মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ১৯

মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ১৯
Tahrim Muntahana

স্বচ্ছ তারাযুক্ত আকাশে হুট করেই মেঘের আনাগোনা। বিশাল চাঁদের পাশে কেউ নেই। মেঘের দল উড়ে এসে কিছুক্ষণ পর পর চাঁদ কে ঢেকে দিচ্ছে। কিন্তু স্থায়ীত্ব বেশীক্ষণ টিকিয়ে রাখতে না পেরেই হাল ছেড়ে দিয়ে ছুটে চলে। প্রকট হয় নজরকাড়া চাঁদ। জ্বলজ্বল করে মেঘেদের উপেক্ষা করে। পরিবেশ আস্তে আস্তে গুমোট হলেও চৌধুরী বাড়িতে অবস্থান রত কারোর হেলদুল নেই। তারা নিজ আড্ডাতে ব্যস্ত।

এত এত আলোকসজ্জার মাঝে আকাশ দেখার সময় কোথায়! কিন্তু পান্চুকে তো সব দিকে খেয়াল রাখতে হয়। আকাশের অবস্থা দেখেই সে আদরের কাছে ছুটে এসেছে। আদর তখন আপন মনে ব্লাশ করছিলো। পান্চুর কথায় টনক নড়ে তার। লজ্জাকে পেছনে ঠেলে হৃদান কে নিয়ে মাঝখানে দাঁড়ায়। এগিয়ে আসে সবাই। বিশাল বড় কেক আনা হয়; বাবা ভাইকে দুই পাশে রেখে কেক কাটে হৃদান। মোম গুলো নিভাতে চাইলেও আদর আটকে দেয়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

থাক না আলো; অন্ধকার বড্ড ভয় করে। বেশ কিছুক্ষণ সময় পাড় হয় খাওয়া দাওয়ার উপর। সবাই বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিতেই নাবিল চৌধুরী হাঁক ছেড়ে ডাকেন সবাই কে। কি যেন এনাউন্সমেন্ট করবেন! আত‌ইয়াব কে ডেকে পাশে রাখে নাবিল চৌধুরী। আদর হৃদান পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। আত‌ইয়াব মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই নাবিল চৌধুরী বলে উঠে,

আমার ছোট ছেলের জন্মদিনের পার্টিতে আরেকটি ঘোষণা দিতে চাই। আপনারা সবাই কোনো না কোনো ভাবে আমার নিকটস্থ, শুভাকাঙ্ক্ষী। তাই খুশিটা আপনাদের ভাগ করে নিতে চাই। একসময়ের তুখোড় ব্যবসায়ী রাতাফ আহমেদের মেয়ে এবং ডক্টর আত‌ইয়াব আহমেদ ইত্তেয়াজের বোন আদর আহমেদের সাথে আমার ছেলে হৃদান চৌধুরীর বাগদান ও আকদ তিনদিন পর। আপনারা অনেকেই জানেন আদর নিজেও একজন ব্যবসায়ী; সফলতার শিখরে পৌঁছাতে বেশী দেরী নেই। দোয়া করবেন ওদের জন্য। দাম্পত্য এবং কাজের দিক; দু’জায়গাতেই যেন সর্বোচ্চ সফল হতে পারে। সুখে বসবাস করতে পারে। আপনাদের সবার দাওয়াত র‌ইলো। অবশ্যই খুশীতে সামিল হবেন। ধন্যবাদ!

