মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ১৮
Tahrim Muntahana
গুমোট পরিবেশ। মস্ত বড় চাঁদ আকাশে প্রতীয়মান অপেক্ষায় তারকারাজির। কিন্তু আজ যেন তারকারাজির অভিমান হয়েছে। মেঘমালা দ্বারা সেই অভিমান পুরো পৃথিবীকে জানান দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর গাছের বাঁকে বাঁকে নিরব বাতাস বইছে; দুলিয়ে দিচ্ছে পাতাগুলো। প্রকৃতির এই নিস্তব্ধ রূপ উপভোগ করছিলো হৃদান। আজ তার মনেও অভিমান জমে আছে। সময় চলে গেছে দেড় মাসের বেশী। হৃদান এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। অফিসেও যাচ্ছে।
হুট করেই আদরের কাছে গিয়ে তাকে চমকে দিতেও ভুলে না। কিন্তু আজ তার বড্ড অভিমান হয়েছে। সারাটা দিন কথা হয়নি আদরের সাথে। কতবার ফোন দিয়েছে তবুও ধরলো না। বাহাদুরের কাছে খবর নিয়েছে মেয়ে দিব্যি কাজ করছে; তার ক্ষেত্রেই যত অবহেলা। সেও এখন থেকে কথা কম বলবে; বুঝিয়ে দিবে হৃদান চৌধুরীকে অবহেলা করার ফল। কথাগুলো ভেবেই সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে জানে এটা কখনোই পারবে না। ওই মেয়েটিকে ছাড়া তার চলে না; দুদন্ড কথা না বলে থাকলেই হাঁসফাঁস করে, দম নিতে কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। সেখানে অবহেলা করবে ভাবা নিছক বোকামি ছাড়া কিছু নয়। দরজায় নক হতেই ভাবনা থেকে বের হয় হৃদান। পান্চু এসেছে,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
বস মিটিং আছে পাঁচ মিনিট পর।
হৃদানের রাগ হলো। এই ছেলে কি তাকে মনভোলা পেয়েছে। কিছুক্ষণ আগেও বলে গেছে। এমনিতেই মেজাজ খিটখিটে ছিলো; আদরের সব রাগ এবার পান্চুর উপর ঢেলে দিলো,
কি সমস্যা কি আধা টাকু? আমাকে তোমার কি মনে হয়? মনে নেই আমার? কিছুক্ষণ পর পর এসে ডং করছো। টাক মাথায় সপাটে এক চড় দিবো দিনদুনিয়া ভুলে অক্কা নিবে। আমার চোখের সামনে থেকে সরো নাহলে তোমার টাক মাথায় গুনে গুনে পঁচাত্তর টা বারি দিবো!
পান্চুর মুখ হা হয়ে যায়। এই বসের আবার কি হলো। প্রেমে পড়ে বস তার পাগল হয়ে গেছে সে নিশ্চিত। তাকে নিজেই বললো পাঁচ মিনিট আগে মনে করিয়ে দিতে অথচ এখন! পান্চু টাক মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে হাঁটা ধরলো। সে ভেবে পায় না এরা দুইটা তার টাক মাথাটাকে কি মনে করে। একজন কথায় কথায় একাত্তর টা বারি দিতে চায় যুদ্ধ কে স্মরণ করে, আরেকজন পঁচাত্তর টা বারি দিতে চায় বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুকে স্মরণ করে। মনে হয় সে রাজাকার! বিড়বিড় করে পান্চু মিটিং রুমে চলে যায়। প্রায় সবাই এসে গেছে এখন শুধূ বসের অপেক্ষা। হৃদান পান্চুকে বকেই ফাইল রেডি করতে শুরু করে। মধ্যে আরেকবার আদরের ফোনে ডায়াল করে , রিং বেজে কেটে যায়। মন খারাপ নিয়ে মিটিংয়ে চলে যায় সে।
আহমেদ বাড়িটা এখন আনন্দে ভরপুর থাকে। রামিয়ার একাকিত্ব দূর হয়েছে হৃদযার আগমনে। ইদানিং তার মন খুব একটা খারাপ থাকে না। সারাদিন হইচই করে কাটিয়ে দেয়। আবার হঠাৎ করেই রাফিন নামক অসুখ টা হৃদমাজারে জ্বলন ধরায়। কাতরাতে থাকে সে; একসময় রাতের গভীরেই কষ্টগুলো ধামাচাপা দিয়ে হাসি মুখে দিন পার করে। এই যে এখন মেঘলা আকাশে একা পড়ে থাকা চাঁদ টাকে নিজে মনে করে দুঃখ বিলাস করছে রামিয়া।
