আদর কে নিয়ে সোজা আহমেদ বাড়িতে এসেছে। এরপর থেকেই আদর ঘর বন্দি। কয়েকবার ডেকে গেছেন আত‌ইয়াব ও তার মা। কাজ হয়নি‌।

হঠাৎ করেই আদরের মনে হয় তার কাল বিয়ে হয়েছে! এখন তার শশুড় বাড়ি থাকা উচিত। জ্ঞানশূন্য আদর যেন চারপাশের পরিস্থিতি ভুলে গেছে‌। ঘর থেকে বের হয়ে সোজা গাড়িতে বসে পড়ে। গাড়ির হর্ন শুনেই আত‌ইয়াব ঘর থেকে তাড়াহুড়ো করে বের হয়; খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। তার আগেই আদর ছুট লাগায়। হৃদযাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রাখা হয়েছে। পিছু নিতে উদ্যত হতেই পান্চু মাথা নেড়ে না করে; আশ্বস্ত করে সে আছে আদরের সাথে! আত‌ইয়াব কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঘরে চলে যায়।

চৌধুরী বাড়ির সামনে গাড়ি রেখেই আদর নিজেকে একবার দেখে নেয়‌। লেহেঙ্গা টা এখনো খুলেনি। নির্জীব পায়ে হেঁটে সদর দরজায় দাঁড়ায়। নাবিল চৌধুরী কে বাড়ি নিয়ে আসা হয়েছে। মৃহান ফোন হাতে ড্রয়িং রুমে বসে ছিলো। পুলিশ জানিয়েছে যখন তখন খবর দিবে তাই সে ড্রয়িং রুমেই বসে ছিলো। এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠতেই চমকে উঠে। একপ্রকার দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে‌। আদরকে বিয়ের পোশাকে দেখেই মৃহানের চোখ জলে ট‌ইটম্বুর হয়ে যায়। উথাল পাতাল ঝড় শুরু হয় বুকে। আদর মিষ্টি হেসে বলে উঠে,

ভাইয়া দেখো না সবাই আমাকে রেখেই চলে এসেছে। আমাকে বরণ করবে না? বরণ করো, আমি এ বাড়ির নতুন ব‌উ না?
হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মৃহান। কথা শুনেই সুবাহ বাইরে আসে; প্রাণপ্রিয় বান্ধুবীকে দেখেই ঢুকরে কেঁদে উঠে সে। একপলক ফোনে জ্বলজ্বল করা আত‌ইয়াবের মেসেজের দিকে তাকিয়ে মৃহান সুবাহ কে ইশারায় বোঝায়, ‘আদর যা বলে তাই শুনতে’ । ট্রমার মধ্যে আছে আদর; তাই এমন ব্যবহার করছে। সুবাহ আদর কে বরণ করে ঘরে নিয়ে আসতেই আদর কাউকে কিছু না বলেই হৃদানের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। অনুভূতিহীন চোখে তাকিয়ে থাকে দুজন। শব্দরাও যেন বেইমানি করেছে আজ। কেমন করে স্বাভাবিক হবে সবাই? আদ‌ও কি হতে পারবে?

মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ১৯

(কালকে না দেওয়ার জন্য দুঃখিত বলবো না কারণ অপারগ ছিলাম। ব্যাথা নিয়ে লিখা যায়? আজকের পর্বটা কয়বার বসে যে শেষ করেছি ইয়াত্তা নেই। বড্ড অগোছালো হয়েছে। কি লিখেছি নিজেই অনুধাবন করতে পারিনি। ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। শুকরিয়া!)

মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ২১