চারদিক করতালির শব্দে মুখরিত। একটা মানুষ ই শুধু স্তব্ধ, বিমুড়। থমকে গেছে তার স্পন্দন। মনের মধ্যে হাজারো অনুভূতি কিলবিল করছে; একরাশ সুখের আগমন বার্তা জানান দিচ্ছে তিনদিন পর আদর তার‌। পুলকিত হয় মন; চিকচিক করা নয়ন যুগল নিয়ে জাপটে ধরে বাবাকে। এতটা খুশি সে, দিকবেদিক ভুলে গেছে। আদর নিজেও স্তব্দ। সে ভেবেছিলো হৃদান অতিরিক্ত খুশিতে হাসবে, নাচবে। কিন্তু লোকটা যে খুশিতে নিজের অস্তিত্ব ভুলে যাবে সে ভাবতেও পারিনি। নাবিল চৌধুরী আদুরে স্পর্শে ছেলের পিঠে হাত রেখে‌। হৃদান নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারে না। একপলক আদরের ছলছল চোখের দিকে তাকিয়েই চোখের জল ছেড়ে দেয়। আদো আদো বুলিতে বলে উঠে,

আমার জন্মদিনে শ্রেষ্ঠ উপাহার বাবা। আমি নিজের খুশি প্রকাশ করতে পারছি না; ভেতর টা তুলপাড় হয়ে যাচ্ছে। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না বাবা, হাসবো? নাচবো? নাকি গাইবো? কোনটা বলে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করবো? আমার কান্না পাচ্ছে, ভিষণ কান্না পাচ্ছে বাবা। তিনদিন পর আদর সম্পূর্ণ‌ই আমার, আমার অর্ধাঙ্গিনী! আমি স্বপ্ন‌ দেখছি না তো বাবা? তোমরা প্রাঙ্ক করছো আমার সাথে?

এতক্ষণের খুশির মুহুর্তের আদলে অদ্ভূত দৃষ্টি। আহা ভালোবাসা! এতটা ভালোবাসতে কেউ পারে? হৃদানের বলা প্রতিটা শব্দ সবার কর্ণগহরে পৌঁছেছে। আদর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি দৌড়ে চলে যায় হৃদানের কাছে। জাপটে ধরে পেছন থেকে। শান্ত হয়ে যায় হৃদান। কিছু সময় পাড় হতেই আদর ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
কোলে নিন বোকা ছেলে! এত খুশির খবরে কান্না করলে ক্যান্সেল করে দিবো!

হৃদান বাবাকে ছেড়ে দেয়। মুহূর্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে। আদর একটু সরে আসতেই হৃদান সময় ব্যয় করে না; ফট করে কোলে তোলে নেয়। চারদিক থেকে ভেসে আসে চিৎকারের শব্দ। সমাগম থেকে দূরে চলে আসে হৃদান। নাবিল চৌধুরী খুশিতে আবার সবাইকে মিষ্টি মুখ করান। আস্তে ধীরে বাড়ি খালি হতে শুরু করেছে। চৌধুরী বাড়ির ড্রয়িং রুমে জম্পেশ আড্ডা চলছে যার মধ্যমনিই হলো পান্চু-বাহাদুর। এরা দুজন একসাথে থাকলেই যে পরিমাণ ঝগড়া করে তা দেখে সবাই হাসতে হাসতে শেষ।

আকাশের মেঘলা ভাব টা কেটে গিয়েছে। দৃশ্যমান হচ্ছে তারকারাজির। আকাশ নিজের ছন্দে আবার সেজে উঠেছে। মৃদু বাতাস; পরিবেশটা প্রেমিকযুগলের জন্য একটু বেশীই মানানস‌ই। চাঁদনি রাতে মৃদুমন্দ বাতাসে অপরূপা কন্যাকে দেখলে কবি হয়তো শ’খানেক কবিতা রচনা করে ফেলতো। হাজারো প্রেমময় শব্দ আওড়াতো। তবে আদর কে কোলে নিয়ে বসে আছে হৃদান। একদম নিশ্চুপ! দৃষ্টি তার মিশে থাকা মেয়েটির উপর।