চোখের জল গুলো নির্লজ্জের মতো কোমল গালটা ভিজিয়ে যাচ্ছে। তবুও তার খেয়াল নেই; আপন মনেই ভাবতে ব্যস্ত সে। এমন সময় হৃদযার ডাকে চোখের জল মুছে নেয় সে। চোখ মুখে পানি দিয়ে রেডি হয়ে একবারে বের হয়। সে দুঃখ বিলাস করতে করতে ভুলেই গিয়েছিলো যে আজ তারা চৌধুরী বাড়িতে যাবে। নিচে নামতেই হৃদযাকে সোফায় বসে থাকতে দেখে। রামিয়াকে দেখে হৃদযা মিষ্টি হাসে। পা চালিয়ে হাঁটা ধরে। আতইয়াব অপেক্ষা করছে বাইরে। হৃদযা ওদের দেখেই আতইয়াব দরজা খুলে দেয়। সবাইকে বেশ খুশি খুশি লাগছে। হাসি মজা করে তিনজন গাড়ি নিয়ে ছুটতে থাকে।
চৌধুরী বাড়িতে মানুষের আনাগোনা। তুমুল বেগে কাজ চলছে। বাড়ি ভেতরে সাজানো হচ্ছে; নানা রকম ফুল বেলুন দিয়ে। সোফায় বসে সাজানো দেখছিলো আদর। নাবিল চৌধুরী পাশে এসে বসে। কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে আদরকে। পাশে কারো অস্তিত্ব টের পেতেই আদর তাকায়। নাবিল চৌধুরী কে দেখেই মিষ্টি করে হাসে। নাবিল চৌধুরীও বিনিময়ে মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে হাসে ফেরত দেয়। আদর দুষ্টু হেসে বলে উঠে,
বড় ছেলের বিয়ে তো হলো ছোট ছেলে যে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে চোখে পড়ে না তোমার আব্বু?
নাবিল চৌধুরী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। আদর মুখ চেপে হাসছে। তা দেখে নাবিল চৌধুরী বলে উঠে,
এত করে ছেলে টাকে বলি বিয়ে করতে অথচ ছেলে আমার বলে কোনো মেয়েই পছন্দ হয় না।
আদর জানে নাবিল চৌধুরী মজা করছে । তাই কপট রেগে বলে উঠে,
তাই নাকি? মেয়ে পছন্দ হয় না? আজ আসুক তাকে দেখাবো কেমন মেয়ে তার চাই।
নাবিল চৌধুরী শব্দ করে হেসে উঠে। আদরও যোগ দেয়। কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে নাবিল চৌধুরী ঘরে চলে যায়। বিশ্রাম করবে কিছুটা। আদর পকেট থেকে ফোন বের করে। ৪৯ টা মিসড কল দেখে মুচকি হাসে। ইচ্ছে করেই এমন করেছে সে। সেঞ্চুরি করেনি বলে হালকা রাগ ও হয় তার। নিজেই ফোন করে। জরুরী মিটিংয়ে ব্যস্ত হৃদান।
ডিলার দের দিনে কাজ পড়ে যাওয়ায় রাতে মিটিং টা রাখতে হয়েছে। ভালোভাবে মন ও দিতে পারছে না সে। মনটা পড়ে আছে আদরের কাছে। মেয়েটা নিষ্ঠুর; তাকে ছাড়া বেশ আছে, সে কেন পারছে না। হৃদানকে অন্যমনস্ক দেখে ডিলার রা মিটিং স্থগিত করতে চেয়েছিলো কিন্তু হৃদান মানে নি। কষ্ট করে এসেছে; সময়ের দাম সে ভালো করেই জানে। হাতের কাছেই ফোন টা ছিলো। ভ্রাইবেশন হতেই ফোন টা এক প্রকার খুবলে নেয় সে। এতে সবার চোখ ই তার উপর পড়ে। হৃদানের সেদিকে খেয়াল নেই; সে তো ফোনের উপর জ্বলজ্বল করা নিঃশ্বাস নামটার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। ঝটপট করে ফোন তুলে কানে দিয়েই বলে উঠে,
সারাদিন পর অধমের কথা মনে পড়লো বুঝি? কতবার ফোন দিয়েছি; না ধরেছো, না কল ব্যাক করেছো, না ম্যাসেজ। আমার টেনশন হয় তুমি বুঝো? ভাগ্যিস বাহাদুর ছিলো না হলে কখন দম আটকে শেষ হয়ে যেতাম।
আদর নিঃশব্দে হাসে। হৃদান কে বুঝতে দেয় না। লোকটা আসলেই পাগল। রসিকতা করে বলে উঠে,
তার জন্যই মিটিংয়ে বসে ধ্যান অন্য জায়গায়? হাই হাই দুনিয়ার মানুষ কি জানে হৃদান চৌধুরী তার না হওয়া বউয়ের জন্য এতটা পাগল। ইশ আপনার মেয়ে ফ্যানরা জানলে তো আপনি শেষ!