হৃদান কবি না হলেও প্রেমিক তো। আর প্রেমিক রা চাইলেই প্রেমিকার জন্য শতশত কবিতা রচনা করতে পারে। অনুভূতি প্রকাশ করে প্রেমিকার মন কে পুলকিত করতে পারে। সবটাই নিজের মনমতো! হৃদানের খুব ইচ্ছে করছে কবিদের মতো কিছু বচন আওড়াতে। কিন্তু সে পারছে না; আজ সে এতটাই খুশি যে কথাও বের হচ্ছে না। আদর নির্মিশেষ তাকিয়ে আছে খোলা আকাশে; চাঁদ কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। মনের মধ্যে কি চলছে বোঝা বড় দায়‌। এমতাবস্থায় হৃদান একটু নড়েচড়ে বসে; আদরের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। আদর বুঝতে পেরেও চুপ থাকে‌। হৃদান না পেরে সরল কন্ঠে বলে উঠে,

আমি অপেক্ষায় আছি সেই ক্ষণ টার জন্য
তোমাকে বৈধ ভাবে পাওয়ার তৃষ্ণায়!
নির্মিলিপ্ত ভাবে চাতক পাখির মতো দিন গুনছি!
প্রতিটা মিনিটের ঝংকার হৃদয়ে দোলা দিয়ে যাচ্ছে।
এ কি করিলে প্রেয়সী? বার বার মরে যাচ্ছি!
প্রতিটা ক্ষণ শরীরে অদ্ভূত শিহরণ হচ্ছে!

শিরা উপশিরায় রক্ত প্রবাহের সাথে জানান দিচ্ছে অপেক্ষার কারণ!
বক্ষপটের চিনচিনে ব্যাথা, হৃদয়ের ধুকধুকানি, কম্পনরত শরীর আমার অনুভূতি দৃশ্যমান করছে সমাগমে।
অথচ যাকে ঘিরে এত আয়োজন সে তো নির্মিশেষ তাকিয়ে আছে অন্তরীক্ষে!

ঠোঁটের কোণে নিরব হাসি নিয়ে মায়া মায়া দৃষ্টিতে হৃদান কে অবলোকন করছে আদর। এ‌ই মানুষটা কি অবলিলায় নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে‌। অথচ সে? হৃদয়ে রঙিন পাখির মতো ঝাপটানো অনুভূতি গুলো প্রকাশ করতে পারছে না। মনের সাথে লড়াইতে বারবার হেরে যাচ্ছে। আ’রক্ত গাল দুটো লুকিয়ে আদর হৃদানের বক্ষে মাথা এলিয়ে দেয়। নির্জিব থাকে দুজন‌ই। অদ্ভূত শান্তিতে দুজনেই ডুবে থাকে!

হাফ টাইমে অফিস থেকে চলে এসেছে হৃদান। রাজীব আহমেদের সাথে দেখা করতে এসেছে। খোশমেজাজেই ছিলো রাজীব আহমেদ। কিন্তু হৃদানের চিন্তায় নেতিয়ে যাওয়া মুখটা দেখে বুকের ভেতর অজানা আশঙ্কায় হুহু করে উঠে। বিচলিত কন্ঠে বলে উঠে,

সব কিছু ঠিক আছে হৃদান?
একপলক রাজীব আহমেদের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নেয় সে। চাপা স্বরে বলে উঠে,
ঠিক আছে আবার ঠিক নেই! গুড নিউজ আগে দিবো না ব্যাড নিউজ?
তোমার গুড নিউজ আগেই জানা হয়েছে। একটু তো লজ্জা রাখো। আমার মেয়েকে বিয়ে করছো আর শশুড় কে বলতে এসেছো!

রাজীব আহমেদের কথায় হেলদুল হয় না হৃদানের। ঠেস দিয়ে বলে উঠে,
তোমার অসভ্য ছেলে জানিয়ে দিয়েছে?
খবরদার আমার ছেলেকে অসভ্য বলবে না। অসভ্য তো তুমি, ঠোঁটকাটা স্বভাবের।
হৃদান তীক্ষ্ম চোখে তাকায়। রেষাত্মক কন্ঠে বলে উঠে,
হ্যাঁ তোমার ছেলে আমার বোনের সাথে চিপকে থাকতো তখন প্রেম হতো আর আমি একটু কথা বললেই অসভ্যতা হয়ে যায়। মীর জাফরের গোষ্ঠী!‌

রাজীব আহমেদ কটমট চোখে তাকিয়ে থাকে‌। এ‌ই ছেলের সাহস কত। রাজীব আহমেদ রেগে যাচ্ছে বুঝতে পেরে হৃদান কথা ঘুরিয়ে বলে উঠে,
আমি চাইছি আকদের দিন আদরের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ টা কাছে থাকুক। কিন্তু এত চেষ্টা করেও সম্ভব হচ্ছে না। ওদের মেইন মোটিভ টা জানলেও প্ল্যান‌ কোনো ভাবেই জানতে পারছি না। আর না পারছি সব গুলো ধরতে‌। রহস্য যেন বেড়েই যাচ্ছে।

হৃদানের কথায় রাজীব আহমেদের কপালেও চিন্তার ভাঁজ পড়ে। কিছুক্ষণ ভেবে বলে উঠে,
আমার মনে হয় সমাগমে আসার সময় হয়েছে। ওরা আমাকে তোমাদের সাথে দেখেই দিকবেদিক ভুলে যাবে। ধরা পড়ার ভয়ে তটস্থ থাকবে যার ফলে কোনো না কোনো ভুল তো করবেই। তখনি আমরা সমূলে ওদের ধরবো!
হৃদান ও ভাবতে বসে যায়। মন বলছে রাজীব আহমেদ ঠিকই বলছে কিন্তু মস্তিষ্ক বলছে না এটা করলেই ওদের মাঝে সব খোলাসা হয়ে যাবে। যার ফলে সবার পরিচয় জানার আগেই ওরা ক্ষতি করে ফেলবে!

না বড় শশুড়! এমন করলে ওদের আরো ক্ষেপিয়ে দেওয়া হবে‌। ভুলে যেও না আমাদের কাছে কোনো‌ প্রমাণ নেই; শুধুমাত্র টাকা-ক্ষমতার জুড়ে ওদের ধরা সম্ভব নয়। আর পুরো দেশ জানে তুমি দোষী, তোমার কথাও কেউ বিশ্বাস করবে না। ওদের ও টাকা কম নেই! সতর্ক হয়ে যাবে ওরা; ক্ষতি করতেও দু’দন্ড ভাববে না। আর কথা হচ্ছে তুমি কি ভাবছো ওরা জানে না তুমি আমাদের কাছে আছো? জানে! শুধু জানে না কেন‌ তুমি আমাদের‌ কাছে। ধরে নিয়েছে তোমাকে শাস্তি দিতেই ধরে রেখেছি। না হলে এতদিন কিছু না কিছু করে ফেলতো।

রাজীব আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হৃদানের একটা কথাও ভুল নেই। দোষী ওদের সামনে তবুও শাস্তি দিতে পারছে না। এর থেকে আফসোসের বুঝি কিছু আছে?
আত‌ইয়াব কে সবটা বলো, কাজে লাগবে ওকে।

একদম না, আপনার ছেলে অবিশ্বাস করবে। শেষমেষ দেখা যাবে বিয়েটাই ভেঙে দিলো, আদর কে নিয়ে কোনো রিস্ক আমি নিতে চাই না। যা করবো বিয়ের‌ পর‌ই করবো। আগে নিজের করে নিই তারপর সবার মাথায় ঘন্টা বাজাবো।
চিন্তার মাঝেও হালকা হাসলো রাজীব আহমেদ। আদর কে বড্ড বেশিই ভালোবেসে ছেলেটা। হৃদান রাজীব আহমেদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসে। বাড়িতে যেতে হবে।