আদরের রসিকতা বুঝতে পেরেও হৃদান চুপ থাকে। সে ভালোবাসে অথচ পাগল হবে না তা কি করে হয়। আর মেয়ে ফ্যান জানলেই কি না জানলেই তার কি। সে তো শুধু ওই মেয়েটার মাঝেই সকল কিছু খুঁজে পায়। গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,
দুনিয়ার মানুষ যারা যারা জানেনা তাদের কেউ জানানোর ব্যবস্থা করছি ওয়েট এন্ড ওয়াচ! এখন মিটিংয়ে পুরো মন বসবে। আপনার কন্ঠটা যে আমার কলিজা শিতল করে দিয়েছেউ।
হৃদান কথা বলতে বলতে ভুলেই গেছে সবাই শুনছে তার কথা। পান্চু বসের কান্ড দেখে মাথায় হাত দিয়ে নিচে বসে আছে। এমন খামখেয়ালি হলে হয়? ডিলার রা যদি রেগে চলে যায়। হৃদান কিছুক্ষণ কথা বলে কল রাখার পর সামনে তাকাতেই থ হয়ে যায়। সবার দিকে একপলক তাকিয়ে ঢোক গিলে। সে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো। এখন না লোকগুলো তার কাজকে ইনডিসিপ্লিনে ভেলে দেয়। সে তো এমন ছিলো না। প্রেমে পড়ে সব খেয়ে ফেলছে। মাথা চুলকে আমতা আমতা করে বলে উঠে,
আ’ম সরি। আসলে কি হয়েছে মানে!
সবাই একসাথে হেসে উঠে। হৃদান নিজেও হে হে করে হাসে অথচ তার লজ্জা পাওয়ার দরকার ছিলো। সবাই যে খারাপ ভাবে নেয়নি এতেই হৃদান স্বস্তি পায়। মিটিং শেষ হয় রাত দশটাই। অতিথিদের খালি মুখে বিদায় করে না হৃদান। পান্চুকে ইশারা দিতেই সে জলদি করে ডিনারের ব্যবস্থা করে। গল্প করে খেতে খেতে ১১ টা বেজে যায়। সবার সাথে সেও বাড়ি ফেরার জন্য বের হয়। যদিও তার কিছু কাজ বাকি ছিলো তবে শরীর চলছে না।
পান্চু ড্রাইভ করছে, ক্লান্ত শরীর টা এলিয়ে দিয়েছে হৃদান। একপলক বসের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো সে। একটুপর এই ক্লান্তি হয়তো আর থাকবে না। বাড়ি ফিরতে প্রায় আধা ঘন্টার বেশী চলে যায়। হৃদান ক্লান্ত শরীর টা ঠেলেঠুলে সিঁড়ি বেয়ে নিয়ে যায়। চারপাশ তাকানোর প্রয়োজন মনে করে না; ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দেয়। কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। তখনি চিপাচুপা থেকে বের হয় আদর রামিয়া হৃদযা সুবাহ। কিছু কাজ বাকি বলেই নিঃশব্দে কাজ করতে থাকে। চলে যায় আরো কিছু সময়। আদর হাত পা ছড়িয়ে সোফায় বসে পড়ে।
আজ সময়ের হলো টা কি। এত ধীরে যাচ্ছে কেন? নাকি সে বেশী এক্সাইটেড বলে এমন মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। এমন সময় হুড়মুড় করে আতইয়াব-মৃহান আসে। ১২ টা বাজতে ৫ মিনিট আছে। নাবিল চৌধুরীও নিচে নেমে আসে। আদরের প্লেন মতো সবাই ঠিকঠাক দাঁড়ায়, চাপা হাসি সবার মাঝেই। আদর ফোনের লাইট জ্বালিয়ে হৃদানের ঘরের সামনে দাঁড়ায়। হৃদান গোসল সেরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।