চারদিক লালাভ আভায় ছেয়ে গেছে। প্রকৃতি সেজেছে নতুন রঙে। সূর্য কে বিদায় দিতে প্রকৃতি লাল টুকটুকে বউ রূপে সেজেছে। প্রকৃতির লজ্জারাঙা রূপ দেখতে ব্যস্ত হৃদান। আজ রাত টা পেরোলেই আকদ। মনের মধ্যে যেমন প্রশান্তি ব‌ইছে তেমনি অজানা আশঙ্কায় খচখচ করছে। কালকে অফিস থেকে ফেরার পথে তার মনে হচ্ছিল ফলো করছে কেউ‌। বিশেষ পাত্তা দেয় নি কিন্তু যখনি একেরপর এক গুলির বর্ষন হতে লাগলো তখনি একরাশ ভয় এসে হানা‌ দিলো মনে।

মৃত্যকে বড্ড ভয় করে সে। পরিবার, সুশ্রী মুখশ্রীর মেয়েটিকে ছেড়ে যেতে বড্ড ভয় করে। এখনো তো অনেকটা পথ চলা বাকি‌। ফাইট করার শক্তি বা ইচ্ছে কোনোটাই পেল না সে। অগত্যা ঝুঁকি না নিয়ে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে ফিরেছে সে। এও বুঝেছে তাকে মারার কোনো উদ্দেশ্য‌ই তাদের ছিলো না। এমন টা থাকলে কপাল বরাবর গুলি করে দেওয়ার মতো সুযোগ তাদের ছিলো। কিন্তু দেয় নি; শুধু মাত্র ভয় দেখিয়েছে। এর কারণ টাও সে বুঝতে পারেনি। তারা কি চাইছে জানলে সে এক মুহুর্ত‌ও অপেক্ষা করতো না। শাটশাট করে গুলি করে দিতো।

কথাগুলো ভেবেই জানালা থেকে সরে আসে সে। বিছানার দিকে চোখ যেতেই মুচকি হাসে। রাজীব আহমেদের বুকে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে আদর। রাজীব আহমেদ ও দু হাতে মেয়েকে আগলে নিয়েছে। কান্না করতে করতে কখন ঘুমিয়ে গেছে হৃদান বুঝতেই পারেনি। সে তো প্রেয়সীর কন্দনরত মুখশ্রী দেখবে না বলেই প্রকৃতি বিলাস করছিলো; এ মেয়ে তো ঘুমিয়ে গেছে।

হৃদানের দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাজীব আহমেদ। তা দেখে হৃদান বলে উঠে,
নিশ্চয়ই আমার মতো মেয়ের জামাই পেয়ে তোমার গর্বে আকাশে উড়তে ইচ্ছে করছে? কিন্তু তুমি ভুলে যেও না বয়স টা তোমার আমার মতো না। দেখা যাবে আকাশে উড়ার আগেই ধপ করে মাটির নিচে ঢুকে গেলে। হাই হাই শশুড় ছাড়া আমি থাকতে পারবো না!

এতক্ষণের কৃতজ্ঞতা সব হাওয়ায় উড়ে গেল। কটমট চোখে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,
এটা তোমার ডিউটি। সো তোমাকে নিয়ে গর্বের কিছু নেই। এ পর্যন্ত গর্বের কিছু করে উঠতে পারোনি।
হৃদান মুখ বেঁকায়। আত‌ইয়াবের অসভ্য হ‌ওয়ার পেছনে যে শশুড়ের হাত আছে বুঝায় যাচ্ছে। ব্যাঙ্গাত্মক কন্ঠে বলে উঠে,
তার জন্য‌ই তো বলি মি. ডক্টর এমন হলো কেন? যার এমন হিটলার বাপ আছে সে হিটলার না হয়ে পারে? বাপ-বেটা দুটোই ঘাড়ত্যাড়া; মধ্যে আমি এক নিষ্পাপ ফেঁসে গেছি।

রাজীব আহমেদের ইচ্ছে করছে ফর্সা গাল দুটোই গুনে গুনে চারটা থাপ্পড় মারতে। সে যে এই ছেলেটার শশুড় হবে কালকে; ছেলের কোনো পাত্তা আছে? নিজেও পাল্টা বলে উঠে,
আমি ভাবছি নাবিল আর ভাবির মতো ভালো সহজ সরল মানুষের পেট থেকে এরকম এক বেয়াদপ কিভাবে জন্ম নিলো। কুড়িয়ে পাইনি তো আবার?
রাজীব আহমেদের কথা শুনেই হৃদান রাগে দাঁড়িয়ে যায়। এ‌ই লোক তো সুবিধার না। কিভাবে অপমান‌ করলো। সে ও ছাড় দিবে না।

আমি তো শুনেছি তোমার বাবা-মা দুজন‌ই অনেক ভদ্র, নরম মনের মানুষ ছিলো। কিন্তু দেখো তুমি এক নম্বরের জাঁদরেল হয়েছো। নিশ্চয়‌ই তোমাকে চুরি করে ধরা পড়ার ভয়ে আহমেদ বাড়িতে ফেলে গেছে।

শান্তি লাগছে হৃদানের। এ‌ই না হলো হৃদান চৌধুরী। হঠাৎ ই হাসির শব্দ শুনে দুজন‌ই চমকায়। রাজীব আহমেদ রাগ ভুলে যায়। কিছুক্ষণ হলো আদর ঘুম থেকে উঠেছে। উঠেই দুজনের ঝগড়া দেখছিলো। এদের দেখে কেউ বলবেই না জামাই-শশুড়। কেউ কাউকে অপমান করতে ছাড়ে না। না হেসে সে পারলো না। দুজন‌ই আদরের দিকে মায়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হৃদানের খুব আদর আদর পাচ্ছে।

মেয়েটিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে‌। ফট করে বলে উঠে,‌
এ‌ই দিন তো আমার ব‌উ কে। কখন থেকে জড়িয়ে ধরে আছেন। এখন আমি জড়িয়ে ধরবো।
আদর চোখ বড় বড় করে তাকায়। ঠোঁটকাটা স্বভাবের লোকটার মাথায় আসলেই সমস্যা আছে। বাবার সামনে কিসব বলছে। রাজীব আহমেদ বিড়বিড় করে ‘বেরাদপ শব্দটা উচ্চারণ করে। আদরের হালকা চেঁচিয়ে বলে উঠে,
দূরে যান, আমি বড়‌আব্বুর কাছে থাকবো। আর কিসের ব‌উ? বিয়ে হয়নি এখনো ভুলে যাবেন না তাই দূরে থাকুন। অসভ্য ছেলে!

রাজীব আহমেদ খুশিতে লাফিয়ে উঠতে গিয়েও পারেনা। আদর রাজীব আহমেদের বুকে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকে। জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বাবার গন্ধটা নেওয়ার চেষ্টা করে। রাজীব আহমেদ আদরের মাথায় আদুরে স্পর্শ করে যায়। হৃদান হতাশ হয়ে সোফায় হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়ে। শশুড় কি কম ছিলো; এখন ব‌উ ও তাকে অসভ্য খেতাব দিয়ে দিলো। কি এমন অসভ্যতামো করেছে সে; একটু তো জড়িয়েই ধরতে চেয়েছে। হাইরে এই দুনিয়ায় ভালোবাসার দাম নাই। উদাস হয়েই বসে থাকে হৃদান! রাজীব আহমেদের বুকে মুখ গুঁজে আদর ভাবনায় চলে যায়;

অফিসে কাজ করছিলো সে। হুট করেই হৃদান এসে উপস্থিত হয়। বলা নেই জলদি করে তাকে অফিস থেকে বের করে নিয়ে আসে। এতবার জিজ্ঞেস করলেও চুপ থাকে। নির্জন পরিবেশে বাংলোটা দেখেই ভ্রু কুঁচকে আসে তার। হৃদান কিছু বলার সুযোগ দেয় না। রাজীব আহমেদ কে দেখেও নিরব থাকে আদর। চোখ ছলছল করে উঠে। কোনো শব্দ করে না; একপ্রকার ঝাঁপিয়ে পড়ে তার বুকে। চমকে যায় দুজন‌ই‌। ভেবেছিলো আদর প্রচন্ড রিয়েক্ট করবে; ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিবে অথচ হলো তার উল্টো। আদর কিছুক্ষণ কান্না করার পরেই সরল কন্ঠে বলে,