এমন সময় দরজায় নক হতেই কিছুটা বিব্রত হয় সে। তাড়াহুড়ো করে দরজা খুলে বাইরে আসে, কেউ নেই। চারপাশ তাকায় সব শান্ত। হৃদানের খটকা লাগতেই ঘরে ঢুকে রিভলবার হাতে নিয়ে বের হয়। নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই ঘড়ির টং শব্দে চমকে উঠে। ১২ টা বাজে। এমন সময় একসাথে লাইট জ্বলে উঠে, চিৎকারের শব্দ ভেসে আসার সাথে সাথে কেউ তার দিক তাক করে পার্টি স্পে মেরেছে। হাত থেকে রিভলবার পড়ে যায়। মুহূর্তেই সারা শরীর তার স্প্রে তে ভরে যায়। চোখ ও খুলতে পারে না। এর মধ্যেই কানে ভেসে আসে,
হ্যাপি বার্থডে!
টনক নড়ে হৃদানের। মনে পড়ে যায় আজকে তার বার্থডে। এরমধ্যে কেউ রুমাল দিয়ে তার মুখ মুছে দিচ্ছে। ফট করে চোখ খুলতেই আদরের হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী চোখে পড়ে। অবাক হয়ে যায় সে। আরো অবাক করে দিয়ে সবাই সামনে এসে দাঁড়ায়। হৃদযা ভাই কে জড়িয়ে ধরে উইশ করার আগেই আতইয়াবের হাসির শব্দ শুনে থেমে যায়। হৃদযা খুশিতে ভুলেই গেছে যে হৃদানের সারা শরীরে স্প্রে। নিজেও মাখামাখি হয়ে যায়।
হদযার রাগ হয় ভিষণ। আদরের হাতে থাকা স্প্রে টা নিয়ে আতইয়াব কে ভূত বানিয়ে দেয়। শুরু হয় মারামারি। একসময় দেখা যায় আদর বাদে সবাই সাদা ভূত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবার নজর আদরের উপরের পড়তেই আদর বুঝতে পারে সবার চাহনী। ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার করে না বলেই ছুটতে থাকে। শেষমেষ আর রক্ষা পায় না। হৃদান তাকে বাহাডুরে আটকে নেয়। চুপ হয়ে যায় দুজনই। তখনি আবার হামলা।
আদর কটমট চোখে হৃদানের দিকে তাকিয়ে আছে। জোকার ছাড়া কিছু লাগছে না। বাহাদুর পান্চু হো হো করে হেসে দেয়। একসময় সবাই হাসতে থাকে। আজ যেন হাসির ব্যামো হয়েছে। বাহাদুর পান্চুর টাক মাথায় স্প্রে করে দেয়। উজবুকের মতো লাগছে তাকে।
সবাই মিলে রাত টা স্মরণীয় করে রাখতে ফটাফট কয়েকটা ছবি উঠিয়ে নেয়। নাবিল চৌধুরীও আজ বাচ্চা হয়ে গেছে। কেক কেটে শুরু হয় আবার মাখামাখি। ভিন্ন এক মুহুর্ত পার করে সবাই। নিজেদের সর্বোচ্চ সুখীর তালিকায় বসিয়ে তিনটা ঘন্টা পাড় করে দেয়। যার যার মতো ঘরে চলে যায়। মনের মধ্যে সুখকর অনুভূতি নিয়ে নিদ্রায় মনোনিবেশ করে। কাল আবার পার্টি রেখেছে নাবিল চৌধুরী। অনেক কাজ!