কি ভেবেছিলেন বড়‌আব্বু জেল থেকে পালিয়েছে আমি জানি না? প্রথমেই খবর পেয়েছিলাম। চুপ ছিলাম আপনার জন্য। শপিংমলে অদ্ভূত ব্যবহারের জন্য‌ই আর ঘাটায় নি। তার পর হঠাৎ করে ভাইয়ার বিয়েতে সিনিয়র ডক্টর আসলো। চোখ দেখেই আমার খুব চেনা লাগছিলো। হঠাৎ করেই আগলে নেওয়া, ভরসা দেওয়া; মন বলছিলো বড়‌আব্বুই হবে। শিউর হলাম সেদিন, মাথায় ব্যাথা নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম।

গভীর ঘুম নয়, মনে হচ্ছিলো কেউ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখি ভাইয়ার স্যার। সেদিন ই বুঝে গিয়েছিলাম সবকিছুই আপনি আর ভাইয়া জানেন। এরপর হঠাৎ করে হাওয়া। এত খুঁজলাম পেলাম না। ভাইয়াকে আপনার জন্মদিনের দিন কথা বলতে শুনেছি। সবমিলিয়ে আমার বুঝতে বাকি নেই। আর আমি জানি আমার ভাইয়া আর আপনি অন্যায় কে কখনোই সাপোর্ট করবেন না।

বড়‌আব্বুও যে ভুক্তভোগী আমি আপনার কাছে তাকে দেখেই বুঝেছি। তাই আদর টা ফেলে দিতে পারলাম না। অনেকটা বছর অনাদরেই চলে গেছে‌। এবার আর ছাড়বো না; সব পুষিয়ে নিবো।
কথাগুলো বলেই নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিলো আদর। রাজীব আহমেদ বলার জন্য কিছু খুঁজে পায়নি। হৃদান ও বাবা-মেয়েকে একা ছেড়ে দিয়ে প্রকৃতি বিলাস করছিলো। হৃদানের ডাকে আদর ভাবনা থেকে বের হয়। মুখ তুলে একবার দেখে আবার মুখ গুঁজে দেয়। রাজীব আহমেদ হাসে। হৃদান হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে।

আদু এবার যেতে। বাচ্চাদের মতো করো না। কালকে তো দেখা হচ্ছেই বড়‌আব্বুর সাথে। এখন ছাড়ো। সময় নেই; যেতে যেতে দশটা বেজে যাবে। কালকে অনেক কাজ।

হৃদানের কথায় সায় জানিয়ে আদর রাজীব আহমেদ কে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। আবার ছলছল করে উঠে আদরের চোখ। একটু বেশীই ইমোশনাল সে। এত এত ভালোবাসা পেয়ে আবার আগের আদর হয়ে যাচ্ছে। তবে চেন্জ এতটুকুই পরিস্থিতি বুঝে খাপখাওয়াতে পারে সে। রাজীব আহমেদ মিষ্টি হেসে আদরের ললাটে চুমু এঁকে দেয়। আদরের মুখে হাসি ফুটে। দুজন‌ই বিদায় নিয়ে গাড়িতে বসে। যতদূর পর্যন্ত দেখা যায় রাজীব আহমেদ তাকিয়ে থাকে।

আজ বুকটা যেন শান্তিতে ভরে গেছে। অনেকদিন পর সে আরামে ঘুমাবে। আহমেদ বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে আদরের দিকে একপলক তাকায় হৃদান। আদর কে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না তার। মনে হচ্ছে খুব দূরে চলে যাচ্ছে। আর দেখতে পারবে না। জড়িয়ে ধরে হৃদান। আদর ভড়কায়, থমকায়,‌ শিথিল হয়ে আসে শরীর। হৃদানের আকুলতা বুঝতে পারে। চুপ করে থাকে। হৃদান চাপা কন্ঠে বলে উঠে,

আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি আদর। যতটা ভালোবাসলে নিঃশ্বাস ও নিজের সাথে বেইমানি করে অন্যের হয়ে যায় ততটাই ভালোবাসি। সামনের দিনগুলো খুব কঠিন হবে আদর। নিজেকে খুব স্ট্রং রাখবে। ভেঙে পড়বে না; কাউকে বিশ্বাস করবে না। আপনজন রাই ক্ষতির কারণ হয়। ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে পেছন থেকে তারাই ছুরি চালায়। বিশ্বাস করবে; কিন্তু অন্ধ ভাবে নয়। চোখ কান খোলা রেখে চলবে।

আমি যেখানেই থাকি না কেন তোমার সাথে সবসময় থাকবো। দূর থেকে তোমাকে আগলে রাখবো। জানিনা সামনের পথ কেমন‌। যদি কখনো এমন সময় আসে তোমায় ছেড়ে দূরে থাকি; ভেঙে পড়ো না। ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নিজেকে আরো শক্ত করে গড়ে তুলবে। আমার আদর সব দিক থেকে সফল।

হৃদানের দূরে থাকার কথা শুনেই আদরের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছে। নিমিষেই চোখের কোণে চিকচিক করা জলরাশি গুলো ভিজিয়ে দেয় আদরের গাল, হৃদানের কাঁধ। চমকে আদরকে সামনে আনে হৃদান। স্পষ্ট অভিমান ফুটে উঠেছে আদরের চোখে। হৃদান হালকা হাসে। ললাটে গাঢ় করে ঠোঁট ছোঁয়ায়। কেঁপে উঠে আদর। হৃদান কিছু বলার খুঁজে পায় না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে হুট করেই বলে উঠে,

আঙ্কেল কে বিশ্বাস করার কারণ জিজ্ঞেস করলে না?
আদর গাড়ি ছেড়ে বাইরে আসে। একপলক হৃদানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
যেখানে আপনি আছেন কারণ জানার আগ্রহ, ইচ্ছে, কৌতুহল কোনোটাই হয়নি আমার। আমি শুধু জানি আমার হৃদ শ্রেষ্ঠ!
অভিমান নিয়েই হাঁটতে থাকে আদর।

হৃদান মায়াময় ছলছল দৃষ্টিতে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। হাঁটার প্রতিটা ঝংকারে শরীর দুলছে। কারোর হাঁটাও বুঝি এত নিখুঁত হয়; নাকি তার কাছেই এমন লাগছে। মেয়েটা যে অভিমান করেছে সে বুঝতে পেরেছে। কিন্তু মেয়েটি কে তো বুঝতে হবে সামনের পথ সুগম নয়। প্রিয়জনের বিশ্বাসঘাতকতায় শক্ত থাকতে হবে। এর জন্য তো তৈরি করতে হবে। ভালোবাসা পেয়ে কাঠিন্যতা ভুলে গেছে।

মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ১৮

এভাবে চললে অন্যকেউ যে খুব সহজেই ভেঙে ফেলবে মেয়েটিকে। সে কি করে হতে দিবে এসব। ভালোবাসে তো। নিজেও গাড়ি স্টার্ট দেয়। বুকটা কেমন খা‌ খা করছে। আকদ টা ভালোভাবে হলেই সে কিছুদিন ছুটি নিবে। অজানায় হারিয়ে যাবে প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে। শুধু সময়ের অপেক্ষা!

মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ২০

1 COMMENT

  1. খুব খুব খুব অপেক্ষায় ছিলাম গল্পটার জন্য অনেনননননক গুলো ধন্যবাদ আপনাকে আপু ।
    পরের পর্ব টা একটু তারাতারি দেবেন প্লিজ।
    অপেক্ষায় রইলাম।
    আর গল্পটার জন্য খুব খুব একসাইটেড আমি।

Comments are closed.