অন্ধকার ঘর। দহন পরিবেশ। মেঘলা আকাশের রেষ ধরেই আকাশ ফেটে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। যার সাথে তাল মিলিয়ে ভূবন কেঁপে কেঁপে উঠছে। দমকা হাওয়ায় মচমচে পাতাগুলো ঝরে পড়ছে ভূমিতে। গাছের বাঁকে পাতাগুলোকে সজিবতা দিতে বারিধারা নেমে এসেছে। ভিজিয়ে দিচ্ছে ধরিত্রী। শুদ্ধতার প্রতীক হিসেবে বৃষ্টি তার ধরণ অনুসারেই শুদ্ধ করে দিচ্ছে প্রকৃতিকে।
প্রকৃতি শুদ্ধ হলেও যে কিছু কিছু মানুষের মন শুদ্ধ হয় না। অশুদ্ধতায় ঘেরা মনটা তিক্ততায় ভরা থাকে। অন্যের জীবন কে তছনছ করে দিতে বেমালুম নিজের মনুষ্যত্ব কে বিকিয়ে বসে। বিবেক এদের হানা দেয় না, আবেগ কে পরোয়া করে না। শুধু মাত্র নিজেদের কৃষ্ণ মনের আঁধারে ঢাকা বক্তব্যকে উপস্থাপন করতে উঠে পড়ে লেগে যায়। অন্ধকার ঘরে শুধু মাত্র একটা মোমের আলো; বসে দুজন লোক মদ্য পানে ব্যস্থ।
মদ্যপনেশা এদের টলতে পারেনি; তারা অন্যের ক্ষতির পরিকল্পনায় ব্যস্ত। পুরুষ মহিলা চেনার উপায় নেই। দুজনে এতই কথা বলতে ব্যস্ত ছিলো রাত পেরিয়ে যাচ্ছে টের পায় নি। যখন টের পেল অনেকটা দেরী হয়ে গেছে। তবে তাদের সেই দেরীর জন্য আফসোস করতে দেখা গেল না। বরং নিশ্চিন্তে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। আরেকজন ফোন হাতে নিয়ে পরিকল্পনার প্রথম গুটি চালতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সফলতার চরম শিখরে পৌঁছানোর মতো আনন্দ উপভোগ করছিলো যেন মন। তবে বাঁধা কি আসবে নাকি সফল হবে?
ভোরের আলো ফুটেছে অনেকটা সময়। কালকে রাতের আঁধারে ঢাকা আকাশ এখন আর আঁধারে ঢাকা নেই। সূর্যের আগমনে আকাশটাও আলোকিত হয়ে গেছে। নীলাভ আকাশে সাদা মেঘের ছড়াছড়ি। ভিজা মাটির গন্ধ, সজিব বৃক্ষরাজি, ঝকঝকে আকাশ; প্রকৃতির প্রশংসার যেন শেষ নেই। চৌধুরী পরিবার ও নতুন ছন্দে জেগে উঠেছে। এলাহি কারবার! হৃদান কে অফিসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে; সকল স্টাফদের দাওয়াত দিতে।
আদর নিজেও অফিসে গিয়েছে। ঠোঁটের কোণে বিরাজমান সুক্ষ হাসি। আজ হৃদান কে আরেকবার চমকে দিবে সে। গোল গোল চোখখানা দেখতে বড্ড মায়া লাগে তার। হাফ টাইম কাজ করে সবাই কে ছুটি দিয়ে হৃদান-আদর একসাথেই ফিরেছে। দুজনের খুনসুটির শেষ নেই। চৌধুরী বাড়িতে গাড়ি থামাতেই আদর নেমে দাঁড়ায়। পা বাড়াতে পারে না; হাত চেপে ধরেছে হৃদান। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই হৃদান বাঁকা হাসে, ভড়কায় আদর। দৃষ্টি ঘুরাতে থাকে এদিক ওদিক। মুখটা আদরের কানের কাছে এনে ফিসফিস কন্ঠে বলে,
বার্থডে বয় কি আজ উপাহার হিসেবে ঠোঁটের স্পর্শ টা পাবে?
চমকে উঠে আদর। আ’রক্ত গাল দুটোর দিকে হৃদানের দৃষ্টি। ঘোরে চলে যায় সে। আদর ব্যাপার টা বুঝতে পেরেই লাফ দিয়ে সরে আসে। ভেঙচি কেটে বলে উঠে,
আমার তরফ থেকে যে গিফটা আজ পাবেন! পাওয়ার পর কোলে নিয়ে ঘুরতে ইচ্ছে হবে আপনার!
হৃদানের অভিব্যক্তি দেখার সময় নেয় না আদর। দৌড়ে ভেতরে চলে যায়। সে না দেখেই হৃদানের দ্বিধায় ভরা দৃষ্টি বুঝতে পারে। হাসে সে! হাসতে ক্ষতি নেই!
সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। সব গেস্টরা চলে এসেছে। চৌধুরী বাড়ির সবাই অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত। হৃদান চারপাশ চোখ ঘুরিয়ে আদর কে খুঁজে চলছে। এই মেয়ের দেখা নেই। হৃদযা কে বলতেই সে জানায় আসছে আদর। কিছু সময় যেতেই আদরের আগমন ঘটে। লাল খয়েরি ভারি গ্রাউন টাই আদর কে দেখে থমকে যায় হৃদানের দৃষ্টি। অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকতেই আদরের অস্তিত্ব অনুভব করে সামনে।
পলক ঝাপটায় সে; আদর মিষ্টি হেসে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। অনেকের দৃষ্টিই তাদের দিকেই নিবদ্ধ। হওয়ার ই কথা। হৃদান নিচু হয়ে আদরের মুখোমুখি হয়। সামনের অবাধ্য চুলগুলোকে ফূ দিয়ে সরিয়ে দেয়। চোখ বুজে ঈষৎ কেঁপে উঠে আদর। গ্রাউন খামচে ধরে চোখ বন্ধ করে থাকে। হৃদান নিজের পাগলামির সর্বস্তরে পৌঁছে আদরের বন্ধ চোখের পাতায় শব্দ করে চুমু খায়। খামচি দেওয়া হাত আলগা হয়ে যায়; থরথর করে কেঁপে উঠে আদর। হৃদানের হাত খামচে ধরে নিজের ব্যালেন্স ঠিক রাখতে। মুহূর্তেই হাতের জ্বলন অনুভব করে হৃদান।
চুপটি করে থাকে; ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি। দৃষ্টি তার আদরের মুখশ্রীতেই; ঘুরালেই যেন অপরাধ হয়ে যাবে। হৃদানের সাড়া শব্দ না পেয়ে পিটপিট করে চোখ খুলে আদর। হৃদানের মুখশ্রীতে দুষ্টুমির আভাস পেতেই মাথা নিচু করে নেয়। রক্তিম গাল কিছুটা ফুলে উঠে। হঠাৎ ই হৃদানের হাতের দিকে চোখ পড়তেই আতকে উঠে আদর। ছলছল করে উঠে দু নয়ন। হৃদান থমকায়; ভালো লাগায় ছেয়ে যায় হৃদয়। এই ছোট্ট আঘাতেই প্রেয়সীর চোখে জল; প্রেমিক পুরুষের কাছে যেন অপার্থিব এক সুখ। আদরের মুখশ্রীর ভাবাবেগ পাল্টাতে ফিসফিস করে বলে উঠে,
হৃদয়হরোণির কাছ থেকে পাওয়া হাতের ছোঁয়ায় সামান্য আঘাতটায় এই পাগল প্রেমিক শরীরে আলাদা শিহরণ সৃষ্টিতে সক্ষম; সেটি কি অপরূপা কন্যাটি জানে? এ তো কিছুই না; এমন ও সময় আসবে হাতে কেন শরীরের অর্ধাংশ জুড়ে চিহ্ন গুলো বিচরণ করবে। সুখকর এক মুহুর্ত পার হবে! মিশে যাবো…
হৃদানের কথাগুলো শোনার অবস্থায় থাকে না আদর। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস শব্দ কে রুখতে না পেরে দু হাতে গ্রাউন চেপে ধরে দৌড়াতে থাকে। হৃদান শব্দ করে হেসে দেয়। হাসি বেশীক্ষণ স্থায়ী না করতেই পিঠ চাপড়ে ধরে মৃহান। বিয়ের পরেও সে বউকে কারোর সামনে জড়িয়ে ধরতে লজ্জা পায় আর তার ভাই! সোজা চুমুতে চলে গেছে, তাও এত গুলো মানুষের সামনে। সাহস আছে বলতে হবে। তবে নিজের বড় ভাইয়ের দায়িত্ব তো তাকে পালন করতে হবে। গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,
সংযত করো নিজেকে। অনেক মানুষ আর তুমি ভুলে যেওনা একজন জনপ্রিয় মডেল তুমি। বাইরে রিপোর্টার রা বসে আছে। ছবি তুলে সোজা হাইলাইট করে দিবে!
হৃদানের কোনো ভাবাবেগ নেই। ভ্রু কুঁচকে মৃহানের দিকে তাকিয়ে আছে যেন এই মুহূর্তে সে সবচেয়ে অপছন্দের কিছু শুনেছে। মৃহান হালকা কেশে উঠে।
আমি তো তাই ই চাই, ছবি গুলো হাইলাইট হোক। সবাই জানুক আদর আহমেদ শুধু হৃদানের। হৃদান চৌধুরীর একান্ত মানুষ। আর সংযত করবো মানে আমি কি সবার সামনে লিপ কিস করেছি নাকি যে দৃষ্টিকটু হবে। নিজের চরকায় তেল দাও, এখন তো সুবাহ’র কাছ থেকেই আসলে।
হৃদান কথাগুলো বলেই প্রস্থান করে। মৃহান অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে হৃদানের যাওয়ার দিকে। এ কেমন পাগল। পাগলামির সীমানা তার ভাই পার করে ফেলেছে। হাইরে ভালোবাসা। কাঠখোট্টা হৃদান চৌধুরী কেও কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে!
~খবরদার, তুমি আমার হৃদানের কিছু করলে আমি তোমাকে ছেড়ে কথা বলবো। একদম শেষ করে দিবো।
চমকে উঠলেন এপাশের মানুষ টি। কি বলে তার মেয়ে। কিছু করবে না মানে। কালকে রাতে কত প্লেন করলো এমনি এমনি! এই আদর কে দমাতে তাকে হৃদান কে মারতেই হবে। ধমকে বলে উঠে,
~কি বলতে চাইছো তুমি?
~আমি কি বলতে চাইছি তোমার মতো ধুরন্ধর ব্যক্তি ঠিকই বুঝেছে। তিনটা বছর ধরে ভালোবাসি হৃদান কে। ওই আদর ছিনিয়ে নিলো। যা করার আদর কে করো, আমাকে হৃদান কে এনে দাও!
মেয়ের কথায় কিছুটা শান্ত হয়। বড্ড ভালোবাসে সে মেয়েকে। গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,
~আচ্ছা হৃদান তোমার, ধরে রাখতে পারবে? আদরের জন্য যে পাগলামি করে আমার মনে হয় না তোমার কোনো লাভ হবে। তবে তুমি যেহেতু বলছো হৃদান কে কিছু করবো না। আদর কেও কিছু করবো না। ওর কষ্ট আমি নিজ চোখে দেখবো। হৃদান কে হারিয়ে কাতরাবে সেসব দেখে মনে শান্তি পাবো।
~একবার হৃদান কে আমার কাছে এনে দাও সে চাইলেও আমার; না চাইলেও আমার। ইউ ক’নো না তোমার মেয়ে কেমন? এতদিন ভালো ছিলাম কাজে দিলো না; এখন না হয় উল্টো পথ ই বেছে নিলাম।
দুজনই হাসতে থাকে। পরিকল্পনা পাল্টে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তবে কি আদর-হৃদানের ভালোবাসায় ভাটা পড়বে? দুজন ভালোবাসার মানুষ আলাদা হয়ে যাবে?
মন পাথরে হঠাৎ ঝড় সিজন ২ পর্ব ১৭
( কালকে দাদু বাড়ি যাবো; তাই কালকে গল্প দিতে পারবো না মনে হয়। তবে চেষ্টা করবো। সোর্স পেলে ছোট করে হলেও দিবো ইনশাআল্লাহ! শুকরিয়া)